প্রহর শেষে
পর্বঃ৩
ওয়াসিয়াত পেছন ফিরে একবার দেখলো বাবা এখনো আছে কি না।সেদিকে কারও অস্তিত্ত না পেয়ে সে ঘুরে দাড়ালো। গুনগুনের দিকে তাকিয়ে দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললো -“কি অবস্থা গুনগুন?”
-“ভালো “বলেই গুনগুন কিছুটা সামনে এগিয়ে কামিনী ফুল গাছটায় পানি দিতে লাগলো।
আড় চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে ওয়াসিয়াত বললো-
” আজকাল দেখছি ছেলেদের সাথে রাস্তাঘাটে খুব ভালোই হাসাহাসি হচ্ছে। ”
-“মানে? ”
ওয়াসিয়াত দুহাত পেছনে মুড়ে চারদিকে একনজর তাকিয়ে বললো -“সেদিন দেখলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে দীপুর সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছিলে।”
-“তাতে সমস্যা কোথায়? দীপু আমার ছোট বেলার বন্ধু।”
-“আমাদের বাড়ির মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলবে এটা সমস্যা না?”
গাছে পানি দেওয়া বন্ধ করে গুনগুন ঘুরে তাকালো।তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ।সে কঠিন স্বরে বললো -“কেন? তুমি তো মাঝে মাঝেই রাস্তায় দাড়িয়ে ফারহানা আপুর সঙ্গে কথা বলো।তখন? ”
ওয়াসিয়াত বড় বড় চোখ করে তাকালো।আমতা আমতা করে বললো -” আমি ছেলে আর তুমি মেয়ে।সেটা ভুলে গেছ”?
-“বাহ! তুমি ছেলে বলে সাত খুন মাফ?”
ওয়াসিয়াত কিছু বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু তখনই তার চেয়ে গেল তাদের পাশের বাড়ির ছাদটার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে হা করে গুনগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে গুনগুন কে বললো -” শোন, গুঞ্জন ভাই যেহেতু এখানে থাকে না তাই আমাকেই এসব দেখতে হবে।যাইহোক তুমি এখন নিচে যাও।”
গুনগুন দেখলো ওয়াসিয়াত কথা বলার ফাঁকে বারবার পাশের ছাদে তাকাচ্ছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে সে পাশকাটিয়ে যেতেই ওয়াসিয়াত আবার বললো –
” যাচ্ছ ভালো কথা যাও,কিন্তু শোন কথায় কথায় এভাবে ঝগড়াটে মেয়েদের মতো তেড়ে আসবে না।এটা খুব খারাপ। আর কখনো এমন করবে না। ”
তারপর সে একটু জোড়ালো গলায় বললো -” যাও”।
গুনগুন চোখ মুখ শক্ত করে একা একা বিরবির করতে করতে চলে গেল।
ওয়াসিয়াত পাশের ছাদের ছেলেটাকে ইশারায় ডাকলো।ছেলেটা খানিক ভরকে গিয়ে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাড়াল।আবার তাকালো ছাদের দরজার দিকে তাকালো। ওয়াসিয়াত তা দেখে তুরি মেরে বললো –
“ওদিকে বারবার কি দেখো,ভাই? ”
ছেলেটি বোকার মতো হেসে বললো -“না ভাই কিছু না। ”
-“ওকে পছন্দ করো?”
ওয়াসিয়াত খুব স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইলো।
ছেলেটি যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তাকে এমন প্রশ্ন করা হয়েছে।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওয়াসিয়াত বললো -“ফাহাদ তোমার মেসের বড় ভাই না?”
ছেলেটা শুকনো মুখে মাথা নাড়লো।
-“আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড, বুঝেছ? তোমার এই ঘন ঘন আসা আর এদিকে তাকানোর বেপারটা ওকে জানাতে হবে দেখছি। কি বলো?”
মূহুর্তে ছেলেটির মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে। সে বোধহয় জানে ফাহাদ ভাইয়ের কানে এসব কথা গেলে তার খবর আছে।
সে জলদি বললো-“ভাই আমি আর এদিকে তাকাবো না,তাকাবোনা কি আর কখনো ছাদেও আসবো না।আপনি ফাহাদ ভাই কে কিছু বলবেন না প্লিজ। ”
ওয়াসিয়াত হেসে বললো -“মনে থাকবে তো?”
-“জি ভাই। আর কক্ষনো ছাদেও আসবো না। ”
-“গুড, এখন যাও।”
ছেলেটা সালাম দিয়ে চলে গেল।
ওয়াসিয়াত নামলো না।পড়ন্ত বিকেলের আকাশ দেখতে তার ভালো লাগছে। সে বসে রইলো। এখন এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না।
ওয়াসিয়াত আর গুনগুনের মাঝে বয়সের তফাৎটা সাত বছরের। গুনগুনের বড় ভাই গুঞ্জন আর ওয়াসিয়াত একসঙ্গে অনার্স করছে। তবে গুঞ্জন এখানে থেকে পড়ে না। সে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।তাদের তুলনায় গুনগুন পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে। সে কেবল নবম শ্রেণিতে পড়ে।ওয়াসিয়াত তার,থেকে গুনে গুনে সাত বছরের বড়।বয়সের বিস্তর ফারাক থাকা সত্ত্বেও তাদের সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো।
বড় দুই ভাইয়ের সাথে কখনোই ওয়াসিয়াতের সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। সেদিক থেকে গুঞ্জন তার সমবয়সী হলেও সে অত্যন্ত গম্ভীর। তাকে দেখে মনে হয় সে বোধহয় বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেছে।অন্যদিকে গুনগুন বয়সে তার অনেক ছোট হলেও তাদের স্বভাবে খুব মিল।দুজনেই চঞ্চল প্রকৃতির এছাড়াও নিজেদের পরিবারের ছোট সদস্য। যার ফলে তাদের পরিস্থিতিটাও একই রকম। তাই তাদের সম্পর্ক টা গড়ে উঠেছে বন্ধুর মতো। ওয়াসিয়াত গুনগুনের পেছনে লাগলেও গুনগুনের সাথেই তার যত কথা। এমন কথাও যা সে বন্ধুদের বলেও ভরসা পায় না।এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ হলো গুনগুন খুব ভালো শ্রোতা। সব ধরনের কথাই খুব স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা তার আছে। তাই তার কাছে নিঃসংকোচে সব বলা যায়।
___________
পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছে ঘন কালো মেঘ।মেঘেদের ঘর্ষণে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। এই নৈশ হাওয়ায় গুনগুনের শরীর কেমন শির শির করে উঠলো।তার চোখে মুখে খুশি উপচে পরছে। তক্ষুনি নিচ থেকে মা চেচিয়ে বললেন -“গুনগুন, জলদি কাপড় গুলো নিয়ে নিচে আয়।বৃষ্টি আসার আর সময় পেল না”।
গুনগুনেএ মন একটু খারাপ হলো। বৃষ্টি আসার আগের এই নিস্তব্ধ আর গুমোট আবহাওয়াটা গুনগুনের খুব পছন্দ। কারন এখানে অপেক্ষা করার মতো মিষ্টি একটা বেপার আছে। আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার অপেক্ষা। যে অপেক্ষায় মিশে থাকে শুদ্ধ ভালোবাসা।বোধহয় সব অপেক্ষা গুলোই ভালোবাসার হয়।অথচ মা এসব একদম পছন্দ করেন না।মা সবসময়ই খুব গম্ভীর। মেঘলা দিনে তার সেই গম্ভীরতা আরও বৃদ্ধি পায়।
একটা ভাবনা মাথায় আসতেই আবার গুনগুনের মুখে হাসি ফুটলো।আজ নিশ্চয়ই জলজ্যান্ত অত্যাচার টা আসবে না।সে এলে গুনগুনের ভীষণ রাগ হয়।মুশলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এমন দিনে তো তার না আসাই উচিৎ। তখনি নিচ থেকে মা আবার ডাকলেন।বললেন
-“গুনগুন ওয়াসিয়াত এসেছে, জলদি নিচে এসে পড়তে বোস। ”
মূহুর্তেই তার মনের সব আনন্দ উবে গেল। সে বড় বড় পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে এলো।
প্রতিদিন কার মতো আজও ওয়াসিয়াত এসেই সোফায় হেলান দিয়ে আয়েস করে বসলো। সেলিনা হক তাকে বলেছেন মাঝে মাঝে এসে সে যেন গুনগুনকে ইংরেজিটা পড়ায়।অথচ তার কাছে পড়তে গুনগুনের একদম ভালো লাগে না। ওয়াসিয়াত তাকে যতটুকু না পড়ায় তার চেয়ে বেশি কথা শোনায়। একসময় যখন জ্ঞান দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পরে তখন বলে-“এই পড়ালেখা করে কি লাভ? কিছুই তো করতে পারবে না।শেষে রেধেই খেতে হবে। যাও এখন চা নিয়ে এসো। ”
এভাবে সে ঘন্টায় পাঁচ-ছ বার চা খেয়ে ফেলে। কথা না শুনলেই মায়ের কাছে নালিশ করার হুমকি। এটা যে গুনগুনের দুর্বলতা সেটা ওয়াসিয়াত জানে।মা যখন বকে তখন তার মনে হয় বকে তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন।ভেবে সে অস্থির হয়ে ওঠে।
পড়াতে এসে প্রথম দিনই সে ঘোষণা করলো গুনগুন একটা মহা গর্দভ। গ্রামারের ‘জি’ ও নাকি সে জানে না।তাই তাকে রোজই পড়তে হবে। তাহলেই সে পাস করতে পারবে।
গুনগুন গাল ফুলিয়ে বই খাতা নিয়ে এসে বসলো। ওয়াসিয়াত হাই তুলতে তুলতে বললো -“কালকে যে রুলস গুলো পড়িয়েছিলাম চটপট সবগুলো বলো।”
গুনগুন কিছুটা বলে ওপরে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। তারপর আর বলতে পারলো না।
ওয়াসিয়াতের মুখে পৈশাচিক হাসি। মূহুর্তেই হাসি থামিয়ে সে মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে এলো। আর বললো
-“যাও চা নিয়ে এসো। পড়াশোনা তো আর তোমার দ্বারা হবে না। আজ হোক কাল হোক এই রান্নাবান্নাই করতে হবে। এটা অন্তত ভালো ভাবে করতে শেখো।”
যেতে যেতে গুনগুন বিরবির করে বললো -” ছেচড়ার ছেচড়া অন্যের বাড়ি এসে নিজে থেকেই চা খেতে চায়।”
দের ঘন্টা যাবৎ পড়ানোর পর ওয়াসিয়াত যাওয়ার আগে বলে গেল বড়মা তাকে যেতে বলেছেন। ও বাড়ি যাবার কথা শুনেই গুনগুনের মুখটা হাসি-হাসি হয়ে গেল।
সারাদিন এভাবে ঘরে একা বসে থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। এ বাড়িতে কোনো আনন্দ নেই, হাসি নেই।চারিদিকে শুধুই বিষন্নতা।
বাড়িতে মানুষ বলতে শুধু গুনগুন আর সেলিনা হক। গুঞ্জন আসে কালে-ভাদ্রে।
সেলিনা হক খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাকে খুব কমই হাসতে দেখা যায়। গুনগুন শুনেছে মায়ের নাকি এমন স্বভাব ছিল না। বাবার মৃত্যুই তাকে আমুল বদলে দিয়েছে। খুব ছোটবেলায় যখন বাবা মারা গেলেন তারপর থেকেই মা হয়ে গেলেন ভীষণ গম্ভীর। বাবার মৃত্যু যে শুধু তাকেই বদলেছে তাই নয় তার ভাই কেও বদলে দিয়েছে। অত ছোট বয়সে পিতৃহীনতার মতো বিশাল শোক সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে নি। ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে।পড়ালেখা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না।দিনরাত শুধুই পড়ে। দুনিয়ার আর কোনো কিছুরই সে ধার ধারে না।জগতের কোনো কিছুতেই যেন তার কোনো আগ্রহ নেই।
কিন্তু গুনগুন হয়েছে তার সম্পুর্ন উল্টো । এমন গুমোট পরিবেশে থেকেও সে হয়েছে সম্পুর্ন আলাদা। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। বেশিক্ষণ কথা বলতে না পারলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
শৈশব কৈশোরের বেশির ভাগ সময়ই সে কাটিয়েছে চাচার বাড়ি। চাচা-চাচী তার এই দুরন্তপনায় আনন্দ পান।তাই সে বাড়ি তার এতো পছন্দ।
চলবে………….
লেখিকাঃঅদ্রিজা আহসান