গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:-২৪
সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙলো দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে।বিরক্ত হয়ে নড়েচড়ে উঠে বসলাম।উর্মি আপু গিয়ে দরজা খুলে দিল।আম্মু ঘরে ঢুকে বলল,
‘উঠেছো তোমরা?’
আমি ভ্রু কুচকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি কাল রাতে তো উমানের রুমে ঘুমিয়েছিলাম আর এখন উর্মি আপুর রুমে কিভাবে আসলাম?আমার ভাবনার মাঝেই উর্মি আপু আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘হুম আমি আরও আগেই উঠেছি, মিতি এই মাত্র উঠলো আর প্রীতি দশটার আগে উঠবেনা।’
উর্মি আপুর কথা শুনে আমার পাশে শুয়ে থাকা প্রীতি আপুর দিকে তাকালাম।প্রীতি আপু কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে কিন্তু দুই পা কম্বলের বাইরে রেখেছে।আম্মু বিছানার কাছে এসে আমাকে বলল,
‘তাড়াতাড়ি উঠো মাম,তোমার নানুর বাসায় যাব।’
আমি বিছানার ধারে গিয়ে আম্মুর পেট জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললাম,
‘কোথায় আমার নানুর বাসা?’
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘চলো,গেলেই দেখতে পাবা।’
আমি ইনোসেন্ট মুখ করে আম্মুর দিকে তাকালাম।আম্মু গোসল করে কালো পাড়ের হালকা নীল শাড়ি পড়েছে।ভেজা চুলগুলো কোমড় পর্যন্ত ছাড়িয়ে আছে।অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে।এই গন্ধ শুধু আম্মুর গা থেকেই পাই।আম্মু বলে এটা মায়ের গায়ের গন্ধ।সন্তানরা ছাড়া এই গন্ধ কেউ অনুভব করতে পারেনা।আম্মু আমার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,
‘তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি মিনিকে রেডি করিয়ে দিই।’
আমি মাথা নাড়ালাম।আম্মু আমার কপালে চুমু দিয়ে রুম থেকে চলে গেল।উর্মি আপু মোটা একটা ডক্টরি বই হাতে নিয়ে সোফায় বসে আছে।আমি আপুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপু?আমি এখানে কখন এসেছি?’
আপু বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘ভোরে উম রেখে গিয়েছে।’
আমি কিঞ্চিত রেগে বললাম,
‘তুমি আমাকে ওই রুমে কেন রেখে এসেছিলে?তুমি জানো উম ভাইয়া আমাকে জোর করে….’
উর্মি আপু ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিলেন।আমি একটু ভয় পেয়ে আশেপাশে তাকালাম।উর্মি আপু বই রেখে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে ব্যালকনিতে এসে ফিসফিস করে বলল,
‘বিয়ের কথা এখনই কাউকে বলিসনা,খুব অশান্তি হবে।চাচ্চু ফিরে আসুক তারপর বলিস।এখন এসব জানাজানি হয়ে গেলে দাদি অনেক রেগে যাবে।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘আমি উম ভাইয়াকে বিয়ে করবনা।’
উর্মি আপু আমার গাল টেনে বলল,
‘বিয়ে হয়ে গেছে পাগলি।’
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
‘বাবাকে বলে দিব।’
উর্মি আপু মুচকি হেসে বলল,
‘আচ্ছা বলিস।’
আমি থমথমে মুখ করে ধপ ধপ করে পা ফেলে রুমে এসে ফ্রেশ হতে ঢুকলাম।সাদা গাউন আর গোলাপি পায়জামা ওড়না পরে বেড়িয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে উর্মি আপুর রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।উর্মি আপুও আমার সাথে নিচে আসলো।মিনিকে উমানের সাথে ড্রইং রুমের সোফায় বসে থাকতে দেখেই অন্যদিকে হাঁটা দিলাম।উর্মি আপু আমাকে ডেকে বলল,
‘আরে ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?ওদিকে কিচেন।’
উমান সোফাতে বসে থেকেই বললেন,
‘মিতি?শোন।’
আমি নাক মুখ ফুলিয়ে পেছনে ঘুরে উনার দিকে তাকালাম।উনি মুচকি হাসছেন।আমি ভ্রু কুচকে মিনিকে বললাম,
‘মিনি?আম্মু কোথায়?’
মিনি উমানের হাতের আঙুল টানছিল আমার কথা শুনে সোফা থেকে নামতে নামতে বলল,
‘আম্মুল কাছে যাই।’
বলেই মিনি আম্মুর ঘরের দিকে দৌঁড়ে গেল।আমিও মিনিকে অনুসরণ করে সেদিকে যেতে গিয়ে উমান পেছন থেকে খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে বললেন,
‘কোথায় যাচ্ছিস?ডাকলাম না তোকে?’
উনার দিকে ঘুরে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললাম,
‘ছাড়ুন আম্মুর কাছে যাব।’
উমান উর্মি আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আপু নিয়ে যাই ওকে?তুই একটু এদিকটা সামলে নে।’
আপু সেন্টার টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে বলল,
‘না এখন নয়।ছোটআম্মু ওকে নিয়ে ওর নানুর বাসায় যাবে।তাছাড়াও ব্রেকফাস্ট হয়নি এখনও।’
উমান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
‘আমিও যাব তোদের সাথে।’
তারপর উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত উপরে যেতে যেতে বললেন,
‘ওয়েট আমি জাস্ট টু মিনিটে আসছি।’
কিসের ওয়েট?পারবোনা।আমি বড় বড় পা ফেলে আম্মুর কাছে আসলাম।আম্মু বিছানায় বসে লাগেজ গোছাচ্ছে।আমি গিয়ে আম্মুর সামনে বসলাম।আম্মু মিনির ড্রেস গোছাতে গোছাতে বলল,
‘উর্মির রুমে তোমার লাগেজ আছে না।ওখান থেকে দুটো ড্রেস নিয়ে আসো।আজকে আমরা তোমার নানুর বাসায় থাকবো।
আনছি বলে দৌঁড়ে উর্মি আপুর রুমে যেতে লাগলাম।সিঁড়ি দিয়ে দাদিকে নামতে দেখেই আমি একদম নিচের সিঁড়িটায় মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম।উর্মি আপু ড্রইং রুমেই বসে আছে।ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে উর্মি আপুর কাছে চলে যাই।পেছন দিকে একধাপ দিতেই দাদি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এই মেয়ে দাঁড়া ওখানে।’
আমি অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়ালাম।দাদি আমার চারটে সিঁড়ি উপরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘তোর বাবার সাথে কথা হয়েছে?’
আমি মিনমিন করে বললাম,
‘না।’
দাদি অন্যদিকে তাকিয়ে আদেশ করার মতো করে বললেন,
‘তোর বাবা ফোন দিলে বলবি আমার সাথে যেন কথা বলে।আর তুই এভাবে ইঁদুরের মতো দৌঁড়াদৌঁড়ি করবিনা।তোর ছোটটাকেও যেন ইঁদুরের মতো দৌঁড়াতে না দেখি।আমি এসব একদম পছন্দ করিনা।বাড়িতে এতগুলো ছেলে মানুষ,চাকর-বাকর আর এত বড় মেয়ে ধেই ধেই করে দৌঁড়াচ্ছে।’
বলেই দাদি নিচে নামতে লাগলেন।আমি মাথা নিচু করে আড় চোখে দাদির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম আমি ইঁদুর?তুই তাহলে ডাইনি বুড়ি।বাবা আসুক একবার,বাবাকে বলে দিব তুই আমাকে ইঁদুর বলেছিস।
দাদি নিচে গেল আমি উপরে উর্মি আপুর রুমে আসলাম।প্রীতি আপু এখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।সারারাত কি চুরি করে নাকি!আমি নিঃশব্দে লাগেজ খুলে দুটো ড্রেস বের করে নিলাম।বেড সাইট টেবিলে প্রীতি আপুর ফোন চার্জে দেওয়া আছে।কয়টা বাজে দেখার জন্য আপুর ফোনের পাওয়ার বাটন অন করতেই উমানের ছবি দেখে ভরকে গেলাম।মুহূর্তেই আমার মুখ কালো হয়ে গেল।প্রীতি আপুর ফোনে উমানের ছবি থাকবে কেন?আমি শুকনো মুখ করে ড্রেস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।করিডোরে এসে উমানের সাথে দেখা।উনি সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স প্যান্ট পরেছেন।আমাকে এখানে দেখে যেন উনার আনন্দের সীমা নেই।উনাকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই আমি এক দৌঁড়।নিচে এসে দাদিকে দেখেই দৌঁড়ানো থামিয়ে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে লাগলাম।ডাইনি বুড়িটা সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর আমার দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে। মিনিকে দেখলাম ডল কোলে নিয়ে ঘর থেকে লাফাতে লাফাতে বের হয়ে আসছে।এই বুড়িটাতো এবার আরও রেগে যাবে।আমি তাড়াহুড়ো করে ড্রইংরুম ক্রস করে আম্মুর রুমে এসে আম্মুকে ড্রেসগুলো দিলাম।দাদি যা যা বলেছে সব আম্মুকে বললাম,উমান আমাদের সাথে যেতে চেয়েছেন সেটাও বললাম।আম্মু লাগেজের চেইন লাগিয়ে বলল,
‘দাদির কথা শুনতে হয়।দৌঁড়াতে নিষেধ করেছে তাই আর দৌঁড়াবেনা।’
আম্মুর কথা শুনে আমি ঠোঁট উল্টালাম।আম্মু লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।আমিও আম্মুর আঁচল ধরে বেরিয়ে আসলাম।মিনি সেন্টার টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে উমানকে ইংলিশ ছড়া পড়ে শুনাচ্ছে।উমান আর উর্মি আপুকে খুব মনোযোগী শ্রোতা মনে হলেও দাদিকে উল্টোটা মনে হচ্ছে।দাদি রেগে আছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।মিনি টেবিলের উপর উঠেছে এটা দাদির পছন্দ হয়নি।আম্মু মিনিকে ডাকতেই মিনি আম্মুর দিকে তাকালো।দাদি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ছোট বউমা?এদিকে আসো।’
আম্মু লাগেজ রেখে দাদির দিকে এগিয়ে গেল।আমিও আম্মুর পেছন পেছন আসলাম।আম্মু নরম কন্ঠে বলল,
‘জ্বী মা বলুন।’
দাদি কড়া কন্ঠে বললেন,
‘তোমার ছোট মেয়ের নাম মিনি কেন?কুকুর বিড়ালের নাম মিনি রাখা হয়।’
আম্মুর মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পারলাম।আম্মু মলিন কন্ঠে বলল,
‘আসলে মা ওর নাম মিলি।ছোটবেলা থেকেই মিতি ওকে আদর করে মিনি ডাকে তাই আমরাও ডাকি।’
দাদি আমার দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
‘ও ডাকলে তোমাদেরও ডাকতে হবে?এই তুই ওকে কুকুর বিড়ালের নামে ডাকিস কেন?বোন হয়না ও তোর?বোনকে কেউ এসব নাম দেই?’
দাদির কথা শুনে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।কিছুদিন আগেও ল উচ্চারণ করতে পারতাম না।লাল কে বলতাম নাল লিচুকে বলতাম নিচু আর মিনি তো হয়েছে আরও আগে।আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম।বাবা শখ করে মিলি নাম রাখলো আমি হাজার চেষ্টা করেও মিলি বলতে পারিনা।বার বার মিনি হয়ে যায়।বাবা বলেছিল আমার মুখে মিনি নামটায় বাবার কাছে বেশি সুন্দর লাগছে।তাই বাবাও মিনি ডাকতে শরু করল আর বাবার দেখে আম্মুও কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেটে মিলি নামই দেওয়া আছে।
দাদি আবার আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ওসব মিলি মিনি কিছু নয় বুলবুলের মেয়ের নাম ব তেই হওয়া উচিত।বড়টার নাম হবে বেলিফুল,বেলিফুল আমার শাশুড়ি মার নাম ছিল আর ছোটটার নাম হবে বেলা।আমি আজই আকিকার ব্যবস্থা করছি।’
উমান হো হো করে হেসে দিলেন।আমি তো ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিয়েছি।বেলিফুল!কি বিশ্রী নাম।বেলি মানে তো পেট।আমার ফ্রেন্ডরা শুনলে হাসতে হাসতে পেট ফাটিয়ে ফেলবে।আমি কাঁদছি আর মিনি কিছু না বুঝে উমানের সাথে হাসাহাসি করছে।উর্মি আপু একবার আম্মুর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার দাদির দিকে তাকাচ্ছে।আম্মু আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে দাদির দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল,
‘কিন্তু মা ওদের আকিকা হয়ে গিয়েছে।ওদের বাবা নিজে পছন্দ করে এসব নাম দিয়েছে। আর এতবছর পর চেন্জ করলে কেমন দেখাবে।’
দাদি কাঠ গলায় বললেন,
‘তুমি চুপ কর।এখানে আমি যা বলব তাই হবে।’
আম্মু আর কিছু বলল না।আমি নাক টেনে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে লাগলাম।উমান হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এই টুকুতেই কান্না করা লাগবে?আমি আছি না?’
তারপর উমান দাদির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমি একটা নাইজেরিয়ান কুকুর কিনবো তার নাম রাখবো আনারকলি।’
দাদি ফুসে উঠে বললেন,
‘উমান!!’
উমান সোফা থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখমুখ শক্ত করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আন্টি চলো।’
চলবে…………..
(রি-চেইক করা হয়নি।)