গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:-১৪

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই খেয়াল করলাম পিরিয়ড শুরু হয়েছে।অস্বস্তিতে কান্না পেয়ে যাচ্ছে।বাসায় কোনো স্যানিটারি প্যাডও নেই।সেদিন শপিংয়ে গিয়ে উমান সাথে ছিলেন জন্য লজ্জায় কিনতেও পারিনি।এখন আমি কি করব!চিন্তায় আমার মুখ শুকিয়ে গেল।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি বেড শিটেও দাগ লেগে গেছে।তাড়াহুড়ো করে বেডশিট তুলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ভিজিয়ে দিলাম।কোন একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।ফার্মেসিতে যেতে হবে কিন্তু ফার্মেসি তো অনেক দূর।এখন কি হবে!!!আম্মু!!!

খুব কান্না পাচ্ছে।ধপ করে মেঝেতে বসে পরলাম।নাক টেনে কান্না করছি আর ভাবছি কিভাবে কি করা যায়।হঠাৎ উমান এসে রুমে ঢুকলেন।উনার বামহাতে একমগ কফি আর ডানহাতে কালো রঙের নোটবুক।আমার দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকে বললেন,

‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?ওখানে বসে কি করছিস?এই তুই কাঁদছিস কেন?’

উনি হাতের জিনিসপত্র টেবিলের উপর রেখে বিচলিত হয়ে আমার দিকে আসতে লাগলেন।আমি মাথা নিচু করে চোখ মুছে নাক টেনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম।উমান আমার সামনে হাঁটু গেরে বসে আমার ডান কাঁধে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বললেন,

‘কি হয়েছে?’

আমি নিচু মাথা আরও নিচু করে মিনমিন করে বললাম,

‘কিছুনা।’

উনি আমার দুইগাল ধরে নরম গলায় বললেন,

‘একা ভাল লাগছেনা?আর কয়েকদিন ওয়েট কর সবাইকে ফিরে পাবি।ফ্রেশ হয়েছিস?আজকে ব্রেকফাস্ট বাইরে গিয়ে করব।যা রেডি হয়ে আয়।’

উনার কথা শুনে আমি আরো বেশি অস্বস্তিতে পরে গেলাম।এই অবস্থায় বাইরে যাব কি করে।আমি গাল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,

‘বাইরে যাব না।ব্রেকফাস্ট করতে ইচ্ছে করছেনা।’

উনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে টেবিলের দিকে যেতে যতে বললেন,

‘ইচ্ছে না করলেও ব্রেকফাস্ট করতে হবে।ব্রেকফাস্ট করে ওখান থেকে আমারা তোর স্কুলে…..’

কথা থামিয়ে উনি বিছানার দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকালেন।খানিকটা বিরক্ত হয়ে বিছানায় বসে বললেন,

‘বেডশিট কোথায়?’

আমি অসহায় মুখ করে উনার দিকে তাকালাম।উনি কফিতে চুমুক দিয়ে আর নোটবুকের পাতা উল্টাতে লাগলেন।আমি মাথা নিচু করে হাতের নখ খুটলাচ্ছি আর ভাবছি উমানকে এতকিছু বলব কি করে। উনার হেল্প না নিলে হবেই না।আর বাইরে তো আমি কিছুতেই যেতে পারবোনা।উনাকে বলতেও লজ্জা করছে।আবার না বলেও কোন উপায় নেই।হঠাৎ উমানের রাগী কন্ঠ শুনে শুকনো মুখ করে উনার দিকে তাকালাম।উনি ভ্রু কুচকে রাগী কন্ঠে বললেন,

‘তুই কি ওখানে ধ্যানে বসেছিস?আর এই বেডশিট কি করেছিস হ্যাঁ?কথা বলছিস না কেন?’

আমি মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে বললাম,

‘একটু ফার্মেসিতে যেতে পারবেন?আমার…’

আমাকে পুরোটা বলতে না দিয়েই উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে চিন্তিত হয়ে বললেন,

‘শরীর খারাপ করছে?কি মেডিসিন লাগবে?বাসায় সব আছে তো।’

আমার কান্না চলে এসেছে।জীবনে এরকম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরিনি।নাক মুখ ফুলিয়ে নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলাম।উমান আমার সামনে বসে আমার গাল ধরে ভ্রু কুচকে বললেন,

‘হেডএইক হচ্ছে?’

আমি মাথা নাড়ালাম।উমান আমার কপালে গলায় হাত রেখে বললেন,

‘জ্বর তো নেই তাহলে স্টোমাক এইক?’

আমি নাক টেনে থেমে থেমে বললাম,

‘বাইরে যেতে পারবোনা।মোনালিসা লাগবে।এখনই।

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

‘মোনালিসা কি?’

এবার আমার রাগ হল।উনি মোনালিসা চিনেন না?পরক্ষণেই মনে হল না চিনাই স্বাভাবিক।তাও উনার দিকে তাকিয়ে নাক মুখ ফুলিয়ে বললাম,

‘স্যানিটারি ন্যাপকিন।’

উনি অপ্রস্তুত হয়ে আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে দিলেন।আমি মাথা নিচু করতেই উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘আনছি।’

তারপর উনি ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন,

‘হ্যালো সৌরভী,তোকে একটু বাসায় আসতে হবে।……..মিতির পিরিয়ড হয়েছে,কি যেন কি যেন লাগবে ওসব নিয়ে আয়।…আমি তো ওকে একা রেখে বের হতে পারছিনা।……আচ্ছা নিষাদ বাসায় থাকলে ওকে একটু পাঠিয়ে দে।ওকে ওকে বাই।’

উনি রুমে এসে এবার আমার পাশে বসলেন।আমি মাথা নিচু করে আছি।উনি আমাকে একপাশ থেকে জরিয়ে ধরে বললেন,

‘এসব কি মিতি!কান্না করে একদম চোখমুখ লাল করে ফেলেছিস।পেইন হচ্ছে?মেডিসিন নিতে হয়?ওই?লুক এ্যাট মি।আমি তো আলাদা কেউ না,এত সংকোচ কিসের তোর?স্পিক আউট।’

আমি কিছু বললাম না।উনি আরও কিছুক্ষণ আমাকে হাবিজাবি বলে ওয়াশরুমে গিয়ে বেডশিট ধুয়ে সেটা ছাদে শুকোতে দিতে গেলেন।আধঘন্টার মধ্যেই নাসির ভাইয়া বাসায় এসে হাজির।একদম ইউনিফর্ম পরে পুলিশ সেজে এসেছে।দরকারি জিনিসগুলো নাসির ভাইয়ার হাতে দেখে আমি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাওয়ার উপক্রম।ভেবেছিলাম সৌরভী আপু আসবে এখন দেখছি নাসির ভাইয়া চলে এসেছে।তাও ভাল নিষাদ ভাইয়া আসেনি।আজকের দিনটায় আমার জন্য কুফা।

তিনজন একসাথে বসে ব্রেকফাস্ট করছি।নাসির ভাইয়া খেতে খেতে আমাকে বলল,

‘কিরে কথা বলছিস না কেন?’

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম।নাসির ভাইয়ার কথা শুনে তার দিকে তাকালাম।ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘কি?কথা নেই কেন?’

আমি মলিন হেসে মিনমিন করে বললাম,

‘ভাবিকে নিয়ে আসতা।’

নাসির ভাইয়া মুচকি হেসে বলল,

‘নিয়ে আসবো একদিন।আগে এসব ঝামেলা মিটুক।ভাবি পছন্দ হয়েছে?’

‘হুম খুব।’

উমান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘হবেনা আবার?এখন যে ভাইয়ের বউ হয় সেজন্য খুব পছন্দ।আমাদের বিয়ের দিন সৌরভীকে কি বলেছিলি?পেত্নী না?’

নাসির ভাইয়া হুহা করে হেসে দিল।আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম,

‘জোর করে সাজিয়ে দিচ্ছিল সেজন্য।’

নাসির ভাইয়া হাসি থামিয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তুই ওকে জোর করে বিয়ে করতে গেলি কেন?এমনিই তো বিয়ে হত।’

উমান খেতে খেতে বললেন,

‘ততদিন যদি মরে টরে যাই…’

উনার কথা শুনে আমার হাত থেকে চামচ নিচে পরে গেল।নাসির ভাইয়া খাওয়া থামিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল,

‘তোর কি সেরকম কিছু মনে হচ্ছে নাকি?গার্ডের ব্যবস্থা করব?’

উমান মেঝে থেকে আমার চামচ তুলতে তুলতে বললেন,

‘আরে না গার্ডস লাগবেনা।এমনি একটু নজর রেখো এদিকটায়।’

আমি নাসির ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম,
‘তুমি জানো এসব?আমাকে একটু বল তো।’

নাসির ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোর এসব জানতে হবেনা।’

তারপর উমানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল,

‘শুনলাম পাপনের কোন খোঁজ নেই?দুদিন আগে ওর ভাইয়ের উপর এ্যাটাক হয়েছিল।মিতির মতোই জখম করে ছেড়ে দিয়েছে।সাদ কোথায়?এসব ও করছে?স্যার কিন্তু তোর পেছনে সিআইডি লাগাতে চাইছে।’

উমান খাওয়া শেষ করে আমাকে বললেন,

‘হয়েছে যা অনেক খেয়েছিস আর খেতে হবে না।এখন গিয়ে পড়তে বস,গো।’

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘কেন?ভাইয়ার সাথে কথা বলব এখন আমি।’

নাসির ভাইয়াও আমাকে যেতে বলল।আমি ঠোঁট উল্টে রুমে চলে আসলাম।মনে মনে ভাবলাম কি এমন কথা যে আমাকে বলা যাবেনা?সব লুকিয়ে শুনবো আজ।যেমন ভাবা তেমন কাজ।পা টিপে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।উমান আর নাসির ভাইয়া এর মধ্যে ডাইনিং ছেড়ে বাবার ল্যাবের দিকে যাচ্ছে।ওরা ল্যাবে ঢুকতেই আমি ল্যাবের দরজায় গিয়ে উঁকি দিলাম।ওরা একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।উমান বলছেন,

‘সাদের কথা বাদ দাও।আমি কারো কথা কিছু জানিনা।সিআইডি তো লেগেই আছে।ওদের জন্যই বেঁচে আছি রে ভাই।’

নাসির ভাইয়া উমানের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘সাদের কথা সত্যি জানিস না?এসবের কান টানলে কিন্তু তোর মাথায় আগে আসবে।’

উমান মৃদু হেসে বললেন,

‘তোমাদের কমিশনার বলেছে এসব?ঘটে বুদ্ধি না থাকলে যা হয় আরকি।আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ কর নাহলে দেখবা কবে যেন ওর মাথা আমি নাই করে দিব।’

আর কিছু বলার আগেই উমান পেছনে তাকালেন।আমি দরজার সামনে হা করে দাঁড়িয়ে থেকে কথা শুনছিলাম।উমান যে পেছনে তাকাবেন এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।আমাকে দেখে উনি চরম বিরক্ত হলেন।আমি অপ্রস্তুত হয়ে দুধাপ পিছিয়ে আসতেই উনি আমার দিকে তেড়ে আসলেন।ঠাস করে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।ধূর কাজের কাজ কিছুই হল না।মন খারাপ করে রুমে এসে শুয়ে পরলাম।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এসব নিয়ে আর চিন্তা করব না।এখন থেকে খাব আর ঘুমাবো।একদম মহারাণী স্টাইলে জীবনযাপন করব।রাণীদের মতো বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেলাম।

আমার ঘুম ভাঙলো দুপুর সাড়ে বারোটায়।প্রায় দুঘন্টা ঘুমিয়েছি।মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে তাও ভ্যাপসা গরমে শরীর ভিজে উঠছে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশ সাদা হয়ে আছে।বাবা বলতো সাদা মেঘে প্রচুর পানির কণা থাকে।সেসব পানির কণা ভেদ করে সূর্যের কিরন পৃথিবীতে আসতে পারেনা তাই আকাশ ঘোলাটে সাদা দেখায়।এখন তারমানে মেঘে প্রচুর পানির কণা জমা হয়েছে।এরপর সেগুলো কালো মেঘে পরিণত হবে তারপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামবে।বৃষ্টির কথা মনে হতেই সেদিনের ঘটনা মনে পরলো।উমান সেদিন ছেলেটাকে যা মাইর দিয়েছেন,আল্লাহ্‌ মালুম ছেলেটার এখন কি অবস্থা!আমি জানালা থেকে চোখ সরিয়ে উঠে বসলাম।উমানের খোঁজে রুম থেকে বেরিয়ে দেখি ড্রইংরুমের সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে আছেন।আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ল্যাপটপের স্যাটার নামিয়ে আড়মোরা ভাঙতে ভাঙতে বললেন,

‘ঘুম হল?’

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘নাসির ভাইয়া চলে গেছে?’

উনি হা করে কয়েকসেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।বিরবির করে কি যেন বলে আবার বললেন,

‘কাম টু মি?’

আমি ভ্রু কুচকে উনার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
‘কি হয়েছে?’

উনি আমার হাত টেনে উনার পাশে বসিয়ে জরিয়ে ধরে বললেন,

‘তোকে এরকম ভূতের মতো দেখাচ্ছে কেন?আমার বউয়ের একি হল?’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

‘এই ছাড়ুন।কিসের বউ?আমি আপনার বউ না।বউ হলে সব বলতেন আমাকে।বাবা আম্মুকে সব কথা বলে দেয়।’

উনি আমার ডান চোখের কোনায় কিস করে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

‘আমিও তো আমার বউকে সব কথা বলি।’

আমি কাঁধ থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,

‘কচু বলেন আপনি।তখন কিভাবে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন!’

উনি আমার ডানহাত কোলের মধ্যে নিয়ে বললেন,

‘ভালবেসে শুনতে চাইলেই বলব।তোকে মেইন কাজটা যেটা করতে হবে সেটা হল আমাকে ভালোবাসতে হবে।’

আমি রেগে হাত টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।উনি একহাতে আমার ওড়না চেপে ধরে বললেন,

‘আরে চলে যাচ্ছিস কেন?বস না।আমার সাথে কথা বলতে তোর ভাল লাগেনা?ভাল না লাগলেও একটু বস না,আমার ভাল লাগছে।প্লিজ!’

উনার কথা গুলোর মধ্যে কিছু একটা আছে।সেটা কি বুঝতে পারছিনা।কেমন যেন অস্থির লাগছে।চুপচাপ উনার পাশে বসে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘এমন করছেন কেন?ভয় লাগছে আমার।’

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

‘কেমন করছি?কিসের ভয়?’

আমি মাথা নিচু করে বললাম,

‘মারা যাওয়ার কথা বলছেন বার বার।’

উনি মৃদু হেসে আমাকে একপাশ থেকে জরিয়ে ধরে বললেন,

‘ও এই জন্য আমার মহারাণীটা ভয় পায় ?ওকে আর বলব না।বাই দ্যা ওয়ে আমি মারা গেলে কষ্ট পাবিনা ওকে?চাচ্চুর কাছে থাকবি সবসময়।’

আমি একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘আমি মারা গে…’

উনি রেগে আমার মুখ চেপে ধরলেন।আমি উনার হাত সরানোর চেষ্টা করতেই উনি আমার মুখ ছেড়ে দিয়ে উঠে চলে গেলেন।বুঝলাম না উনি রেগে গেলেন কেন!উনার কাজ কর্ম কিছুই বুঝতে পারিনা।রহস্যমানব।

(পেইজে কেউ আছেন?দিলাম আরও একটা পার্ট😊।দেখি কেমন মনে রেখেছেন আপনারা আমাকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here