গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani Simu
পর্ব:১১
নাসির ভাইয়াদের বাসা থেকে ফিরছি।নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে।রাস্তার দুধারে কাশফুলের গাছ।এখন শরৎকাল নয়,বর্ষাকাল তাই কাশফুল নেই।চোখে পরার মতো শুধু কাশফুলের এই সবুজ প্রান্তর আর ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ।যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে।ইতিমধ্যে বাতাস শুরু হয়েছে।কাশফুলের গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে।আমি ফ্রন্ট সিটে বসে নিস্তেজ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি।জানালার কাচ বন্ধ করে গাড়িতে এসি দেওয়া আছে।বাইরে বাতাস দেখে উমান এসি অফ করে জানালা খুলে দিলেন।আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকালাম।উনি মুখে হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ফ্রেশ এয়ার ইজ গুড ফর হেল্থ।’
আমি মুখ ভেংচিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।উনি সামনের দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
‘বাট ইউ!!’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘গুড ফর নাথিং।’
আমি উনার দিকে চোখ কটমট করে তাকালাম।মনে মনে দুচারটে গালি দিয়ে রাগী মুখ করে বললাম,
‘আপনিই গুড ফর নাথিং।অপদার্থ,ফালতু,গুন্ডা একটা!!’
উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘আর কি?’
আমি বুকে হাত গুজে মুখ ফুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।অনেক রেগে আছি।নাসির ভাইয়াদের বাসায় থাকতে চেয়েছিলাম উনি থাকতে দিলেননা।নিষাদ ভাইয়ার সাথে তো দেখায় হল না।উফ্ কতদিন দেখিনি নিষাদ ভাইয়াকে!নিষাদ ভাইয়া সেই যে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার ওর আমাদের বাসায় মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলেন তারপর আর জাননি।প্রায় পাঁচমাস হল উনার সাথে দেখা নেই।আজকেও হলনা শুধু মাত্র এই উমান গুন্ডাটার জন্য।উনি ওখানে দুপুরের খাবারটা পর্যন্ত খেতে দিলেননা আর এখন আমাকে বলছেন গুড ফর নাথিং,হুয়াই?মনের মধ্যে প্রশ্ন আসতেই উমানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম,
‘এই লোক?আপনি আমাকে গুড ফর নাথিং বললেন কেন?’
উনি সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,
‘এমনি।’
‘এমনি নয়,বলুন কেন?’
উনি একবার আমার দিকে তাকালেন।মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ওসব কথা বাদ দে।আই লাভ ইউ।এখন বল আই লাভ ইউ কেন বললাম।’
আমি বাঁকা চোখে উনার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
‘কেন আবার,কথা ঘুরানোর জন্য।’
উনি ব্রেক কষলেন।আমি সামান্য সামনে দিকে ঝুকে আবার ঠিক হয়ে বসে উনার দিকে তাকালাম।উনি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন,
‘কথা ঘুরানোর জন্য?’
আমি তেজি গলায় বললান,
‘তা নয় তো কি?আমাকে ওই বাসায় দিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?আর এতবার ড্রেস চেন্জ করেন কেন?আপনি কি নিজেকে সিনেমার হিরো মনে করেন?বাস্তবে তো হনুমানের মতো চেহারা।’
উনি আমার কথা শুনে কয়েকসেকেন্ড ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর মৃদু হেসে বললেন,
‘নিষাদের সাথে দেখা হলনা সেজন্য আমার উপর রেগে আছিস?’
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
‘না।’
‘মিথ্যুক।’
আমি রেগে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি মিথ্যুক।’
উনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,
‘শাট আপ!’
আমি কেঁপে উঠে ভীত চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি রেগে বললেন,
‘আর একবার নিষাদের কথা মনে আনলে তোকে…….।’
আমি মুখ কাঁচুমাচু করে মাথা নিচু করে বললাম,
‘নিষাদ ভাইয়া তো…’
উমান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমার কথার মধ্যেই বললেন,
‘অন্যকিছু বল।’
আমি উনার দিকে ঘুরে বললাম,
‘বাসায় গিয়ে আমার ডায়েরী আমাকে ফেরত দিবেন।’
উনি মৃদু হেসে বললেন,
‘দিব,দুইবার পরেছি আর একবার পড়তে হবে।তিনবার পড়েই দিয়ে দিব।’
আমি ঠোঁট উল্টালাম আর লজ্জায় অন্যদিকে তাকালাম।আমি ভেবেছিলাম উনি ডায়েরীটা তেমনভাবে দেখেননি কিন্তু উনি দুই পড়ে ফেলেছেন অলরেডি।ওটা নিয়ে আর কি হবে।সব তো উনি পড়েই ফেলেছেন।আমি মিনমিন করে বললাম,
‘পড়েই যখন ফেলেছেন তাহলে লাগবেনা ওটা আর।’
উনি কিছু বললেন না।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হতেই উনি জানালার কাচ লাগিয়ে দিলেন।আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘আরে কাচ লাগিয়ে দিলেন কেন?বৃষ্টি দেখব।’
উনি সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ভেতর থেকেই দেখা যাচ্ছে।’
‘হাত দিব আমি বৃষ্টির পানিতে।’
উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘দরকার নেই।ঠান্ডা লাগবে।’
আমি দুই হাতে উনার বাম হাতের কনুই এর ভাজ জরিয়ে ধরে বললাম,
‘প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ গাড়ি থামান।বৃষ্টির পানিতে হাত দিতে হয়।বৃষ্টির পানি স্পর্শ করা সুন্নত আর আল্লাহ্ যখন খুশি হন তখনই বৃষ্টি দেন।আল্লাহ্ এখন অনেক খুশি।’
উনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি একটা টং এর টি স্টলের পাশে সাইড করলেন।স্টলের ছোট্ট ছাউনির নিচে চার-পাঁচটা লোক কোন মতে পানির থেকে গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এছাড়া রাস্তায় দুয়েকটা গাড়ি চলছে।উমান গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিলেন।আমি খুশি হয়ে ডান হাতটা বারিয়ে দিলাম।হাতের উপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পরতে লাগলো।প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করার পর আমার হাতের তালু পানিতে পূর্ণ হল।হাত ভেতরে নিয়ে এসে উমানের দিকে তাকালাম।উনি অন্যরকমভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনার তাকিয়ে থাকা দেখে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু উনি মুহূর্তেই স্বাভাবিক হলেন।আমি মুচকি হেসে আমার ডান হাতের তালু উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘নিন আপনিও হাত দিন।’
উনি মুচকি হেসে বিসমিল্লাহ্ বলে উনার হাতের তর্জনী আঙুল বারিয়ে দিয়েও থেমে গেলেন।কিছু একটা ভেবে ফট করে আমার হাতের পানি এক চুমুকে খেয়ে নিলেন।উনি তো খুব খুশি কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেল।কারন আমি বৃষ্টির পানি স্পর্শ করার আগে বিসমিল্লাহ বলিনি।উমানের বলা দেখে খেয়াল হল।ধূর কিছু ভাল লাগছেনা বলেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।উমান রেগে গেলেন।আমার সিটে এসে দরজায় উকি দিয়ে চেঁচামেচি করতে লাগলেন।কে শুনে কার কথা।আমি হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে আসলাম।রাস্তায় সামান্য নিচু এক জায়গায় বৃষ্টির পানি জমা হয়েছে সেখানে পা ডুবিয়ে মজা করতে লাগলাম।বৃষ্টির তেজ ধীরে ধীরে বেরেই চলেছে।আমি এখনও সেরকমভাবে ভিজিনি তবে পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে কাকভেজা হয়ে যাব।উমান গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে যখন বুঝলেন আমি এখন গাড়িতে ঢুকবোনা।উনি গাড়ি নিয়েই আমার দিকে এগিয়ে আসলেন।আমিও দৌঁড়ে চলে যেতে লাগলাম।পেছনে তাকিয়ে দেখি উনি রেগে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছেন।আমি ঠোঁট উল্টে আবার দৌঁড়।উনিও দৌঁড়ে এসে আমার বাম হাত ধরে ফেললেন।আমি যাবনা বলে চেঁচামেচি শুরু করলাম।উনি আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই টি স্টলে থাকা চার-পাঁচজন লোক উনার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘কি ভাই,জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
উনি রেগে বললেন,
‘সরুন সামনে থেকে,ভিজে যাচ্ছি।’
একটা তরুন ছেলে উমানের কালো শার্টের কলারের নিচে খামচে ধরে বললেন,
‘আগে বল মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?ছাড় ওকে।’
আমি হা করে উমানের দিকে তাকালাম।উনি নিজের বুকের দিকে তাকালেন তারপর সামনের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বউ হয় আমার।’
বাকি তিনজন মধ্যবয়সী লোক বললেন,
‘বউ হয় তাহলে জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?তখন থেকে দেখছি মেয়েটার পেছনে লেগে আছো।মতলব বুঝিনা ভেবেছো?’
উমান কিছু বলার আগেই কম বয়সি ছেলেটা মস্তানের মত ভাব দেখিয়ে উমানের শার্ট আর একটু টেনে উমানকে নিজের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারলোনা।তাও ছেলেটি ভাব দেখিয়ে বলল,
‘বাঁচতে চাস তো ছেড়েদে মেয়েটিকে নাহলে আমাকে চিনিস?হেব্বি গরম রক্ত আমার।’
উমান ছেলেটির দিকে রাগী চোখে তাকালো।আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বাকি তিনটে লোকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনারা মিতির সাথেই কথা বলুন।ওর থেকেই শুনুন আমি ওর কে হই।’
লোকগুলো আমার দিকে তাকালেন।আমি ভয়ে ভয়ে উমানের একহাত জড়িয়ে ধরে মাথানিচু করলাম।একটা লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘এই ছেলেকে চিনো তুমি?ও সত্যি তোমার স্বামী হয়?’
আমি মাথা নাড়ালাম।লোকগুলো তাও সন্তুষ্ট হলেন না।আমাকে বললেন,
‘তুমি ভয় পেয়না মা।আমাদেরকে সত্যি বলে দাও আমরা দরকার হলে এই ছেলেকে পুলিশে দিব।তোমার কোন ভয় নেই।’
আমি উমানের হাত আরো শক্ত করে ধরে মিনমিন করে
বললাম,
‘সত্যি বলছি।’
তিনজন লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলেন।তারপর আমাকে আর উমানকে কিছু কটু কথা শোনাতে শোনাতে ছাউনির দিকে চলে গেলেন।উমান এক ঝটকায় সামনের ছেলেটির থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
‘যা বস এবার গাড়িতে।’
আমি গাড়ির দিকে না তাকাতেই উমান ছেলেটিকে একটা থাপ্পড় দিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
‘লেট মি সি,হাউ হট ইউর ব্লাড ইজ।’
ছেলেটার দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছে,মুখের ভেতর রক্ত দেখা যাচ্ছে।গালে হাত দিয়ে ব্যথায় মুখ কুচকে ফেলেছে একদম।আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে উমানের দিকে তাকালাম।উনি চোখমুখ শক্ত করে ভেজা শার্টের অল্প ভাজ করা হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করছেন।উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি এখন এই ছেলেকে আচ্ছা মতো ধোলায় দিবেন।উমান আমার দিকে তাকিয়ে আবার ধমক দিয়ে বললেন,
‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন?তোরও থাপ্পড় খাওয়ার শখ হচ্ছে?’
আমি ভয়ে তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে বসলাম।উমান ছেলে টাকে এত মারছেন দেখে আমি শিহরিত।কেউ থামাচ্ছেওনা উনাকে।ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোও এগিয়ে আসছেন না।উনাদের বুদ্ধি ভার,উনারা হয়তো বুঝতেই পারছেন এসব ঝামেলায় উমানের কোন প্রবলেম হবেনা কারন উনি সত্যি ছিলেন।উল্টো উমানই যদি পুলিশের কাছে গিয়ে লোকগুলোর নামে অভিযোগ করেন উনারা ফেঁসে যাবেন।তাই বলে লোকগুলো উমানকে আটকাতেও আসবেনা?একটু আগেই তো আমার উপর দরদ একদম উতলে উঠছিল।এখন কোথায় গেল সেই দরদ???
চলবে………..