গল্প:-মনের_মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:-০৯
রুমে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিলাম তাই উঠে ধীরে ধীরে হেঁটে কিচেনে আসলাম।উমান ভাইয়া দাঁড়িয়ে সবজি কাটছেন।গরমে উনার গা ঘেমে গিয়েছে।টিশার্টের হাতাই কপালের ঘাম মুছছেন আর কুচি কুচি করে সবজি কাঁটছেন।দরজায় দাঁড়িয়েই ভ্রু কুচকে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি রান্না করছেন?’
উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিয়ে বললেন,
‘খিচুড়ি।’
আমি ভেতরে যেতে যেতে বললাম,
‘পারেন আপনি?’
‘উনি সবজিগুলো জালিতে নিয়ে সিংকে ধুতে ধুতে বললেন,
‘না পারার কি আছে?’
আমি উনার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘বাবাও পারে।আম্মু মাঝে মাঝে বাবার অফিসের কাজ করে দিত তখন বাবা রান্না করতো।আপনি ছোলা,পুঁইশাক আর ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করতে পারেন?আমার বাবা সব রান্না পারে।’
উনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুই পারিস না?’
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
‘না আমি এখনও শিখিনি।’
উনি মাথা নাড়িয়ে শব্দহীন হাসলেন।চাল ধুয়ে নিয়ে আমার হাত টেনে চুলার সামনে দাঁড় করালেন। আমার পেছনে পিঠ ঘেষে দাঁড়িয়ে আমার দুই হাত ধরলেন।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘কি করছেন?’
উনি আমার বাম হাত দিয়ে প্রশার কুকার স্টোভে দিয়ে বললেন,
‘আজকে আমার মহারাণী রান্না করবে।’
‘আমি পারিনা।’
উনি মৃদু হেসে আমার হাত দিয়ে চাল প্রেশার কুকারে ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘তাহলে মানছিস তুই আমার মহারাণী?’
আমি যেন বোকা বন থেকে ঘুরে এলাম।মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘শুনুন আপনি আমার ভাইয়া হন।’
উনি আমার হাত দিয়েই প্রেশার কুকারে একে একে ভিজিয়ে রাখা ডাল,ছোলা,পুঁই পাতা কুচি,সবজি,মসলা, তেল দিয়ে প্রেশার কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে তারপর আমার হাত ছেড়ে দিলেন।আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আমার কোমড় জরিয়ে ধরে বললেন,
‘ভাইয়া ছিলাম,এখন আর নেই।এখন আমি তোর হাজব্যান্ড আর বড়াব্বুর ছেলে।ভাইয়া নয়,বুঝেছিস?’
আমি উনার হাত সরাতে সরাতে বললাম,
‘না বুঝিনি।বাবা বলেছে আপনি ভাইয়া তাই আপনি শুধু ভাইয়া।’
উনি মৃদু হেসে আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
‘বাবা যদি বলে হাজব্যান্ড তাহলে?’
আমি মাথা পেছনে হেলিয়ে বললাম,
‘তাহলেও নয়।’
উনি ফট করে আমাকে জরিয়ে ধরে বললেন,
‘বললেই হল?সবাই জানে তুই আমার বউ।একবার তুই মেনে নে দেখ তোকে একদম রাজরানী বানিয়ে রাখবো।’
আমি চোখমুখ খিচে বললাম,
‘উফ্ ছাড়ুন,লাগছে,আহ্!’
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে কিঞ্চিত ভ্রু কুচকে বললেন,
‘কোথায় লাগছে?এখনও ব্যথা কমে নি?দেখি।’
উনি আমার গলায় হাত দিতেই আমার পেছনে প্রেশার কুকারের সাইরেন বেজে উঠলো।লাফিয়ে উঠে উনাকে জরিয়ে ধরে বললাম,
‘কে এসেছে?’
পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এটা প্রেশার কুকারের সাইরেন।উমান ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘আর কেউ আসবেনা।কোনো ভয় নেই।এত ভীতু কেন তুই?মহারাণী মিতি খুব ভীতু।ভীতুর ডিম একটা।এই ডিম, চল অমলেট বানাই।তুই পারিস অমলেট বানাতে?’
আমার সত্যি অনেক ভয় লাগছে।এখন প্রায় রাত আটটা বাজে।বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।আবার যদি ওই লোকটা আসে?আমাকে যদি নিয়ে যায়?ওরা যদি কয়েকজন মিলে আসে উমান ভাইয়া একা কিছুই করতে পারবেননা।মনের মধ্যে কু ডাকা শুরু হল।উমান ভাইয়াকে জরিয়ে ধরেই বললাম,
‘ওই লোকটা যদি আবার আসে?’
উনি আমার মাথায় কিস করে বললেন,
‘বললাম তো আসবেনা।রুমে চল,এখানে অনেক গরম।’
আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে অসহায় মুখ করে বললাম,
‘উম ভ…।’
উনি হাত দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে বললেন,
‘খুব রাগ করলাম।আর কথায় বলব না তোর সাথে।থাক তুই তোর ভাইয়া নিয়ে।’
উনি স্টোভ অফ করে হন হন করে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি জোরে হাঁটতে পারছিনা নাহলে উনার সাথেই যেতাম।উনি কিচেন থেকে বেড়িয়ে আমার রুমে ঢুকলেন।আমিও ধীরে ধীরে হেঁটে আমার রুমে আসলাম।রুমে এসে দেখি উনি ওয়াশরুমে ঢুকেছেন।আমি বিছানায় বসে উনার জন্য অপেক্ষা করছি।জানালা আর ব্যালকনির দরজা খোলায় আছে।বাইরে বাতাস হচ্ছে তাই জানালার পর্দাগুলো উড়ছে।রুমে আলো জ্বলছে তাই বাইরের সবকিছু অন্ধকার দেখাচ্ছে।আমি ভীত চোখে খোলা জানালার দিকে তাকািয়ে আছি।উমান ভাইয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে একবার তাকালেন তারপর ধপ ধপ করে হাঁটতে হাঁটতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আমিও আর দেরি না করে উনার কাছে যেতে লাগলাম।উনি কিচেনে যেয়ে খাবার বারছেন আর আমি কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।উনি খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলে আনলেন,আমিও উনার পেছন পেছন ডাইনিংয়ে আসলাম।উনি আবার কিচেনে গেলেন,আমিও গেলাম।আবার ডাইনিংয়ে আসলেন তাই আমিও আসলাম।উনি চেয়ার টেনে বসলেন,আমিও বসলাম।তারপর কিছু একটা ভেবে উনি আবার আমার রুমে গেলেন,আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার পেছনে হাঁটা দিলাম।আমি রুমে আসতে না পারতেই উনি রুম থেকে দরকার সেরে বেরিয়েও আসলেন।আমি উনাকে দেখেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।উনার হাতে মেডিসিন।আমার সামনে এসে আমার মুখে একটা মেডিসিন গুজে দিলেন।আমি বুঝতে পারলাম উনি এখন পানি নিতে যাবেন তাই আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।উনি একগ্লাস পানি এনে আমার হাতে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন।আমি মেডিসিন খেয়ে উনার পাশে গিয়ে বসলাম।ড্রইং রুমের সাথে লাগানো যেই ব্যালকনি আছে সেটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘সেদিন ওই লোকটা ব্যালকনিতে হাঁটছিল।আমি ব্যালকনির দরজার কাছে যেতেই আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।’
উমান ভাইয়া আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে উঠে গিয়ে টিভি অন করে দিলেন।টিভির কথা আমার মাথাতেই ছিলনা।রাজশাহী যাওয়ার আগে ডিস লাইন কেঁটে দিয়ে গিয়েছিলাম তাই ভেবেছি কাঁটায় আছে।যাক ভালই হল।এখন বসে থেকে কার্টুন দেখা যাবে।আমি মনে মনে খুশি হয়ে টিভির দিকে তাকালাম।উমান ভাইয়া রিমোট হাতে নিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরে দেখছেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,
‘চারশো একে দিন না,সিএনে।’
উনি চারশো বারোতে দিলেন।ডব্লিউ ডব্লিউ ই রেসলিং হচ্ছে।উনি আরাম করে বসে টিভি দেখছেন আর আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।প্রায় দশমিনিট পর উনি টিভি অফ করে উঠে ডাইনিংয়ে গেলেন।আমি খুশি হয়ে রিমোট নিয়ে কার্টুন নেটওয়ার্কে দিলাম।উমান ভাইয়া রাগী কন্ঠে বললেন,
‘খেতে আয়।’
আমি টিভির দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘পরে।’
উনি এসে টিভি অফ করে দিলেন।চোখ গরম করে আমার দিকে তাকাতেই আমি দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম,
‘যাচ্ছি,যাচ্ছি তো।’
ধীরে ধীরে হেঁটে এসে চেয়ারে বসলাম।উমান ভাইয়া আমার পাশে বসে আমার প্লেটে খিচুড়ি ডিম ভাজি আর একটু ঘী ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে খেতে বললেন।আজকে আমার প্রিয় একটা খাবার রান্না হয়েছে তাই খুশি মনে খেতে লাগলাম।সবার আগে ছোলাগুলো বেছে খেতে লাগলাম।উমান ভাইয়া উনার প্লেট থেকে কিছু ছোলা বেছে আমার প্লেটে দিলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
‘বাবাও দেয়।’
উনি কিছু বললেন না।খাওয়া শেষ করে আমাদের প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলেন।উনি সিংকে বাসন পরিষ্কার করছেন আর আমি উনার পাশে দাঁড়িয়ে বলছি,
‘রাতে কিন্তু আমি একা থাকতে পারবোনা।আমার অনেক ভয় করছে।’
উনি কাজ করতে করতে বললেন,
‘নিজের ভাই হলে তোর সাথে থাকতাম কিন্তু আমি তো কাজিন ভাই।একসাথে থাকলে লোকে খারাপ বলবে।আমি পাশের রুমে থাকবো।’
হুহ্ ঢং!সারাদিন বউ বউ করে এখন আবার ভাই সাজার চেষ্টা করছে।মনে মনে কথাটা বলেই আমি থমথমে মুখ করে বললাম,
‘আচ্ছা ঠিক আছে।আপনি তাহলে আমার রুমের জানালাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে আসুন প্লিজ।’
উনি হাত ধুয়ে টাওয়ালে মুছে বললেন,
‘পারবোনা।’
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।উনি কিচেন থেকে চলে গেলেন।আমি ধীরে ধীরে বাইরে এসে দেখি উনি ড্রইং রুমের সোফায় বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন।আমি ল্যাপটপটাতো লুকিয়ে রেখেছিলাম তাহলে কি করে পেলেন!ভাবতে ভাবতে উনার পাশে গিয়ে বসলাম।উনি টেবিলের দিকে ইশারা করে বললেন,
‘মেডিসিন খেয়ে নে।’
আমি মেডিসিন খেয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।উনি এগারোটা পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করলেন।আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম।উনি টিভি অফ করে ড্রইং রুমের লাইট অফ করে আমার পাশের রুমে চলে গেলেন।আমি দ্রুত উনার রুমে গেলাম।উনি রুমের লাইট অফ করে ল্যাম্প শেড অন করে বিছানায় শুয়ে পরেছেন।আমি তাড়াহুড়ো করে বিছানায় উঠে বললাম,
‘আমিও এখানে থাকি?’
উনি অন্যপাশ ফিরে বললেন,
‘না, নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পর।’
আমি বিছানার উপর দাঁড়িয়ে উনাকে ডিঙিয়ে উনার অন্যপাশে গিয়ে বসলাম।উনি আমার দিকে তাকালেন।আমি উনার পাশে শুয়ে উনার উপর হাত-পা তুলে দিয়ে বললাম,
‘এটা আমার বাসা,আমার যেখানে খুশি সেখানে থাকবো।’
তারপর উনার গালে একহাত দিয়ে বললাম,
‘আর এটাতো মহারাজা তাই মহারাণীকে উনার সাথেই রাখতে হবে।’
উনি গাল থেকে আমার হাত সরিয়ে একটু নড়েচড়ে অন্যপাশ ফিরে শুলেন।আমি উনার টিশার্ট টানতেই উনি বললেন,
‘কথায় হবে না,ভালোবাসতে হবে।’
আমি উনার টিশার্ট ছেড়ে দিলাম।উনি আমার দিকে পাশ ফিরে বললেন,
‘বাবা-মা আর মিনি যেমন তোর আপনজন আমাকেও সেরকম আপন করে নিতে হবে আর ওদের মতোই ভালোবাসতে হবে।এখন তো চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে ঘুরছিস।যাকে দেখিস তাকেই ভাল লাগে।ডায়েরীর মধ্যে কত ছেলের ছবি।সবগুলো ক্রাশ,ক্রাশের অভাব নেই।আমিও কি তোর ক্রাশ?আমি ভালোবাসা হতেতে চাই।’
আমি উঠে বসলাম।উনার কথা শুনে লজ্জা লাগছে।উনি ক্রাশতো বটেই।কি সুন্দর উনি!সবসময় উনার সামনে থাকতে ইচ্ছে করছে আর উনার একটু এটেনশন পাওয়ার জন্য কত চেষ্টা করছি।উমান ভাইয়া শুয়ে থেকেই আমার একহাত বুকের উপর নিয়ে বললেন,
‘ভালোবাসার আগে ভালো লাগাটা জরুরী। একটা এক্সামপল দিই শোন।আয় শুয়ে পর আগে।’
উনি আমাকে শুয়ে দিয়ে আমার উপর দিয়ে হাত বারিয়ে ল্যাম্প শেড অফ করে দিলেন।অন্ধকারে থেকে আমার অভ্যাস নেই তাও কেন যেন ভাল লাগছে।উনি আমার একহাত ধরে বিরবির করে বললেন,
‘ঘুম পাচ্ছে।কাল কথা হবে।গুড নাইট।’
আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার কপালে কিস করে বললেন,
‘চোখ বন্ধ কর নাহলে অন্ধকারে উল্টা-পাল্টা কিছু দেখতে পাবি।’
আমি চোখ খিচে বন্ধ করে উনাকে জরিয়ে ধরে বললাম,
‘আমার রুমে চলুন,এখানে ভয় লাগছে।’
উনি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন,
‘চুপ থাক নাহলে ছাদে রেখে আসবো।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম।উনি ঘুমোচ্ছেননা জানি কিন্তু ঘুমোবার চেষ্টা করছেন।আমি ভাবছি আমার ডায়েরীটাকি উনি পুরো পড়ে ফেলেছেন নাকি কিছু অবশিষ্ট রেখেছেন।মান-সম্মান আর কিছু থাকলোনা।ক্রাশ-বাঁশ,ভালোলাগা-খারাপ লাগা থেকে শুরু করে ফার্স্ট পিরিয়ডের কাহিনীও লিখে রেখেছি ওটাতে।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘উম ভাইয়া?’
উনি মুখ দিয়ে বিরক্তের শব্দ করলেন।আমি মিনমিন করে বললাম,
‘আপনি তো আমাদের নিজেরই লোক তাইনা?আমার ডায়েরীর কথা প্লিজ কাউকে বলবেন না।’
উনি মৃদু হেসে বললেন,
‘ওকে বলবোনা বাট আমাকে আর ভাইয়া বলা যাবেনা।’
‘ওকে’
বলে আমি অন্যপাশ ফিরে শুলাম।উনি এবার আমাকে জরিয়ে ধরে বললেন,
‘ডাক দেখি কেমন পারিস।’
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘উমান।’
উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘শুধু উম বল।’
‘উম।’
‘আর একটু ভালোবাসে বল।’
‘উম।’
‘আবার।’
‘উম।’
‘বলতে থাক।’
আমি আরো দুবার বলে মুখে কুলুপ আটলাম।আর একবারও বলবোনা।নিজে তো একটা পাগল,তাই আমাকেও পাগল বানানোর প্রসেস শুরু করেছেন।
চলবে…………………