গল্প:মনের মহারাণী
লেখিকা:Sohani Simu
পর্ব:১
অবশেষে বাসটা ছাড়বে।বিক্ষিপ্ত যাত্রীরা বাস স্ট্যান্ডে পায়চারী বন্ধ করে বাসে উঠছে।আমি বামদিকের সারিতে সামনের দিকের সিটে বসে আছি।আমার সাথে আছে ছয় বছর বয়সি আমার ছোট বোন মিনি।ওকে জানালার ধারে বসিয়ে দিয়ে আমরা দুজনই জানালায় উঁকি দিয়ে বাবার বন্ধু ইমরুল আঙ্কেলের সাথে কথা বলছি। আঙ্কেল মিনির মাথায় হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘রাস্তায় অসুবিধে হলে আমাকে ফোন দিস মিতি।আর ওখানে গিয়ে ওরা যদি কেমনও করে আমাকে জানাবি।একটা কথা মাথায় রাখবি।আমার দরজা তোদের জন্য সারাজীবন খোলা থাকবে।তোদের বাবার অবর্তমানে আমি তোদের বাবা।’

আমি কান্না চেপে বললাম,

‘ঠিক আছে আঙ্কেল।ওখানে প্রবলেম হলে তোমাকে জানাবো।আর তুমি ইউকে থেকে ফিরে আসলে আমরা তোমার কাছে চলে আসবো।’

বাস ছেড়ে দিয়েছে তাই আর কথা হলো না।আমরা সিটে ঠিক হয়ে বসলাম।মিনি আমার একবাহু জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আপু আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

আমি মলিন মুখ করে বললাম,

‘উমান ভাইয়াদের বাসায়।’

মিনি সিট থেকে নেমে নিচে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে উঁকি দিতে লাগলো।পায়ের গোড়ালি উচু করে অনেক কষ্টে রাস্তায় ছোট বড় গাড়ি চলতে দেখে মিনি খুব মজা পাচ্ছে আর আমার ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ করে এভাবে একা হয়ে যাব সেটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।একটা দূর্ঘটনা একমুহূর্তে আমার জীবন বদলে দিল।জীবন কি উপলব্ধি করার আগেই আমাকে দুটো জীবনের হাল ধরতে হল।অসময়ের ঝড়ে আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে গিয়েছে।বেঁচে থেকেও মনে হচ্ছে মারা গিয়েছি।কি হবে,কি করবো,কোথায় যাব কিছু বুঝতে পারছিনা।বোনকে নিয়ে আমি যেন অথৈয় সমুদ্রে পরেছি।

বাবা-মা আর ছোট বোনকে নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী পরিবার ছিল আমাদের।চব্বিশ ঘন্টা আগেও সব ঠিক ছিল।হঠাৎ গতকাল দুপুরে একটা রোড এক্সিডেন্টে বাবা-মা গুরুতর আহত হল।আম্মুকে হসপিটালে নেওয়ার আগেই চলে গেল,শেষ কথাও বলতে পারলাম না আর বাবা রাত দশটায় আমাদের ছেড়ে গেল।সকাল হতেই ইমরুল আঙ্কেল বাবার প্রোপার্টির সব পেপার্স আর ব্যাংক ব্যালেন্স আমার হাতে তুলে দিল।বাবা অনেক আগেই সব কিছু আমার নামে উইল করে রেখেছিল।আমার একুশ বছর না হওয়া পর্যন্ত আমি সেগুলো ব্যবহার করতে পারবোনা কিন্তু বাবার ব্যাংক একাউন্টে যেই এক কোটি টাকা ছিল।ইমরুল আঙ্কেল সেগুলো কয়েক ভাগ করে আমার নামে কয়েকটা একাউন্ট খুলে রেখে দিয়েছে।আমি চাইলেই সেই টাকা গুলো তুলতে পারবো কিন্তু আঙ্কেল তুলতে নিষেধ করেছে।এর মধ্যে আমাদের যা টাকা পয়সা লাগবে সব ইমরুল আঙ্কেল দিবে।আগের থেকে সবকিছু আমার নামে থাকায় শুধু কয়েকটা পেপারে সাইন করেই সব ঝামেলা ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে।ইমরুল আঙ্কেল বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।আমার বাবা সায়েন্টিস্ট ছিলেন।ইমরুল আঙ্কেকও সায়েন্টিস্ট।আঙ্কেল কাল পরশু নাগাদ একটা প্রজেক্ট নিয়ে ছয় মাসের গবেষণার জন্য ইউকে যাবে তাই বাবার কথা মতো আমাদের দাদু বাড়িতে উমান ভাইয়ার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছে।আঙ্কেল কখনও বিয়ে করেনি,সংসার নেই তাই আমাদের এই ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।বাসা-বাড়ি,টাকা-পয়সা আর সব কাগজ পত্র ঠিক করে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিয়ে আঙ্কেল আমাদের রাজশাহীর বাসে তুলে দিল।বাস চলছে তার আপন গতিতে।বাসের ড্রাইভার আঙ্কেলের পরিচিত হওয়ায় আমি একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি।সারারাত ঘুম না হওয়ায় আর শরীর ক্লান্ত থাকায় মিনিকে আমার কাছে থাকতে বলে ওর হাত ধরে রেখেই ঘুমিয়ে গেলাম।

রাজশাহী পৌঁছাতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।এক হাতে লাগেজ আর অন্যহাতে মিনিকে ধরে একটা রিক্সা নিলাম।বাবার বলা ঠিকানা রিক্সা মামাকে বললাম।প্রায় কুড়ি মিনিট পর রাজপ্রসাদের মতো বড় একটা দোতলা বাসার সামনে রিক্সা থামলো।ভাড়া মিটিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়াতেই বয়স্ক একটা দাঁড়োয়ান কর্কশ কন্ঠে বললেন,

‘কি চাই?কে আপনেরা?’

মিনি ফিক করে হেসে বলল,

‘দাদু তুমিও ফোকলা?আমিও ফোকলা।জানো আমার দুটো দাঁত পোকায় খেয়ে নিছে।আম্মু বলেতে ওখানে নতুন দাঁত আসবে।’

দাঁড়োয়ান হাসলেন।সেই হাসিতেই যেন সব কঠোরতা ভেঙ্গে গেল।শক্ত আবরণ ভেঙ্গে বেরিয়ে এল নরম সত্তা।বাবা বলেছিল দাঁড়োয়ান রহমান আলী সাধারনের মধ্যে অসাধারন একজন।এ বাসায় থাকার জায়গা পেলে আমি যেন অবশ্যই রহমান আলীর কাছে প্রতিদিন একটা হলেও গল্প শুনি।বিচিত্র জীবনের গল্প,মানুষ হওয়ার গল্প।দাঁরোয়ান মিনিকে দেখে বললেন,

‘ভাল কইছো।এক কালে আমিও তোমার মতো ফোকলা আছিলাম তারপর নতুন দাঁত আসিলো।কত হাসি-আনন্দ!কত খাওন-দাওন।সময়ের সাথে সাথে আবার সেই দাঁত চইলা যাইতে শুরু করলো।আমারও চইলা যাইতে হইবো।সবাইরে যাইতে হইবো।এই যা কিছু দ্যাখতেছো সবই মায়া,মিছে মায়া। তা মিষ্টি মাইয়া,নাম কি তোমার?’

মিনি দাঁড়োয়ানের কথা কিছু শোনেনি।দাঁড়োয়ানের হাতের লাঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।আমি দাঁড়োয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘দাদু?এটাকি সৈয়দা আনারকলি বেগমের বাসা?’

দাঁড়োয়ানের মুখ গম্ভীর হল।শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘জ্বে আপনেরা কে?’

আমি মলিন হেসে বললাম,

‘আমরা উমান ভাইয়ার কাছে এসেছি।উনি কি বাসায় আছেন?’

দাঁড়োয়ান আবার হাসলেন।দরজা খুলে বললেন,

‘উমান বাবা বাসাতেই আছেন।তয় তোমরা গিয়া ওই ছাউনির নিচে বইসা থাকো আমি মনোয়ারা রে কইতাছি ও তোমাগো উমান বাবার কাছে নিয়া যাইবো।’

আমি বেশ খানিকটা দূরে ছাউনির দিকে তাকালাম।ফুলের বাগানের মধ্যে বড় একটা ছাউনি।সবুজ রঙের টিন দিয়ে ছাওয়া।সন্ধ্যা হয়ে আসায় বাগানের মধ্যের ওই ছাউনিতে সাদা আলো জ্বলছে।মিনির হাত ধরে আমি ছাউনির নিচে গেলাম।মিনির ক্ষুধা লেগেছে তাই হাতের ব্যাগ থেকে কিছু চকলেট বের করে ওকে খেতে দিলাম।প্রায় এক ঘন্টা বসে থেকেও আমাদের কেউ নিতে আসলোনা।এদিকে রাত হয়ে গিয়েছে।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।বেশি অন্ধকার আমি সহ্য করতে পারিনা আর রাতে বাইরে থাকতে খুব ভয় করে।আমি একহাতে মিনিকে কোলে নিয়ে অন্যহাতে লাগেজ নিয়ে দ্রুত বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।

হাঁটছি তো হাঁটছি রাস্তা আর শেষ হয়না।চোখের সামনে বিশাল বাসা অথচ এত হেঁটেও দরজার কাছে যেতে পারছিনা।কি জানি মরীচিকার পেছনে ছুটছি কিনা!যা বুঝতে পারছি তা হল এই বাসার এরিয়াটা অনেক বড়।ফলের বাগান,ফুলের বাগন,খেলার মাঠ,পুকুর সবকিছুই চোখে পরছে।ফলের বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলামম।হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মানুষের গোঙানোর আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলাম।মিনি ভয় পেয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে আছে।আমি ডানপাশে তাকাতেই দেখলাম একটা সরু রাস্তা বাগানের ভেতর দিকে চলে গিয়েছে।সেই রাস্তাতেই একটা লোক পরে গিয়ে কাতরাচ্ছে।কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথায় থেকে একটা ছেলে দৌঁড়ে এসে লোকটা মারতে শুরু করলো।ছেলেটা দেখতে সুন্দর হলেও দেখে মনে হচ্ছে অনেক নিষ্ঠুর আর রাগী।আমরা ভয় পাচ্ছি তাই সেখান থেকে চলে যেতে লাগলাম।তখনই গুলির শব্দ শুনে আমি আর মিনি লাফিয়ে উঠলাম।ছেলেটা মাটিতে গুলি করেছে আর ওই লোকটাকে শাসাচ্ছে।আমরা একমুহূর্তও দেরি না করে বাসার দিকে ছুটলাম।

বাসায় ঢুকে মিনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম।এত বড় বাসা!কোনদিকে যাব কিছু বুঝতে পারছিনা।একটা লোকজনকেও দেখতে পাচ্ছি না।সোফার কাছে লাগেজ রাখলাম।ড্রইং রুমের বামদিকে লম্বা একটা করিডোর।করিডোরের দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের শৌখিন আর মূল্যবান জিনিস ঝুলছে।হরিণের চামড়া দেখেই মিনি দৌঁড়ে সেদিকে চলে গেল।আমি ক্লান্তিতে একদম ভেঙ্গে পরেছি।পা আর চলছেই না।তাই সোফায় বসে গা এলিয়ে দিলাম।ফোন নিয়ে ইমরুল আঙ্কেলকে কল করার আগেই ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেল। আমরা বাগানে বসে থাকার সময় আঙ্কেলের সাথে কথা হয়েছিল তাই বেশি চিন্তা করবেনা।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করতেই মনে হল চোখ আর খুলতে ইচ্ছে করছেনা।একটু ঘুমের ভাব হতেই বাবাকে দেখলাম।বাবা কান্না করছে।চলে যাচ্ছে কোথাও।আমি চিৎকার করে বলছি যেওনা বাবা।বাবা ধীরে ধীরে চলে গেল সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন অনেক উঁচু কোথাও থেকে পরে গেলাম।হকচকিয়ে লাফিয়ে উঠে চোখ খুলতেই দেখি বাগানের সেই ছেলেটা আমার দিকে ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল।ছেলেটাও আমাকে তাকাতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।আমিও দাঁড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে সোফার পেছনের দিকে যেতেই হাত লেগে সোফার কোনায় থাকা ছোট টেবিল থেকে দামী একটা সিরামিকের ফুলদানি পরে ভেঙ্গে গেল।আমি ভয় পেয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম।উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি ফুলদানির দিকে তাকিয়ে কাঁপা কন্ঠে বললাম,

‘ভ-ভেঙ্গে গ-গ-গেল স-স-সরি,ক-কিনে দিব।’

ছেলেটা রেগে কপালের নীল রগ ফুলিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলেন।আমি ভয় পেয়ে কয়েকধাপ পিছিয়ে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়ালাম।ভয়ে ফোনটাও হাত থেকে পরে গেল।ছেলেটি আমার দিকে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে আমার গাল ছুয়ে দেখলেন।আমার মাথার পাশে দেয়ালে একহাত রেখে মুচকি হেসে বললেন,

‘নাম কি?’

‘মি-মি-মি-মি…..!’

নাম বলতে পারলাম না।উনি মেঝেতে পরে থাকা আমার ফাঁটা ফোন আর ভাঙ্গা ফুলদানিটার দিকে তাকালেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘এই বাড়িতে বাহিরের লোক প্রবেশ নিষেধ।তুমি কি দাদির জন্য এসেছো মিস মি-মি-মি-মি?কে পাঠিয়েছে?’

ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে।এই লোকটায় তো বাগানে একটা ছেলেকে মেরে হাত-পা ভেঙ্গে দিলেন।উনার কাছে বন্দুক থাকে দেখেছি। আমাকে যদি চোর টোর ভেবে গুলি করে দেয়!!ভয়ে আমি রক্তশূন্য মুখ নিয়ে বললাম,

‘আমি চোর নই।প্লিজ মারবেন না আমাকে।বাবা,বাবা পাঠিয়েছে এখানে।’

উনি চোখ ছোট করে তাকালেন আমার চোখের দিকে।আমি মাথা নিচু করলাম।উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘কে বাবা?’

আমি মাথা নিচু করেই বললাম,

‘আপনাকে বলা যাবেনা।বাবা বলেছে শুধু উমান ভাইয়াকে বলতে।’

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

‘আমিই উমান।এবার বল কে তোমার বাবা?’

আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালাম।উনিই উমান ভাইয়া?এত খারাপ ছেলের কাছে বাবা আমাকে কেন আসতে বলল!এই ছেলের যা রাগ,একটু কিছু করলেই তো গুলি করে মাথা ফুটো করে দিবে।আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

‘বাবা বলেছে এখানে আসলে আগেই যেন কাউকে কিছু না বলি তাহলে বাসা থেকে বের করে দিবে।’

উনি রেগে গেলেন।দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এই মেয়ে যা বলার তাড়াতাড়ি বল,একদম সময় নেই আমার।’

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি তখনই কোথায় থেকে মিনি দৌঁড়ে এসে আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আপু ওইদিকে একটা বুড়িকে বাবার কথা বলতেই আমাকে লাঠি দিয়ে মেলেছে।দুটো কালো লোককে বলেছে আমাকে তুলে বাহিলে ফেলে দিতে।’

আমি মিনিকে কোলে নিলাম।মিনি আগের চেয়ে অনেক মোটা আর ভারি হয়েছে তাই ওকে কোলে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।মিনি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।আমি সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আমাদের বাবার নাম মো:মাহফুজ আহমেদ বুলবুল।’

লোকটা যেন আকাশ থেকে পরলেন।আমার দিকে দুধাপ এগিয়ে এসে বিস্ময় নিয়ে বললেন,

‘হোয়াট!!চাচ্চু??চাচ্চু তোমাদের এখানে পাঠিয়েছে?কই আমাকে তো কিছু বলেনি?কে হও তোমরা চাচ্চুর?’

আমি ছলছল চোখ নিয়ে উনার দিকে তাকালাম।কান্না আটকে চাপা কন্ঠে বললাম,

‘মেয়ে।’

উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন।ভ্রু কুচকে বললেন,

‘তোরা একা কেন?চাচ্চু আসেনি?’

আমি মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,

‘বাবা-মামুনি কাল রাতে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে।’

উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,

‘হোয়াট!!!’

আমি বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

‘বড় আব্বুকে কল করেছিল কিন্তু ধরেনি তাই চিঠি লিখেছে।আমার কাছে সব আছে।’

উনি মলিন মুৃখ করে মিনিকে আমার কোল থেকে নিজের কোলে নিলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আয় আমার সাথে আর লাগেজ নিয়ে আয়।’

আমি লাগেজ নিয়ে উনার পেছনে যেতে লাগলাম।সিঁড়ির কাছে আসতেই পেছন থেকে কেউ রাগী কন্ঠে বললেন,

‘উমান!!কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওদের?এই মুহূর্তে ওদের এই বাড়ি থেকে বের করে দাও।’

আমি চমকে পেছনে তাকালাম।একটা বয়স্ক মহিলা।হালকা পাতলা শরীরে একরঙা হালকা গোলাপি মিহি জর্জেট শাড়ি জড়ানো,চোখে খয়েরী ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা,মাথা ভর্তি সাদা চুল,ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ,দুই হাতে মোটা মোটা দুটো সোনার বালা সাথে এক হাতে কালো একটা লাঠি।উনি সম্ভবত আমার দাদি।দাদিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক অহংকারী আর আধুনিক রুচি সম্পন্ন মহিলা,ব্যক্তিত্বে আভিজাত্য ভাব।বাবা বলেছিল দাদির খুব রাগ।একবার যা বলেন তাই করেন।এই বাড়ির সবাই অহংকারী,নিষ্ঠুর।এত সহজে কাউকে বিশ্বাস করা যাবেনা।বাবা বলেছে এরা খুব লোভী।যদি জানতে পারে আমার কাছে এক কোটি টাকা আছে তাহলে টাকা নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিবে।আমি ভয় পেয়ে মিনিকে উমান ভাইয়ার কোল থেকে নিয়ে নিলাম।মিনিও খুব ভয় পেয়ে আছে।মিনি আমার গলা ধরে ভীত কন্ঠে বলল,

‘আপু এই বুড়িটায় আমাকে ওই লাঠি দিয়ে মেলেছে।’

আমি মিনিকে কিছু বলার আগেই উমান ভাইয়া শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘ওরা আজ থেকে এখানে থাকবে।ওরা দুজন চাচ্চুর মেয়ে।’

দাদি রেগে বললেন,

‘কে তোমার চাচ্চু?ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে।আর এই ছোটলোকের বাচ্চা গুলোকে এখানে কিছুতেই থাকতে দিবনা।ওই মালির বাচ্চা তো যাওয়ার আগে বড় মুখ করে বলেছিল বুলবুল কোনদিন ধন-সম্পদ চাইতে এই বাড়িতে পা রাখবেনা তাহলে আজ কেন এদের পাঠালো?ভিক্ষা করেও ওদের খাবার জুটছেনা?আরও ভিক্ষা করতে হবে।ওই মালির মেয়ের কোনদিনও ভাল হবেনা।’

উমান ভাইয়া রেগে সিঁড়ির পাশে সাজিয়ে রাখা বড় ফুলদানি ভেঙ্গে ফেললেন।দাদি একদম স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।বুঝায় যাচ্ছে দাদি এসব দেখে অভ্যস্ত।আমি ভয় পেয়ে মিনিকে জড়িয়ে ধরে শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বললাম,

‘আ-আ-আমরা চলে য-যাব।’

উমান ভাইয়া রেগে বললেন,

‘কোথাও যাবিনা,তোরা এখানেই থাকবি।দাদি?চাচ্চু আর মোহনা অ্যান্টি কাল রাতে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।এবার খুশি তো তুমি?’

দাদি এত বড় ধাক্কা সামলাতে পারলেন না।আমার বুলবুল বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন
অথচ একটু আগেই আমার মৃত বাবা মাকে কত গালি গালাজ করলেন।বাসার কাজের লোকগুলো এতক্ষণ সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল এখন সবাই দাদিকে নিয়ে ব্যস্ত।উমান ভাইয়া আমার সামনে এসে বললেন,

‘চল।’

আমি ভীত কন্ঠে বলল,

‘কোথায়?’

উনি আমার একহাত ধরে বললেন,

‘বয়স কত তোর?’

আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম।ভেবেছিলাম কোথায় নিয়ে যাবেন সেটা বলবেন কিন্তু উনি বয়স জিজ্ঞেস করছেন।আমি মিনমিন করে বললাম,

‘ষোল।’

উনি আমার দিকে মাথা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘কত বললি?শুনতে পাইনি আবার বল।’

আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

‘ষোল।’

উনি এক আঙুল দিয়ে চোখের নিচে নাকের পাশে চুলকিয়ে বললেন,

‘মাত্র ষোল?আঠারো নয়?’

আমি মাথা নাড়ালাম।উনি এক ভ্রু উঁচু করে কিছু একটা ভেবে বললেন,

‘তোর নাম যেন কি?ম, মে, মি না কি যেন?’

‘মিতি’

উনি বিরবির করে বললেন,

‘মহারাণী?’

তারপরই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জোরে বললেন,

‘অহ ইয়াহ মিতি।দ্যা প্রিন্সেস।’

আমার মুখ মলিন হয়ে গেল।বাবার কথা মনে হতেই দুই চোখ ভরে এল।বাবা আমাকে প্রিন্সেস ডাকতো।এলাকার সবাই বলতো দ্যা প্রিন্সেস।মিনিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম।উনার মুখও মলিন হয়ে গেল।অন্যদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।হঠাৎ বাবার মতোই একজনকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে আমার চারপাশ ঘোলা হয়ে গেল।মিনিকে নিয়ে নিচে পরে যাওয়ার আগেই কেউ আমাকে ধরে ফেললো।

চলবে………….. …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here