মাতোয়ারা
পর্ব_১৪
দুশ্চিন্তায় আর অস্বস্তিতে আমার দিন কাটতে লাগলো। আমি কি চাই বুঝতে পারছিলাম না। আমি যেটা চাই ইরিন সেটা চায় কিনা তা নিয়ে মহা দোটানায় পড়ে গেলাম। অথচ ইরিন একদম আমার হাতের কাছেই ছিলো। লিগ্যাল ওয়াইফ। চাইলেই আমি তাঁকে আদর করতে পারি, বুকে টানতে পারি। কিন্তু কোথাও যেনো অস্পষ্ট তবে শক্ত একটা বাঁধা আমাকে তাঁর দেয়াল পার হতে দিচ্ছিলো না। বলছিলো বিয়ে নামক আইনি শিকলে ইরিনকে চাইলে আমি দখল করতে পারি কিন্তু সত্যিকারভাবে অধিকার করতে পারি এমন হৃদয়ের শিকল কি আমি তৈরি করতে পেরেছি? পারিনি।
কিন্তু আমার পৃথিবী যে ভয়ংকরভাবে বদলে যাচ্ছে, সেটা টের পাচ্ছিলাম প্রবলভাবে। বদলানো পৃথিবীতে আমার ইরিনকে দরকার, শুধু ইরিনকে। তাঁকে ছাড়া সেই পৃথিবীতে দিন রাত কিছুই কাটবে না আমার।
ইরিনের নাফিস বিষয়ক আগ্রহ কমাতে আমি নিজের যত্ন নেয়া শুরু করলাম। হেয়ার স্টাইল নতুন করলাম।একশোরকম ফেইসওয়াস, ক্রিম কিনলাম। নিয়মিত এক্সারসাইজ শুরু করলাম। কিছু নতুন কাপড়চোপড় শপিং করলাম। ইউনিভার্সিটি যেতে লাগলাম স্টাইলিশ হয়ে। যদিও স্টাইলিশ বয় আমি আগেও ছিলাম। মেয়েদের দল আমাকে ঘিরে থেকেছে সবসময়। কিন্তু ইরিনের জীবনে নাফিস নামক বন্ধুর আগমনের পর মনে হলো, ওর চোখে আমি পড়ছি না।কিন্তু মনে পৌঁছাতে হলে চোখের দেখায় সহজে পৌঁছানো সম্ভব। চোখের খোঁচা বুকের খাঁচায় লাগে জোরে, যে ধাক্কা খাঁচাটা ভাঙতে পারে সহজে।
স্টাইলে আমি আবার ইউনিভার্সিটির নতুন করে ক্রাশ হয়ে উঠলাম। আমার জুতা থেকে সানগ্লাস, ছেলেরা আবার সবকিছুতে আমাকে ফলো করতে লাগলো। মেয়েদের দল দিশেহারা হচ্ছিল। শুধু ইরিন নয়। সে প্রথমের মতই চঞ্চল, কথাকাটা আর অসম্ভব স্বাধীন। আমার এত এত প্রস্তুতির কিছুই যেনো তাঁর চোখে পড়ছিলো না।
একদিন সকালে বের হবার সময় আমি নিজে থেকে ইরিনকে বলেই ফেললাম,
—তুমি আমার সাথে চলো.. একসাথে যাই!
—আপনি এত সকালে কি জন্য যাবেন? ক্লাস আছে?
—নাহ্। মিটিং আছে।
—বাপরে। আমি এত বড় নেতার সাথে যাবো না।
আপনার আগে পিছে একদল চামচা। আমার খুব লজ্জা লাগে।
—এতে লজ্জার কি আছে?
—বারে! আপনাকে না হয় ছেলেপুলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করাটা মানায়। আপনার কি দাপট! চোখে সানগ্লাস, হাতে দামী ফোন, ঠোঁটে সিগারেট, একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। যাস্ট লাগে। একদম ফিল্মি.. কিন্তু আমি?
—তুমি কি?
—আমি তো ইঁদুরছানা! দুটো রিয়েকশান বলতে গিয়েই ঘাম ঝরাই। আমি এরকম চামচা নিয়ে ঘুরলে সবাই বলবে,
“হেডম নেই মুরগির চেডম আছে,
ডিম নেই মুরগির কুক্কুরুক্কু আছে।”
এখন বলুন, কে নিজেকে ডিম ছাড়া মুরগী ভাবতে চায়? আপনি তো মোরগ, ডিম পাড়ারও চিন্তা নেই। মোরগবাবাকে আর তো কেউ কিচ্ছু বলবে না। যত চিন্তা সব মুরগির।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ইরিনের সাথে কথা বলা মানে ইচ্ছে করে গালে জুতো খাওয়া। মুহূর্তেই আমাকে মোরগ বানিয়ে ফেললো!
রোজ এত স্টাইলে ইউনিভার্সিটির মেয়েরা আবার পিছু ধরতে শুরু করলো। যদিও আমি বিবাহিত। কিন্তু ছাত্রনেতাদের তো পাতলা ক্যারেক্টার। আগের মতই মেয়েদের কাতরতা শুরু হলো। এর এই সমস্যা, সেই সমস্যা। এর বার্থডে ওর বার্থডে এসব বাহানায় আমার সাথে দেখা করতে লাগলো। রিয়াও ইচ্ছে করে হাই হ্যালো করছে। আমি রেগুলার ক্লাসে বসছি, মাঝে মাঝে টপিক অনুযায়ী ক্লাস ডিসকাশনে অংশ নিচ্ছি। সবাই একই সাথে বিস্ময়, ভয় আর প্রশংসায় মুখরিত হচ্ছে ।
আর ইরিন? তাঁর আমাকে দেখার সময় কই?ইউনিভার্সিটিতে সে আমার থেকেও বেশি ব্যস্ত। ক্লাসের পর লাইব্রেরি। তারপর ওখান থেকে প্রায় দৌঁড়ে বাড়ি ফেরে। তারপর টিউশনি। সকালবেলায় সে আমাকে মাঝে মাঝে এক্সারসাইজ করার সময় খালি গায়ে দেখলেই, অন্য রুমে চলে যায়। প্রায়ই আমি গোসল সেড়ে টাওয়েল পরে বের হই। ইচ্ছে করেই ঘরে ঘুরাঘুরি করি। এটা করি, সেটা করি। আর ইরিন তখন শক্ত হয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। আমার সন্দেহ আরো ঘন হতে থাকলো।
একদিন রাতে নোট করতে বসেছি। ইরিন ইউটিউবে টপিক রেফারেন্স খুঁজছে।
এক সময় আমি এই কথা সেই কথার প্রসঙ্গে নাফিসের কথা ইরিনকে জিজ্ঞেস করলাম,
—নাফিস নামে তোমার কোনো বন্ধু আছে ইরিন?
—হুঁ আছে তো। বন্ধু না বেশ ভালোই পিছুধরা ছেলে বলুন। আপনি কি করে জানলেন?
—ওই এমনি।
—অনেকেই এটা নিয়ে খুব কথা বলছে জানেন। বলছে আমিও নাকি আপনার মত লুজ ক্যারেক্টার।নেতা বিয়ে করে এখন ক্লাসমেট বাগাচ্ছি। অথচ আমি নাফিসকে চক্ষু লজ্জায় কিছু বলতে পারছি না। সে ভালো ছেলে। আমাকে তেমন কিছু বলে না। শুধু পেছনে পেছনে ঘুরে। কি করা যায় বলুনতো? আপনি কি ওকে বলবেন কিছু ?
আমি ইরিনের কথার জবাব না দিয়ে বললাম,
—আমি লুজ ক্যারেক্টার?
—আমি বলিনা। মেয়েরা বলে। বলে আপনি নাকি তুড়ি মেরে বিছানায় মেয়ে ফেলে দেন। আবার তুড়ি মেরে উঠিয়ে ফেলেন।
—আর তুমি কি বলো?
—আমি তো কিছু বলতে পারি না। হাজার হোক আপনি আমার লোকদেখানো হাসবেন্ড তো..
হয়তো আমরা দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছি না। কিন্তু লোকে তো আর বুঝবে না। সাপের মুখ লাল, আর মানুষের মুখ কাল। কাল মুখের কাল কথা, বুঝলেন?
—তুমি আমার সম্পর্কে আর কি কি শুনো?
—সবসময় যে খারাপ শুনি, তা নয়। ভালো কথাও শুনি।
—আমি খারাপগুলো শুনতে চাই।
—সবথেকে বেশি শুনি আপনার মেয়েঘটিত ব্যাপার। সাইকোলজির নিকিতা মিস উনার লেকচারে গুড স্মাইলিং ক্যারেক্টার বুঝাতে গিয়ে আপনার কথা বলেছেন। বলেছেন আপনি নাইস গাই।
—নিকিতা ম্যাডাম?
—হুঁ। আপনি নাকি উনাকে সেদিন গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন? এটা নিয়ে অনেক কানাকানি চলছে। আপনার রিয়াই তো রটাচ্ছে বেশি।
আমার মাথায় বাজ পড়লো দিরিম দিরিম।
—কি রটাচ্ছে?
—বললো সেদিন নাকি ম্যামের জন্মদিনও ছিল। আপনি নীল শার্ট, ম্যাডামও নীল শাড়ি। দুজনে ম্যাচ করে পরেছিলেন। সবাই তো বলছে গাড়ি করে আপনারা সেদিন লং ড্রাইভে গিয়েছিলেন।
আমাদের নুরুল স্যার তো ক্লাসে ঠাট্টাও করলেন, আজকাল শ্রেয়ানের নীল গাড়ি, নীল শার্ট, নীল গার্লফ্রেন্ড…
—উনি আমাদের ইউনিভার্সিটির টিচার। উনার গাড়ি খারাপ ছিলো সেদিন। আমার কাছে নিজে লিফ্ট চাইলেন। আমি তো এটাও জানি না উনি বিবাহিত না অবিবাহিত? আমার গাড়িতে কেউ বসলেই গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাবে? এটা কোনো কথা হলো?
—এই কথা তো আমি বলছি না। অন্যরা বলছে। তবে আমি এইসব গায়ে মাখি না। আরে ভাই গায়ে মেখে লাভ কি? বিপদে পরে আমাদের বিয়ে হয়েছে। ভবিষ্যতে কে কোথায় থাকি। আপনার মাইন্ড কোথায় সেট হয়, আমিই বা কোথায় যাই? ভবিষ্যত তো বলা যায় না। আচ্ছা, আপনি যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?
—হুম..
—আমরা দুজন যদি কখনো আলাদা হয়ে যাই.. আমরা কেউ কারো কোনো বদনাম করবো না। কথা দিন।
আমি স্তব্ধ চোখে তাকালাম। ইরিন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—দিন.. আমাকে ছুঁয়ে কথা দিন।
আমি বইয়ে মনোযোগ দিয়ে বললাম,
—আমি কাউকে কথা দিই না। বদনাম করবার মত কেউ কোনো কাজ করলে আমি অবশ্যই তাঁর নিন্দে করবো।
—রেগে গেলেন কেন?
—রাগবো না? টিচার আমার গাড়িতে চড়লো বলেই নাম বদলে প্রেমিকা হয়ে গেলো?
—আরে ভাই এই পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যার বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন নাম। যেমন হলুদ। তরকারিতে পড়লে রং মসলা, আমরা খেয়ে ফেলি। কিন্তু গায়ে মাখলেই বিয়ের মশলা, গায়ে হলুদ। তেমনি নিকিতা ম্যাম ক্লাসে পড়ালে টিচার.. আপনার গাড়ির ভেতরে…
আমি চোখ রাঙালাম।
—তরকারির হলুদের উদাহরণ এখানে কোথায় মিললো?
—আর কোনো উদাহরণ পাচ্ছি না.. তাই দিলাম।এখন বলুন, কোন জিনিস গায়ে মাখতে হয় শক্ত, কাপড়ে মাখতে হয় ঝুরঝুরা?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ইরিন প্রসঙ্গ কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে…
—কি হলো? বলুন!
ইরিন আমার মুখের দিকে উৎসুক চোখে তাঁকিয়ে আছে।
—এটা কি ধাঁধা?
—হু.. বলুন। ছয় সেকেন্ড সময়.. ছয়…. পাঁচ….
—বলবো না।
—তাহলে, দান খেয়েছেন মানুন। ছয় দান ঘাড়ে লাগলো মানুন…
—আমি দান কেন মানবো?
—নাহলে আমি উত্তরটা আমি বলবো না।
আমি মনে মনে বললাম, এই মেয়ে যাস্ট অসম্ভব। এর সামনে থেকে চলে যাওয়াই ভালো। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ইরিন আমার হাত টেনে ধরে বললো,
—পারলেন না তো? দান খেয়ে লজ্জা পেয়ে চলে যাচ্ছেন তো? উত্তরটা হলো সাবান। গায়ের জন্য শক্ত, কাপড়ের জন্য গুঁড়া। আরেকটা ধাঁধা শুনবেন? ডাকলে যেতে হয়… কিন্তু ডাক শুনে ‘না’ বললেই মুখ দেখার জিনিস হয়? বলুন তো কি?
এবার আমি কৌতূহল বোধ করলাম।
—কি সেটা?
—পাস বলুন..
—ওকে পাস…
—আয়- না। আয় বললে যেতে হয়। আয়’ এর সাথে না জুড়ে দিলেই আয়না। মিরর।
ইরিন শব্দ করে হাসতে থাকলো।
—আপনার ধাঁধার আইকিউ তো খুব খারাপ। আরেকটা দিই? বলুনতো কোন আম অনেক বড় বলে আমরা খেতে পারি না কিন্তু সেই আমে আমরা যেতে পারি?
আমি চুপ করে ইরিনের সামনে বসলাম। ধাঁধার উত্তর মনে মনে খুঁজতে লাগলাম। ইরিন কাউন্ট ডাউন শুরু করলো। আমি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলাম।
—ব্যস। পারলেন না তো? এটা হলো বেলজিয়াম৷ হি হি…
আমার ভেতর ভেতর তৃষ্ণা বাড়তেই থাকলো। আমি এই ইরিনের পৃথিবীতেই তো বাঁচতে চাই। কথার মারপ্যাঁচে যে সারাক্ষণ আমায় ভুলিয়ে রাখবে। সারাক্ষণ আমি তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সেই পৃথিবীতে বাঁচবো।
—গান শুনবেন? দেখুন এখন আমি সেঁধে সেঁধে শোনাচ্ছি.. একসময় আমার গান শুনতে আপনার টিকিট কাটতে হবে। এই বলে দিলাম….
আমি হ্যাঁ বলবারও সুযোগ পেলাম না।
ইরিন গান ধরলো,
“পিয়ু বোলে.. পিয়া বোলে…
কেয়া ইয়ে বোলে জানু-না…
জিয়া ডোলে হলে হলে……
সেই সারারাত আমার ঘুম হলো না। এত কিছু কেন ঘটছে আমার সাথে? আমরা কি সত্যিই কখনো আলাদা হয়ে যাবো? সত্যিই?
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা