মাতোয়ারা
পর্ব_১১
তার সপ্তাহখানেক পর আমি ইউনিভার্সিটি যাওয়া শুরু করলাম। চেষ্টা করতে লাগলাম সব যাতে স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে আমার তখন নতুন পরিচয় হয়ে গেছে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের জামাইসাহেব। জুনিয়র ছেলেরা ইচ্ছেমত দুলাভাই ডাকে। মাঝে মাঝে তো আমি কনফিউজড হয়ে যেতাম। ইউনিভার্সিটিতে আছি নাকি শ্বশুরবাড়িতে। মিটিং, মিছিল, আড্ডা সব আগের মতই জমিয়ে শুরু করে দিলাম। আগের মতই ভাবসাব নিয়ে চলতে লাগলাম। ইরিন অবশ্য ইউনিভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় আমার সাথে দেখা করে না। আমি মাঝে সাঝে মিটিং করতে ওর ডিপার্টমেন্টে যাই। কিন্তু গভীর এক অজানা জড়তায় ওর ক্লাসে যেতে পারিনা। ইরিনও আমার মিটিং টিটিং এ থাকে না। নিজের মত করেই ইউনিভার্সিটিতে যায়। ফেরেও নিজের মত, রিকশা করে। বেশিরভাগ সকালবেলা আমি ঘুমে থাকতেই বেরিয়ে যায়।
একদিন আমি ক্যান্টিনে, এক জুনিয়রের ঝামেলা মেটাচ্ছি। এসব ঝামেলায় আমার মাঝে মাঝে হালকা মারামারি করতে হতো। এই যেমন চড় থাপ্পড় !
তো এরকম একজনকে ধরে মাইর দিতে লেগেছি, ইরিন কোথা থেকে যেনো এসে হাজির। আমি মারছি, সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। আমি চোখ ইশারায় যেতে বললাম। ইরিন আমার ইশারার সর্বনাশ করে সবাইকে শুনিয়ে বললো,
—আপনি মারতে পারলে আমি দেখতে পারবো না কেন? করলো বেটার লাজ নাই, দেখলো বেটির বড় লাজ। উঁহু আমি যাবো না।
আমি বিব্রত বোধ করতে লাগলাম।
ইরিনকে কঠিন ধমক দিলাম। তাও সে নড়লো না। আমার চেলাপেলা এতে মহা উৎসাহ পেলো। ইরিনকে চেয়ার এগিয়ে দিলো। কোল্ড ড্রিংক এনে দিলো। ইরিন কোল্ড ড্রিংক নিয়ে হাসি হাসি মুখে চেয়ারে বসলো। রাগে আমার শরীরের সমস্ত রগ ফেটে যাচ্ছিলো।
আমি মারামারি বন্ধ করে জ্যাকেট তুলে গায়ে নিলাম। নিজেকে শান্ত রাখার খুব চেষ্টা করলাম। স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
—ইরিন কোনো দরকারে এসেছো?
—কেন? আমি কি এমনি আপনার কাছে আসতে পারি না?
—দেখছো, আমি ঝামেলায় আছি। তাও বসে আছো কেন?
—আমি দেখবো, আপনি কি করে ঝামেলা মেটান।
—ওসব তোমাকে দেখতে হবে না। প্লিজ.. গো… প্লিজ…
ইরিন চুপ করে বসেই রইলো। এক পর্যায়ে আমি তাঁকে জোর করে ক্যান্টিন থেকে বের করে দিলাম। ইরিন কান্না কান্না মুখ করে চলে এলো।
বাড়ি এসে ভাবলাম, ইরিন হয়তো রেগে ঢোল হয়ে আছে। নিজের কাছে গিল্টি ফিল হতে লাগলো খুব। ওভাবে সবার সামনে আমি এমনটা না করলেও পারতাম। আরেকটু কুল হয়ে ইরিনকে বুঝাতে পারতাম। আফটার অল ওর বয়স কম। ভাবলাম এখন ওকে স্লাইড একটা স্যরি বলে দেবো।
ঘরে এসে ইরিনকে পেলাম না। ওয়াশরুমে যাবো, দরজায় নোট সাঁটা।
“এই যে আপনি, হু আপনি,
আমি আজ নিজ হাতে রান্না করছি, ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে মায়ের ঘরে চলে আসবেন।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই অস্থির মেয়েকে বুঝা আমার পক্ষে অসম্ভব।
নিচে এসে দেখি ইরিন দুনিয়ার অধিকাংশ প্রিপারেশন রান্না করে ফেলেছে। আমাদের বাড়িতে রান্নার দুটো লোক। মা বিজনেস সামলে, অল্প একটু আধটু মাঝে সাঝে রাঁধেন। রুটিন করা খাবার-দাবার চলে সারাবছর। একমাত্র বিশেষ উৎসবগুলোতে মা কয়েকটাপদ বাড়িয়ে রাঁধেন। ইরিনের রান্না দেখে আমার মনে হলো, বাড়িতে আজ উৎসব। হঠাৎ এত রান্না কেন? এই মেয়ে কী সেলিব্রেট করতে চায়?
আমি যেতেই ইরিন মাথা নিচু করে বললো,
—আসুন স্যার আসুন… ওয়েলকাম টু মাই রেস্টুরেন্ট।
—আজ এত রান্না কেন?
—এমনি…
—সব তুমিই রেঁধেছো?
—ইয়েস স্যার! আমিই… এবং বাজারও আমিই করেছি, আমার টাকায়। আজকি পার্টি মেরি তরফসে….. হো…
মা খুশিতে আপ্লুত কণ্ঠে বললেন,
—-ইরিন এত রান্না জানে, আমি তো ভাবতেই পারিনি। ডাবচিংড়ি পর্যন্ত করে ফেললো। বাপরে, এটা তো আমিও পারিনা। মাটনের একটা রেজালা করেছে, তুই যাস্ট কালারটা দেখ বাবু.. । সর্ষে ইলিশের কষাটা শুঁকে দ্যাখ। যাস্ট ফ্যান্টাস্টিক।
ইরিনের রান্না খেয়ে আমি নিজেও বেশ “বাহ” বনে গেলাম। সবকটাই চমৎকার রান্না। স্বাদ মুখে লেগে থাকার মত।
মা আর আমি অনেকদিন পর বেশ জমিয়ে খেলাম। মা বললেন,
—অনেক টাকার বাজার করলে ইরিন!
—কি যে বলেন না আন্টি। আপনাদের বাড়িতে থাকছি, খাচ্ছি। বাড়িভাড়া, খাবার বিল, ইলেকট্রিক বিল কিছুই তো দিই না। তাই একটু খরচ করলাম। অন্য জায়গায় থাকলে তো আমাকে ভাড়াই দিতে হতো মান্থলি চার-পাঁচ হাজার টাকা। ভাগ্যিস আপনার হাজবেন্ডের বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছিলাম।
ইরিনের কথায় মা বিষম খেয়ে গেলেন। আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে ইশারা করলেন।
—বিয়ের পর মেয়েরা তো স্বামীর বাড়িতেই থাকবে তাই না?
—সেটাই তো আন্টি। আমিও তো তাই বললাম, আপনার হাজবেন্ডের বাড়ি। আমার হাজবেন্ডের তো বলিনি। আমার তো বিবেক আছে নাকি? ফট করে অন্যের স্বামীর সম্পদ আমি নিজের স্বামীর বলবো কেন?
মা আবার বিষম খেয়ে গেলেন। আমি ইরিনকে থামাতে বললাম,
—দেখো ইরিন, এটা আমার বাবার তৈরি করা বাড়ি। তার মানে আমারও বাড়ি। মায়েরও। যেমন তোমার বাবার বাড়ি তোমারও…
—মোটেও না। আপনি ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
—আমি ভুল ব্যাখ্যা করছি!
মাথা গরম হয়ে গেলো আমার। পুরো ইউনিভার্সিটির বিচারসভা করি আমি। আর এই মেয়ে কিনা আমাকেই ভুল বলে?
—আপনি আমাকে আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো.. এই বাড়িটা কে বানিয়েছে আপনার বাবা, নাকি আপনার দাদা?
—বাবা বানিয়েছেন। নিজের ইনকামে। দাদুর তো গ্রামে বাড়ি।
—এক্সাক্টলি। আই মিন দ্যাট পয়েন্ট। যে বাড়ি বানাবে; বাড়ি তাঁর। তেমনি আমার বাবার বাড়িও আমার নয়। বাবার মানে বাবার। এবং মজার ব্যাপার হলো আমার বাবার কোনো বাড়ি নেই। আমরা ভাড়া বাসায় থাকি। তবে কোনো কোনো মাসে বাবাকে আমি ভাড়াও শেয়ার করি।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। ইরিনের মত তত্ত্ববিদকে আমার পক্ষে বুঝানো অসম্ভব। বরং একে চুপ করিয়ে রাখাই ভালো।
—প্রপার্টি ইজ প্রপার্টি। আপনি হয়তো লিগ্যালি ইনহেরিট করতে পারেন, বাট নট ইওরস। এনসেসটারাল লাইন মোতাবেক পেয়েছেন। সো নিজের অর্জিত যা তাই নিজের। ক্যারিয়ার বলুন আর কালেকশান বলুন।
মা হতাশ কণ্ঠে বললেন,
—তোমার আসলেই অনেক বুদ্ধি ইরিন। আমি দোয়া করি একদিন যাতে তোমার নিজের একটা বাড়ি হয়।
ইরিন মায়ের খোঁচা ধরতে পারলো না।
লাজুক মুখ করে বললো,
—ইচ্ছে আছে। দোয়া করবেন আন্টি। আল্লাহ্ চাইলে হবে। আমি তো মনে মনে বাড়ির ডিজাইনও ভেবে রেখেছি। শোবার ঘরটায় বড় কাঁচের জানালা থাকবে। জানালা ঘেষেই বিছানা। ঘুম ভাঙবে সকালের মিষ্টি রোদে। গভীররাতে জানালার কাঁচে গাল রেখে বৃষ্টি দেখবো। বারান্দাটা হবে একদম খোলা। বড়সড়! ..
আন্টি আপনি দিল তো পাগল হ্যায় মুভিটা দেখেছেন?
—কেন?
—দেখলে বুঝতে পারতেন। মাধুরীর বৃষ্টি ভেজার সিনের পর ও যে শোবার ঘরের বেলকনিতে বসে থাকে। ওরকম বারান্দা হবে। ফুলের টবগুলো শুধু বদলে যাবে৷ আমার প্রিয় ফুল কিন্তু গোলাপ না…
ইরিন কথা বলতেই থাকলো। আমি আর মা অসহায় দৃষ্টি বিনিময় করলাম শুধু।
আমার খুবই অবাক লাগছিলো। ইরিন আমার দুপুর বেলার রূঢ় আচরণ কিংবা আমার মারামারি নিয়ে কেন কিছুই বললো না।
খাওয়ার পর ইরিন পায়েস নিয়ে এলো। এবং গ্লাসে টুংটাং করে ঘোষণা দিলো,
—-মাই ডিয়ার আন্টি এবং মাই ডিয়ার হাজবেন্ড,
আমার দুটো বিশেষ কথা জানানোর আছে। তবে তার আগে আমি একটা জোক্স বলে আপনাদের গম্ভীর মুখটা হাসি হাসি করবো। তারপর… মূল খবরটা জানাবো।
আমি অনুরোধের গলায় বললাম,
—আমাদের মুড যথেষ্ট ভালো আছে ইরিন। জোক্স শোনাতে হবে না।
মা বললেন,
—শুনতে দে না? বারণ করছিস কেন বাবু? এমনিতেও অনেকদিন হাসির গল্প শুনি না। বলো ইরিন তোমার জোক্স বলো।
আমি মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলাম।
ইরিন মহা প্রস্তুতি নিয়ে আমার কাছাকাছি চেয়ারে এসে বসলো।
—শুনুন, এক লোক ‘ক’ বলতে পারেনা। ক’র উচ্চারণে ‘প’ বলে। যেমন কলমকে বলে পলম, কালোকে বলে পালো, “কিছু না’ বলতে গেলে বলে ‘পিছু না’। বুঝতে পারছেন তো?
মা মহাউৎসাহে বললেন,
—-তাহলে কলাকে নিশ্চয়ই পলা বলে, আর কাজকে নিশ্চয়ই পাজ বলে।
—এই তো, একদম। ঠিক ধরেছেন আন্টি। তো এই লোক বিয়ে করলো কুসিদা নামের এক মহিলাকে।
আমি রেগে বললাম,
—ক বলতে পারে না, আর কিনা ক’ওয়ালী নামের মেয়েকেই বিয়ে করতে গেলো? ইস ইট নট রিডিউকুলাস…?
—সেই তো.. এখনই তো ঘটনা শুরু হবে। তো বিয়ে তো হয়ে গেছে নাকি? কুসিদাকে বেচারা বর বাসর রাতে ডাকলো ওগো পুসিদা!হা হা…
—তোমার সব জোক্সে বাসর রাত কেনো চলে আসে বলোতো ইরিন?
ইরিন চোখ টিপলো।
—বাসর রাতেই তো পৃথিবীর সবথেকে হেভি হেভি জোক্সগুলো তৈরি হয়; বুঝলেন না? আমাদের বাসর রাতে কিছু হয়নি বলে যে সবার হবে না, তা কিন্তু নয়।
মা কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাঁকালেন।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে ইরিনের দিকে তাঁকালাম ।
—তারপর কি হলো?
—জোক্সে? ও হ্যাঁ হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। কুসিদা বেচারীকে বর পুসিদা ডাকায় বেচারি খুব রেগে গেলো। বারবার বলতে লাগলো, আমার নাম কুসিদা, পুসিদা না। জামাই বেচারা ততই বলে, পুসিদা আমার পুসিদারাণী। বউ বিরক্ত হয়ে একসময় কাঁদতে শুরু করলো। তখন জামাই বউটার কান্না থামাতে কি বললো জানেন?
ইরিন চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাঁকালো। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। মা অতি উৎসাহে বললেন,
—কি বললো জামাইটা?
—আন্টি, জামাইটা তখন বললো, পুসিদা আমার পুসিদা বাবু, তুমি পেদো না। তুমি পাদলে আমিও পেদে ফেলবো! তোমাকে পাদতে দেখে আমারও যে পেদে ফেলতে মন চাইছে। বেচারা জামাই, কেঁদো নাকে পেদো না বলছে, বুঝলেন আন্টি!
ইরিন ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলো। মায়ের মুখ এত বড় হা হয়ে আছে। আমি অন্যদিকে তাঁকিয়ে বললাম, আল্লাহ্ আমাকে সব হজম করার শক্তি দাও৷
খানিকক্ষণ হেসে ইরিন আমাদের দিকে বিস্মিত চোখে তাঁকালো।
—আপনারা হাসলেন না কেন? আন্টি আরেকটা জোক্স বলবো? এই জোক্সে লোকটা না গোলআলু বলতে পারে না। গোলআলুকে বলে গুট্টাটু। তো তাঁর সাথে একজন বাজি ধরলো…
মা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—-আজ আর জোক্স শুনবো না।আমাদের ভেতরে ভেতরে অনেক হাসি পেয়েছে। অনেক। এবার বরং তোমার জরুরি কথাটা বলো।
—ও হ্যাঁ আমি তো জরুরি খবরটা বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম। দাঁড়ান বলছি।
আমি ভাবলাম ইরিন হয়তো এবার আমার মারামারির কথাটা বলবে। তা নয়, ইরিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো,
—দ্য ফার্স্ট গুড নিউজ ইজ, আমি হলে সিট পেয়ে গেছি। আমার এপ্লিকেশনে হল সুপার সাইন করে দিয়েছেন। ৩১১ নাম্বার রুম। কালই হলে উঠছি।
মা তব্দা খেয়ে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন,
—তুমি হলে থাকবে মানে? বাসায় থাকতে কি সমস্যা?
—বাসায় কোনো সমস্যা নেই। তাও সিট যখন পেয়ে গেছি ভালোই তো হলো।
মা রাগী কণ্ঠে বললেন,
—কেন ?এখানে থেকে কি তোমার পড়াশোনার কোনো সমস্যা হচ্ছে? তোমাকে কি কাজ করতে হয়? বাড়িতে চারটে কাজের লোক আছে। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার সব রেডী পাচ্ছো। আর কি দরকার? যাতায়াতে সমস্যা তো? আমার গাড়ি ইউজ করবে। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি তারপর অফিস যাবো।
—আমার এখানে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না আন্টি।
—তাহলে হল কেন? তোমার পাদ বিষয়ক জোক্স কি এখানে আমরা শুনছি না? নাকি হলে আরো ভালো শ্রোতা পাবে?
—আসলে আন্টি। সেরকম নয়। এখানে থেকে আমি যখন তখন বেরোচ্ছি…
—তো এখানে আমি বা শ্রেয়ান কেউ কি তোমাকে কিছুতে আটকাচ্ছি? যখন ইচ্ছে বেরুচ্ছ, যখন ইচ্ছে ফিরছো, আর কি দরকার? কি চাই বলো তোমার?
—আমি সেরকম বলিনি আন্টি। হলের সিটের এপ্লিকেশন আমি ভর্তি হয়েই করেছিলাম। তখন তো আমার এতসব চিন্তা ছিলো না। বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি পাবো কে জানতো?
—তোমার এইসব হল ফল ক্যানসেল। কোনো হলে ফলে যাওয়া চলবে না। তোমার এই বাড়িতে থেকেই পড়শোনা চালাতে হবে।
মা ইরিনের কথা না শুনে চলে গেলেন। ইরিন কপালে হাত দিয়ে বললো,
—-এত ভালো একটা খবরে আপনার মা এত ক্ষেপে গেলেন কেন? হলে থাকলে আমার খাওয়া পড়ায় খরচ কত কম হবে জানেন?
—খরচ কমিয়ে লাভটা কি?
—বারে আমার টাকা জমাতে হবে না?
—কেন? টাকা কেনো জমাতে হবে?
—আমার একটা অন্য প্ল্যান আছে। এখন বলবো না। পরে বলবো।
—তাহলে মায়ের কাছ থেকে টাকা নাও। আমার ওয়ালেট সবসময় টেবিলেই থাকে। ওখান থেকে খরচ করো।
—আমি আপনার বাবার টাকা খরচ করবো কেন? আমি আপনার বাবার জন্য কি করেছি? আপনিও তো কিছু করেন না। বুঝতাম যদি বিজনেসে আপনি কাজ করেন। তাও একটা কথা ছিলো। তাছাড়া আমি এস এস সির পর থেকে টিউশান পড়িয়ে নিজের খরচা করি।
আমি বিষম খেয়ে গেলাম। পানি খেয়ে ভাবলাম চলে যাবো।
ইরিন আমার মুখের সামনে এসে অনুনয়ের সুরে বললো,
—আমি কিন্তু আপনাদের জন্য বাড়ি থেকে যাচ্ছি না। এখানে আমি এত ভালো থাকছি, এত ভালো খাবার দাবার পাচ্ছি। আই সয়্যার, আমার বাড়িতেও আমি এরকম ভালো খেতে পেতাম না। এত বড় বাড়ি, এত বড় থাকার ঘর, ভালো বিছানা। এত সুন্দর বাথরুম আমি ছবিতেই শুধু দেখেছি। আর আন্টি ভাবলেন, আমার বাড়ি ভালো লাগছে না।
—বাড়ি ভালো লাগলে যেতে চাইছো কেন?
—আমি তো আপনাদের বাড়ির কোনো কাজে লাগছি না। সকালে বেরোই, সন্ধ্যায় আসি। আর সিট যেহেতু পেয়েই গেছি, হলেই থাকি।
—হলে থাকতে হবে না। আমি সুপার স্যারকে বলে দেবো।
—না মানে, আমি এখানে থাকলে তো আপনারই অসুবিধা বেশি হচ্ছে। আমি রাত জেগে রুমে লাইট জ্বালিয়ে পড়াশোনা করি। আপনার ঘুমের নিশ্চয়ই ডিস্টার্ব হয়। আপনার রুম দখল করে আপনার প্রাইভেসিও তো পুরো খেয়ে দিয়েছি। অবশ্য আমার নিজের প্রাইভেসিও শেষ.. তাই..
—হলে তোমার প্রাইভেসি রক্ষা হবে বলছো? হলে তো তুমি একা থাকবে তাই না?
আমি পায়েসের বাটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে এলাম। আমার এত মেজাজ খারাপ হচ্ছিল যে বলার বাইরে? অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে একটানা কিছুক্ষণ সিগারেট খেলাম। বারবার মনে হচ্ছিল ইরিন চলে গেলে আমার কি? আমি এত রাগ করছি কেন? ইরিন তো আমার পৃথিবীতে ছিলোনা। অপ্রত্যাশিতভাবে এসেছে। তবু কেন মনে হচ্ছে, সে না থাকলে আমার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? কেন? এই কেনোর উত্তর কি সবথেকে বড় অনুভূতিটার নাম?
(চলবে)
ডোন্ট কপি। ইউ ক্যান শেয়ার।
#তৃধা_আনিকা