মাতোয়ারা
পর্ব_০৫
তার দুদিন পরই ইরিন জান্নাত নামক ভূমিকম্পকে ডেকে পাঠালাম আমি ।
—কঠিন করে বলবি, যত কাজই থাকুক দশমিনিটের মাঝে যাতে আমার সামনে এসে হাজির হয়! জরুরি কথা আছে। আর হ্যাঁ, দশমিনিট মানে দশমিনিট।
কিছুক্ষণ পর আমার বাহিনী এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
—কি ব্যাপার? সে আসেনি?
আমার বাহিনী নিশ্চুপ।
—আশ্চর্য! এরকম চুপ থাকার মত কি ঘটেছে? তাঁকে কি পাওয়া যায়নি? ইউনিভার্সিটিতে আসেনি?
—আসছে।
—তাহলে?
—বস, ভাবী উল্টা ধমক দিলেন। আপনি পাঠিয়েছেন বিশ্বাস করলেন না। বললেন, আপনাদের বসের সাথে সব কথা তো আমার ফোনেই হয়..
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। এই মেয়ে তো আমার বাহিনীরও ব্রেন ওয়াশ করে ফেলেছে।
—মেয়ের ফোন নাম্বার আছে?
—জ্বি না বস ।
—তাহলে আবার যা।আলটিমেটাম দে, আধঘন্টার মাঝে হাজির না হলে খবর আছে।
আমার বাহিনী আবার গেলো এবং যথারীতি ফিরে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
—কি হলো? এবারও আসেনি?
—ক্লাস চলছে। একটা পঁয়তাল্লিশে ক্লাস শেষ হবে।
আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে বারো। তার মানে আমায় অপেক্ষা করতে হবে। একবার ভাবলাম ডিপার্টমেন্টে যাই, পরে ভাবলাম বেশি পাত্তা পেয়ে যাবে। ভাব বজায় রেখে বললাম,
—ওকে.. ক্লাস তো..। শেষ করেই আসুক, কারো পড়াশোনায় ডিস্টার্ব করা ঠিক না।
আমার বাহিনী মুচকি হাসলো এতে…!
আমি না দেখার ভান করলাম।
তবে তখন হুট করে আমার রাগের বদলে একটা ইন্টারেস্টিং ফিলিং হলো বেশ।
এই প্রথম একটা মেয়ে পাওয়া গেলো, যে অন্তত শ্রেয়ান চৌধুরীকে খেলাচ্ছে…! বাহ!
আমি খুব অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ইরিন একটা পঁয়তাল্লিশে এলো না।
দুটো নাগাদ খবর দিলো ইউনিভার্সিটির লেকের ওখানে আসবে।
আমি চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ নিয়ে গেলাম সেখানে। লেকের ধারটা বেশ নিরিবিলি। আমার টার্গেট গিয়েই দুটো চড় দেবো। এসব ধেতরা মেয়েদের ভুত কঠিন চড় ছাড়া বিদেয় হয় না।
বাহিনীকে রেখে একাই গেলাম। লেকের সিঁড়ি ফাঁকা।, ইরিন আসেনি তাহলে। বজ্জাত মেয়ে। দাঁত কিড়মিড় করে আমি যখন ফিরে আসবো, তখনি….
—ভাইয়া, আমি খুব দুঃখিত। আমার ভুল হয়ে গেছে, অপরাধ হয়ে গেছে; আপনি যা শাস্তি দেন, আমি মাথা পেতে নেবো। দরকার হলে, দরকার হলে.. সবার সামনে আমি আপনার পা ধরে ক্ষমা চাইবো। তবুও মারবেন না আমায়…
আমি চারদিকে খুঁজলাম। আশেপাশে কেউ নেই, আশ্চর্য! কোথা থেকে কথা বলছে?
—ভাইয়া আমি গাছে লুকিয়ে আছি। খুঁজবেন না। আপনাকে আমার ভয় করে তো।তাই লুকিয়ে আছি।
রাগে আমার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিলো, এত বাঁদর মেয়ে হয়?
আমি আশেপাশে সবগুলো গাছেই হালকা চোখ বুলালাম। নেই, হয়তো গাছের পেছনে বা ডগায় উঠে আছে। টুপ করে হয়তো মাথায় লাফিয়ে পড়বে আমার! আবার ঘটা করে খুঁজতে যাওয়াটাও বোকামি হবে।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এমনও তো হতে পারে, মেয়েটা হয়তো রেকর্ড টেকর্ড বাজিয়ে কথা বলছে? আমি আশেপাশে মাটিতে, সিঁড়ির ধারে, গাছের গোঁড়ায় আবার চোখ বুলালাম।
—বললাম তো ভাইয়া, খুঁজাখুঁজি করবেন না।, আপনি আমায় ক্ষমা করলেই আমি আপনার সামনে চলে আসবো। আপনি আমায় মারবেন না বলুন।
আমি হতাশ গলায় বললাম,
—ক্ষমা করা হলো। সামনে এসো, মারবো না। মুখ না দেখে কথা বলা সত্যিই অস্বস্তির।
—তিন সত্যি বলেন ।
—তিন সত্যি কেন বলবো?
—-এই যে আমাকে মারবেন না, এটা সত্যি কিনা.. এজন্য..
আমার হাতে তখন গুলি থাকলে আমি হয়তো মেয়েটাকে দশটা গুলি করতাম। এ পুরো ভুলভুলাইয়া খেলছে আমার সাথে।
—আচ্ছা, ঠিক আছে ভাইয়া, তিন সত্যি বলার দরকার নেই। শুধু বলুন, সত্যি..
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
—সত্যি। তুমি বেরিয়ে আসো।
আমার কথা শেষ হলো না, দিরিম করে সে গাছ থেকে আমার সামনে লাফিয়ে পড়লো। এবং ও মাগো… বলে চিৎকার দিলো।
আমি বিস্মিত হয়ে তাঁকিয়ে আছি হলুদ সবুজ মিশেলে চমৎকার স্কার্ট পরা ছোট্ট মেয়ে। একপাশে এলোমেলো বিণুনী বাঁধা চুলের বেশিরভাগ চুলই খুলে আছে। মুখের একপাশ ঢেকে আছে তাতে, অপর পাশটা রোদে থাকা গালে গোলাপী মিস্টি আভা। চোখে গাঢ় কাজল, চোখের কোণায় ভাসা বড় তিল। লক্ষী তিল বোধহয় একেই বলে ।
কপাল ঘেঁষে ঘন চুল দু-পাশে। হীরের মাঝে রোদ পড়তে দেখলে যেমন আমাদের চোখ আনন্দে কেঁপে উঠে, সেই মুখটাও দেখতে তেমনি। হৃদয় কাঁপানো, মন ভোলানো ।
বাঁ-হাত ভর্তি হলুদ সবুজ কাচের চুড়ির কয়েকটা ভেঙ্গে গেছে।
আমি বোধহয় তাঁকিয়েই ছিলাম।
—ও মা গো…. ও আল্লাহ গো.. আমার পা ভেঙে গেছে ভাইয়া। আমি মরে গেছি ভাইয়া। ভাইয়া গো…. আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, স্কয়ার হাসপাতাল।
আমি ভাবলাম ভং ধরেছে.. এই মেয়ের কোনো বিশ্বাস নেই।
ওহো নো। ইরিন মাটিতে শুয়ে পড়েছে।
—ভাইয়া, আমার পা ভেঙে গেছে। বাঁচান আমাকে বাঁচান… আমি মরে যাচ্ছি। স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান আমাকে।
আমি কাছে গেলাম। হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে বললাম,
—উঠে পড়ো, হয়তো হালকা মচকে গেছে..
ইরিন চিৎকারের মাত্রা এবার দ্বিগুণ করে দিলো।
আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না, প্রায় জোর করে হেঁচকা টানে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ইরিন ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো।
—-আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান । স্কয়ার হাসপাতাল!
আমি বাধ্য হয়ে তাঁকে কোলে নিলাম। স্কয়ার হাসপাতাল কেনো?
—ওখানে ট্রিটমেন্ট ভালো হয় ভাইয়া।
ইরিন শক্ত করে আমার গলা ধরে কাঁদতে লাগলো।
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা