#শেষটা_সুন্দর পর্ব___১৬
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানার দিকে তাকাতে ঘুম উবে গেল নির্ঝরের। তরী অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে। বই, খাতা সব এখনো বিছানা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো। মোটা একটা নোটবুকের উপর মাথা রেখে কাঁচুমাচু হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডান হাতে এখনো একটা খাতা ধরে রাখা।

ধীরপায়ে এগিয়ে গেল নির্ঝর। তরীর দিকে ঝুঁকে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। গভীর মনোযোগ দিয়ে তরীর মুখের প্রতিটি শিরা, উপশিরা দেখে পর্যবেক্ষণ করে চলল। একটুপর মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো সে। বিছানা জুড়ে থাকা বই খাতাগুলো একত্রে গুছিয়ে ফেলল। অল্প অল্প করে সেগুলো তরীর পড়ার টেবিলে রেখে এলো। বিছানার চাদর টান টান করে বালিশ গুলো ঠিকঠাক জায়গা রেখে সে তরীর নিকট এলো। আলতো করে তাকে কোলে তুলে জায়গা মতো শুইয়ে দিল। মাথার নিচের বালিশটা টেনেটুনে ঠিক করলো। শেষে গলা পর্যন্ত কম্বল টেনে দিয়ে তরীর পাশে বসে পড়লো।

নির্ঝর ভেবে পায় না এই ছোট্ট একটা গোলগাল মুখের মাঝে এমন কি আছে যা তাকে এতটা টানে? এতটা পাগল করে তুলে? এতটা ছন্নছাড়া করে দেয়? তার সমস্ত সুখ এই মেয়েটা যেন শুষে নিয়েছে। শুষে নিয়েছে সমস্ত অনুভূতি। তার নিজের বলতে এখন কিছু নেই। সব এই মেয়ের মধ্যে। এই মেয়েকে হাসতে দেখলে তার মুখে হাসি ফোঁটে, একে সুখে দেখলে তার সুখ সুখ অনুভূত হয়, এই মেয়ের মন খারাপ করলে তার মনের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। মানে এই মেয়ে তার মনের সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নিয়েছে। সে এমনি এমনি বলে না এই মেয়ে তার সম্পূর্নাঙ্গিনী।

নিজের চিন্তা ভাবনায় হেসে ফেলল নির্ঝর। সে যে কতটা তরীনির্ভর হয়ে পড়েছে তা যদি এই মেয়ে বুঝতো! হাসি থামিয়ে সে তরীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ভালোবাসি আমার পিচ্চি বউ! বাচ্চা বউ! ভালোবাসি।’

সরে আসার সময় তরীর কপালে গভীরভাবে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিল নির্ঝর। মুখটা উঁচু করতে টিশার্টে টান পড়লো তার। বুঝতে পারলো তরী ঘুমের ঘোরে তার বুকের কাছের টিশার্ট আঁকড়ে ধরেছে। মুচকি হেসে সে তরীর হাত থেকে টিশার্ট ছাড়িয়ে নিল। মনে মনে বলল,

‘এত সহজে তো আমায় পাবে না তরীরানি! যত কষ্টই হোক আমার, এতদ্রুত তোমার হাতে ধরা দিবো না তো ডিঙিরানি। তোমায় আমার জন্য উতলা করে, পাগল করে সেই পাগলামি আবার অামিই সহ্য করবো। তোমার সব পাগলামি আবার আমিই থামাব।’

তারপর একলাফে নিজের জায়গা এসে বালিশে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করলো।

_______________

ভোরবেলা মেয়েলি স্বরের গুনগুন আওয়াজে নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো। কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ ঠাওর করার চেষ্টা করলো কিসের আওয়াজ। মস্তিষ্ক কাজ করতে বুঝতে পারলো এটা তরীর কন্ঠ। তরী তার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে?

বিস্ময় নিয়ে নির্ঝর চোখ টেনে খুলল। ডান কাত হয়ে শুয়ে ছিল সে। চোখ খুলতে সরাসরি তরীর মুখ আবিষ্কার করলো। তরী বিছানায় বই হাতে বসে আছে। গায়ে পাতলা কম্বল পেঁচিয়ে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। ডান হাত দিয়ে মাঝে মধ্যে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। নির্ঝরের কাছে তরীর এই দৃশ্য বিরল। অবাক হয়ে সে তরীর দিকে চেয়ে রইলো। একটুপর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। পাঁচটা বাজতে এখনো সাত মিনিট বাকি!

বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসলো সে। তরীর দিকে চেয়ে বলল,

‘এত ভোরবেলা উঠেছো কেন তুমি? পাগল হয়ে গেছো?’

‘পাগল হয়েছি কি না সেটা আমায় জিগ্যেস করছেন কেন? পাগল কি কখনো বুঝতে পারে যে সে পাগল হয়েছে?’

তরীর উত্তরে নির্ঝর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এক পলক তার দিকে চেয়ে তরী নড়েচড়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিল। নির্ঝর চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। হাই তুলে বলল,

‘কিছু খেয়েছ?’

‘ক্ষুধা নেই।’

নির্ঝর আর দেরি করলো না। দরজা খুলে বাইরে বের হলো। রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো মায়ের রুমে আলো জ্বলছে। হয়তো নামায পড়ার জন্য উঠেছে। সে নিঃশব্দে চুলা জ্বালিয়ে পানি গরম করতে দিল।

ডেকচিতে পানি টগবগ করে ফুটছে। নির্ঝরের সেদিকে খেয়াল নেই। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছে! পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

‘এক কাপ বেশি করে চা বানা তো!’

নির্ঝর চমকে বলল,

‘বাবা!’

‘হুঁ। বল, শুনছি।’

নির্ঝর পেছন ঘুরে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার বাবা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে নোটবুকে কিছু লেখার চেষ্টা করছে। সে বুকে ফু দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

‘বাবা গো। হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়ে প্লিজ আমায় ভয় পাইয়ে দিবে না। এমনিতে হার্ট দূর্বল আমার।’

‘আমারও দূর্বল। হার্ট আর কি! তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দে।’

নির্ঝর গরম পানিতে সব দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। একটুপর চায়ের কাপে ঢালতে ঢালতে বলল,

‘তুমি এখন চা খাবে, ঘুমাবে না? সারা রাত তো জেগেই পার করলে। এখন অন্তত একটু ঘুমাও।’

‘আমি তো এখন ঘুমাব। চা তোর মায়ের জন্য। নামায পড়ে চা খাবে। আমার উপর চা বানানোর হুকুম পড়েছে। সেজন্য রান্নাঘরে আসছিলাম। ভাগ্যিস তুই আগেভাগে থেকে বানাচ্চিলি। কিন্তু তুই এত সকালে কার জন্য চা বানাস? বৌমার জন্য?’

‘তোমার বৌমার জন্য চা বানাব আমি? হাউ ফানি! সবাই তোমার মতো বউকে ভয় পায় না বাবা। নিজের জন্য চা বানাচ্ছি আমি।’

শফিকুর রহমান নির্ঝরের দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলো। এগিয়ে এসে দুটো কাপের মধ্যে একটা চায়ের কাপ হাতে উঠিয়ে চলে গেল।

মিনিট দশেক পর একটা ট্রেতে এক কাপ চা, কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট আর এক টুকরো ড্রাই কেক নিয়ে নির্ঝর রুমে ঢুকলো। তরীর পাশে চেয়ার টেনে সেখানে রেখে দিল। আবার পাশ কাটিয়ে বিছানায় ফিরে বলল,

‘খালি পেটে পড়া মনে থাকবে না। মা বলেছে! চুপচাপ খেয়ে পড়তে থাকো। আমি ঘুমাই!’

নির্ঝরের কাজে তরী বিস্মিত হলেও তার প্রকাশ ঘটলো না। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে সে চায়ের কাপ হাতে তুলে চুমুক দিল। মুহূর্তে তার ভেতরে অন্য রকম ভালো লাগায় ছেয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি নিয়ে সে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝর তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে।

তরী ইচ্ছেকৃত ভাবে শব্দ করে পড়া শুরু করলো। আড়চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের কোনো ভাবান্তর না দেখে সে গলার স্বর আরো কয়েক ধাপ উঁচু করে পড়া শুরু করলো। সে যেহেতু ঘুমাতে পারছে না, এই মানুষটাকেও ঘুমাতে দিবে না।

তরীর গলার স্বর ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। নির্ঝরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ দেখা দিল। পিঠ সোজা করে শুয়ে বন্ধ চোখে বলল,

‘এক লাইন এতবার পড়া লাগে তরী? আমার তো একবার শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে।’

‘আপনি কি বলতে চাইছেন আমার ব্রেন ভালো না? আমার পড়া মুখস্থ করতে অনেক সময় লাগে?’

‘হাউ ফানি! আমি এসব কখন বললাম? তুমি নিজেই তো বলছো।’

‘কি বলেছি আমি?’

‘তেমন কিছু না। অ্যানি ম্যারেজ ক্যারিড আউট বিলোও দ্য এইজ অফ এইটিন ইয়ার্স ব্লা ব্লা ইজ কলড আর্লি ম্যারেজ।এই লাইনটা বারো বার বলেছো।’

তরী কোনো উত্তর দিল না। চায়ে বিস্কিট চুবিয়ে কচমচ করে খেতে লাগলো। নির্ঝর হঠাৎ চোখ খুলে বলল,

‘আমি বাসায় থাকলে তুমি ম্যাক্সিমাম সময় ‘আর্লি ম্যারেজ’ প্যারাগ্রাফ নিয়ে বসে থাকো কেন? নাকি আমায় বোঝাতে চাও যে আর্লি ম্যারেজ করে আমি গর্হিত অপরাধ করেছি? অথবা এটা ধরে নিবো যে একটা প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করতে তোমার এক বছর লেগে যায়।’

তরী অসহায় চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর মিনমিন করে বলল,

‘এই প্যারাগ্রাফটা কেন জানি মুখস্থ হচ্ছে না। দু চার লাইন মুখস্থ করার পর আবার ভুলে যাই। কিছুতেই মনে থাকে না।’

‘ওটা আসবে না। বাদ দিয়ে দাও। মুখস্থ করতে হবে না। আমি ড্যাম সিউর ওটা আসবে না।’

‘কি করে বুঝলেন ওটা আসবে না?’

‘আরে যেটা তুমি পারবে না, সেটা আসবে না।এই নির্ঝর শাহরিয়ার বলে রাখলো। মিলিয়ে নিও!’

তরী হাল ছেড়ে দিল। এর সাথে বেহুদা কথা বলে শুধু সময় নষ্ট। সে চুপচাপ ইংরেজি রেখে অন্য বই বের করলো।

মিনিট বিশেক পর তরী নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। সে লেখা থামিয়ে হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে বলল,

‘আমি ভালো রেজাল্ট করলে কি উপহার দিবেন আমায়?’

তরী ভেবেছিল নির্ঝর উত্তর দিবে না। কিন্তু নির্ঝর মুখ খুলল। ঘুমের ঘোরে কি না জানা নেই। নির্ঝর বন্ধ চোখে অস্পষ্ট সুর তুলে বলল,

‘কি উপহার চাই তোমার?’

তরী মুখটা একটু এগিয়ে নিল নির্ঝরের দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘আপনাকে! নির্ঝর শাহরিয়ারকে।’

(চলবে)

নয়দিন হলো আমি গ্রামে ঘুরতে এসেছি। নেটওয়ার্কের চরম খারাপ অবস্থা। তার উপর ঘনঘন লোডশেডিং। সেই সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। মাত্র আসলো। ফোনে চার্জ দিয়ে তারপর পোস্ট করলাম। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখীত। যদিও পেইজে সাতটার দিকে একবার পোস্ট করেছিলাম। কিছু ত্রুটির জন্য ডিলিট করে দিয়েছিলাম। শুভরাত্রি সবাইকে। 🤎

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here