#তুমি_আমারই_রবে পর্ব_২২
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)
“আমাকে মাফ করে দিন হিমু। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি বুঝতে পারি নি আমার অগোচড়ে এতোকিছু ঘটে গেছে। ঐ দিন রাতে আমি ও নাবিলাকে হসপিটালের কেবিনে দেখি নি। নাবিলার বেডে অন্য একজন বৃদ্ধ মহিলা ছিলেন।”
“তুমি কেনো ক্ষমা চাইছ রূপা? তোমার তো দায় পড়ে নি এতো আঘাত পাওয়া সত্ত্বে ও সন্দেহজনক কিছু অনুসন্ধান করা।”
“তবে আমি আমার মনকে মানাতে পারছি না হিমু। ঐ দিন যদি আমি নাবিলার এবসেন্সের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিতাম তাহলে হয়তো আপনার এই করুন অবস্থা হতো না। আপনি না বললে ও আমি বুঝতে পারছি হিমু। নাবিলা হয়তো আপনার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো। যার ফলে আপনাকে নিজের চেহারা বদলাতে হলো।”
“ভুল ভাবছ রূপা। নাবিলা বা রাহাত কেউ আমার কোনো ক্ষতি করে নি। আমার পাপের ফল আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন। আমার এই করুন অবস্থার জন্য আমি নিজেই দায়ী।”
“কিভাবে হলো আপনার এই অবস্থা হিমু? প্রথম থেকে সব খুলে বলুন।”
“বলছি। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি রুমে তোমাকে দেখতে পাই নি। ভেবেছিলাম হয়তো কিচেনে আছো। ফ্রেশ হয়ে আমি ডেস্কের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই তোমার চিরকুট টা পাই। চিরকুট টা পড়ার সাথে সাথেই আমি সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। এর মাঝেই আম্মু রুমে আসে তোমাকে খুঁজতে। আমাকে নির্বাক অবস্থায় দেখে আম্মু আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করে। সাথে সাথেই আম্মু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো রাগ করে কুমিল্লায় গেছো। তোমার বাবা-মায়ের কাছে। আমি গেলে তুমি ঠিক ফিরে আসবে। তাই আম্মুকে বারণ করি তোমার পরিবারের কাছে ফোন দিতে। মনে মনে ভেবে নেই, নাবিলা আর রাহাত এই দুই কালপ্রিটকে সাথে নিয়েই আমি তোমার কাছে যাবো। তাদের সাথে আমি ও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো। দরকার হলে তোমার পা ধরে আমি ক্ষমা চাইব। নাবিলা আমার সাথে ফ্লড করেছে যেনে ও আমার বিন্দুমাএ কষ্ট, অনুতাপ, আপসোস কিছুই হয় নি। উল্টে এটা ভেবে খুশি হচ্ছিলাম যে আমাদের পথের কাঁটা সরে গেছে। নাবিলা আমাদের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়ালেই আমাদের কাছাকাছি আসাটা আরো জোরালো হবে।”
“রূপা তুমি হয়তো বুঝতে পারো নি, যখন আমি এক্সিডেন্ট করে ঘরে পড়েছিলাম। যে দুই মাস তুমি আমার সেবা যত্ন করেছিলে, এই দুই মাসে আমি একটু একটু করে তোমার প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম, তোমাকে একটু একটু করে জানতে শুরু করেছিলাম, নিজের মতো করে বুঝতে শুরু করেছিলাম, তোমার পছন্দ, অপছন্দ সবকিছুর প্রাধান্য দিচ্ছিলাম। তোমার কেয়ারিং, নিজের থেকে ও বেশি আমার জন্য ভাবা, আমাকে বুঝা, পরিশেষে আমার প্রতি অগাধ ভালোবাসা সব আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। পাঁচ বছরে ও নাবিলার চোখে আমার জন্য যে ভালোবাসাটা দেখতে পাই নি। সেই ভালোবাসাটা আমি তোমার চোখে দেখতে পেয়েছিলাম। খুব সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত আমি তোমার সাথে উপভোগ করেছিলাম। যে মুহূর্ত গুলো আমার কাছে খুব দামি আর স্পেশাল ছিলো। স্বামী, স্ত্রীর পবিএ বন্ধনটা আমি একটু একটু করে বুঝতে শিখেছিলাম। অন্য রকম একটা পবিএ মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। এই সম্পর্কটায় একটা স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম। মন থেকে এই সম্পর্কটাকে সম্মান করছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম স্বামী স্ত্রীর পবিএ ভালোবাসার উর্দ্ধে পৃথিবীতে আর কোনো পবিএ ভালোবাসা হতেই পারে না। তাই হয়তো উপর ওয়ালা দুটো মানুষকে বিয়ের মতো সুন্দর, সাবলীল, মধুর এবং পবিএ সম্পর্কে আবদ্ধ করার রীতি প্রবর্তন করেছেন। যা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এই ধারাটা এভাবেই বহমান থাকবে। বিয়ের পর অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক রাখা ইসলামে জঘন্য পাপ আর জালিয়াতি। এই পাপ প্রকৃত মুসলিমদের পর্যায়ে পড়ে না। আমি আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কটা বুঝছিলাম। তোমার প্রতি একটা আলাদা টান ও অনুভব করছিলাম। নাবিলাকে ছেড়ে দেওযার ও সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম। তোমাকে ঘিরে আমার সমস্ত অুভূতি তোমার ছোট বোন লোপার কাছে শেয়ার করেছিলাম। ঐ দুই মাসে আমি লোপার সাথে অনেকটাই ফ্রি হয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন আমাদের ফোনে কথা হতো। তবে সবটাই তোমার অগোচড়ে। আমাদের মধ্যে যা যা হচ্ছিলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই লোপা জানত। এমনকি তোমার পরিবার ও। আমি তোমার পরিবারের কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিলাম, তোমাকে নতুন করে আবার বিয়ে করার। এবার সম্পূর্ণ বিয়েটা আমাদের দুজনের মন থেকে হবে। কোনো পক্ষের ই জোর প্রয়োগে নয়। তখনই লোপা আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলো তোমার সাথে আরো কয়েকটা দিন নাটক করতে, ইচ্ছে করে তোমাকে রাগাতে, আরো বেশি জেলাস ফিল করাতে। রাগ করে তুমি বেশি দূর যেতে পারবে না। তোমার বাপের বাড়িতেই যাবে। কারণ কিছুদিন আগেই তুমি ফোন করে তোমার আম্মুকে বলেছিলে, কয়েকদিনের জন্য তুমি তোমার বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। সেক্ষেএে লোপা শতভাগ সিউর ছিলো তুমি রাগ করে তোমার বাপের বাড়িতেই যাবে। এর কারণ হচ্ছে, আগামী মাসেই তোমার জন্মদিন আসছিলো। হাত গোনা তিনদিন পরেই তোমার জন্মদিন৷ সেই জন্মদিনের দিনেই আমি হঠাৎ করে তোমাদের বাড়ি গিয়ে উঠব। তোমাকে আমার সমস্ত মনের কথা খুলে বলব। আমাদের বিয়ের বিষয়টা ও বলব। সব মিলিয়ে খুব বড় সড় একটা সারপ্রাইজ দিবো।
“তবে সেই সুযোগটা আমার নসিবে জুটে নি। এর আগেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে এলে। অবশ্য আমরা সবাই মজার ছলে ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার ও ধৈর্য্য বলে একটা বস্তু আছে। তোমার ও ধৈর্য্যের বিচুত্যি ঘটতে পারে, তোমারো মন আছে, কষ্ট তোমার ও হয়। নিজের স্বামীর মুখে পর নারীর কথা শুনতে তোমারো হৃদয় ভাঙ্গে। বিশ্বাস করো, রাগ করে তুমি বাপের বাড়ি না গিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিলে। আসলে আমি ড্রামা করতে গিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। ঐ দিন বেডে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। নাবিলার জন্য কান্না কাটি, নাবিলার চোখের জল মুছে দেওয়া সবকিছুই অতিরিক্ত করে ফেলেছিলাম। অবশ্য এর পিছনে অন্য একটা কারণ ছিলো। কারণটা পরে বলছি।”
উনি কিছুটা দম নিয়ে আবার বললেন,,,
“ঐ দিন তোমার সামনে নাবিলাকে আমাদের ডিভোর্সের কথা বললে ও নাবিলাকে নতুন করে বিয়ের কথা বললে ও পরে যখন তুমি রুম থেকে বের হয়ে যাও তখনই আমি নাবিলাকে সব খুলে বলি। তোমার আর আমার বিয়ের ব্যাপারটা ও নাবিলাকে জানাই। তোমার প্রতি আমার ফিলিংস, ভালো লাগা, ভালোবাসা সব নাবিলাকে বলি। মূলত এই কারণেই নাবিলার সাথে ঐ দিন হসপিটালে দেখা করতে যাওয়া। নাবিলার মনে ছলনা ছিলো বলেই নাবিলা খুব সহজে আমার সব সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলো। কোনো রকম নাকোচ করে নি। উল্টে সে খুশি হয়েছিলো। তখন আমি ব্যাপারটা ধরতে না পারলে ও ঐ দিন রাতেই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিলাম। নাবিলার এই ভালো মানুষিটাই আমার মনে সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছিলো৷ শুধু তাই নয় নাবিলার চোখের নিচে যে ডার্ক সার্কেল গুলো পড়েছিলো সে গুলো সস্পূর্ণ কাজলের কালি ছিলো। নাবিলার চোখ থেকে যখন পানি পড়ছিলো পানির রং সাদা না হয়ে কালো হচ্ছিলো। তাই আমি নাবিলার চোখের জল গুলো মুছে বার বার পরখ করছিলাম। আমার সন্দেহ ঠিক কিনা। নাবিলাকে জড়িয়ে ধরার কারণ ছিলো নাবিলার “Weight.” দুই মাস আগে যখন নাবিলার সাথে আমার হসপিটালের কেবিনে দেখা হয়েছিলো, তখন নাবিলাকে দেখতে খুব রুগ্ন লাগছিলো। দুই মাস পর আজ যখন নাবিলাকে দেখতে এলাম, তখন মনে হলো নাবিলার স্বাস্থ্য অনেকটাই বেড়েছে। সচরাচর মরণব্যধিতে ভোগা রোগীদের এতো রাতারাতি স্বাস্থ্য বাড়ে না। উল্টে দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। খালি চোখে আমি ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। তার উপর নাবিলার গাঁয়ের উপর চাঁদর জড়ানো ছিলো। তাই বুঝতে আরো অসুবিধে হচ্ছিলো। কৌতুহল বশত আমি নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে নিজের অনুমান যাচাই করতে চেয়েছিলাম। আমার অনুমানই ঠিক ছিলো নাবিলার স্বাস্থ্য বেড়েছে। তুমি নাবিলার থেকে অনেকটাই দূরে ছিলে তাই এসব কিছু টের পাও নি।”
হিমুকে থামিয়ে আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,,,
“আাআর চুমোর ব্যাপারটা?”
“চুমোর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ছিলো। নাবিলার সাথে যখন আমি কথা বলছিলাম, তখন আমি নাবিলার চোখে এক প্রকার আতঙ্ক দেখেছিলাম। বার বার পাশ ফিরে বালিশের নিচে তাকাতে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিলো ঐ পাশের বালিশের তলায় কিছু একটা আছে। যা নাবিলা লুকাতে চেষ্টা করছিলো। আড়চোখে দেখতেই একটা ডক্টরী রিপোর্ট আমার চোখে পড়ল। উপরের হ্যাডিং টা আমি পড়তে পারছিলাম না। তাই নাবিলার মুখের উপর দিয়ে ঐ পাশে একটু ঝুঁকতেই নাবিলা আমাকে বার বার বাধ্য করছিলো ওকে চুমো খেতে। সে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আমি রিপোর্ট টা দেখার জন্য উসখুশ করছি৷ আমাকে দমানোর জন্যই নাবিলা ইচ্ছে করে আমাকে ওর দিকে টানছিলো। আর তখনই তুমি রুম থেকে বের হয়ে গেলে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি চোখের সামনে এসব সহ্য করতে পারছিলে না। তাই রুম থেকে বের হযে যেতে বাধ্য হলে। খালি চোখে দেখা জিনিস সবসময় সত্যি হয় না রূপা। মাঝে মাঝে চোখের দেখা ও ভুল হতে পারে। তাছাড়া তোমার মনে তখন আমার আর নাবিলার মধ্যে ভালো লাগা আর ভালোবাসার একটা সফট চিন্তাধারা ছিলো। তাই তুমি খালি চোখে এতোকিছু ক্ষতিয়ে দেখো নি। তোমার মস্তিষ্ক তোমাকে যা দেখাতে চেয়েছিলো তুমি তাই দেখেছিলে। তুমি বের হওয়ার পর রিপোর্ট টা নিয়ে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আপোসে রিপোর্ট টা দেখা হয় নি আমার। তাই আমি বাধ্য হয়ে হুট করে বসা থেকে উঠে যখন নাবিলাকে জিগ্যেস করলাম ঐ রিপোর্ট টা কিসের। তখনই নাবিলা থতমত খেয়ে বলল, রিপোর্ট টা ওর বড় বোনের প্রেগনেন্সির। বিষয়টা আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হলে ও ঐ মুহূর্তে আমি খানিক চেঁপে যাই। সব গুলো সন্দেহমূলক বিষয় এক করে আমি ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে চেয়েছিলাম। হতে পারে আমার চোখের দেখা, ভাবনা চিন্তা সব ভুল৷ মানে সঠিক না ও তো হতে পারে। নাবিলাকে সন্দেহ করার আরো একটি কারন ছিলো, নার্সের হুটহুাট করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া, লাইট ফ্যান বন্ধ করে দেওয়া, চাঁদা নেওয়ার বিষয়টা ও মূল সন্দেহের বিষয় ছিলো। সব কিছুই আমার কাছে খুব নিঁখুতভাবে সাজানো মনে হচ্ছিলো। আর সেজন্যই আমি বাইক আনতে সেদিন বিকেলে আবার নাবিলাকে দেখতে হসপিটালে যাই। নাবিলাকে আমি আরো একটু পরখ করতে চেয়েছিলাম। তখনই আমার সন্দেহ সম্পূর্ণ সঠিক নিশানায় লেগে যায়। রিসেপশনিস্ট ঠিকই বলেছিলো নাবিলা নামের কোনো পেশেন্ট হসপিটালে ভর্তি হয় নি, না রিসেন্টলি কোনো ক্যান্সার রোগী এই হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলে। সবটাই আমাদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য নাবিলা, রাহাত আর হসপিটালের ঐ ডক্টরটা মিলে করেছিলেন। নাবিলার বাড়িতে ছুটে যেতেই রাহাত আর নাবিলাকে একসাথে দেখে আমার বুঝা হয়ে গিয়েছিলো আমার পেছনে খুব বড় সড় একটা ষড়যন্ত্র চলছিলো। নাবিলাকে দেখতে খুব সুস্থ, স্বাভাবিক আর প্রাণোচ্ছ্বল লাগছিলো। বুঝাই যাচ্ছিলো না সে অসুস্থ। মূলত ক্যান্সারের দোহাই দিয়ে নাবিলা আর রাহাত মিলে প্রতি মাসে মাসে আম্মুর থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত করেছিলো। এরপরে ও আমি কিছু বলি নি। ওদের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই আচরণ করেছিলাম। খুব জরুরী ছিলো ঐ ডক্টরের সাথে সরাসরি কথা বলার। ধারণা করতে পারছিলাম ঐ ডক্টর ও নাবিলা আর রাহাতের সাথে এই ষড়যন্ত্রে যোগ ছিলেন। উনার সহযোগীতাতেই হসপিটালে এডমিট না হওয়া সত্ত্বে ও নাবিলা হসপিটালের একটা কেবিন দখল করে রেখেছিলো। এই কেবিনকে শো করেই ওরা আম্মুর থেকে টাকা হাতিয়ে নিতো। হসপিটালের অন্যান্য বড় বড় ডক্টররা বা হসপিটালের মালিকরা যখন পুরো হসপিটালটা রাউন্ড দিতে আসে তখনই ঐ ডাক্তারের পরামর্শে নার্স এসে কেবিনের দরজা, জানালা বন্ধ করে কেবিনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। যেনো উনারা বুঝতে পারেন কেবিনে কোনো রোগী নেই, কেবিনটা পুরো ফাঁকা। যা আইনীভাবে সম্পূর্ণ জালিয়াতী। আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ও আমি পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম। শুধু মাএ পরের দিন সকালের অপেক্ষায় ছিলাম।”
কৌতুহল নিয়ে আমি উনাকে ঝাঁকিয়ে বললাম,,,
“পরের দিন সকালে কি হয়েছিলো হিমু? নাবিলা, রাহাত আর ঐ ডক্টরটিকে ধরতে পেরেছিলেন তো?”
“না পারি নি। ওরা ঐ দিন রাতেই পালিয়ে গিয়েছিলো। হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলো আমি তাদের সন্দেহ করেছি বা তাদের জালিয়াতি ধরে ফেলেছি। পরের দিন নাবিলা, রাহাত, ডক্টর কাউকেই উনাদের বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুলিশ কেইস করেছিলাম আমি তিনজনের বিরুদ্ধে, হসপিটালের মালিক ও আমার সাথে ছিলেন। ঐ ডক্টরের বিরুদ্ধে উনি প্রতারণার মামলা করেছিলেন। ডক্টরকে কিছুদিন পর খুঁজে পাওয়া গেলে ও নাবিলা আর রাহাতকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। নাবিলার পরিবার, রাহাতের পরিবার ও তাদের ব্যাপারে কোনো খোঁজ দিতে পারেন নি। ডক্টরের থেকে অনেক জবানবন্দী নেওয়ার পরে ও উনি বলতে পারেন নি নাবিলা আর রাহাত কোথায় আছে। এর পাঁচ মাস পরেই কেইসটা ক্লোজ করে দেওয়া হয়। কারণ এমনিতেই আমি তোমায় নিয়ে খুব ডিপ্রেশড ছিলাম তার উপর এই কেইস নিয়ে দৌঁড়োদৌঁড়ি আমার ভালো লাগছিলো না। তুমি চলে আসার পর আমি এক প্রকার পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ছিলাম, তোমার রেখে যাওয়া কিছু স্মৃতি খুব জঘন্যভাবে আমাকে তাড়া করছিলো, এক দন্ড শান্তিতে থাকতে পারছিলাম না আমি। প্রতিদিন নিয়ম করে আমার প্রেশার ফল করত। কতো রাত অনিদ্রায়, অনাহারে কাটিয়েছি জানি না। থানা, বাড়ি এই দুই জায়গায় দৌঁড়োদৌঁড়ি করতে করতে আমি হাঁফিয়ে পড়ছিলাম। তোমার নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আবার দেহে শক্তি সন্ঞ্চার করতাম। কতো রাত যে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে ফেরারী হয়েছি তার হিসেব নেই। প্রতিটা জেলায় দুজন করে লোক লাগিয়ে রেখেছিলাম তোমার খোঁজ নিতে। কিন্তু কোনো জেলা থেকেই তোমার খোঁজ আসছিলো না। দীর্ঘ দেড় বছর প্রতীক্ষার পর আমি তোমার সন্ধান পাই। চট্টগ্রাম থেকে সন্ধানটা আসে। যে লোকগুলোকে আমি চট্টগ্রাম শহরে হায়ার করেছিলাম তাদের মধ্যে একজন তোমার খবর আমাকে দিযেছিলো। তোমাকে এই বাড়ির সামনেই উনি দেখেছিলেন। এড্রেসটা পর্যন্ত লোকটার আমার হোয়াট’স এ্যাপ নাম্বারে সেন্ড করে দেয়। তোমার ঠিকানা পাওয়ার সাথে সাথেই আমি উন্মাদের মতো খালি পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। আম্মু, আব্বুকে শুধু বলেছিলাম আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি, তোমার খোঁজ পেয়েছি। বাইকের পেট্রোল ফুরিয়ে এসেছিলো আমার। এই পেট্রোল নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই আমি আম্মু, আব্বুকে বলে বাস ধরে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা পর চট্টগ্রামের রাস্তায় গাড়িটা মোড় নিতেই অসতর্কতা বশত অন্য একটা বাসের সাথে আমাদের বাসটার বিশাল সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে বাসের প্রতিটা মানুষ গুরুতর ভাবে আহত হয়। তার মধ্যে নিহতের পরিমান বেশি। আমি ও জঘন্যভাবে আহত হয়েছিলাম। বাসের সমস্ত কাঁচ ভাঙ্গা এসে আমার মুখে পড়েছিলো। ড্রাইভারের পাশের সিট গুলোতে বসেছিলাম আমি। তাই বাসের সামনের বিশাল কাঁচটা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে আমার চোখে, মুখে উপচে পড়ে। তাল সামলাতে না পেরে আমি সিট থেকে ছিটকে উল্টো হয়ে মাটিতে পড়লাম। তখনই কাঁচ ভাঙ্গা গুলো মারাত্নকভাবে আমার মুখে গেঁথে যায়। মুখটা সম্পূর্ণভাবে থেতলে যায় আমার। তার উপর বাসের সিট নড়বড়ে হয়ে আমার উপর ভেঙ্গে পড়ে। যন্ত্রণাটা আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলো। বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। মনে হচ্ছিলো আজরাইল এসে আমার রুহটা এক্ষনি নিয়ে যাবে। গলা দিয়ে কোনো আর্তনাদ বের হচ্ছিলো না। চিৎকার করে বলতে পারছিলাম না, “প্লিজ সেইভ মি।” চারদিকে রক্তের স্রোত। লোকজনের বুক ফাঁটা আহাজারী। ছোট বাচ্চাদের বুক ফাঁটা চিৎকার। মনে হচ্ছিলো মৃত্যুপুরীতে শুয়ে আছি আমি। কোনোভাবেই এদিক সেদিক মুভ করতে পারছিলাম না। অনবরত কাশছিলাম আমি। মুখ দিয়ে গড়গড়িয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। কেউ আসছিলো না আমাকে বাঁচাতে, একটু সাহায্য করতে। “তোমাকে নিয়ে তখন খুব চিন্তা হচ্ছিলো। মৃত্যুর আগে একটাবার তোমাকে দেখতে না পাওয়ার আপসোসটা যেনো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। চোখের সামনে মনে হচ্ছিলো তুমি সাদা থান পড়ে ঘুড়ছ। তোমাকে ছুঁতে গেলেই তুমি হারিয়ে যাচ্ছ। বার বার এটাই ভাবছিলাম ভাগ্য কতোটা নির্মম হলে তোমার কাছে শেষ বারের মতো প্রাণ খুলে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটা ও আমার থেকে কেড়ে নেয়। তবে পরক্ষনে মনে হচ্ছিলো, যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছিলো, এসব আমার পাপের শাস্তি। তোমার সাথে করা পাপের শাস্তি। এই শাস্তির কোনো প্রতিকার নেই। এর এক মাএ প্রতিকার হলো মৃত্যু। ভয়ঙ্কর মৃত্যু।”
উনি গলা জড়ানো কন্ঠে আবার বললেন,,,
“এর মাঝেই মনে হলো কেউ আমাকে টেনে হেছড়ে সিটের তলা থেকে তুলছে। সাথে সাথেই আমার ইন্দ্রীয় শক্তি কাজ করা বন্ধ করে দিলো। চোখ বুজে ফেললাম আমি। ভেবেছিলাম হয়তো সারা জীবনের জন্য চোখ বুজে ফেলেছি!”
কাঁদতে কাঁদতে আমি উনাকে ছেড়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লাম। মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা কেউ টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উনার এই করুন পরিণতির কথা শুনে আমার মনে জমে থাকা অভিমানের পাহাড় গুলো একটা একটা করে সরে যাচ্ছে। হিমু এখনো একই জায়গায় নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল চোখ থেকে উনার টলটলিয়ে পানি পড়ছে। শ্বাশুড়ী মা আমার পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,,
“আমার ছেলে তার পাপের শাস্তি পেয়েছে রূপা। খুব জঘন্যভাবে পেয়েছে। আমরা তো অলরেডি হিমুর বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তবে উপর ওয়ালা এতোটা ও নির্দয় হন নি। আমার ছেলের বেঁচে থাকার একটা আশার পথ দেখিয়েছিলেন। ঐ এক্সিডেন্টে খুব ভয়াবহভাবে আমার ছেলের মুখটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কোনো ডক্টরই আমার ছেলের চিকিৎসার রিস্ক নিচ্ছিলেন না। সব ডক্টর বলছিলেন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই আমার ছেলের মুখটাকে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হবে। দেশের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই। তুই তো জানিস ই হিমুর বড় মামা আমেরিকায় থাকেন। উনি ই সাজেস্ট করলেন হিমুকে দ্রুত আমেরিকায় নিতে যেতে। আমেরিকার সবচে উন্নত হসপিটালে হিমুর প্লাস্টিক সার্জারী করাবেন। কিছুদিনের মধ্যে আমরা খুব কাঠ, খড় পুড়িয়ে ভিসা, পাসপোর্ট জোগাড় করে হিমুসহ আমেরিকায় যাই।”
শ্বাশুড়ী মা এতোটুকু বলেই থেমে গেলেন। পেছন থেকে আন্টি আমার কাছে এগুতে এগুতে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,,,
“প্লাস্টিক সার্জারীর মাধ্যমেই হিমুর মুখ পাল্টিয়ে আমার ছেলে “মেহুলের” মুখের ধরণ দেওয়া হয়। আমেরিকায় যাচ্ছিলাম নিজের ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতে। উল্টে আমার ছেলে আমাদের এত্তো বড় সারপ্রাইজ দিবে ভাবতেই পারি নি। আমরা যেদিন আমেরিকায় যাই ঐ দিনই মেহুলের খুব বড় একটা কার এক্সিডেন্ট হয়৷ এক্সিডেন্ট স্পটেই আমার ছেলে মারা যায়। এরপরে ও আমরা পাগলের মতো ছেলেকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে যাই। মনকে শান্তনা দিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো আমাদের ছেলে বেঁচে আছে। ডক্টররা বার বার করে বলছিলেন আমার ছেলে নেই। মরে গেছে। এরপরে ও যেনো বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আর ঐদিনই ওখানে হিমুর পরিবারের সাথে আমাদের দেখা হয়, পরিচয় হয়, কথা হয়। হিমুর মা কাঁদতে কাঁদতে নানাভাবে আমাদের শান্তনা দিচ্ছিলেন। উনার ছেলের করুন অবস্থার কথা আমাকে বললেন, প্লাস্টিক সার্জারীর কথাটা ও বললেন। তখনই আমি উনার হাত ধরে বলেছিলাম উনার ছেলের মুখ পাল্টে যেনো আমার ছেলের মুখের ধরণ দেওয়া হয়। হাতে, পায়ে ধরে রিকুয়েস্ট করেছিলাম উনাকে। অন্তত উনার ছেলেকে দেখে যেনো আমরা আমাদের মৃত্য ছেলের শোক ভুলে থাকতে পারি। আমার আকুতি, মিনতি দেখে হিমুর মা রাজি হয়ে যান। উনার ছেলেকে মেহুলের রূপ দিতে। আর সে অনুযায়ী হিমুর মুখে প্লাস্টিক সার্জারী করানো হয়। দীর্ঘ দেড় মাস পর হিমু কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে। আর সুস্থ হতেই সে তোমার জন্য পাগলামী জুড়ে দেয় রূপা। হিমুর মুখে বার বার রূপা নামটা শুনে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে যখন হিমুকে জিগ্যেস করলাম রূপা কে। তখনই হিমু গড়গড় করে আমাকে সব বলল। যখন তোমার ছবিটা হিমু আমাকে দেখালো তখনই আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমার অতি পরিচিত রূপাই হলো “হিমুর রূপা।” খুব কষ্টে হিমুকে পনেরো দিন আটকে রেখেছিলাম আমেরিকার হসপিটালে। পনেরো দিন পর হিমু সহ আমরা সবাই বাংলাদেশে ফিরে আসি। বাংলাদেশে ফিরেই হিমু তোমাকে দেখার জন্য চট্টগ্রাম ছুটে আসে। আর আমরা চলে যাই হিমুর মা, বাবার সাথে কুমিল্লায়!”
অবাকের পর অবাক হচ্ছি আমি। আমার অগোচড়ে কতো কিছুই না ঘটে গেলো। যা আমার ধারণা শক্তির বাইরে ছিলো। এর মাঝেই মনে হলো আমার আম্মু পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকছেন। আশ্চর্য হয়ে আমি পিছনের দিকে তাকাতেই দেখলাম, আম্মু, আব্বু আর লোপা চোখে জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
#চলবে…🙂
(গল্পের জট আশা করি খুলতে পেরেছি। কারো মনে আর কোনে কৌতূহল নেই। গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তাই বাস্তবের সাথে না মিলালেই খুশি হবো। যাই হোক, সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা। আগামী কাল গল্প দেওয়া সম্ভব নয়। কোরবারী ঈদ। বুঝতেই পারছেন খুব ব্যস্ততা।)