তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_১৯
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)
“তুমি বুঝো নি, আমি বলি নি,
তুমি স্বপ্নতে কেনো আসো নি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে সব গেয়েছি!”
থেমে গেলেন উনি। নিঃশব্দে গিটারের স্টিঙয়ে এলোমেলো ভাবে সুর তুলছেন উনি। মাঝে মাঝে চোখ থেকে দু, এক ফোঁটা জল ও গড়িয়ে পড়ছে। নিবার্ক চাহনী উনার। এই চাহনীর মাঝেই সয়ে যাওয়া শত সহস্র যন্ত্রণার রেশ লেগে আছে। যা হয়তো উনি কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেন নি। বুঝলাম না! এই লোকের কিসের এতো কষ্ট? সবসময় তো উনাকে হাসি, খুশি আর মজার মানুষ হিসেবে দেখেছি। কখনো উনাকে দেখে বুঝা যায় নি উনার মনে কষ্ট আছে বা উনি ও কাঁদতে পারেন। রাতারাতি উনার এই পরিবর্তন অন্তত আমার কাছে সাপোর্টিভ লাগছে না। জানতে হবে উনার কি হয়েছে। কেনো উনি এভাবে কাঁদছেন।
ধীর পায়ে হেঁটে আমি দরজাটা হালকা ঠেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করলাম। রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি এখনো টের পান নি উনি। কোথায় একটা মশগুল আছেন উনি। আশেপাশের কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে কোনো ধ্যান, ধারণা নেই উনার। হাঁটতে হাঁটতে আমি ব্যালকনীতে এলাম। একদম উনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম। উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,,,
“মেহুল শুনছেন?”
কিছুটা থতমত খেয়ে উনি আমার দিকে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে চোখে, মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটিয়ে উনি ব্যালকনী থেকে নেমে গিটারটা পাশে রেখে আমার কপালে হাত রেখে বললেন,,,
“ইসস। জ্বর তো এখনো কমে নি রূপা। উঠে এলে কেনো?”
“আগে বলুন আপনি কাঁদছেন কেনো?”
আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে উনি উল্টো পাশে ফিরে ভার গলায় বললেন,,
“তুমি একটু বেশিই দেখছ।”
“বেশি দেখছি না আমি৷ বলুন আপনার কি হয়েছে? কেনো কাঁদছেন?”
“কিছু হয় নি রূপা। কেনো বার বার একই প্রশ্ন করছ?”
আমি তেড়ে গিয়ে উনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,,,
“আমি জানি আপনার কিছু একটা হয়েছে। হয়তো আপনি ইচ্ছে করে কারণটা শেয়ার করতে চাইছেন না। আপনি যদি সত্যিই আমাকে বন্ধু ভেবে থাকেন তাহলে নিসংকোচে বলে ফেলুন কি হয়েছে।”
উনি হঠাৎ অস্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“আমি ও কাউকে ভালোবাসতাম রূপা। নিজের অজান্তেই তার সাথে আমি খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছিলাম। যখন আমি আমার অন্যায়টা বুঝলাম তখনই সারা জীবনের জন্য তাকে আমি হারিয়ে ফেললাম। আমার থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে সে। আমি চাইলে ও হয়তো তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। আগের মতো করে তাকে পাবো না।”
আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উনাকে বললাম,,,
“তাকে খুঁজছেন না কেনো? খুঁজলেই তো পেয়ে যাবেন। মন থেকে খুঁজুন তাকে।”
“যে নিজে থেকে হারিয়ে যায় তাকে হাজার চাইলে ও খুঁজে পাওয়া যায় না রূপা! মন থেকে চাইলে ও না।”
“তা হয়তো ঠিক। তবে, আপনি তাকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন তো?”
“পাগলের মতো খুঁজেছি। দিন, রাত এক করে খুঁজেছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুলিশ স্টেশানে আপ ডাউন করেছি৷ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। তবু ও তাকে কোথাও খুঁজে পাই নি।”
উনি কিছুটা দম নিয়ে আবার বললেন,,,
“যদি ও তাকে আমি খুঁজে পাই, তার কাছে ক্ষমা ও চাই, তাহলে ও সে আমার কাছে ফিরে আসবে না, আমাকে ক্ষমা করবে না। উল্টে আমার থেকে আরো বেশি দূরে সরে যাবে।”
“কেনো ক্ষমা করবে না? অবশ্যই করবে৷ আপনি তো আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন। একটা সুযোগ তো আপনাকে দেওয়াই উচিত।”
উনি হঠাৎ আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বললেন,,,
“সত্যিই তোমার মনে হয় আমাকে ক্ষমা করা উচিত?”
“হুম উচিত। খুব উচিত। আমি তো জানি আমার বন্ধু কতোটা ভালো আর সুন্দর মনের। আপনার গার্লফ্রেন্ড যদি আপনাকে ক্ষমা না করে প্রয়োজনে আমি তাকে বুঝিয়ে বলব। সে ঠিক আপনাকে ক্ষমা করে দিবে।”
“যদি হিমুর ক্ষেএে ও এমনটা হয়? যদি হিমু ও তোমার কাছে ফিরে আসে? ওর ভুল বুঝে তোমার কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে তুমি তাকে ক্ষমা করতে পারবে তো রূপা?”
উনার থেকে অনেকটা দূরে সরে এলাম আমি। এক দৌঁড়ে দরজার কাছে এসে আমি গলা জড়ানো কন্ঠে পেছন থেকে উনাকে বললাম,,
“হিমু শুধু আমার সাথে অন্যায় করেন নি। আমার মনটাকে ভেতর থেকে ভেঙ্গে দিয়েছেন। সবচে বড় কথা হলো উনি কখনো আমাকে বুঝতেই পারেন নি। না কখনো বুঝার চেষ্টা করেছেন, তাই আমি চাইলে ও হয়তো হিমুকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। কখনো না।”
রুমের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে আমি ঐ রুমে চলে এলাম। দরজাটা ভেতর থেকে লক করে আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে আবারো শুয়ে পড়লাম। ঘুমোতে চাই আমি। জোর করে হলে ও ঘুমোতে চাই। মানসিক প্রেশারাইজ আর নিতে পারছি না। মানসিকভাবে একটু রিলিভ চাই। কিছুক্ষণ পর আপনা আপনিই চোখ লেগে এলো আমার। একটু একটু করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি।
,
,
ঘুম থেকে উঠতেই পিটপিট চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। রুমটা পুরো অন্ধকার হয়ে আছে৷ তবে থাই গ্লাস দিয়ে রোদের ঝাপসা আলো রুমের ভেতর ঢুকছে। বড় করে হাই তুলে আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম সকাল নয়টা বাজছে। চোখ দুটো কিছুক্ষণ কচলে আমি হামি তুলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। শরীর এখন অনেকটাই ব্যাটার লাগছে। কোনো রকম নিশক্তি কাজ করছে না। জ্বর জ্বর ভাবটা ও নেই। ঔষধের এক ডোজেই যে এতোটা ব্যাটার ফিল করব ভাবতে পারি নি।
ধীর পায়ে হেঁটে আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে জট পাকিয়ে আছে আমার। ডান গালে খুব জায়গা নিয়ে বড় করে একটা পিম্পল উঁকি দিয়েছে। নাক, মুখ কুঁচকে আমি পিম্পলটাকে কিছুক্ষণ নখ দিয়ে খোঁচালাম। পিম্পলটার উপরিভাগ এখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। যে কোনো সময় রক্ত গড়িয়ে পড়বে। খুব জ্বালা করছে জায়গাটা। এতো সময় নিয়ে খোঁচানোর পরে ও ভিতরের জীবানুটা বের করতে পারি নি। তাই মনটা খুব উশখুশ করছে। যতোক্ষন না ভেতরের জীবানুটা বের করব আমার শান্তি হবে না। তবে আর একটু খোঁচালে পিম্পলটা থেকে রক্ত বের হবে। হয়তো গালে স্পট ও পড়ে যাবে। তাই খোঁচাখোঁচি বন্ধ করে মুখটা কালো করে আমি পিম্পলটায় হাত দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। মুখে পানি ছিটাতেই পিম্পলের জায়গাটা ছ্যাত করে জ্বলে উঠল। জ্বলনটা বুকে গিয়ে বিঁধল। মুখে দ্বিতীয় বার পানি না দিয়েই কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে আমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম।
বিছানার উপর থেকে উড়নাটা নিয়ে আমি গলায় পেঁচিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। ধীর পায়ে হেঁটে আমি ড্রইং রুমে এলাম। ড্রইং রুমটা পুরো ফাঁকা। ড্রইং রুম থেকে কিচেন রুমটা দেখা যাচ্ছে। কিচেনে আন্টি কাজ করছেন। এই সুযোগে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেলে ও কেউ দেখবে না আমায়। তাড়াহুড়ো করে আমি সদর দরজাটা খুলতে নিলেই কিচেন রুম থেকে আন্টি চেঁচিয়ে বললেন,,,
“রূপা দাঁড়াও। নাশতা করে যাও।”
দরজার খিল খুলতে গিয়ে ও আমি থেমে গেলাম। পিছু ঘুড়ে আমতা আমতা করে আন্টিকে বললাম,,,
“পরে আসব আন্টি। এখন যাই। ফ্ল্যাটে অনেক কাজ পড়ে আছে।”
আন্টি ধোঁয়া উঠা চায়ের মগ হাতে নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,,,
“যাবে পরে। আগে বলো তোমার শরীর এখন কেমন? ভালো লাগছে তো?”
“জ্বি আন্টি। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি।”
আন্টি বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে চায়ের মগটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে এক নিশ্বাসে বললেন,,,
“রূপা একটু কষ্ট করে মসলা চা টা মেহুলকে দিয়ে এসো না। ছেলেটার ভোর রাত থেকে খুব জ্বর। চুলায় স্যুপ বসিয়েছি, তাই আমি যেতে পারছি না। যদি তুমি একটু যেতে, তাহলে খুব উপকার হতো।”
ভ্রু দুটো সংকুচিত করে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আন্টির দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
“মেহুলের জ্বর? কই আমি তো টের পাই নি। কাল রাতেই তো উনার সাথে আমার কথা হলো। তখন তো সুস্থই দেখেছিলাম।”
“রাতে ভালোই ছিলো। ভোর থেকে প্রচন্ড জ্বর। ফজরের নামায পড়ে আমি ওর রুমে গিয়েছিলাম। রুমে ঢুকেই দেখি ছেলেটা বেডের এক কোণায় গুটি শুটি হয়ে পড়ে আছে। টানা দু ঘন্টা মাথায় পানি ঢেলেছি, জল পট্টি দিয়েছি। হাচ্চি, কাশি সব একসাথে। কিছুতেই জ্বরটা নামছে না। পুরো খারাপ অবস্থা হয়ে গেছে আমার ছেলেটার। তাই তাড়াহুড়ো করে আমি মসলা চা আর স্যুপ বসিয়েছি। তুমি যদি চা টা একটু দিয়ে আসতে খুব ভালো হতো।”
আমি তাড়াহুড়ো করে আন্টির হাত থেকে চায়ের মগটা নিয়ে প্রতি উত্তরে আন্টিকে কিছু না বলেই দৌঁড়ে মেহুলের রুমের কাছে চলে এলাম। রুমের দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতেই দেখলাম মেহুল উল্টো হয়ে বেডে শুয়ে আছেন। শরীরের অর্ধেক অংশ উনার বেডের বাইরে ঝুলে আছে, বাকি অর্ধেক অংশ বেডে। হাত দুটো উনি শূন্যে ভাসিয়ে বিড়বিড় করে কিসব যেনো বলছেন। একটু এগিয়ে যেতেই শুনলাম উনি মিনমিনিয়ে বলছেন,,,
“পানি খাবো। কেউ আছো?”
চায়ের মগটা ডেস্কের উপর রেখে আমি গ্লাসে পানি ঢেলে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে মেহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ঝুঁকে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
“মেহুল উঠুন। পানি খান।”
উনি ঢুলুঢুলু কন্ঠে বললেন,,,
“হুম?”
আমি উনার দিকে আরেকটু ঝুঁকে বললাম,,,
“পানি এনেছি। উঠুন। পানি খান।”
উনি এবার মাথা তুলে পিটপিট চোখে আমার দিকে তাকালেন। সমস্ত মুখ উনার লাল হয়ে আছে। সাথে চোখ গুলো ও। খুব রুগ্ন দেখতে লাগছে উনাকে। চোখের নিচ গুলো ও কেমন কালো গেছে। সামনের ছোট ছোট চুল গুলো কপালে লেপ্টে আছে। চোখ দুটো উনি স্থির রাখতে পারছেন না। বার বার বুজে যাচ্ছে। কেনো জানি না উনার এই করুন অবস্থা দেখে আমার চোখে জল চলে এলো। খুব ইচ্ছে করছে উনাকে একবার বুকে নিতে। ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে। হিমুর ছায়া আমি উনার মাঝে দেখতে পাচ্ছি। হিমুর যখন এক্সিডেন্ট হয়েছিলো তখন উনাকে রুগ্ন অবস্থায় যেমন খাপ ছাড়া লাগত, মেহুলকে ও ঠিক তেমনই লাগছে। সেই একই রকম ছটফটানি, রোগের তাড়নায় নির্জীব হয়ে পড়া। মানে কোনো ফাঁক ফোঁকড় নেই। কেবল চেহারাটাই অমিল!
ভেসে থাকা জল গুলো চোখের মাঝে পুড়েই আমি মেহুলের মুখের কাছে পানির গ্লাসটা ধরলাম। মেহুল আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে গ্লাসটা মুখে নিয়ে একটু একটু করে পানি খাচ্ছেন। সর্বোচ্চ তিন ঢোক পানি খেয়ে উনি মাথাটা আবারো শূণ্যে ভাসিয়ে দিলেন। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে উনার। তাই তাল ঠিক রাখতে পারছেন না। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে উনার গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। হাতটা মনে হচ্ছে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে আমার। সাথে সাথেই হাতটা আমি উনার কপাল থেকে সরিয়ে নিলাম। পানির গ্লাসটা পাশে রেখে আমি উনার দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে বললাম,,,
“মেহুল। উঠুন। এভাবে মাথাটা বেশিক্ষন শূণ্যে ঝুলিয়ে রাখলে মাথায় রক্ত উঠে যাবে।”
উনি কিছু বললেন না। চোখ বুজে কেবল ঠোঁট গুলো নাড়াচ্ছেন। উপায় বুদ্ধি না পেয়ে আমি উনাকে দু হাত দিয়ে ঠেলে উল্টানো অবস্থা থেকে সোজা করলাম। পাখার বাতাসে উনার কপালে লেগে থাকা চুল গুলো উড়তে শুরু করল। একটু একটু করে আমি উনার মাথাটা সম্পূর্ণ বেডের উপর এনে বালিশে শুইয়ে দিলাম। নাক দিয়ে পানি পড়ছে উনার। নাক টেনে উনি একটানা সাতটা হাচ্চি একসাথে দিলেন। নাক ঘঁষতে ঘঁষতে লাল করে ফেলছেন। কিছুক্ষন পর পর নাক, মুখ চুলকাচ্ছেন। হয়তো নাকের পানি গুলো শিহরণ দিচ্ছে। কি হলো আমার জানি না, উড়নার আঁচলটা এনে আমি উনার নাক মুছে দিলাম🤮 এরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে উনার মাথায় হাত বুলিয়ে কানের কাছে বললাম,,,
“মেহুল উঠুন। গরম গরম মসলা চা টা খেয়ে নিন। দেখবেন সর্দি কমে গেছে।”
উনি চোখ বুজেই বিড়বিড় করে বললেন,,,
“কিছু খাবো না আমি। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। গাঁ টা ও জ্বলছে।”
“আচ্ছা আগে চা টা খেয়ে নিন। এরপর ঔষধ খাবেন। তারপর আমি আপনার গাঁ টা মুছে দিবো। দেখবেন ভালো লাগবে।”
“খাবো না রূপা। ভালো লাগছে না আমার।”
“খেতে হবে আপনাকে। জোর করে হলে ও খেতে হবে।”
কথাটা বলেই আমি মেহুলকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বেডের কর্ণারে হেলান দিয়ে বসালাম। উনি চোখে, মুখে বিরক্তি নিয়ে মাথাটা এপাশ থেকে অপাশ করছেন। তবে কিছুতেই চোখ খুলছেন না। হয়তো চোখ বুজে রাখতেই ভালো লাগছে। চায়ের মগটা নিয়ে আমি উনার মুখের কাছে ধরলাম। উনি কিছুতেই মগটা মুখে পুড়ছেন না। জোর করে আমি মগটা উনার মুখে পুড়ে দিলাম। এবার উনি একটু একটু করে চুমুক দিয়ে চা টা খাচ্ছেন। পুরোটা চা শেষ হওয়ার পর উনি বালিশে মাথাটা সম্পূর্ন এলিয়ে দিলেন। আমি উনার পাশ থেকে উঠে দৌঁড়ে কিচেন রুমে চলে এলাম। আন্টি এতক্ষনে স্যুপ বানিয়ে ফেলেছেন। স্যুপ ভর্তি বাটি নিয়ে আমি মেহুলের রুমে চলে এলাম। গরম স্যুপে ফুঁ দিয়ে আমি পুরোটা স্যুপ উনাকে খাওয়ালাম। আমার রুম থেকে মেডিসিনের প্যাকেট টা এনে আমি সবগুলো মেডিসিন থেকে একটা একটা করে মেডিসিন উনাকে খাইয়ে দিলাম। এতক্ষণ যাবত যে আমি উনার জন্য এতো কিছু করিছি বা করছি উনার কিন্তু বিন্দু পরিমান হুশ, জ্ঞান ও নেই। অর্ধ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন উনি।
পরিশেষে আমি ওয়াশরুম থেকে বালতি ভর্তি পানি এনে সফট একটা নেকড়া ভিজিয়ে আলতো করে উনার শরীরটা মুছে দিলাম। শেষে বারের মতো যখন আমি উনার মুখটা মুছতে নিলাম, অমনি হঠাৎ উনি আমাকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলেন। শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে উনি আমাকে ঝাপটে ধরেছেন। হুট করে এই লোকের গাঁয়ে এত্তো শক্তি কোত্থেকে এলো তাই আমার মাথায় ঢুকছে না। কোনো ভাবেই ঠেলে উনাকে কুল পাচ্ছি না। উনার শক্তির সাথে আমি ঠিক পেরে উঠছি না। এক পর্যায়ে আমার খুব রাগ লেগে এলো। চোখ, মুখ লাল করে প্রচন্ড চিল্লিয়ে আমি কিছু বলার আগেই মেহুল অস্পষ্ট স্বরে বললেন,,,
“কাছে থেকে ও তুমি সবসময় দূরে থাকতে। কখনো তোমাকে সেভাবে জড়িয়ে ধরা হয় নি। এই প্রথমবার তোমাকে এতো কাছ থেকে ফিল করার, নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপটে ধরার সৌভাগ্য হলো আমার। বুকটা সবসময় তৃষ্ণার্ত থাকত তোমার জন্য। আজ সেই তৃষ্ণা মিটে গেলো।”
বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলেই উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পেয়েই আমি হুড়মুড়িয়ে উনার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বুকের বাঁ পাশটা তীব্র গতিতে লাফাচ্ছে আমার। বুকে হাত দিয়ে আমি নাক, মুখ কুঁচকে খুব বিরক্তি নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি এতক্ষনে মাথাটা বাম পাশে এলিয়ে দিয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আমি উনার দিকে একটু ঝুঁকে উনার বুকের বাঁ পাশটায় কান রাখলাম। অমনি উনার হার্টবিটের আওয়াজ আমার কানে এলো। উনার হার্টবিট ও দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। যদি ও আওয়াজটা শোনার কথা না এরপরে ও আমি শুনছি। কানটা সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। আমার বুকের বাঁ পাশটা ও ঠিক উনার মতোই ধুকপুক ধুকপুক করছে৷ কোথাও একটা অদৃশ্য মিল আছে। সেই মিলটাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া একটু আগে উনার বলা প্রতিটা কথা আমার মনে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। কথাগুলো উনি কাকে অনুভব করে বললেন? আমাকে অনুভব করে, নাকি উনার গার্লফ্রেন্ডকে অনুভব করে?
উনার গাঁয়ের উপর কাঁথা মেলে দিয়ে আমি এখনো বুকে হাত রেখে আকস্মিক দৃষ্টিতে রুমের দরজাটা হালকা ভেজিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। ড্রইং রুমে আসতেই আন্টি আমাকে পেছন থেকে ডেকে বললেন,,,
“রূপা। হিমু এখন কেমন আছে?”
আমি উনার দিকে না তাকিয়েই সদর দরজার খিল খুলে ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছি আর বলছি,,,
“ভালো আছে।”
এই একই দৃষ্টি নিয়ে আমি আমাদের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। লামিয়া আর নীলা আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করছে। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি সোজা রুমে ঢুকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। বিছানায় হাঁটু গুজে বসে আমি একটু আগের ঘটা প্রতিটা মুহূর্তকে ভাবছি আর পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছি। নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি আমি। এই প্রথমবার কেউ আমাকে ঝাপটে ধরেছে। কারো হার্টবির্টের আওয়াজ আমি নিজ কানে শুনেছি। তা ও আবার এতোটা কাছ থেকে। শুধু তাই নয় আমার হার্টবিটের আওয়াজের সাথে সেই লোকটার হার্টবিটের আওয়াজ ও মিলে গেছে। অবাক না হয়ে কূল পাচ্ছি না আমি। কিছুতেই যেনো আমি এই আকস্মিকতার রেশ কাটাতে পারছি না।
যখন আমার ধ্যান ফিরল তখন লামিয়া আর নীলা দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে রুমের বিভিন্ন আসবাবপএ নিয়ে একটা প্লাস্টিকের বস্তায় পুড়ছে আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,
“রূপা উঠ। আসবাবপএ গুলো গুছিয়ে নে। একটু পরেই ভ্যান আসবে। ঐ ফ্ল্যাটে আসবাবপএ গুলো শিফট করতে হবে।”
উঠে দাঁড়ালাম আমি। অন্য মনস্ক হয়ে ওদের সাথে কাজ করছি। দুপুর তিনটের মধ্যেই এই ফ্ল্যাটের সমস্ত আসবাবপএ ঐ ফ্ল্যাটে শিফট করা হলো। পুরনো ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে আমরা নতুন ফ্ল্যাটে চলে এলাম। নতুন ফ্ল্যাটে আসবাপএ সেট করে গুছাতে নিলেই আন্টি আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন৷ উনি জোর করে আমাদের লাঞ্চ করানোর জন্য উনাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলেন। ডাইনিং টেবিলে খুব হেসে হেসে আন্টি আমাদের জন্য খাবার সাজাচ্ছেন। লামিয়া আর নীলা আন্টির সাথে নানা ধরনের কথা বলছেন। আমি কেবল এদিক সেদিক তাকিয়ে মেহুলকে খুঁজছি। উনার জ্বরটা কমেছে তা ও জানতে পারছি না। মনটা কেমন উসখুস করছে। না চাইতে ও উনাকে নিয়ে ভাবছে।
আমার ছটফটানি দেখে আন্টি ডাইনিং টেবিল থেকেই আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,,
“রূপা৷ তুমি চাইলে মেহুলের রুমে যেতে পারো। সকালে একবার গিয়েছিলাম ওর রুমে। আর এখনো যাওয়া হয় নি। তুমি একটু দেখে এসো মেহুল ঘুম থেকে উঠেছে কিনা।”
আর এক মুহূর্ত ও দেরি করলাম না আমি। সোফা থেকে উঠে সোজা মেহুলের রুমে চলে এলাম। এতোক্ষণ হয়তো এই পার্মিশনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। মেহুলের রুমে ঢুকতেই দেখলাম বেডটা ফাঁকা। মেহুল বিছানায় নেই। হম্বিতম্বি হয়ে আমি ব্যালকনী থেকে শুরু করে পুরো রুমটায় মেহুলকে খুঁজলাম। রুমের কোথাও মেহুল নেই। ওয়াশরুমের কাছটায় আসতেই ঝর্ণা ছাড়ার আওয়াজ আমার কানে এলো। ভেতর থেকেই হঠাৎ মেহুল খানিক চেঁচিয়ে বললেন,,,
“আম্মু কাবার্ড থেকে আমার ব্ল্যাক কালার টাউজারটা দাও তো। টাউজার ছাড়াই আমি ওয়াশরুমে ঢুকে গেছি।”
আমি কিছুটা আমতা আমতা করে ওয়াশরুমের দরজার সাথে চিপকে দাঁড়িয়ে বললাম,,
“মেহুল। আমি রূপা। আপনি দাঁড়ান। আন্টিকে ডেকে দিচ্ছি আমি।”
“কাউকে ডাকতে হবে না। টাউজারটা তুমিই দাও।”
#চলবে…..🥵
(আমি জানি, রিসেন্ট কয়েকটা পর্ব আপনাদের খুব বিরক্ত লাগছে। আসলে বিরক্ত লাগলে ও কিছু করার নেই। চালিয়ে যেতে হচ্ছে। হয়তো এই বিরক্তির মাঝেই শেষে খুব ভালো একটা দিক খুঁজে পাওয়া যাবে! সেই ভালো দিকটার জন্যই পাঠক মহলদের অপেক্ষা করতে হবে🙂। ধন্যবাদ সবাইকে।)