তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_১৮
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

হনহনিয়ে উনি রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কৌতুহল নিয়ে আমি উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি৷ উনাকে একটু ও বুঝতে পারছি না আমি। এই মুহূর্তে উনাকে সম্পূর্ণ হিমুর মতো লাগছে আমার। রাগলে হিমুকে যেমন দেখাতো উনাকে ও ঠিক তেমন দেখাচ্ছে৷ তবে এটাই বুঝতে পারলাম না, হিমুর নাম শুনে কেনো উনার হিংসে হচ্ছে!

চোখ বুজে ঠোঁট চেঁপে অনবরত কাঁদছি আমি। বিছানার চাঁদর খামচে ধরে এপাশ ওপাশ হচ্ছি। কিছুতেই যেনো শান্তি পাচ্ছি না আমি। শারীরিক, মানসিক দু দিক থেকেই যথেষ্ট ভেঙ্গে পড়েছি। শারীরিক কষ্ট টা না হয় কাউকে এক্সপ্লেইন করে বুঝাতে পারব৷ এর ঔষধ ও পেয়ে যাবো। তবে মানসিক? মানসিক কষ্ট টা তো আমি কাউকে এক্সপ্লেইন করে বুঝাতে পারব না। না এর ঔষধ খুঁজে পাবো! ভিতরটা কষ্টে দিন দিন তিক্ত হয়ে উঠছে আমার। মনে হচ্ছে কিছুদিন পরে বিশাল একটা রোগ ধরা দিবে। যে রোগের পরিণাম হবে শুধু মৃত্যু। শুধুই মৃত্যু!

ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চারপাশটা গভীর অন্ধকার হয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম ঘড়িতে রাত আটটা বাজছে। দুপুর থেকে এই পর্যন্ত টানা এতগুলো সময় আমি অজ্ঞান ছিলাম। ভাবতেই গাঁ টা শিউরে উঠছে। গলাটা ও কেমন শুকিয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি গাঁ থেকে কম্বলটা সরিয়ে আস্তে ধীরে উঠার চেষ্টা করলাম। সমস্ত গাঁ থেকে যেনো আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে আমার। কম্বলটা গাঁ থেকে সরাতেই তীব্র শীতের অনুভূতি হলো। মনে হচ্ছে আমি ফ্রিজের মাঝখানে বসে আছি। কম্বলটা ভালো করে গাঁয়ে জড়িয়ে আমি আস্তে ধীরে বেডের কর্ণারে ঢ্যাশ দিয়ে বসলাম। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে আমি ডেস্কের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই গ্লাসটা আমার কাঁপা হাত থেকে পিছলে পড়ে গেলো। মাটিতে পড়ে গ্লাসটা এতক্ষনে ভেঙ্গে চূড়ে চুরমার হয়ে গেছে। আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁচের টুকরোর সাথে ভাসমান পানি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। পানি খাওয়া আর হলো না আমার! তেষ্টায় হয়তো এক্ষণি জানটা বের হয়ে যাবে।

এর মাঝেই মনে হলো কেউ হম্বিতম্বি হয়ে দরজা খুলে রুমে ঢুকছেন। ফোলা চোখ নিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ তা ও চোখ ঘুড়িয়ে আমি দরজার দিকে তাকালাম। মেহুল উন্মুক্ত শরীরে হাতে ধোঁয়া উঠা স্যুপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চুল থেকে উনার টপটপ করে পানি পড়ছে। সেই পানি গুলো দেহের প্রতিটা কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে। দেখতে খুব স্নিগ্ধ, সুন্দর লাগছে। ক্লান্ত মুখটা এখন ঠিকঠাক লাগছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি শাওয়ার নিয়েছেন। নিচে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরো গুলোর দিকে উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উনি ধীর পায়ে হেঁটে আমার বেডের পাশে বসলেন। আমি কম্বলটা আরো বেশি করে খাঁমচে ধরে বেডের কর্ণারের সাথে একদম চিপকে বসলাম। একটু আগে উনি যেভাবে রেগে গেছেন, সেই রাগটাতে উনাকে এতোটাই ভয়ঙ্কর লাগছিলো যে, এখন উনাকে দেখলেই আমার ভয় লাগছে। উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“কি হলো রূপা? তুমি এভাবে দূরে সরে যাচ্ছ কেনো? ভয় পাচ্ছ আমাকে?”

আমি কিছু বললাম না। শুধু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনি স্যুপের বাটি টা ডেস্কের উপর রেখে মলিন হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“তুমি বসো। আমি পানি নিয়ে আসছি।”

রুম থেকে বের হয়ে গেলেন উনি। মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে চোখ বুজতেই আবার দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ফটাফট আমি চোখ খুলে দরজার দিকে তাকালাম। মেহুল গ্লাসে পানি নিয়ে রুমে ঢুকেছেন। মৃদ্যু হেসে উনি আমার পাশে বসে গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,,

“নাও।”

আমি শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম। আমি ঢকঢক করে পানি খাচ্ছি আর উনি গড়গড় করে বলছেন,,,

“আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই রূপা। ঐ সময় একটু বেশিই পজেজিভ হয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো তোমার সাথে রুড বিহেভ করতে হলো। আসলে রূপা…. আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই চিনি। বলতে পারো তোমাকে অনেকটা ভালো ও বেসে ফেলেছি।”

শেষের কথাটা কানে আসতেই তৎক্ষনাত পানিটা আমার নাকে, মুখে উঠল। মুখে থাকা পানিটা না চাইতে ও সরাসরি মেহুলের চোখে, মুখে এসে ছিটকে পড়ল। মেহুল ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে রূপা? আমি তোমাকে আগে থেকে চিনতে পারি না? ভালোবাসতে পারি না?”

নিতে পারছি না আমি এসব কথা। গলার সমস্ত জোর দিয়ে আমি উনাকে চেঁচিয়ে বললাম,,,

“মেহুল আপনি আমার সামনে থেকে সরে যান। আপনাকে সহ্য করতে পারছি না আমি। আপনি জানেন আমি বিবাহিত, তারপরে ও কোন সাহসে আপনি আমাকে এসব কথা বলছেন?”

মেহুল হঠাৎ হু হা করে হেসে আমার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“তুমি এতো সিরিয়াস হচ্ছো কেনো রূপা? আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। আসলে মজা করার স্বভাবটা আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে। তাই সিরিয়াস মোমেন্টে ও আমি মজা করে ফেলি। এনিওয়েজ… এই তো এক সপ্তাহ আগে তোমার সাথে আমার দেখা হলো। এর মাঝেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলা আদৌ সম্ভব না। আর এখন তো সব ক্লিয়ার হয়ে গেলো, “তুমি বিবাহিত।” তোমাকে ভালোবাসা বারণ, ছোঁয়া দেখা ও বারণ, তোমার কাছাকাছি থাকা ও হয়তো বারণ।”

আমি ফুঁফাতে ফুঁফাতে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখে জল টলমল করছে। চোখে জল নিয়েই উনি শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে চাই রূপা৷ ততোটাই অধিকার দেখাতে চাই, যতোটা অধিকার একজন বেস্ট ফ্রেন্ড তার বেস্ট ফ্রেন্ডের উপর খাঁটায়। প্লিজ এই অধিকারটা আমার থেকে ছিনিয়ে নিও না।”

কিছু বললাম না আমি। শুধু শান্ত চোখে উনার দিকে তাকালাম। চোখের কোণে জমে থাকা জল গুলো মুছে উনি জোরপূর্বক হেসে আমার পাশে বসে বললেন,,,

“তোমার জীবন বৃত্তান্ত শুনে যতোটা বুঝলাম, তুমি ভালো নেই রূপা! জীবন তোমাকে বিভিন্নভাবে ঠকিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছে হিমু। তোমার হাজবেন্ড৷ একদম ভালো করেছ তুমি, ঐ ছেলেটাকে ছেড়ে এসে।”

কিছুক্ষন দম নিয়ে উনি আবার বললেন,,,

“আচ্ছা রূপা… তুমি যদি মাইন্ড না করো তাহলে কি আমি জানতে পারি তুমি কেনো হিমুকে ছেড়ে এসেছ?”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে দুহাত দিয়ে চোখের জল গুলো মুছে গলা জড়ানো কন্ঠে উনাকে বললাম,,,

“হিমু আগে থেকেই কাউকে ভালোবাসত, আমাকে কখনো উনি স্ত্রী হিসেবে মানেন নি। উনার গার্লফ্রেন্ডের প্রতি উনার এতোটাই আসক্তি ছিলো যে, আমার ভালোবাসা কখনো উনার চোখে পড়ে নি। তাছাড়া উনার গার্লফ্রেন্ডের ক্যান্সার ছিলো। বাঁচতই বা কতো দিন। তাই আমি উনার গার্লফ্রেন্ডের হাতে উনাকে তুলে দিয়ে সারাজীবনের জন্য উনার জীবন থেকে সরে এসেছি।”

“হিমুকে একেবারে ডিভোর্স দিয়ে চলে এলে?”

চোখ, মুখ লাল করে আমি উনার দিকে তাকিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বললাম,,,

“রূপা কখনো হিমুকে ডিভোর্স দিতে পারে না। রূপা হিমুকে দেখতে না পেয়ে মরে যাবে এরপরে ও কখনো হিমুকে ছাড়তে পারবে না। হিমু রূপার রক্তের সাথে মিশে আছে। রূপার প্রতিটা ধ্যান, জ্ঞান জুড়ে আছে। প্রতিটা ক্ষণে, প্রতিটা মুহূর্তে রূপা হিমুকে ফিল করে। হিমুকে ছাড়া এই রূপা অচল, প্রাণহীণ একটা নির্জীব প্রাণী। হিমু, রূপার মাঝে আকাশ সমান দূরত্ব থাকলে ও তাদের মাঝে কখনো বিচ্ছেদ আসতে পারে না। কখনো না!”

মেহুলের চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি পড়ছে। আমার চেয়ে ও উনি বেশি কাঁদছেন। উদ্বিগ্ন হয়ে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। তাড়াহুড়ো করে উনি আমার পাশ থেকে উঠে পিছু ঘুড়ে চোখের জল গুলো মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“তার মানে হিমুকে তুমি ডিভোর্স দাও নি? শুধু ছেড়ে এসেছ?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালাম। উনি রুমে পায়চারী করছেন আর বলছেন,,,,

“আমার মনে হচ্ছে হিমুকে ডিভোর্স দিয়ে এলেই তোমার জন্য ভালো হতো। তুমি নতুন করে একটা জীবন শুরু করতে পারতে!”

“হিমু একান্তই আমার। শুধুই আমার। হিমুকে ছাড়া আমি নতুন জীবন নিয়ে ভাবতে চাই না। না কখনো এসব চিন্তা আমার মাথায় আসবে।”

উনি হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে চোখে জল নিয়ে আবার বললেন,,,

“ঐ প্রতারক ছেলেটাকে এতোটাই ভালোবাসো তুমি? কেনো বুঝতে পারো না, সে তোমার এত্তো এত্তো ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না।”

আমি হাঁটু ভাজ করে কান্না জুড়ে দিলাম। চিৎকার করে কেঁদে আমি উনাকে বললাম,,,

“ভুল বললেন মেহুল। কথাটা উল্টো হবে! রূপা হিমুর ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না। তবে রূপা ঐ “প্রতারক” হিমুকেই এখনো ভালোবাসে! আর জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তাকেই ভালোবেসে যাবে।”

“তার মানে তুমি ধরে নিচ্ছ হিমু প্রতারক?”

“শুধু প্রতারক না। হিমু খুব খারাপ একটা লোক। যে শুধু নিজেরটাই ভাবে, আমার কথা কখনো ভাবেন নি। আমার অনুভুতিগুলোর কোনো মূল্যই ছিলো না উনার কাছে। যদি বিন্দুমাএ মূল্য ও থাকত, তাহলে এতোদিনে হিমু আমাকে ঠিক খুঁজে নিতেন। অন্তত বন্ধু হিসেবে হলে ও আমাকে উনার লাইফে রেখে দিতেন!”

“এ ও তো হতে পারে রূপা, তুমি আসার পর হিমুর লাইফে অনেক খারাপ কিছু ঘটে গেছে। যা হয়তো তুমি কল্পনা ও করতে পারছ না। আচ্ছা… তুমি কখনো খোঁজ নিয়ে দেখেছ হিমু কেমন আছে, কোথায় আছে, ভালো আছে কিনা?”

“আমি জানি হিমু ভালো আছে। নাবিলাকে নিয়ে হয়তো খুব সুখে আছে। নাবিলা যদি বেঁচে থাকে নিশ্চয়ই সে হিমুকে ভালো রাখবে, যত্নে আগলে রাখবে, ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে। এই অধম রূপা হিমুর খোঁজ না নিলে ও চলবে!”

“কখনো নাবিলার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলে? নাবিলা সব সত্যি বলেছিলো কিনা বা হিমু নাবিলার সাথে আদৌ সুখে ছিলো কিনা?”

“খোঁজ নিতে হবে না। ওরা ভালো থাকবে। সুখে থাকবে। এই রূপার দো’আ সবসময় উনাদের সাথে থাকবে।”

“আচ্ছা মন থেকে একটা কথা বলবে?”

“কি?”

“এই এতো গুলো বছরে কখনো হিমুর প্রতি ঘৃণা জন্মায় নি তোমার?”

“ভালোবাসার মানুষকে কখনো ঘৃনা করা যায় না মেহুল। তবে জমে থাকা অভিমানগুলো এক একটা পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। তখন চাইলে ও সেই অভিমানের পাহাড় সরিয়ে ঐ মানুষটাকে আপন করে নেওয়া যায় না!”

“তার মানে হিমু যদি কখনো ফিরে আসে, তুমি তাকে মেনে নিবে না?”

আমি কানে হাত দিয়ে জোরে চিল্লিয়ে বললাম,,,

“প্লিজ দয়া করে এই টপিকটা বাদ দিন মেহুল। হাত জোড় করে অনুরোধ করছি আপনার কাছে। প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন। একটু নিজের মতো করে বাঁচতে দিন।”

প্রতি উত্তরে উনি কিছু বললেন ন। কাঁদতে কাঁদতে আমার শ্বাস প্রশ্বাস বড় হয়ে আসছিলো। নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। জ্বর টা বোধ হয় একটু ছেড়েছে। ঝড়ঝড়িয়ে ঘাম পড়ছে শরীর বেয়ে। এক্ষনি আমার ফ্রেশ হতে হবে। হাঁটু থেকে মুখ উঠিয়ে আমি মেহুলের দিকে তাকালাম। মেহুল এখনো চোখে জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি গলা জড়ানো কন্ঠে উনাকে বললাম,,

“কি হয়েছে মেহুল? আপনি কাঁদছেন কেনো?”

উনি তাড়াহুড়ো করে চোখের জল গুলো মুছে বললেন,,,

“জানি না। তবে মনে হচ্ছে তোমার কান্না দেখে আমি ও কাঁদছি। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছি না। আসলেই বেস্ট ফ্রেন্ডের কষ্ট চোখের সামনে মানা যায় না।”

“ছেলেরা তো এতো সহজে কাঁদে না মেহুল। সত্যিই কি আপনি আমার কান্না দেখে কাঁদছেন? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?”

“একদমই না। অন্য কোনো কারণ থাকবে কেনো? আমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের করুন জীবন কাহিনী শুনে কাঁদলাম৷ এর বাইরে আর কিছুই না।”

উনার থেকে চোখ সরিয়ে আমি বিছানা থেকে মাটিতে পা রাখতেই মাথাটা হঠাৎ ঘুড়ে এলো৷ মেহুল ওখানেই দাঁড়িয়ে বললেন,,

“সাহায্য করব আমি?”

“না মেহুল। আমি পারব।”

“ঠিকাছে।”

মেহুল আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন। আমি ধীর পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে ঢুকে কিছুক্ষনের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে এলাম। মেহুল এখনো উন্মুক্ত শরীরে ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন৷ আমি পেছন থেকে মেহুলকে ডেকে বললাম,,,

“মেহুল আমি আসছি।”

পিছু ঘুড়তেই মেহুল আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,,,

“কোথায় যাচ্ছ?”

“আমাদের ফ্ল্যাটে।”

“এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথাও যেতে হবে না তোমাকে। তাছাড়া কালই তো তোমরা এই ফ্ল্যাটে শিফট হচ্ছ। তাই এই রাতে বাড়াবাড়ি করে ঐ ফ্ল্যাটে তোমাকে যেতে হবে না।”

“কিন্তু…..

“কোনো কিন্তু না। ডেস্কের উপর রাখা স্যুপটা খেয়ে নিও। পানি, মেডিসিন সব ডেস্কের উপরই রাখা আছে৷ এর বাইরে কোনো কিছুর দরকার হলে, আমাকে ডেকে দিও।”

“আমি এ রুমে থাকলে আপনি কোথায় থাকবেন?”

“পাশের রুমেই৷”

সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে উনি রুম থেকে বের হচ্ছেন। সিগারেটের সমস্ত উড়ন্ত ধোঁয়া আমার নাকে এসে ঠেকছে। সিগারেটের এই উগ্র গন্ধটা আমি নিতে পারছি না। গাঁ গোলাচ্ছে। উড়না দিয়ে নাক চেঁপে ধরে আমি বেডের উপর বসলাম। মেহুল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে আমাকে ডেকে বললেন,,

“এই রুমে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো রূপা। আর আমার উপর পূর্ন আস্থা রাখতে পারো। আমি এখন জেনে গেছি তুমি বিবাহিত। তাই চান্স নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বেস্টফ্রেন্ড হয়েই আমি সারা জীবন তোমার পাশে থাকতে চাই। যদি তুমি পাশে রাখো তো!!!”

উনি বাহির থেকে দরজাটা লাগাতে নিলেই আমি পিছন থেকে উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,

“মেহুল। আজ থেকে আমি ও আপনাকে, মন থেকে বন্ধু হিসেবে মানছি। এখন আপনার সাথে মিশতে আমার আর কোনো দ্বিধা নেই। কারণ, আমার অতীতটা আপনার কাছে এখন পানির মতো পরিষ্কার। বিবাহিত মেয়েদের ও ছেলে বন্ধু থাকে। যার কাছে সানন্দে সে সব মনের কথা শেয়ার করতে পারে। আপনিই হলেন আমার সেই ছেলে বন্ধু মেহুল। আমি আমার সুখ, দুঃখ শেয়ার করার জন্য আরো একটা জায়গা পেয়ে গেলাম!”

মেহুল প্রতি উত্তরে কিছু বললেন না। উল্টে ঠাস করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলেন। উনার আচরণে আমি কিছুটা অবাক হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। মেহুল আসলেই রহস্যময়ী একটা চরিএ। যে চরিএটা ক্রমাগত আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। কখনো মনে হয় উনি মেহুল আবার কখনো মনে হয় উনিই হিমু। মেহুল, হিমু। হিমু, মেহুল এ দুটো চরিএই আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছে৷ এই কনফিউশন দিন দিন চলতে থাকলে বদ্ধ উন্মাদ হতে আমার বেশিদিন সময় লাগবে না।

ডেস্কের উপরে রাখা স্যুপটা এতক্ষনে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ক্ষিদের চোটে এই ঠান্ডা স্যুপটাই আমি খেয়ে নিলাম। জ্বর টা একটু একটু করে বাড়ছে। ঠান্ডায় গাঁ টা শিউরে উঠছে। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম কপালটা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। শরীরটা ঝাঁকুনী দিয়ে কাঁপছে। দাঁতে দাঁতে সংঘর্ষ লেগে গেছে। তাড়াহুড়ো করে আমি ডেস্কের উপরে রাখা মেডিসিন গুলো খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে এক পর্যায়ে আমার চোখে ঘুম লেগে এলো।

এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ গিটারের স্টিঙয়ের শব্দে আমার কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। মাথায় হাত দিতেই কিছুটা অবাক হলাম আমি। কপালে জলপট্টি দেওয়া আমার। পট্টি টা এখনো পানিতে ভেজা। ঠান্ডা হয়ে আছে। কপালের গরম ভাপটা এখনো পট্টিটাতে লাগে নি। মনে হচ্ছে কেউ একটু আগে পট্টি টা আমার কপালে দিয়ে গেছে। পিটপিট চোখে এদিক সেদিক তাকাতেই দেখলাম বেডের পাশে থাকা জানালাটা বন্ধ। ব্যালকনীর দরজাটা ও ভেতর থেকে বন্ধ, রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। অথচ ঘুমোনোর আগে আমি রুমের জানালাটা বন্ধ দেখেছি, ব্যালকনীর দরজাটা খোলা দেখেছি, রুমে ড্রিম লাইটের বদলে টিউব লাইট জ্বলতে দেখেছি। এসব এসে কে করে গেছে তাই আমার মাথায় ঢুকছে না।

গিটারের বাজানোর মধুর শব্দটা একটু একটু করে আরো বেশি মধুর হচ্ছে। গানের সুর ভেসে আসছে আমার কানে। কন্ঠ টা খুব সুরেলা। মনে হচ্ছে কোনো ছেলে গান গাইছে। শোয়া থেকে উঠে আমি কাঁপা কাঁপা শরীরে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। খুব জানতে ইচ্ছে করছে কে গিটার বাজাচ্ছে, গান গাইছে। চোখে, মুখে তীব্র কৌতূহল নিয়ে আমি পাশের রুমের দরজার কাছে আসতেই হঠাৎ থমকে গেলাম। গিটারের সুরেলা আওয়াজটা পাশের রুম অর্থাৎ মেহুলের রুম থেকে আসছে। রুমের দরজাটা আধ খোলা উনার। বাইরে থেকেই ব্যালকনীটা দেখা যাচ্ছে। অর্ধ ব্যালকনীর উপর বসে উনি আনমনে গিটার বাজাচ্ছেন। চোখে, মুখে উনার উদাস ভাব৷ গাঁ থেকে ঘাম ঝড়ছে, চোখের কোণে ও বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যতো রাজ্যের কষ্ট, যন্ত্রণা, তিক্ততা উনার মধ্যে ভর করে আছে। রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে উনি গাইছেন,,,

“কখনো যদি আনমনে চেয়ে,
আকাশের পানে আমাকে খুঁজো,
কখনো যদি হঠাৎ এসে,
জড়িয়ে ধরে বলো ভালোবাসো!
আমি তখনই হ্যাঁ তখনই,
তোমার নামে লেখা চিঠিটি
পড়ে তোমাকে শুনাবো!
ঠিক তখনই, হ্যাঁ তখনই,
ভালোবাসি কতোটা এ আমি,
বলো কি করে তোমায় বুঝাবো?”

“তুমি বুঝো নি, আমি বলি নি,
তুমি স্বপ্নতে কেনো আসো নি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে সব গেয়েছি!”

#চলবে……🤦‍♀️

(গল্পটাকে আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে সময় দিন আপনারা। আমার মনে হচ্ছে এই কনফিউশনে আরো কয়েকটা দিন থাকলে গল্পের প্রতিটা চরিএের জন্য খুব ভালো হয়। আমি একটু ডিফারেন্ট করতে চাইছি। তাই প্লিজ ধৈর্য্য ধরে গল্পটা পড়ুন৷ অনুরোধ করছি। দয়া করে ধৈর্য্য হারা হবেন না। ধন্যবাদ সবাইকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here