তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_৩
#Nishat_Khan_Raat (ছদ্মনাম)

—“খাবারটা এবার তুমি খেয়ে নাও। আমি তোমার চুলটা বেঁধে দিচ্ছি।”

ঝিম মেরে বসে আছি আমি। মুখের ভেতরে থাকা পাউরুটির পিসটা জিহ্বা দিয়ে নাড়ছি। উনার করা আচরণ গুলো আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে। ঐদিকে, উনি অতি দক্ষতার সাথে আমার চুলে খোঁপা বেঁধে দিচ্ছে। আমরা মেয়েরা যেভাবে ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে চুলে খোঁপা করি উনি ও ঠিক সেভাবে ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে খুব নিঁখুতভাবে খোঁপাটা বাঁধছে। উনার এমন পারদর্শিতা দেখে আমার বুঝা হয়ে গেছে উনি আগে ও অনেকবার কারো মাথায় খোঁপা বেঁধেছে। তবে কি উনি এক্টু আগে যা যা বলেছে সবটাই শতভাগ সত্যি ছিলো? কাউকে ভালোবাসে উনি? আর এভাবেই হয়তো উনি উনার ভালোবাসার মানুষটাকে খোঁপা বেঁধে দিতো!

এসব ভাবতে ভাবতেই টের পেলাম হিমু কেবিন থেকে হনহন পায়ে বের হয়ে যাচ্ছে৷ উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি খানিক চেঁচিয়ে বললাম,,

—“হিমু?”

উনি হঠাৎ থেমে গেলো। পিছু ফিরে না তাকিয়েই উনি গম্ভীর কন্ঠে বলল,,,

—“হুম বলো!”

—“আপনি সত্যিই কাউকে ভালোবাসেন?”

উনি লম্বা এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,

—“হুম বাসি।”

—“কে সে? তার পরিচয়টা জানতে পারি?”

তাৎক্ষনিক উনি পিছু ফিরে বেশ রেগে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,,,

—“কেনো তাকে গিয়ে বলবে আমি বিবাহিত? তুমি আমার বৌ?”

টলমল চোখে আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“বললে ও কি উনি আমার কথা শুনবে? পারবে আপনাকে ছেড়ে দিতে?”

—“কক্ষনো না! সে তোমার কথায় আমাকে ছাড়বে না।”

—“এতোটাই ভালোবাসেন উনাকে?”

—“হুম বাসি৷ নিজের থেকে ও বেশি!”

—“নিজের থেকে কখনো কাউকে বেশি ভালোবাসতে নেই হিমু। “গুরুত্ব বেশি হলে দূরত্ব বাড়ে!” জানেন সেটা?”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে উনি আমার দিকে তাকালো। এতক্ষনে আমার চোখ বেয়ে দু ফোটা জল ও টুপ করে গড়িয়ে পড়ল। আচমকাই উনি অট্ট হেসে পিছনে মোড় নিয়ে কেবিন থেকে বের হচ্ছে আর বলছে,,

—“ভুল বললে রূপা। “দূরত্ব বেশি হলে গুরুত্ব বাড়ে!”

ব্যাস চলে গেলো উনি। উনার কথায় কৌতুহল বেড়ে গেলো আমার। উনি কার সাথে কার দূরত্বের কথা বললেন? আমার সাথে উনার দূরত্ব নাকি উনার সেই ভালোবাসার মানুষটার সাথে উনার দূরত্ব? হিমু আমাকে সম্পূর্ণ ধোঁয়াশায় রেখে গেলো। ঐ মেয়েটা সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিলো৷ উনার সেই ভালোবাসার মানুষটা সম্পর্কে আমার সব জানতে হবে। ফার্স্ট টু লাস্ট এভরিথিং। তার জন্য খুব তাড়াতাড়ি আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। মেয়েটার সাথে আমাকে দেখা করতে হবে৷ মেয়েটার মুখ থেকে সব সত্যি জানতে হবে। এর আগে মেয়েটার পরিচয় আমাকে জানতে হবে। একমাএ হিমুই পারবে মেয়েটার পরিচয় দিতে। যেভাবেই হোক হিমুর পেট থেকে মেয়েটার পরিচয় আমাকে বের করতেই হবে। এর জন্য হিমুর হাতে যদি আমাকে মার খেতে হয় এতে ও আমি রাজি!

“পরক্ষনে আবার ভাবলাম, মেয়েটার সামনে গিয়ে কি বলব আমি? হিমুকে ছেড়ে দিতে? নাকি বলব, আমিই তোমাদের মাঝখান থেকে সরে যাচ্ছি? কোনটা???”

সামনে রাখা খাবারটা কোনো রকমে শেষ করে আমি বেড থেকে উঠে দাঁড়ালাম। মোটামুটি এখন নিজেকে সুস্থ লাগছে। আজই বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে। ধীর পায়ে হেঁটে আমি কেবিন থেকে বের হতেই আমার আম্মু, আব্বু, শ্বাশুড়ী মা আর শ্বশুড় আব্বুকে দেখতে পেলাম। উনারা আমাকে দেখে বেশ পেরেশান হয়ে আমার কাছে ছুটে এলো। সবাই খুব বকাঝকা করছে কেনো আমি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কেবিন থেকে বের হলাম। অন্তত আজকের দিনটা আমাকে বেড রেস্টে থাকতে হবে। সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমি সন্ধ্যের মধ্যে রিলিজ নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। হসপিটালে একদিনের বেশি থাকলে তো সুস্থ মানুষটা ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এটাই আমি আমার বাড়ির লোকদের বুঝিয়েছিলাম। আর উনারা ও আমার কথা মেনে নিলো। রিলিজের সময়টাতে সবাই আমার পাশে থাকলে ও হিমুকে কোথাও দেখতে পাই না। হয়তো অফিসের কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে নয়তো উনার ঐ ভালোবাসার মানুষটার কাছে… না না এসব আমি কি ভাবছি? এসব আর ভাবব না। এসব ভাবলেই বুকটা ধক করে উঠে। আমি হিমুকে অন্য কারো হতে দিবো না। আকাশের মতো আমি হিমুকে হারাতে পারব না। প্রয়োজনে আমি ঐ মেয়েটার হাতে পায়ে ধরে আমার হিমুকে ভিক্ষা চেয়ে নিবো। তাছাড়া হিমু আমার হাজবেন্ড৷ ঐ মেয়ের থেকে ও হিমুর প্রতি আমার অধিকার বেশি! যেকোনো মূল্যেই হোক, আমি আমার সংসারটাকে ধরে রাখতে চাই।

রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। ছোট বোনটার সেমিস্টার এক্সাম চলছে বলে আম্মু, আব্বু এক্টু আগেই কুমিল্লায় রওনা দিলো। আমি কিছুটা সুস্থ হলেই হয়তো আমার শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী ও কুমিল্লায় ফিরে যাবে। তখন আমি আবার একা হয়ে যাবো!

ঘড়িতে এখন রাত নয়টা বাজছে। শাওয়ার নিয়ে আমি রুমে ঢুকতেই শ্বাশুড়ী মা আমার জন্য খাবার নিয়ে এলো। খাওয়ার জন্য জোর করার আগেই আমি শ্বাশুড়ী মা কে মুখের উপর বলে দিলাম,,,

–“আমি এখন খেতে পারব না মা। আপনার ছেলে এলে একসাথে খাবো।”

মা মৃদ্যু হেসে খাবারের প্লেইট নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মা বুঝে গেছে পাঁচ মাসের অভ্যেসটা এতো সহজে বদলে ফেলা সম্ভব না। অধীর আগ্রহ নিয়ে আমি হিমুর জন্য অপেক্ষা করছি। ঘড়িতে রাত এগারোটা ঘনিয়েছে। উনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে আমার চোখ লেগে এলো ঠিক বুঝতে পারি না।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুমের মধ্যেই মনে হলো রুমে কেউ হাঁটছে। এক ঝটকায় চোখ জোড়া খুলে আমি ব্যালকনীর কাছটায় হিমুকে দেখতে পেলাম। উন্মুক্ত ভেজা শরীরে উনি ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। চুল থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সদ্য শাওয়ার নিয়েছে উনি। হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে আমি উনার পেছনটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। চুল থেকে ঝড়া জল গুলো উনার পুরো শরীরটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রিফ্রেশ লাগছে উনাকে। খুব ইচ্ছে করছে পেছন থেকে উনাকে একবার ঝাপটে ধরতে! কোনো কিছু না ভেবেই আমি নির্লজ্জের মতো উনাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলাম। সাথে সাথেই উনি এক ঝটকায় আমাকে উনার থেকে প্রায় এক গজ দূরে নিয়ে ছিটকে ফেলে দিলো। হাতে থাকা সিগারেটটা পা দিয়ে পিষে উনি পিছু ফিরেই অগ্নিরূপ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। ভয়ে আমি জনাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর কিছুক্ষন পর পর শুকনো ঢোক গিলছি। আচমকাই উনি তেঁড়ে এসে আমার থুতনী চেঁপে ধরে বলল,,,

—“তোমার সাহস হলো কিভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরার? তুমি জানো আমাকে জড়িয়ে ধরার অপরাধে তোমাকে এই মুহূর্তে আমি গলা টিপে মেরে দিতে পারি?”

আমি হতভম্ব হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি তেজী দৃষ্টিতে আমাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দুই গালের মাংসপেশি উনার হাতে চাপে টনটন করছে। ব্যাথার তাড়নায় চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি পড়ছে। আমার চোখের পানি দেখে উনি মুহূর্তের মধ্যে থুতনীটা ছেড়ে দিলো। দুই গালে ধরে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে অনবরত কেঁদে চলছি। উনি আমার কাছে এক্টু এগিয়ে এসে কিছুটা শান্ত কন্ঠে বলল,,,

—“এখনো সময় আছে। ছেড়ে দাও আমাকে। আমাকে ছাড়লেই তুমি কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে।”

চোখ তুলে তাকালাম উনার দিকে। উনি শান্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার দিকে তাকিয়ে আমি ও বলে দিলাম,,

—“মরে যাবো, তবু ও আপনাকে ছাড়ব না।”

শান্ত চোখ দুটো উনার মুহূর্তের মধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠল। আমার ডান হাতটা চেঁপে ধরে উনি চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,

—“আমাকে তোমার ছাড়তেই হবে। এই হিমু “তাকে” ছাড়া আর অন্য কাউকে আপন করতে পারবে না। কাউকে না।”

—“সে কে হিমু? তার নামটা বলুন প্লিজ!”

উনি আরো জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,

—“নেক্সট টাইম ওর সম্পর্কে কিছু জানতে চাইবে না তুমি। বুঝতে পেরেছ?”

—“না বুঝি নি। আমি তার পরিচয় জানতে চাই হিমু।”

—“রূপা তুমি চাইলে ও কিন্তু আমাদের মাঝখানে আসতে পারবে না। ফর গড সেইক তুমি ওর পরিচয় জানতে চেয়ো না।”

আমি ও খানিক চেঁচিয়ে বললাম,,,

—“ফর গড সেইক হিমু উনার পরিচয়টা আমাকে দিন। আমি বেঁচে থাকতে আমার স্বামীকে আমি অন্য কারো হতে দিতে পারব না।”

উনি হঠাৎ ই অট্ট হেসে বলল,,,

—“তুমি আসার আগেই সে আমার জীবনে এসেছে রূপা। উল্টে তোমার কারনেই আমি ওর হতে পারছি না। কেনো এলে বলো তুমি আমার জীবনে? কেনো আমাদের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে?”

উনার বলা কথা গুলো আমার সহ্যশক্তির বাইরে চলে যাচ্ছে। হাউমাউ করে কেঁদে আমি এক ছুটে উনাকে টাইট করে ঝাঁপটে ধরে বললাম,,,

—“আমি আপনাকে হারাতে পারব না হিমু। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আপনার সংস্পর্শে এসে আমি এক্টু এক্টু করে বাঁচতে শিখেছি। আমাকে এভাবে ছেড়ে দিবেন না হিমু। এবার হয়তো আমি মরেই যাবো। বিশ্বাস করুন এবার আমি সত্যিই মরে যাবো।”

উনি আমাকে উনার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,,

—“রূপা প্লিজ লিভ মি। আর কতোটা নিচে নামলে বুঝতে পারবে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”

—“আমি আপনাকে ছাড়ছি না হিমু। আপনি যতোই নিচে নামুন। আপনি শুধু আমার হিমু। শুধুই আমার।”

উনি হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলো। আমাকে ছাড়ানোর জন্য আর জোরাজুরি করল না। কান্নাকাটির এই পর্যায়ে এসে আমার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে এলো৷ হিমুকে আরো টাইট করে ধরে আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,,,

—“হিমু আমার মাথাটা ঘুড়ছে। শরীরটা ও খুব খারাপ লাগছে।”

উনি খুব শান্ত স্বরেই বলল,,,

—“খেয়েছ?”

—“আপনাকে ছাড়া কখনো খেয়েছি?”

—“দয়া করে আমাকে ছাড়ো। আর চুপচাপ খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমাকে এক্ষনি এক্টু বেরুতে হবে।”

এর মাঝেই হঠাৎ হিমুর ফোন বেজে উঠল। আমাকে এক্টা ধাক্কা দিয়ে উনি দূরে সরিয়ে দিলো। তাড়াহুড়ো করে উনি বেডের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে কলটা রিসিভ আমাকে ক্রস করে ব্যালকনীর দিকে চলে গেলো। চোখের জল মুছে আমি পা টিপে টিপে ব্যালকনীর দিকটায় গেলাম। তখনই শুনতে পেলাম হিমু মিনমিনিয়ে ফোনে এক নিশ্বাসে বলছে,,

—“আমি আসছি ডক্টর। “নাবিলা” ঠিক আছে তো?”

#চলবে,,,,,

(ধৈর্য্য নিয়ে গল্পটা পড়ার অনুরোধ রইল৷ আস্তে ধীরে সব রহস্য সামনে আসবে। “নাবিলা” চরিএটি কে? পাঠকরা কি বলতে পারবে?😊)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here