#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৯

বাসের পাশাপাশি সিটে বসে আছে দু’জন। কারো মুখেই কোন কথা নেই। আকাশে নেমেছে আঁধার। জানালা থেকে আসা হাওয়া চোখেমুখে আঁচড়ে পড়ছে রজনীর। সে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। কি চলছে তাঁর মনে তা সে জানে না। একসময় রজনী মাথা এলিয়ে দিলো। রজনী চোখ বুজতেই সেদিকে পল্লব এক ঝলক তাকালো। সেও একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। তারপর নিজেও মাথা এলিয়ে দিলো সিটে। চোখ বুঁজে বললো।

_ নিজের প্রতি এতোটা ঘৃণা কেন রজনী আপনার? যে একটা সত্যি ঢাকতে এতোগুলা মিথ্যা বললেন।

পল্লবের কথায় রজনী বুঁজে রাখা চোখ খুলে তাকালো পল্লবের মুখো-পানে। আলোআঁধারির মাঝে স্পষ্ট নয় পল্লবের মুখখানা। তবুও যতটা রজনী বুঝলো পল্লব তাঁকে ধরে ফেলেছে। সাজানো মিথ্যা গুলো যে এভাবে ধরা পড়ে যাবে! তা রজনী বুঝতে পারেনি। কিন্তু পল্লব সত্যিটা বুঝলো কি করে! তাহলে কি মঈনুল সত্যিটা বলে দিয়েছে। আর ভাবতে পারলো না রজনী। কারণ হঠাৎ পল্লব রজনীর হাতটা আঁকড়ে ধরলো। ধুক করে উঠলো বুক। রজনীকে অবাক করে দিয়ে পল্লব নিজের বুকের মাঝে হাতটা রাখলো। এবার যেন নিশ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়। রজনী মোচড়া-মুচড়ি করতেই পল্লব আরো একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। আর সেটা হলো রজনীর অধরখানা ছুঁয়ে দিলো! রজনী কেঁপে উঠলো। ভয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে, পারলো না পল্লবের শক্ত বাঁধনের জন্য । আরো একটু টেনে নিজের হাতের বাঁধনের আঁটকে নিলো পল্লব। এখন তাঁদের মাঝের দুরত্ব বলে কিছু নেই। রজনীকে আরো অবাক করে দিয়ে পল্লব বললো।

_ এই যে আপনার অনিচ্ছায় আপনায় ছুঁয়ে দিলাম! তাহলে কী আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন। উঁহু হননি। কেউ হয় না। এই যে দেখছেন ব্যস্ত শহর! এই ব্যস্ত শহরের আনাচে-কানাচে এমন ঘটনা অহর-অহর ঘটে। এই যে আমরা যেমন পাশাপাশি বসে আছি,তেমনি আরো অনেকেই বসে। কেউ হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা,কেউ আপনার আমার মতো অল্প জানাশোনা, কেউ হয়তোবা পুরোপুরি অচেনা। আমার মতো হাজার পুরুষ আপনার মতো মেয়েদের সাথে ভিড়ভাট্টার মাঝে সুযোগ খোঁজে। কেউ বা এই পাশাপাশি সিটে থেকে নিজের হাতকে কাজে লাগায়। কোন কোন পুরুষ,প্রেমের মিথ্যা নাটক করে,নগ্ন ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। সব কিন্তু আমরাই করি। আবার আরো একটা কথা আছে। একজন আর্দশ বাবা কিন্তু একজন পুরুষ,একজন কেয়ারিং স্বামী বা প্রেমিক তাঁরাও পুরুষ। আপনার খুব ভালো একজন শিক্ষক,তিনিও পুরুষ। একজন ভালো তো অন্যজন খারাপ। আমি আমার হাত সরিয়ে নিয়েছি শুধুমাত্র আপনার মিথ্যা শুনে! ঘৃণা করে না। আমি সকালেই আপনার বাবা-র সাথে কথা বলেছি! তিনি আমায় সবটা বলেছেন। কিভাবে আপনি মঈনুলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে সে আপনায় কিডনাপ করেছে, সবটা। এমন কী আপনাকে কতদিন আঁটকে রেখেছে সেটাও আমায় আপনার বাবা বলেছে। তাহলে শুধু শুধু মিথ্যা বলার কি দরকার ছিলো। ভেবেছিলেন,আমরাও যদি আপনায় ধর্ষিতা বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেই? কেন আপনি তো ধর্ষণ হননি,তাহলে এতো ভয় কেন? আর সব থেকে বড় বিষয়, হলেও কি? আপনি নিশ্চয়ই যেচে ধর্ষণ হননি। তাহলে? এই মিথ্যা বলে নিজেকে কতোদিন আড়াল করবেন আপনি? একমাস,দুইমাস, একবছর,বেশি হলে দুই বছর। একদিন না একদিন তো এসবের মুখোমুখি আপনায় হতেই হবে! তখন কী হবে? তাই পিছন থেকে নয়,সামনে থেকে লড়াই করুন। আপনি না অনেক সাহসী, তাহলে এমন ভীতু হয়ে লুকিয়ে আছেন কেন? এবার নিজের আসল রূপে ফিরে আসুন।

কথা শেষ করেই পল্লব আমার হাত ছেড়ে দিলো। কারণ আমরা পৌঁছে গেছি। পল্লব একটা রিক্সা নিলো। আবারও পাশাপাশি আমরা বসলাম। কিছু সময় পর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। আমি সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। দরজা আঁটকে বিছানায় নিজের শরীরটা বিছিয়ে দিলাম। তখন পল্লবকে বলা কথাগুলো বাবা-র সাজানো ছিলো। কিন্তু আমি কখনোই ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে। এই সব মিথ্যার মাঝে একটা সত্যি হলো,সত্যিই আমার বাবা-র মেয়ে আমি নই। মঈনুল আমার ক্লাসমেট। আমরা একসাথেই লেখাপড়া করেছি। এমন কি এক পাড়ায় আমাদের বাড়ি। ওর সাথে আমার ভালো কোন সম্পর্ক না থাকলেও টুকটাক মাঝেমধ্যে কথা হতো। আমি নিজের লেখাপড়া ছাড়া তেমন কারো সাথে কথা বলিনি। প্রয়োজন শেষ হতেই কলেজ থেকে বাড়িতে চলে আসি। একদিন বাড়িতে ফেরার পথে মঈনুলকে আমি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মারামারি করতে দেখি। মঈনুল নেশার ঘোরে ওর এক বন্ধুকে ছুড়ি মেরে বসে। আমি ভয়ে তখনই চিৎকার করে উঠি। কোন রকমে বাড়িতে ফিরে বাবাকে সবটা বলে দেই। বাবা শুনে আমায় কলেজে যেতে কিছুদিন বারন করে। আমিও বাবা-র বারন শুনে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেই। এক সপ্তাহ পর কলেজে গেলে মঈনুল আমার পথ আঁটকে দাঁড়ায়। আমি জানতে চাইলে বলে! ওর বন্ধু যাকে ও ছুরি মেরেছে, ও নাকি ওর নামে কেস করেছে,আর সাক্ষী হিসেবে আমায় ডাকবে! আমি যেন না যাই। আমি কিছু না বলে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। দুদিন পর হঠাৎ একজন দারোগা আমাদের বাড়িতে আসে জিজ্ঞেসা বাদ করতে। আমি যা দেখেছি সেটাই বলে দেই। এতে মঈনুল আর ওর পরিবার ক্ষিপ্ত হয় আমার উপর। অনেক ভাবে আমাদের হুমকি দেয়। কিন্তু এখানে আমাদের কি করার ছিলো। সত্যি যেটা আমি সেটাই বলেছি এরথেকে বেশি তো কিছু বলিনি। ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়,পরে জানতে পারি ও মেয়ে পাচার কারি দলের সাথে যুক্ত। অনেক মেয়েকে নাকি ও পাচার করেছে। পুরো পাড়ায় ওদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। লজ্জায় ওর বাবা আত্মাহত্যা করে। এর পুরো রাগটাই পরে আমার উপর। বাবা-র মৃত্যু খবর শোনামাত্রই আমার উপর আরো রেগে যায় মঈনুল। ওর বাবা-র দাফনের সময় ওকে নিয়ে আসা হয়। আমার বাবাও সরিক হয় মঈনুলের বাবা-র জানাজায়। মঈনুলকে নিয়ে যাওয়ার সময় মঈনুল বাবাকে বলে! আমাদের সম্মান যেভাবে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে,ঠিক সেভাবেই আপনার সম্মান আমি মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়াবো। বাবা এই বিষয়ে আমায় কিছু জানায়নি। ভেবেছে আমি ভয় পাবো। মঈনুল জেলে যাওয়ার পর কিছুদিন মানুষের মুখেমুখে ছিলো তাঁদের আলোচনা। সময়ের সাথে সাথে তা মিলিয়ে গেলো। একদিন সন্ধ্যায় আমি ঘরে পড়ছিলাম। বাবা মায়ের চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবা-র ঘরের সামনে এসেই আমি থমকে গেলাম! কারণ সেদিন আমি জানতে পারলাম যাকে আমি বাবা বলে জানি,তিনি আমার বাবা নন। এতোদিন জানতাম মা আমার মা নয়, আজ জানলাম বাবা টাও আমার না। এতো কষ্ট আমি মেনে নিতে পারিনি। নিরবে সেখান থেকে সরে এসেছিলাম। ঘরে এসে সেদিন ডুকরে কেঁদেছিলাম। আমার মতো এতো অসহায় হয়তো পৃথিবীতে কেউ নেই। সেদিন মনে হয়েছে মায়ের মৃত্যুর সময় কেন আমার মৃত্যুও হলো না। রাতে বাবা খেতে ডাকতে এলেন! আমার চোখমুখ ফোলা দেখে তিনি বুঝে নিলেন সবটা। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন। তুই আমায় মেয়ে! এটাই চির সত্যি। কারো কোন কথায় তুই মাথা ঘামাবি না। মানুষ অনেক কথাই বলবে! সবার সব কথা কানে তুলতে নেই। আমি কিছু বললাম না,সবটা নিরবে শুনে গেলাম। বাবা চলে যেতেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এই পৃথিবীতে আমার বলতে কেউ নেই! এটাই যেন আমি মানতে পারছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ঘুমটা ছুটে গেলো। অসহ্য চোখের ব্যথায় চোখটা মেলতে পারছিলাম না। চোখে-মুখে পানি দিতে কলপাড়ে যা-ই। মুখে একটু পানি ছিটাতেই,কেউ আমাকে পিছন থেকে মুখ চেপে ধরলো। কিছু বোঝার আগেই আমার হাত-পা বেঁধে দিলো। টানা পনেরো দিন আমায় আঁটকে রেখেছিলো মঈনুল। প্রতিটাদিন ও আমায় মানুষিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমি বলতাম আমায় মেরে ফেল। কিন্তু ও হেঁসে বলতো,তোকে এভাবে মারলে তুই তো সহজ মৃত্যু পাবি। কিন্তু তোকে আমি ধীরে ধীরে মারবো। তুই ভেতর বাহির সব দিক থেকে মরবি। সম্মান হারাবি,তারপর নিজে থেকেই মৃত্যুকে বরন করবি। সত্যি সত্যি ও যেটা বলেছিলো,সেটাই করেছে। আমার সম্মান মাটিতে গড়াগড়ি খাইয়ে ও আমায় ছেড়েছে। আমার শরীরে ইচ্ছে করে এমন কিছু দাগ লাগিয়ে দিলো! যা দেখলে সবাই ভাববে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর আমাদের দেশে ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার বেঁচে থাকা দায়। আমি ধর্ষিতা না হয়েও আমার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হলো ধর্ষণের কালি। সকাল-বিকাল আমাকে কেউ নাম ধরে ডাকতো না ডাকতো! শুনেছিস,ওই যে রবির মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আজ থেকে ও
ধর্ষিতার খাতায় নাম লেখালো। আমার এতো সুন্দর নামের অর্থ সেদিন আমি বুঝলাম। রজনী অর্থ রাত। তাহলে আজ থেকে আমাকে রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকতে হবে। রজনী এখন থেকে রাতের আঁধারে লুকাবে। আমি ভীতু ছিলাম না কখনোই, কিন্তু সমাজের ধারালো কথা আমায় ভীতু তৈরি করলো। আস্তে আস্তে আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে রইলাম। কিন্তু হেরে গেলাম। সব ছেড়ে আমি আত্মহত্যা বেছে নিলাম! কিন্তু সেখানেও আমি ব্যর্থ হলাম। বাবা আমাকে বুঝিয়ে আজ এতদূর পাঠিয়ে দিলো। এতদূর এসে লাভ কি হলো! সেই তো সত্যর মুখোমুখি আবারও আমাকে দাঁড়াতে হলো। হয়তো এখন পল্লব আমাকে শান্ত করতে এগুলো বলছে। কিন্তু ঠিক মনে মনে সেও ভাবছে,একজন পুরুষ নিশ্চয়ই পনেরো দিন আমায় শুধু শুধু বেঁধে রাখেনি। কারণ একজন পুরুষ আর একজন মেয়ে আগুন_মোম। পাশাপাশি থাকলে গলতেই হবে। আর পুরুষ জাত হায়নাদের মতো। মেয়ে দেখলেই হামলে পড়ে। সেখানে মঈনুল কিছুই করেনি এটা কতটা সত্যি। এতোকিছু করার পরেও মঈনুলের শান্তি হয়নি! এখন আমায় খুন করবে। তাঁর কারণ বাবা ওর মা’কে হুমকি দিয়েছে। বাবা ভীতু,কিন্তু মেয়ের অসহায়ত্ব দূর করতে তিনিও হয়তো সাহসী হয়ে উঠেছে। এবার হয়তো মঈনুল আমায় ধরলে আর ছেড়ে দিবে না। মৃত্যুটা হয়তো ওর হাতেই। আমি জানি না,লিমা আন্টিরা আমার কি হয়৷ শুধু জানি বাবা-র পরিচিত । তাহলে কি লিমা আন্টি সেই, যাঁর জন্য মা নিজের অনেক জমি বিক্রি করে তাঁকে টাকা দিয়েছিলো। আমি জানি না,এবার আমি পল্লবের মুখোমুখি কিভাবে হবো। সত্যিটা তাঁর সামনে ছিলো, আর আমি মিথ্যা বলে গেলাম একের পর এক।
এটাই আমার আসল এবং লুকিয়ে রাখা অতীত। বাকিগুলো নিজের এই অতীত লুকাতেই মিথ্যা বলা। কেমন হবে আগামী সকাল আমার জন্য?

চলবে,,,

পেজের রিচ একদম নেই। প্লিজ বেশি বেশি কমেন্ট করুন। ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here