#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৮

বিয়ের প্রথম রাতেই আমি এক প্রকার ধর্ষন হই। যাকে বলে কিনা হালাল ধর্ষন। সেদিন আমি বুঝতে পারি অভিমানে নেওয়া সিদ্ধান্ত আমার কতোটা ভুল ছিলো। মঈনুলকে আমি দেখিনি,ওর বিষয়ে কোন খোঁজ নেইনি। আর সেই ফলাফল আমাকে দিতে হলো বিয়ের পর থেকে । আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলো মঈনুল। বাবা-র বাড়ির সাথে আমার সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। অবশ্য কার সাথে যোগাযোগ করবো,আমার আপন বলতে তো কেউ নেই। মঈনুল একজন খারাপ লোকছিলো। যে কিনা যতপ্রকার নেশাদ্রব্য ছিলো সব বিক্রি করতো।অবশ্য এটা আমি জানতাম না। বিয়ের তিনমাস পর জেনেছি। এই তিনমাস আমার জীবনটা পুরো নরক করে দিয়েছে লোকটা। সারাদিন মানুষিক যন্ত্রণা, আর রাতে শারীরিক। আমি যেন একটা যন্ত্রে পরিনত হলাম। মঈনুল আমায় প্রচুর মারধোর করতো। কখনো লাঠি দিয়ে, কখনো হাত। কখনো তো সিগারেটের আগুন আমার পিঠে চেপে ধরতো। আর সব সময় আমায় হুমকি দিতো! যদি আমি এসব কাউকে বলি,ও আমার সাথে সাথে আমার পরিবারকেও মেরে ফেলবে। বিষয়টা আমি অন্য কাউকে না জানালেও ওর পরিবারকে জানাই। কিন্তু তাঁরা উল্টে মঈনুল বাসায় আসতেই নালিশ করে দেয়। আর যাঁর জন্য মঈনুল আমায় প্রচুর মারধোর করে। টানা তিনদিন ও আমায় খেতে দেয়নি। এতটা নরপশু আমার স্বামী, ভাবলেও আমার ঘৃণা হতো। মাঝে মাঝেই মনে হতো মরে যাই। কিন্তু ওই যে আত্মাহত্যা মহাপাপ। এই জন্য কখনোই সাহস হয়নি। বহুবার চেষ্টা করেছি,কিন্তু আমি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। একদিন বাবা সকল রাগ,অভিমান দূরে সরিয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে সে কি কান্না। আমি সেদিন আবারও বুঝলাম! রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সত্যিই তিনি আমার বাবা। বাবা আমার চেহারা দেখেই বুঝে নিলেন,আমি ভালো নেই। কিন্তু তিনি মঈনুলের পরিবারের সামনে জিজ্ঞেস করতে পারছিলেন না। তাই কৌশলে তিনি আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু মুখের উপর মঈনুল না করে দেয়। এতে বাবা আরো সন্দেহ করে। কারণ আমাদের বাবা-মেয়ের মাঝে এতোদিন মান-অভিমান চলছিলো। অন্য কেউ হলে আমাকে তখনই পাঠিয়ে দিতো। তাই বাবা গোপনে নিজের ফোনটা আমায় দিয়ে গেলেন। গভীর রাতে বাবা ফোন করলেন তাঁর নাম্বারে! যেটা আমাকে তিনি দিয়ে গেছেন। আমি গোপনে সবটা বলে দেই। বাবা শুনে কি উত্তর দিবেন যেন ভেবে পেলেন না। তিনি বারবার নিজেকে দায়ী করলেন। তিনি ভাবলেন, আমি ছোট তাই ভুল করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাঁর উচিত ছিলো আমাকে শাসন করা। আমি বাবাকে বোঝালাম, তাঁর দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি জেদ না করলে এমন কিছুই হতো না। বাবা নিজেকে স্থীর করলেন এবং আমায় বললেন। মঈনুল যেহেতু নেশাদ্রব্য বিক্রি করে! তাহলে নিশ্চয়ই ঘরে কিছু রাখে। যদি পুলিশের হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে পারি সেই জিনিসগুলো,তাহলে শাস্তিও দেওয়া হবে,আমি মুক্তিও পাবো। তারপর থেকে আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে সুযোগটা পেয়েও গেলাম। বাবা পুলিশ নিয়ে এলো,এবং ওকে ধরিয়ে দিলো। আমাকে আর বাবাকে ও হুমকি দিয়ে যায়,ও খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। বাবা মঈনুলের পরিবারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমাকে নিয়ে চলে আসে। আমি চলে আসার পরই বাবা আমার সৎমাকে বলে দিলো! সে যদি আমার সাথে কোন বারাবাড়ি করে তাহলে পুলিশকে জানাবে,সেও এসবের সাথে জড়িত। মা ভয় পেলেন এবং চুপ হয়ে রইলেন। কিছু দিনের মাঝেই আমাদের ডির্ভোসের জন্য বাবা এপ্লাই করলেন। অবশ্য সফলও হলেন। কারণ একজন অপরাধীর সাথে আমার মতো মেয়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। তাই কোর্ট থেকে আমার তরফেই রায় হলো। বাবা আবারও আমায় পড়ালেখা করার জন্য বললেন। আমি রাজি হলাম। যেহেতু আমার বিয়ের সম্পর্কে তেমন কেউ জানতো না,তাই কেউ আমায় ডির্ভোসী বলে খোটাও দিতে পারেনি। বাবা সব সময় বলতো একটা কাজ আমি ভালোই করেছি,কাউকে বিয়ের বিষয়ে না জানিয়ে। অবশ্য কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে,বাবার শিখিয়ে দেওয়া উত্তর আমাকে আর মা’কে দিতে হতো। এতোদিন কোথায় ছিলাম? উত্তর ছিলো অসুস্থতার জন্য ডাক্তার দেখাতে শহরে ছিলাম। মা’কেও এই উত্তর দিতে হতো। তাই সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো। যেহেতু মঈনুলকে আমি মন থেকে বিয়ে করিনি,বা ওর সাথে আমার বিয়ের পর তেমন ভালো কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই ওর চলে যাওয়ায় আমার জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় এসে আবারও সব কিছু ধোঁয়াশা করে দিলো। যেহেতু আমাদের বাড়ি গ্রামে,তাই আমাদের কলপাড়টা ঘর থেকে একটু দূরে। তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য ওজু করতে যাই কলপাড়ে। সেদিন বাহিরে চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিলো। ওজু শেষ হতেই অনুভব করি,আমার পাশে কারো উপস্থিত। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভালো করে তাকাতেই দেখলাম মঈনুল, দাঁত বের করে হাসছে। কি বিচ্ছিরি ওর ওই হাসি। আজও মনে পড়লে আমার শরীরে কাঁটা দেয়। চিৎকার করার আগেই ও আমার মুখ বেঁধে দেয়। আমাকে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে ও নিয়ে যায় ওর সাথে। কিন্তু সেদিন মহান রাব্বুল আলামিন আমার উপর দয়া করেছিলেন। কারণ আমি সেদিন বাহিরে একা ছিলাম না,নিলিও ছিলো। ও টয়লেট গিয়েছিলো,আর আমি কলপাড়ে। পুরো ঘটনা ওর সামনেই ঘটেছিলো। ও তখন ভয়ে চিৎকার করতে পারেনি। কিন্তু আমাকে মঈনুল ধরে নিয়ে যাওয়া সাথে সাথেই ও বাবাকে ডেকে তোলে। বাবা তৎক্ষনাৎ পুলিশের কাছে যায়। যেহেতু ও একজন জামিন পাওয়া আসামি ছিলো,তাই ওর অপরাধের কথা শুনে পুলিশ সাথে সাথেই রিয়াকশন করে। আমাকে একটা অন্ধকার রুমে বন্দী করে রাখে। যে অন্ধকারে নিজের অস্তিত্বও আমি বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ দরজার খোলার আওয়াজে আমার মনের ভয়টা দ্বিগুন বেড়ে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি। কে, কে আপনি? আসলে আমি নিজেকে বোঝাতে চাইছিলাম,যেন এটা মঈনুল না হয়। কিন্তু আমায় ভুল প্রমাণ করে মঈনুল শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠলো। যে হাসি অতিভয়ংকর ছিলো। আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে! ও হঠাৎ আমার ঘাড়ে কামড় দেয়। আমি আল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠি। ওই ব্যথা এতটাই ভয়াবহ ছিলো,যা আমি কখনোই কাউকে বিশ্লেষণ দিতে পারবো না। আমি তো মনেই করে নিয়েছি,আমি হয়তো আর দিনের আলো দেখতে পারবো না। আমি কামড়ের ব্যথা সইতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদতে রইলাম। আমার ওই কান্না যতো গাড়ো হলো,মঈনুলের হাসি ততোই ভয়ংকর হলো। আমাকে কষ্ট দিয়ে ও যেন সুখ অনুভব করছিলো। আমার হাতের বাঁধন ও খুলে দিয়ে বললো। আমি তোকে কোপাবো,আর তুই কষ্টে ছটপট করবি। তোর সেই কষ্ট দেখে আমি শান্তি পাবো। আমি বুঝলাম মঈনুল স্বাভাবিক মানুষ না। ও হয়তো মানুষীক রোগী হবে। ও প্রথম কোপটা যখন আমার দিকে ছুরলো,আমি তখন বুঝে নিলাম। আমার আর সূর্য দেখা হবে না। আমার আর হয়তো বাবাকে বাবা বলে ডাকা হবে না। আমার হয়তো সময় হয়ে গেছে,আমার বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার । কিন্তু ওই যে রাখে আল্লাহ মারে কে। ওর দেওয়া ধারালো দায়ের কোপ আমার বুকে নয় হাতে এসে লেগেছে। আমি ব্যথার চিৎকার করে উঠলাম। হাত চেপে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। গলগল করে রক্ত ঝড়তে শুরু করলো! চারিদিকের অন্ধকার আরো অন্ধকার হয়ে এলো আমার চোখে। তখনই আমার বাবাসহ পুলিশদের নজরে পড়লো। তখন বুঝলাম তাঁরা আমাকে আশেপাশেই হয়তো খুঁজছিলো। কিন্তু পায়নি,এখন আমার চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে। সবার হাতের টর্চের আলোয় আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। বাবা আমাকে তাঁর বুকে তুলে নিলো। আর মঈনুলকে পুলিশ ধরে নিলো। মঈনুল যাওয়া আগে একটা কথা বললো। তোর ওই ঘাড়ের ক্ষতটা শুকানোর আগেই আমি ফিরে আসবো। আর কিছু আমি শুনতে পাইনি। জ্ঞান হারিয়ে বাবার বুকে পড়ে রই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি,বাবা,নিলি দাঁড়িয়ে আছে আমার কাছে। নিলির পাশে একটা ব্যাগ। আমি বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো! তাঁর আগেই বাবা বলে– তুমি আর এখানে থাকবে না। একটা ঠিকানা দিচ্ছি সেখানে চলে যাবে। আর এসবের কিছু কাউকে বলার দরকার নেই। যা বলার আমি বলে দিয়েছি! তাই তোমার চিন্তা নেই। আমি বাবাকে বললাম– আর কতদিন। বাবা বললো– যতোদিন না এটার সমাধান হয়।

নিজের অতীত শেষ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো রজনী। আর পল্লব, সে এখনো নিজের ঘোরে আছে। সে হয়তো এমন কিছু কখনোই ভাবেনি। পল্লব ভেবেছিলো,মঈনুল হয়তো পাড়ার কোন বখাটে ছেলে হবে। যে রজনীকে বিরক্ত করতো। কিন্তু সে যে রজনীর প্রাক্তন স্বামী হতে পারে! তা যে কল্পনার বাহিরে ছিলো। ততোক্ষণে পল্লব নিজের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। আর সেদিকে তাকিয়ে রজনী হাসলো। মানুষ এমনই হয়তো? সত্যিটা জানার পর দয়া দেখাতেও চায় না। অবশ্য ভালোই হয়েছে! জীবনে দয়া কম নেওয়া হলো না! এবার না-হয় সেটাও হারিয়ে যাক।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here