#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৭

মঈনুল আমার প্রাক্তন স্বামী।

রজনীর কথায় পল্লবের জড়িয়ে রাখা হাত,আলগা হয়ে গেলো। এমন কিছু হতে পারে পল্লব হয়তো ভাবতে পারেনি। তাই পল্লব অনেকটা অবাক হলো। কিন্তু রজনীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে বলতে রইলো তাঁর অতীত।

_ বর্তমানে যিনি আমার বাবা! তিনি আমার সৎবাবা। আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। আমার বাবা যখন মারা যায় তখন আমি আমার মায়ের পেটে সাত মাস। আমার বাবা-র বন্ধু ছিলেন আমার বর্তমানের বাবা। আমাদের অনেক জায়গাজমি ছিলো। আমার বাবা-র আত্মীয় স্বজনরা সেটা লুটে নিতে চেয়েছিলো,বাবা-র মৃত্যুর পর! কিন্তু আমার মা শক্ত হয়ে সব আগলে নেয় সবটা। তিনি যতোই আগলে রাখুক সে একজন মেয়ে। তাঁর দিকে বাজে নজর সবার ছিলো। আমার মা যে অল্পবয়সী বিধবা নারী। এক সময় মা’কে আমার বাবা,মানে যাকে আমি বাবা বলে জানতাম! তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন। সে বেকার ছিলো,তিন কূলে কেউ ছিলো না যে তাঁকে বাঁধা দিবে এই বিয়ের জন্য। আমার তখন চারমাস বয়স। মা রাজি হয়! কারণ এই পৃথিবীতে একা যুদ্ধ করা অনেক কঠিন। তারপর তাঁদের বিয়ে হয়। আমাদের সংসার অনেক ভালোই কাটে। বাবা আমায় খুব ভালোবাসতেন। কখনোই তিনি বুঝতে দেননি,আমি তাঁর মেয়ে নই। এমন কী আমার কদর্য কমে যেতে পারে ভেবে আর কোন বাচ্চা তাঁরা নেয়নি। আমার বয়স যখন চার,তখন বাবা-র অনেক জমি মা বিক্রি করে দেয় হঠাৎ, তাঁর একজন বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য । তাঁরা কথা দেয়,সময় হলে তাঁরা টাকা ফেরত দিয়ে দিবে। তারপর আস্তে আস্তে দিন শেষে বছর শেষ হলো। আমি তখন নয় বছরে পা দিলাম। ভালো খারাপ কমবেশি বুঝি। মায়ের খুব বড় রোগ হলো। তখন খুব বড় বলেই জানতাম রোগটাকে। কারণ তখন ক্যান্সার কেমন রোগ এটা তো জানতাম না৷ বাবা নিজে থেকে সব বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করালেন। কিন্তু মা সুস্থ হলেন না। কথায় বলে ক্যান্সারের নেই কোন এ্যান্সার। যদি মহান আল্লাহ রহম না করেন। বাবা তখন বাধ্য হয়ে মায়ের সেই বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করে। তাঁরা ধীরে ধীরে সব টাকা ফেরত দেয়,যা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করানো হয়। সব টাকা শেষ হয়েছে, কিন্তু মায়ের অসুখ সারেনি। আমার দশ বছর বয়সেই মা মারা যায়। হাউমাউ করে কেঁদেছি। মাটিতে গড়াগড়ি করেছি,কিন্তু মা ফিরে আসেনি। শোক সইতে না পেরে দেয়ালে মাথা ঠুকেছি,কিন্তু মা আমার চোখ খুলে তাকায়নি। সেদিন আবারও উপলব্ধি করলাম বাবা আমায় অনেক ভালোবাসে। স্ত্রী শোক ভুলে গিয়ে আমায় আগলে নিলেন বাবা। মা’কে নিয়ে গেলেন মাটি দিতে। আমি চিৎকার করলাম,আমার মা’কে তোরা রেখে যা। ওরে আমি ঘুমাবো কেম্নে। আমায় কে খাইয়ে দিবে বায়না করলে। ওরে তোরা রেখে যা আমার মা’কে। কিন্তু আমার কথায় কি আর নিয়ম বদলে দিবে ওরা। তাই শুনলো না আমার কথা। আমি অসুস্থ হয়ে পরলাম মায়ের মৃত্যুশোক সইতে না পেরে। দিন যায় আর আমি অসুস্থ হতে থাকি। সবাই বাবাকে বললো দ্বিতীয় বিয়ে করতে। অনন্ত আমার জন্য হলেও যেন তিনি বিয়ে করে। অবশেষে ছয়মাসের মাথায় বাবা বিয়ে করলেন। তখনো আমি জানতাম না তিনি আমার বাবা নন। বাবা-র দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে বাবা শর্ত রাখলেন,তিনি কখনোই মা হতে পারবে না। তিনি রাজি হলেন। ঘরে নতুন প্রাণ ফিরে এলো। সারাদিন মায়ের মতো সংসারে কাজ করতেন,আমার খেয়াল রাখতেন। আস্তে আস্তে আমি সুস্থ হলাম। কিন্তু আমার প্রতি খেয়াল শুধুমাত্র তাঁর লোকদেখানো ছিলো। অবশ্য শুরুতে বুঝতে পারনি,পরে বুঝতে পেরেছি। মা প্রেগন্যান্ট হলো বাবা-র শর্ত অমান্য করে। বাবা রাগারাগি করতেই তিনি বললেন। রজনী আপনায় বাবা ডাকলে হয়তো আপনার প্রাণ ঠান্ডা হয়,কিন্তু আমায় মা ডাকলে আমার প্রাণ ঠান্ডা হয় না। আমার শান্তির জন্য হলেও আমি মা হতে চাই। বাবার বলার মতো আর কোন কথা ছিলো না সেদিন। তারপর আর কী? আমার সাথে সেসব অত্যাচার হতে রইলো! যা বাকি পাঁচটা অসহায়, এতিম মেয়ের সাথে হয়। বাবা আসলে হয়তো তিনি একটু ভালো ব্যবহার করতেন, কিন্তু বাবা চলে যেতেই শুরু হতো তাঁর ক্ষমতা জারী করা। এক সময় বাবা-র চোখের পরে গেলো আমার সাথে করা অন্যায় গুলো। সেদিন বাবা মা’কে বোঝালেন। কারণ অল্পতেই রেগে যাওয়ার মানুষ বাবা নন। কিন্তু বাবা-র বুঝানো,মায়ের কানে গেলো না। দিনকে দিন তাঁর অত্যাচার বেড়েছে। আর আমি নিরব হয়ে সয়ে গেছি। কখনো কখনো প্রতিবাদ করেছি,কিন্তু পেরে উঠিনি৷ আমার এই ভাঙাচুরা জীবনটা আরো ভেঙে দিতে একটা সংবাদ এলো! আমার বিয়ের। সমোন্ধটা আমার সৎমা নিয়ে এলেন। কিন্তু বাঁধ সাধলো বাবা।
কারণ সবে আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। কিন্তু আমার সৎমা সেটা মানতে নারাজ। তাঁদের প্রচুর কথা-কাটাকাটি হলো। এক সময় বাবা থাপ্পড় দিয়ে বসলেন মা’কে। আমি ভয়ে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে আড়াল থেকে। কিন্তু মা যেন নিজের রাগটা বহুগুণ বারিয়ে নিলেন,ওই থাপ্পড় খেয়ে৷ তিনি সেদিন মুখ ফস্কে বলে দিলেন। রজনী তোমার নিজের মেয়ে না,অথচ তাঁর জন্য তুমি তোমার জান দিয়ে দাও। আর নিজের সন্তানের জন্য তো কখনো মুখ ফুটে কথাও বলো না। নিজের আসল পরিচয় জানার পর আমি থমকে গেলাম। নিজের প্রতি তখন প্রচুর অনীহা এলো। খুব ঘৃণা হতে রইলো। আমার জন্য বাবা হয়তো সুখী একটা জীবন পাচ্ছেন না। আমি ঘরে চলে এলাম। আর ওদিকে চলতে রইলো বাবা-মায়ের তুমুলঝগড়া। সকাল হলো,সেই সাথে সূচনা হলো আমার জীবনের নতুন এক সকালের। বাবা কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে সবেমাত্র খেতে বসলেন। আমিও পাশে বসলাম। মা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। মায়ের গালে বাবা-র শক্ত হাতের দাগ স্পষ্ট। বুঝতে পারলাম,আমি চলে আসার পরে-ও মা’কে বাবা মেরেছে। আমি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম নিজের মনের সাথে তখনই । আর সেটা বাবাকে বলেও দিলাম।

_ বাবা

_ বলো

_ মা যেই সমোন্ধেটা এনেছে, আমি রাজি সেখানে বিয়ে করতে।

আমার কথায় বাবা-র খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো! সাথে মায়ের খাবার দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেলো। আমার কথা শুনে বাবা কঠিন সুরে বললেন।

_ কোন বিয়ে হবে না,চুপচাপ খেয়ে উঠে কলেজে যা-ও।

_ পরের মেয়ের জন্য আর কত করবে আব্বা?

এই কথাটা আমি বলতে পারি,এটা হয়তো সেদিন বাবা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। তাই তাঁর মুখে ওঠা পানির গ্লাস পড়ে গেলো। আর আমি তখনো নিরব হয়ে খাচ্ছি। বাবা-র সাথে সাথে মাও খুব অবাক হলেন। তাঁরা কয়েক মুহূর্তে বুঝে নিলেন! রাতে তাঁদের তর্কবির্তক সবটাই আমার কানে এসেছে। আর সবটা না হলে-ও আসল ঘটনা আমি জেনে গেছি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি আরো একটি কথা বললাম।

_ বিয়েটা এই সপ্তাহের মাঝেই হবে। আর কাউকে জানানোর দরকার নেই। শুধু শুধু পরের মেয়ের জন্য টাকা খরচ করার কোন দরকার নেই।

কথা শেষ হতেই, আমি প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। আর তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাবা। কিন্তু আমি বাবাকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। আমার কথায় বাবা খুব অভিমান করলেন। তাঁর অভিমানের প্রথম কারণ, সে তো কখনো আমায় বুঝতে দেয়নি আমি তাঁর মেয়ে নই! তাহলে কেন আমার এতো কঠিন সিদ্ধান্ত। আর দ্বিতীয় কারণ, তাঁকে আমি এতোটা পর কীভাবে ভাবলাম। বাবা বিয়েতে রইলেন না। মা নিজ দায়িত্বে সব করলেন। কারণ তাঁদের ঘাড় থেকে যে আপদ বিদায় হচ্ছে। আমি বিদায়ের সময় কাঁদিনি। হয়তো বাবা সামনে থাকলে কাঁদতাম। কারণ একমাত্র তো তিনিই আমার আপন কেউ ছিলেন এই পৃথিবীতে। বাবা ছিলেন না বলেই হয়তো আমার চোখে পানি আসেনি। একমাত্র বাবার উপর আমি নির্ভরশীল ছিলাম। তাঁর কাঁধে আমি নিশ্চিন্তে মাথা রাখতে পারতাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি সেদিনের অভিমানে নেওয়া সিদ্ধান্ত আমার জীবনের ভূমি নাড়িয়ে দিবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here