#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩

বেশিদূর যাওয়া হলোনা মিতালী আর ইশরাকের। কোথা থেকে নির্ভীক এসে টপকালো। নিজের নাম ধরে ডাক পড়ায় পেছন ঘুরে তাকালো মিতালী। ইশরাক চোখেমুখে বিস্ময়বিমূঢ় ভাব ফুটিয়ে বলল,
-“তুই না বাজারে গিয়েছিলি?”

নির্ভীক আগেই ইশরাকের প্রশ্নের জবাব দিলোনা। মিতালীর দিকে ক্রু*দ্ধ দৃষ্টি ফে*লে বলল,
-“বলেছিলাম না কথা আছে তোর সাথে। আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি!”

মিতালী ভীষণ আশ্চর্য হলো। নির্ভীকের সাথে তো তার এমন কোন কথাই হয়নি। তাই বলল,
-“কিন্তু তুই তো আমায়….”

এতটুকুতেই থামতে হলো মিতালীকে। নির্ভীক বাঁধা দিয়ে বলল,
-“এখন আর এত কথা বলতে হবেনা।”

অতঃপর ইশরাকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো। খানিকটা ভারী সুরে বলল,
-“আমি মিতাকে পৌঁছে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি চলে যাও। অফিস করে নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত তুমি।”

ইশরাক কিয়দংশ সময় নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো নির্ভীকের শক্ত ভাঁজে লুকিয়ে রাখা একজোড়া চঞ্চল চোখে। অতঃপর ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। যার অর্থ বা মর্ম উপলব্ধি করতে পারলোনা নির্ভীক। ইশরাক সামনে ইশারা করে বলল,
-“চল, দুজনে গিয়েই দিয়ে আসি। আর আমি ঠিক আছি, ক্লান্তি বোধ হারিয়ে সেই কবেই সতেজতা ফিরে এসেছে।”

কথাটি বলতে গিয়ে আড়চোখে মিতালীকে দেখলো।
নির্ভীক কথা বাড়ালোনা। মিতালীকে পৌঁছে দিলো দুজন।

★★★

টিমটিমে চাঁদের আলোয় যখন মিতালীকে পৌঁছে দিয়ে দু’ভাই রাস্তায় নামলো, পায়ে পা মিলিয়ে সমানতালে হেঁটে চললো, তখন ইশারাকই আগে কথা বলল,
-“মিতালীকে ভালোবাসিস?”

চমকানোর কথা থাকলেও চমকালো না নির্ভীক। এটুকু সত্য যেন সবার জানা উচিত।

-“বুঝতে পেরেও তুমি পিছু নিয়েছো?”

ইশারাক জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁ*ড়*লো,
-“সে ও কি তোকে ভালোবাসে? বলেছে কখনো?”

নির্ভীক হুট করেই থেমে গেলো। নিভে গেলো তার গম্ভীর ভাব, চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসলো।
ইশরাক তা দেখে হাসলো। বলল,
-“তোর মতো তুই চেষ্টা করে যা। আমি তোকে বাঁধা দেবোনা। দেখি এই ল*ড়া*ই*য়ে কার জয় হয়।”

এরপর দুদিকেই নিরবতা চললো। কেউ কোনো কথা বললোনা। মূলত নির্ভীক কথা বাড়াতে চাইলোনা। দু’ভাইয়ের মাঝে ঝা*মে*লা বাঁধিয়ে পরিবারে অ*শা*ন্তি বাড়াতে চাইছেনা সে।

★★★

দুদিন পরের ঘটনা। ভোরের আবছা আলো কে*টে গিয়ে সূর্যের আগমন। ঘাসের উপর হালকা শিশির বিন্দু রৌদ্রজ্জ্বল ছোঁযায় ঝলমল করে উঠছে। ফজরের নামায পড়ে কিছুক্ষণ তসবিহ জপছিলেন রোজী বেগম। বেশিক্ষণ বসলেন না, দুটো মেয়েই একটুপর বেরিয়ে পড়বে। তাদের নাস্তার ব্যবস্থায় উঠে পড়লেন।
মিতালী বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে বাবাকে দেখতে গেলো। শরীর পূর্বের তুলনায় আরো দুর্বল হয়ে গিয়েছে। গতমাসে একহাজার টাকার ঔষধ এনে দিয়েছিলো মাত্র দশদিনের। তখন খানিকটা সুস্থ বোধ করলেও এখন পূর্বের তুলনায় একটু বেশিই অসুস্থ। বাবা চোখ খুললেন না। রোধ হয়ে আসা হাত-পা গুলো নিজে নিজে নাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বলা যায় ব্যায়াম, যাতে একেবারেই অবস না হয়ে যান। তাহলে যে তাকে নড়াচড়া করতে স্ত্রী আর মেয়েদের কষ্ট হয়ে যাবে। মিতালী বাবাকে দেখে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো ‘তার যদি কাড়াকাড়ি টাকা থাকতো তবে, আব্বাকে সে কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে পারতো।’

প্রতিটি নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তের একটাই দীর্ঘশ্বাস। আর সেটা হচ্ছে টাকা।

★★★

আজও মিতালীর গতিপথে রিকশা এসে থামলো। সে উঠলোনা রিকশায়। আজ কিছু কড়া কথা বলার পালা। এভাবে রোজ রোজ লোকসমাজে তাকে হে*ন*স্তা করার জবাব নেবে সে। পাশে মাহা ও ছিলো। মিতালী তার হাত ধরে সামনে এগোলো। ইশরাক রিকশা থেকে নেমে সে ও ওদের পেছন পেছন আসলো।

জনাকীর্ণহীর্ণ সরু রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে গিয়েও পা জোড়া থামিয়ে নিলো মিতালী। আশেপাশে লোকসমাগম নেই। এটাই কথা বলার মোক্ষম সুযোগ। মিতালীকে থেমে যেতে দেখে ইশরাক বলল,
-“রিকশায় উঠলেনা যে?”

মিতালীর চোয়াল খানা শক্ত হয়ে আসলো। মরম রূপ ভাটা পড়লো কঠিন খোলসের আড়ালে। শান্ত রূপে কঠিন হলো সে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“কেন রোজ রোজ আমি ভাড়া ছাড়া রিকশায় উঠবো? যখন আমার মনে হবে আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা আছে, আমি রিকশায় চড়ে যেতে পারবো। তখন আমি নিজ থেকেই উঠবো।”

ইশরাক ডান ভ্রু খানিক কুঁচকে নিলো। রাশভারি গলায় শুধালো,
-“তোমার ভাড়া দেওয়ার প্রয়োজন তো পড়ছেনা।”

এতক্ষণ যাবত ঠান্ডা মস্তিস্কে বাক্যালাপ চললেও এ পর্যায়ে তেতে উঠলো মিতালী। খানিক জোরালো কন্ঠে বলল,
-“আমরা আত্মসম্মান চিনি। আর নিজেদের আত্মসম্মান আছে বলেও মনে করি। এতটুকু জ্ঞান আমাদের আছে যে, কে আমাদের কতটা পছন্দ করে। আমরা ও তাকে ঠিক ততটাই সম্মান দিতে জানি। শুধু শুধু তাকে বিরক্ত করিনা।”

কথার তীরটা যে সরাসরি ইশরাককেই ইশারা করলো সেটা সে হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই নিঃসংকোচ প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-“কাউকে পছন্দ করা কি অপরাধ?”

মিতালী কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
-“পছন্দ করা অপরাধ নয়, কিন্তু তার অপছন্দীয় কাজগুলো করা অপরাধ।
আশাকরি আমাদের পিছু পিছু আপনাকে আর দেখতে পাবোনা।”

কথাটি বলেই মাহার হাত চেপে পা বাড়ালো মিতালী। চোখের কোন জলে চিকচিক করছে মাহার। সে এতটুকু আজ নিশ্চিত হলো যে ইশরাক ভাই আপুকে পছন্দ করে। এজন্যই বুঝি এতদিন তার সাথে ভাব জমিয়েছে? ছলেবলে কৌশলে কিভাবে আপুর কথা জিজ্ঞেস করতো, তা ও মনে পড়ে গেলো। সে চোখের জল গড়াতে দিলেনা, তার পূর্বেই স্কার্ফের কোনা দিয়ে সন্তর্পণে মুছে নিলো চোখের কোন।

ইশরাক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কী হলো ঠিক বুঝলোনা। মিতালী কি কোনোভাবে বিয়ের পূর্বের দুজনের সন্ধিটাকে ভ’য় পাচ্ছে? তবে সে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

★★★

আজ মালিহাকে পড়াতে এসেই মিতালী চেয়ারম্যান চাচার খোঁজ করলো। তিনি বাড়ি ছিলেন না বিধায় মালিহাকে পড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নির্ভীক ও এসে পড়লো মিতালীকে পৌঁছে দিতে। চেয়ারম্যান সাহেব স্ত্রীর কাছে জরুরি তলব শুনে মিতালীর মুখোমুখি বসলেন।

-“বলো মিতালী, কী বলতে চাও?”

শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো মিতালী। সরল গলায় বলল,

-“আব্বা আমায় নিয়ে দু*শ্চি*ন্তা*য় থাকেন। সন্ধ্যার পর কখনো বাড়ির বাইরে থাকিনি তো। তাছাড়া সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়ে বাড়ি ফিরি। তারপরই এখানে আসতে হয়। আমি পরিবারকে সময় দিতে পারিনা। আব্বা – মা চাইছেন না আমি সন্ধ্যার পর কোথাও পড়াই। ক্ষ*মা করবেন আমায়। আপনারা আমার বি*প*দে অনেক সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু বাবা – মায়ের অবাধ্য হয়ে আমি মালিহাকে পড়াতে পারছিনা।”

নির্ভীকের মনে লাড্ডু ফোটে। এতদিনে মেয়েটা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ইচ্ছে হলো একবার মিতালীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বলতে ইচ্ছে করলো ‘শুনতে পাচ্ছিস? তোর সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে আমার বুকের লাব ডাব বেড়ে গিয়েছে’।

চেয়ারম্যান সাহেবের চোয়ালে আঁধার নামলো। তিনি বেশ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,

-“সে কি কথা মিতালী? এতটা অনুনয় করে বললাম তোমায়, তাছাড়া মালিহাকে ও দেখছি তোমার সাথে বেশ মিলেমিশে পড়াশোনা করছে। এখন তুমি এ কথা বললে কি চলে?”

-“আমি দুঃখিত চাচা। কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায় নেই।”

মিতালীকে বাঁচাতে নির্ভীক বলল,
-“মালিহা কে না হয় আমিই পড়াবো এখন থেকে।”

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
-“এতদিন পড়াতে পারিসনি, এখন পারবি? ও পড়বে তোর কাছে?”
অতঃপর মিতালীর উদ্দেশ্য বলল,
-“তোমার রাতে পড়াতে সমস্যা তো? তাহলে দিনে পড়িয়ে দিও।”

মিতালী ইতস্ততভাবে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা। অনবরত দু’হাত কচলে চলেছে।

সেটা লক্ষ করে চেয়ারম্যান সাহেব তীক্ষ্ণ চাহনি ফে*লে বললেন,
-“দিনের বেলা ও সমস্যা?”

মিতালী লজ্জায় আর জবাব দিতে পারলোনা। তার তো সকাল থেকেই সময় নেই। সামনেই বছর শেষে সবার পরীক্ষা আসছে। কোন স্টুডেন্টের মা – বাবাই শিক্ষক ছাড়তে চাইবেন না। আর না সে দিনে মালিহাকে পড়াতে পারবে।
মিতালীকে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব বিরস মুখে জবাব দিলেন,

-“আচ্ছা বেশ।”

মিতালী সালাম জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মালিহাকে পড়াতে তার ভালোই লাগে। তাকে পড়ানো বাদ দিয়েছে বাধ্য হয়ে। তার একমাত্র কারণ ইশরাক। তার চোখের দৃষ্টি খুব ভালো কিছু বলছেনা। এভাবে তার দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলা কারো নজরে পড়ে গেলেই সর্ন*নাশ। সবাই হয়তো তার দোষই চোখে দেখবে। গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের দো*ষই ধরা হয় বেশিরভাগ সময়। কেউ ইশরাকের দো*ষ দেবেনা। সবাই মিতালীর চরিত্রে আঙ্গুল তুলবে। সবার মুখেমুখে রটে যাবে ‘টাকার লো*ভে চেয়ারম্যানের ছেলেকে হাত করেছে।’
কেননা মিতালীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। হাজার দু’য়েক টাকার জন্য আত্মসম্মানে সে দা*গ লাগতে দেবেনা।

নির্ভীক পেছন থেকে প্রফুল্লচিত্তে শুধালো,
-“চল আইসক্রিম খাই।”

মিতালী বাঁধ সাধলো।
-“এখন ঠান্ডার প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। আইসক্রিম খাবোনা।”

নির্ভীক বাঁধা মানলোনা। তাকে দাঁড় করিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে এলো দোকান থেকে।

★★★

রাতে বাবার সাথে আলাদা ঘরে বসলো ইশরাক। কিছু সময় থম ধরে পড়ে রইলো। এরপরই ঠাস করে বলে দিলো,

-“আমি মিতালীকে বিয়ে করতে চাই।”

চেয়ারম্যান সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here