#ধারাবাহিকগল্প
#সামাজিক থ্রিলার
#চোরাবালি
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
জুলির বাড়িটা ডুপ্লেক্স বাংলো বাড়ি। ডোর বেল বাজতে কাজের হেলপার মিনারা খালা দরজাটা খুলে দিলো। জুলি ওর বেডরুম থেকে সায়ানের সিড়ি দিয়ে উঠে আসার শব্দ শুনতে পারছে।
জুলি রুমের দরজা খুলে দাড়িয়ে সায়ানকে বললো,
——এতো দেরী হলো রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো?
——তা একটু ছিলো। তবে অফিসে কাজের চাপও বেড়েছে।
জুলি সায়ানকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। সায়ান পাশ কাটিয়ে দামী ব্রান্ডের পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে রুমে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো। জুলি সায়ানের এই আচরণে একটু অবাক হলো। তবে সায়ানকে বুঝতে না দিয়ে ওর পাশে ঘনিষ্ট হয়ে বসে বললো,
——তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। মানসিকভাবেও একটু ডিপ্রেসড লাগছে। তুমি ঠিক আছোতো?
—– Don’t Worry.I am fine.
দরজায় নক করে মিনারা খালা দুগ্লাস ডালিমের জুস দিয়ে গেলো। জুলি সায়ানের হাতে জুসের গ্লাস তুলে দিয়ে বললো,
—–আমাদের বিয়েটা কবে হবে?
সায়ান একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—–এতো বিয়ে বিয়ে করছো কেন? বিয়ে তো করেছিলে কি পেয়েছিলে? ভালো মত খেতে পড়তে পর্যন্ত পারোনি। আর বিয়ে না করেও আমি তোমায় রাজরানির মতো রেখেছি। থাকার জন্য মহল বানিয়ে দিয়েছি। দামী গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছো। সোনা দানা হীরা জহরত দিয়ে তোমায় মুড়িয়ে রেখেছি। বাপের জনমে এতো সুখ চোখে দেখেছো? এমনকি তোমার বিবাহিত তথাকথিত স্বামীর বাড়ির খরচ থেকে শুরু করে ওর নেশার টাকা সমস্ত কিছু দিয়ে যাচ্ছি। আর তুমি আছো তোমার বিয়ে নিয়ে।
জুলি সায়ানের এই আচরণে অবাক হলো। কিন্তু ওকে দমে গেলে তো হবে না। তাই ও মোলায়েম সুরে বললো,
—-আমি আসলে রায়হানের বোঝাটা আর টানতে পারছি না বলে তোমায় বিয়ে করতে চাইছি। তুমি আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে আমি রায়হানকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
——তুমি রায়হান ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি তো তোমায় নিষেধ করিনি। তারপর আমাদের সময়মত আমরা বিয়ে করবো।
—–শোন সায়ান আমি আর রক্ষিতার তকমাটাও বইতে পারছি না। তুমি তো পুরুষ মানুষ তুমি কখনও আমার এই জ্বালাটা বুঝবেনা। এমনকি মিনারা খালাও জানে তোমার সাথে আমার কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক নেই।সমাজে আমাকে নিয়ে অনেকে কানাঘুষা করে। রায়হানকে ডিভোর্স দিলে তোমার এখানে আসাটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সায়ান মনে মনে ভাবতে লাগলো পায়ের জিনিস পায়ের কাছে পায়ের তলায় রাখতে হয়। মাথায় তুললে ওদের স্পর্ধা বেড়ে যায়। জুলিকে মনের কথা বুঝতে না দিয়ে বললো,
—–কার এতো বড় সাহস তোমাকে রক্ষিতা বলে।সবাই জানে তুমি আমার বান্ধবী।
—–সেটা তোমার সামনে প্রদর্শন করে। কারণ অর্থ বিত্ত ক্ষমতা সব তোমার আছে। তাই সায়ান চৌধুরীর রক্ষিতাকে উনার সামনে লোকদেখানো সম্মানটা সবাই করে। তাকে অপমান করার সাহস তখন কেউ দেখায় না। কিন্তু আড়ালে আবডালে কানাঘুষা ঠিক চলে। আর তুমি আমাকে বিয়ে না করলে রায়হানকে ডিভোর্স দিলে আমাকে আরোও বেশী প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
——আমি তা মনে করি না। এখনও কাগজে কলমে তুমি আমার এমপ্লয়ি। আমি আমার পার্সোনাল সেক্রেটারীর কাছে আসতেই পারি।
—–কি পারপাসে?
—-অফিসের কাজে আসতে পারি না?
—-সায়ান চৌধুরী আমি আপনার অফিসের একজন সামান্য কর্মচারী। আপনি কেন আমার কাছে আসবেন? বরঞ্চ আমি আপনার কাছে যাবো। এটাই কি স্বাভাবিক না?তুমি তো বলেছিলে আমাকে বিয়ে করে বিদেশে সেটেলড করে দিবে।
—–আমি তো অস্বীকার করিনি। এখনও তো বলছি আমি তোমায় বিয়ে করবো। শুধু একটু সময় চাইছি। আমাকে তো সব ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলার কথা চিন্তা করতে হয়। তারপর মা আমাকে ডেকে বলেছে বাজারে নাকি আমার সম্পর্কে নানা গুজব শোনা যাচ্ছে। আমি যেন সাবধান হই। আজকে আবার রুবি দুবাই থেকে আসছে। আর আমি বুঝে পাইনা তোমার যখন মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়া বাকি ছিল, তুমি যখন ভালো মত খেতে পড়তে পারতে না,তোমার শ্বশুরের অসুস্থতার খরচ যারা তোমাকে রক্ষিতা বলে তারা দেয়নি। তুমি তোমার মতো করে যোগাড় করেছো। তাহলে আজ কেন তাদের কথা তোমার কাছে এতো গুরুত্ব বহন করে?
এমন সময় সায়ান চৌধুরীর মোবাইলটা বেজে উঠলো।
—–হ্যালো মাই সুইটহার্ট প্লেন কি ল্যান্ড করেছে?
Don’t Worry baby আমি পথে আছি।এখনি পৌঁছে যাবো।
জুলির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে সায়ান বললো,
—-জীবনে এতো প্যারা নিও না। খাও দাও ফুর্তি কর। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি চলি।
সায়ান সিঁড়ি দিয়ে গট গট করে নিচে নেমে গেলো। জুলি ওর বিএমডব্লিউ গাড়ি স্টার্ড দেওয়া শব্দ শুনতে পেলো।
মিনারা খালা এসে দরজা নক করে বললো,
—-ম্যাডাম টেবিলে খাবার দিবো?
—-না, আমি আজ রাতে আর কিছু খাবো না।
জুলি বেডরুমের দরজা লক করে কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে এসে শুয়ে পড়লো। জুলি সায়ানের চলাফেরায় অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে। আগে রুবি ম্যাডামকে এয়ারপোর্ট থেকে সায়ানের প্রটোকল অফিসার নিয়ে আসতো। আজ ও নিজেই রিসিভ করতে লাগলো। আর জুলি তো নিজেই দেখলো ফোনে বউয়ের প্রতি প্রেম যেন উথলে উঠছে। তবে আজ ও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এ পথে ঢোকা সহজ কিন্তু বের হওয়া কঠিন। সায়ান বলেছিল ওকে বিয়ে করবে। জুলিও সায়ানকে বিশ্বাস করেছিলো। জুলির মতো মেয়েদের অসহায়ত্বের সুযোগে একটু ভাল থাকার লোভে সায়ানের মত ধুর্ত শেয়ালরা ওদের নিজেদের শয্যাসঙ্গীনি বানিয়ে ফেলে। জুলি ভেবেছিলো সায়ান হয়ত সেরকম নয়। সায়ান ওকে ভালবাসে। জুলিও সায়ানকে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু ইদানিং সায়ান অনেক বদলে যাচ্ছে। জুলির কি এখন ফেরত আসার উপায় আছে?জুলিতো জানে এই লোকের ক্ষমতার শেকড় কত গভীর। ও চাইলেও এখন আর সায়ানের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারবে না। যতক্ষণ না ওকে সায়ান নিজেই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে? এতো সোজা না এতবড় ক্ষমতাধর শিল্পপতির আমোদ প্রমোদের আসর ভেঙ্গে উঠে আসা। সেই সাহস দেখালে জুলির জীবনটাও হয়ত দিয়ে দিতে হতে পারে।
পরদিন ভোরে জুলির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মিনারা খালা দরজা নক করল,
—-ম্যাডাম আপনার কফি।
কফিটা হাতে নিয়ে জুলি জিজ্ঞাসা করলো,
—–রায়হান কাল রাতে বাড়ি ফিরেছে?
—-না, ফিরেনি ম্যাডাম।
—–ঠিক আছে। আমার জন্য ব্রেকফাস্ট রেডী করেন। আজকে তাড়াতাড়ি অফিসে যাবো।
জুলি ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের পথে রওয়ানা হলো। প্রটোকল অফিসার মিজান সাহেব জুলিকে দেখে বললো,
—গুড মর্নিং ম্যাডাম।
—-গুড মর্নিং।
—-আপনার জন্য একটা ফাটাফাটি নিউজ আছে। বড় ম্যাডামের আপনার সাথে জরুরী কথা আছে। অফিস ছুটির পর আপনাকে অফিসে থাকতে বলেছে।
—-কি বিষয়ে কথা বলবে আপনি জানেন কিছু?
—-আপনাদের ভি আইপি ব্যাপার আমার মতো বামুনের জানা কি ঠিক হবে?
মিজানসাহেব চলে যাওয়ার পর জুলির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
চলবে