#অভিশপ্ত_জীবন
পর্ব ৮
লেখিকা #Fabiha_Bushra_Borno

কাল রাতে হয়তো এতোক্ষণ এই বুকে অন্য কেউ মাথা রেখে পরম তৃপ্তিতে নতুন জীবনের সুচনা শুরু করবে। আজ যে কথা গুলো মুহিত আমাকে বলছে কাল এই সময় হতে হতে নতুনত্বের ছোঁয়াতে ভুলে যাবে। পাশের ঘরে কেউ তাদের একান্ত মুহূর্তের জন্য ছটফটিয়ে মরছে তা বুঝার বিন্দুমাত্র আগ্রহও থাকবেনা। সত্যিই কি পারবে মুহিত আমাকে ভুলে যেতে? এমন কিছু ভাবনার মাঝেই মুহিতের স্পর্শ গুলো গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো। অন্য দিন মুহিতের স্পর্শে যে অনুভূতি জাগতো আমার আজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে, মুহিতের ছোঁয়া বা স্পর্শে আমি থাকলেও কল্পনা বা অনুভূতিতে অন্য কেউ বিরাজ করছে।

গভীর রাতের ঝিঝি পোকার ডাকের সাথে বদ্ধঘরে স্বামী স্ত্রীর আলিঙ্গনের রেষ কাটিয়ে ঘুমিয়ে পরে মুহিত। আমার চোখে কোন ভাবেই ঘুম আসছে না। ভাবলাম বাকি রাত টুকু আল্লাহর ইবাদতের মধ্য দিয়ে শেষ করি। আজ কেন জানি একা একা কলপাড়ে যেতে ভয় করছে না। গোসল সেরে অযু করে তাহাজ্জুদ নামাজে বসলাম,,,,,,,,। ফজরের নামাজ শেষ করে বাইরে বের হলাম। প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম শেষ করে রান্না বসালাম। মুহিত ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে আসে আর বলে, এখনো সময় আছে, আবারও ভেবে দেখো তুমি পারবে তো সব কিছু সহ্য করতে? পারবে তো তোমার চোখের সামনে আমাকে অন্য কারো ঘরে যেতে দেখতে,,
কারো ভেজা চুল ভেজা কাপড় দেখে নিজেকে সামলাতে পারবে ??

বুক ফেটে কান্না আসছে আমার,, আমি পারবো না কখনোই পারবো না এইসব দেখতে। কিন্তু এই কথা গুলো প্রকাশ করে বলার সময় শেষ। তাই আমি বললাম,,,

হয়তো কষ্ট পাবো কিন্তু সেই কষ্টগুলো ভুলে যাবো যখন আমাদের বৃদ্ধকালের কোন অবলম্বন আমাদের সামনে আসবে,, তুমি বাবা হবে আর আমি মা। সৎ মা হলেও আমাকে ফেলে দিবে না। নিজের সন্তানকে যে ভালোবাসা দিতাম সেই ভালোবাসা দিবো তোমাদের সন্তানকে। এতো ভালো বাসবো যে, সে বিশ্বাসই করবে না আমি তার সৎ মা। তোমাকে বাবা বলে কেউ ডাকবে এটা ভেবে, এর চেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করতে পারবো। শুধু তুমি আমাকে কখনো ভুলে যেওনা না বা অবহেলা করো না।

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মুহিত লুঙ্গি গামছা নিয়ে গোসল করতে গেলো। আমি রান্না শেষ করলাম, মুহিত গোসল সেরে খেতে আসলো। দুজনে এক সাথে খেলাম। কাল সকালে চারজন একসাথে খাবো, খাওয়ার সময় কত কি নিয়ে গল্প হবে,, এইসব ভাবছি।মুহিত বাজারে গেছে খাওয়া শেষে আর বাড়িতে আসছে দুপুরে। চুল কেটেছে, ক্লিন সেভ করেছে, দু একটা চুল পাকা ছিলো তাই চুলে কালি ও করেছে। খুব ভালো করে মুহিত কে পর্যাবেক্ষন করলাম। মুহিত নাকি বিয়েতে রাজি নাই অথচ মনে মনে এতো প্রস্তুতি দেখছি আর অবাক হচ্ছি।

আমাদের বাড়ির চারটি ঘর ই এখন আমাদের। শাশুড়ীর ঘর ফাঁকা, বড় ভাসুরের ঘর ফাঁকা, মেজো ভাসুর বাইরে থাকেন,, উনারাও আলাদা বাড়ি করবেন। আমি বড় ভাসুরের রেখে যাওয়া ঘর পরিষ্কার করছি রুনা আর মুহিতের জন্য। বাড়িতে এসেই মুহিত ব্লেড নিয়ে উঠোনের মাঝখানে চেয়ার নিয়ে বসে হাত পা-য়ের নখ কাটছে। মুহিতের এমন প্রস্তুতি দেখেই আমি ঠিক থাকতে পারছি না তাহলে আগামীতে আরো কিছু কিভাবে সহ্য করবো। অন্যদের তো দেখি কি সুন্দর মিলেমিশে থাকে। তাদেরও কি আমার মতো এমন হতো। না না এইসব হিংসাত্মক চিন্তা ভাবনা করা যাবে না। আমার মনকে আরো শক্ত করতে হবে।

ঘরে নতুন বিছানা একটা আলনা আর শাশুড়ীর ঘর থেকে একটা টেবিল দুটো চেয়ার সহ কিছু আসবাবপত্র এ ঘরে রাখলাম। মুহিতকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললাম দেখো কেমন হয়েছে। ফুল দিয়ে ঘর সাজানোর খুব ইচ্ছে করছিলো কিন্তু মানুষে আজেবাজে কথা বলবে তাই করলাম না। মুহিত বললো,, তুমি দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছো, জ্ঞান বুদ্ধি সব লোপ পাচ্ছে তোমার, যা ইচ্ছে করো কিন্তু আমাকে এইসবে জরাবে না।

বুঝলাম না কথা গুলো কতটা মুহিতের মন থেকে বলা। যে মানুষ মনে মনে এতো প্রস্তুতি নিতে পারে তার মুখে এমন কথা গুলো হাস্যকর। নিজের হাতের কাজ গুলো শেষ করে গোসল সেরে নিলাম। দুপুরেও মুহিত আমি এক সাথে খেলাম। কিছুক্ষণ পরে বড় ভাসুর এসে মুহিত কে নিয়ে গেলেন চাচাদের বাড়িতে। আমাকেও ঘর বাড়িতে তালা দিয়ে আসতে বললেন।ওখানে গিয়ে দেখি রুনার শশুর শাশুড়ী সাথে আরো দুই একজন মানুষ এসেছেন। পাড়ার বেশ কিছু গণ্যমান্য মুরব্বিরা চেয়ারে বসে আছেন। রাতে কাজি আসবেন। রুনা হয়তো ঘরে বসে আছে,, আমাকে দেখেই শিহাব ওর দাদির কাছে থেকে দৌড়ে চলে আসে। শিহাবের জন্য আনা নতুন জামা কাপড় বের করে নিজ হাতে পড়িয়ে দিলাম। নতুন জামা পেয়ে বেজায় খুশি ছেলেটা। মায়ের বিয়ে,, কথাটার অর্থ কি তা সে বুঝে না তবে বিয়েতে আনন্দ করতে হয় এটা বুঝে।

রুনার শাশুড়ী আমার উসকোখুসকো চুল দেখে আমার মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছেন। বুঝলাম শুধু তেল আমার চুলে না, চরকাতেও দিচ্ছেন। এতো আদর এতো আপ্যায়ন সইবে তো আমার কপালে। আমাদের বংশীয় কিছু বউয়েরা এসে রান্নার কাজে সাহায্য করতে লাগে। তাও তো ১৫/২০ জন মানুষ রাতে খাবে। সন্ধ্যার আগে আমি রুনার জন্য কেনা সব কিছু নিয়ে গেলাম।

রাত ৮/৯ টার দিকে কাজি আসলেন। নিজের চোখের সামনে বরের বিয়ে, বিষয় টা অদ্ভুত তাই-না!!

বুকের ভেতর কেমন যেন হচ্ছে, ধরফর করছে, নিঃশ্বাস ফেলতেও কেমন যেন লাগছে। এই যন্ত্রণার কথা গুলো লিখে বা বলে প্রকাশ করা সম্ভব না। বিয়েটা সম্পুর্ন হলো, আমি রুনাকে কাপড় পড়িয়ে দিতে দিতে বললাম,, তোমাকে আমি কখনো ননদ ভাবিনি, আর এখনো সতিন ভাববো না।আমরা সব সময় দুই বোনের মতো থাকবো। তুমি ভালো করেই জানো আমার আর মুহিতের অতীত জীবন সম্পর্কে তাই দয়া করে আমাকে কখনো নতুন করে কষ্ট দিবে না এই অনুরোধ তোমার কাছে। আমি চাই মুহিত সন্তানের বাবা ডাক শুনুক। শুধুমাত্র মুহিতের জন্য একটা নারীর সবথেকে বড় সম্পদ তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি এই সম্পদের অমর্যাদা করবে না কখনো।

খাওয়া দাওয়া শেষে মুহিত রুনা আর শিহাব কে সাথে নিয়ে আসলাম। বুঝতে পারছি না এখন আমার কি করনীয়। কাকে কি বলবো আর কে-ই বা আমাকে সান্ত্বনা দিবে। আমি তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। কান্না করবো তাও পারছি না। এই মুহূর্তে আমার চোখ দিয়ে বিন্দু পরিমাণ পানি বের হওয়াটাও অনুচিত। কিন্তু গলাটা কেমন ধরে গেছে কথা বলতে গেলেই কান্না চলে আসবে। চুপিচুপি কোন রকম রান্না ঘরে গিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। মুহিত আমাদের ঘরে চলে গেছে,, রুনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমিও চলে এসে রুনাকে ওদের জন্য তৈরি করা ঘরে নিয়ে গেলাম। রুনা বসে আছে বিছানার উপরে। আমাদের ঘরে এসে দেখি শিহাব কে নিয়ে বসে আছে। শিহাব কে নিয়ে রুনার কাছে রেখে এসে মুহিত কে বললাম ও ঘরে যেতে।কিন্তু মুহিত নাছোড়বান্দা,, ও ঘরে কিছুতেই যাবে না। এতোক্ষণের চেপে রাখা কান্না এবার অঝোরে বেড়িয়ে আসছে। আওয়াজ ছাড়া চোখ এবং নাক দিয়ে পানি বের হচ্ছে আমার। হয়তো ও ঘরে রুনার মনের অবস্থাও আমার মতো। কোন মেয়েই এমন মুহূর্তে বরকে তার বড় বউয়ের সাথে দেখতে পারবে না।

মুহিত কে বুঝিয়ে রাজি করালাম ওঘরে যেতে। যদিও জানি মুহিত ওঘরে যাওয়ার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছে কিন্তু তা প্রকাশ করছে না। মুহিতের কিছু লুঙ্গি আর শার্ট বাইরে বারান্দায় রাখছি আগেই। ওঘরে গিয়ে শিহাব কে নিয়ে মুহিত কে বললাম দরজা লাগিয়ে দিতে। আমার বিশ্বাস আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন বউ-ই তার বর কে এমন কথা বলে নি। এঘরে এসে দরজা বন্ধ করে আমি টিভি অন করে কার্টুনের চ্যানেলে দিলাম। উদ্দেশ্য ওঘরের কোন কথা বা সাউন্ড যেন আমার কানে না আসে। এই ফাঁকে শিহাব ও ঘুমিয়ে যাবে।

এভাবে কি মন কে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব?? ইচ্ছে করলেই কি ওই ঘরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেই ভাবনা গুলো দূর করা যায়। যতই চাইছি না কান বা মন ওইদিক দিতে ততই আরো বেশি যাচ্ছে। ইদুঁরের শব্দ কেও কেন যেন বিষাক্ত মনে হচ্ছে। আমার ই ভুল হয়েছে, আজ এই মুহূর্তে এ বাড়িতে আসা উচিত হয় নি আমার। এর আগেও মুহিত অন্য কারো সাথে থেকেছে কই তখন তো রাতে এমন কিছু মনে হতো না,, হয়তো দূরে ছিলাম বা অজান্তেই মুহূর্ত গুলো পার হয়ে গেছে তাই এমন তুষের আগুনের যন্ত্রণা বুঝিনি।

শিহাব ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। টিভি টা বন্ধ করতে হবে নয়তো পাশের বাড়ির মানুষজন অন্য কিছু ভাব্বে। কোন রকম সাউন্ড কমিয়ে কানের উপর আরেকটা বালিশ চাপা দিলাম। চোখে ঘুম আসার জন্য বিভিন্ন দোয়া পড়তে লাগলাম। একটু ঘুমুতে পারলেই রাত পার হবে, একটু ঘুম চাই শুধু। কিন্তু অতি সামান্য ঘুমটুকুও মনে হয় আমার জন্য বরাদ্দ নেই উপরওয়ালার কাছে।টিভির সাউন্ড,বালিশের চাপের ফাঁকেও মুহিতের ফিসফিসানি কথার সাউন্ড আমার কানে আসছে। কামাড়ের বড় হাতুড়ির আঘাত যেন আমার কলিজায় লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন বুকের ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে কলিজা ফুসফুস সহ সব কিছু বের করে নিয়ে যাচ্ছে,,

চলবে,,,

প্লিজ ছোট করে দেওয়ার জন্য কেউ রাগ করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here