#শেষ_পেইজ
#পর্ব_5
অঙ্কিতার পাঠানো রিপোর্ট গুলোতে চোখ বুলিয়ে বললাম-
-বন্যা আপুর দুই বার ডেলিভারি হয়েছে। একবার নরমাল,একবার সিজার। ক্রাইম সিনে, বাড়িতে বা আপনার গল্পে কোথায় ও তাদের পেলাম না।কোথায় বন্যা আপুর বাচ্চারা? আর কোথায় বন্যা আপুর মা বাবা? যারা মেয়ের জন্য এত কিছু করল, সে মেয়ে জেলে কোথায় তারা?
চোখ মুখ দৃঢ় করে সোজা হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে অর্পিতা বলে উঠলো,
– ওদের সবাইকে খুন করে বন্যা।
আমি অবাক হয়েই তাকিয়ে আছি অর্পিতার উপর। সাথে কিঞ্চিৎ সন্দেহ৷
-কে মেরেছে?
উনি একটু জোরেই বলে উঠলেন, বন্যা।
আমি হাসতে গিয়েও আবার আটকে গেলাম।
-বন্যা যখন আবীরের সাথে এই ধরনের ব্যবহার করতে লাগলো।তখন আবীর ঠিক করলো ও বন্যাকে ওদের বাসায় দিয়ে আসবে কিছুদিনের জন্য। কারণ আবীর সারাদিন বাইরে চলে যায়। বন্যা কখন কি বসে জানা নেই৷
আবীর ঘরে ঢুকে মাঝেমধ্যে দেখতো রান্না হয় নি। মাঝেমধ্যে দেখতো বিড়াল মরে পড়ে আছে। সারা ঘরে রক্ত। আবীর নাকি সে বিড়াল কে আদর করতো তাই।
-কেন?
-সে প্রশ্ন আবীর ও করতো। কেন? কেন এমন করে বন্যা?
বন্যা বলতো আবীর বাইরে গেলেই কোন মেয়ের সাথে সর্ম্পক করে।আবীর কে নিয়ে খুব অবসেস হয়ে গিয়েছিলো।
আবীরের এমন কোন অভ্যাস ছিলো না।
কিন্তু তাও। কখনো ফোন না ধরলে দুই মিনিট পর কল ব্যাক করলে আবীর কে তখনিই বাড়ি আসতে বলতো যতক্ষণ আসতো না ততক্ষন জিনিস ভাঙ্গতো সে।
এইগুলো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যখন চলে যায় তখন সে নিজেকে আঘাত করতে। আবীর ওকে থামাতে ওর গায়ে হাত তুলতো।
একবার ছুড়ি দিয়ে নিজের হাত কাটার চেষ্টা করছিলো। আবীর ওকে ধরতে গেলে সে ঘুরে খাটের পাশে বারি খায় আর তখন ও খুব ব্লিডিং হতে থাকে।
কেউ বুঝতে পারে নি। কি হচ্ছিলো? বন্যা জানতোই না। ও প্রেগন্যান্ট ছিলো।
আমার গলাটা আবার ধরে আসছে। অনেক কষ্টে বললাম, তারপর?
– আবীর আমাকে ফোন দিলো। ওর মা বাবাকে ফোন দিলো। ওকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। ডাক্তার বলল বন্যা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো। তখন সবাই আসলে আবীরকেই দোষ দিচ্ছিলো। আবীর ও নিজেকে দোষ দিচ্ছিলো।
তখন আবীর নিজেকে পালটে ফেলার চেষ্টা করলো। আবীর বন্যাকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি উঠলো আবারো৷ সারাক্ষণ বন্যার সাথে সাথে থাকতো।
কারণ ডাক্তার বলেছে আবীর কে নিয়ে বন্যার ভয় কাটাতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে তা কারো জন্যেই ভালো হবে না।
আবীর বন্যাকে আবার সেই প্রেমিকে মতো ভালোবাসতে লাগলো। যেমনটা বন্যা আবীরের মধ্যে পেয়েছিলো বিয়ের আগে। আবার যখন সেভাবে পাচ্ছিলো। তখন বন্যার মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করলাম। যখনিই বন্যার মনে হতো আবীর একটু করে দূরে সড়ে যাচ্ছে। তখন সে নিজের আপণ জন দের ক্ষতি করতে লাগলো। যাতে সে আবীর কে সব সময় কাছে পায় তার প্রেমিকের মতো।
কিন্তু যা একবার কাজ করে তা বার বার করে না। প্রথমে ব্যাপার টা আমরা কেউই ধরতে পারি নি।
শুরু হয়েছিলো বন্যার বাবাকে দিয়ে।
আমি ঢাকা থেকে চটগ্রামে চলে যাই। কারণ বন্যা আমাকে যে দেখতে পারে না সে আমি জানি। আবীর বের হলেই ওর মনে হয় আবীর আমার কাছে আসে। আর আমি আবার আবীর কে দূরে সড়িয়ে ফেলছি।
আমি একটা জব পেলাম ভালো একটা কোম্পানি তে। সেখানে আমার স্বামী রিহানের সাথে আমার পরিচয় আর আমাদের বিয়ে ঠিক হয়। আমিও ভেবে নিয়েছি। ওখানে বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাবো। আবীর আর বন্যার সাথে সব শেষ করে দেব।
যেদিন আমার বিয়ে হচ্ছিলো তার আগের দিন আবীরের চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা। বন্যাও সব ঠিকঠাক ছিলো। আবীর খুব যত্ন করে বন্যাকে বুঝিয়ে বের হলো। দুইদিনে সে ফিরে যাবে৷
আবীর বের হয়ে স্টেশনে আসতে পারে নি বন্যা ফোন দিলো, ওর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷
আবীর কে ছুটতে হলো। চট্টগ্রাম আর আসা হলো না। আমি আবার একা বিয়ে করলাম। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছিলাম। কিন্তু না কেউ আসে নি। রিহান আমার হাত চেপে ধরেছিলো৷ বলেছিল, চিন্তা করো না।আমি আছি।
আবীরের শাশুড়ী বলল, উনি গোসলে গিয়েছিলো। দুপুরে খাওয়ার আগে করেই বন্যা কফি খাইয়েছিলো অনেক টা জোর করে ওর বাবাকে। এত দিনে মেয়ে কিছু বানিয়েছে, না করতে পারে নি।উনিও।
এরপর ভাত খেতে বসেই কেমন যেন লাগছিলো। একটু পরেই টেবিলে মাথা রেখে হার্ট অ্যাটাক করলো৷
ডাক্তার জানালো হার্টের ওষুধের ওভারডোস হয়েছে। কিন্তু বন্যার মা বলল, উনি ওষুধ ঠিক মতো খাইয়েছেন।
আর হার্টের ওষুধ উনি খায় রাতের বেলা। সকালে খাওয়াই নি।
উনার অবস্থা ভালো ছিলো না। কিন্তু বন্যা তার বাবার পাশে না বসে আবীরের কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো।
কেমন যেন নির্ভিক, বন্যার মা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বন্যার দিকে। তা আবীরের চোখ এড়ায় নি।
আবীর ও অনেক টা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। বন্যা সমানে পা দুলিয়ে যাচ্ছে অন্য দিকে তাকিয়ে৷
– মাই গড! যদি এমন হয়, তাহলে বন্যাকে আপুকে কাউন্সিলিং করা হয় নি কেন?
-কারণ ওর যে এই সমস্যা আছে তা তো কেউ ধরতেই পারে নি।
নেক্সট বার একই ঘটনা আবার হলো, তখন বন্যা আবার প্রেগন্যান্ট হলো। আট মাসের প্রেগন্যান্ট৷ সেদিন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম।
বন্যাকে আমিই ফোন দিয়ে বলেছিলাম আমি আসবো ওকে দেখতে। আসলে আমার ওকে খুব মায়া হচ্ছিলো তখন। ভেবেছি ওর মধ্যে আমার মা কে আমি ফিরে পাবো।
আমি চাইছিলাম সব বিবাদ কেটে গিয়ে আমরা আবার এক হই।
কিন্তু আবার আবীর আমাদের আনতে যাওয়ার জন্য বের হওয়ার ঠিক আগেই সে ওয়াশরুমে পড়ে গেল বন্যা।
যখন আবীর বন্যাকে তুলতে যায় তখন দেখে সে নিজেই দাঁড়াতে পারছিল না। এত পিচ্ছিল ছিলো ওয়াশরুম। কিন্তু সে একটু আগেই তা ঝকঝকে করে এসেছিল ওয়াশরুম।
আবীর তখন না বুঝলেও অনেক দিন পর সে বুঝলো।
বেবিটা পুরো তৈরি তো হয়ে গিয়েছিলো। তাই ডেলিভারি করানো হলো।
কিন্তু বাঁচানো গেল না।
আবীর খুব কেঁদেছিলো। কিন্তু বন্যা এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে নি। আবীর কে জড়িয়ে ধরে কিস করতে চায়ছিলো। আর বলছিলো,
-এখন তো বেবি নেই৷ কারো ক্ষতি হবে না। ভালোবাসো না একটু৷
আবীর এত টা অবাক হয়েছিলো।
সেইম কাজ সে আবার করেছিলো যখন তিন বছর পর সে আবার প্রেগন্যান্ট হলো।
দুই বারেই মেয়ে হয়েছিলো। কিন্তু আমরা আর পেলাম কই?
এই বলেই অর্পিতা কেঁদে উঠলো। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
-একটা প্রশ্ন ছিলো৷
সে কান্না মুছে বলল, বলুন।
আমি রিপোর্ট টা সামনে ধরলাম। গলা খাকিয়ে বললাম,
-আপনি বন্যা আপুকে দেখতে পারতেন না। বন্যা আপুর কারণে আপনাদের জীবন নরক হচ্ছিলো। মা বাবা ভাই সব হারালেন। তাহলে আপনার কেন মনে হতো বন্যা আপুর বাচ্চা দিয়ে আপনি মা ফেরত পাবেন। আপনার নিজের বাচ্চাদের মধ্যে কেন নয়? কেন এমন একটা মেয়ে গর্ভে জম্ম নেবে কোন সন্তান, আর তাতে আপনি মা খুজঁবেন তা কীভাবে আসে?
স্বাভাবিক ভাবে মাকে আপনি বেশি দেখেছেন আপনি আশা করবেন। মা আপনার কাছেই আসবে। কেন ভাইয়ের বাচ্চাতে তা খুঁজতে যাবেন? আপনার নিজেরেই তো দুইটা সন্তান তা না?
উনি কেমন যেন আটকে গেলেন। মনে হচ্ছিলো গল্প ইমোশনাল বানাতে গিয়ে ভুল লাইন বানিয়ে ফেলেছেন।
উনি আমতা আমতা করে বললেন,
-আসলে মা আবীরকে বেশি ভালোবাসতো তো?
এইবার আমি হুংকার দিয়ে উঠলাম,
-মিথ্যা। সব মিথ্যা।
সে ভয় পেয়ে গেল৷ আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে খানিকটা ঝুঁকে বললাম।
-বন্যা আপুর বাচ্চারা মারা যায় নি। তারা আছে আপনার কাছে। আপনার বাচ্চা হয়ে।
দুইটা মেয়ে নয়। একটা ছেলে একটা মেয়ে।
আপনার মিজক্যারেজ হয়েছিলো। সতীনরা পেটে লাথি মেরেছিলো৷ তাই আপনি আর কখনো মা হতে পারবেন না। তাই বন্যা আপুর বাচ্চার মধ্যে মা খুঁজতে চেয়েছেন।
ওরা মারা যায় নি। আপনি তাদের চুরি করেছেন। বন্যা আপুর সংসার শেষ করেছেন। আপনি। আবীর ভাইয়াকেও আপনি খুন করতে চেয়েছেন।।
অর্পিতা এইবার ভয়ংকর রেগে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-থামুন, হ্যাঁ, ওরা আবীর আর বন্যার বাচ্চা। কিন্তু আমি বাচ্চা চুরি করি নি৷ আবীর নিজেই আমাকে ওদের মানুষ করতে দিয়েছে। সে চায় নি বন্যার মতো মেয়ের কাছে ওর বাচ্চারা থাকুক। কোন দিন ওদের কেটে না মাংস রান্না করে আবীর কে খাইয়ে দেয়।
এই মেয়ে সব পারতো।
এই বলে ফোপাঁতে লাগলো অর্পিতা।
-আর আপনি কীভাবে বলতে পারেন আমি আমার ভাইকে এমন নৃংসশ ভাবে খুন করার চেষ্টা করব?
আমি থেমে গেলাম, বসে পড়লাম। পানি খেলাম, চেয়ার হেলান দিয়ে অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-জানি আপনি করেন নি, আমাদের ট্রেনিং এ আছে ছোট মিথ্যা বের করতে বদ অপবাদ দিতে হয়।
-চলবে।