#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ৩) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা
ছয়.
অন্বেষাকে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালো আবিদ,
“কেমন আছো? তুমি বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট হবে, তাই তুমি বলাটাই সমীচীন মনে হলো। কিছু মনে করোনি তো?”
অন্বেষা একটুখানি তাকিয়ে কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলল, “আপনি কিংবা তুমি নিয়ে আমার কোনো এলার্জি নেই, তাই এক্সকিউজের ইলাবোরেশনের প্রয়োজন নেই। যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাই বলতে পারেন।”
আবিদ আরেকবার চমৎকৃত হলেও প্রকাশ করল না, এই মেয়ের বয়স ছাব্বিশ কী সাতাশের বেশি হবার কথা নয়, তার বয়স একচল্লিশ। এই ব্যবধান খুব একটা বিচলিত করেনি মেয়েটিকে বরং যথেষ্ট সাবলীলভাবে কথা বলছে।
“চা বা কফি দিতে বলি? তোমার কথা বলতে হয়তো সুবিধা হবে!”
অন্বেষা মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো, মুখে কিছু বলল না। আবিদের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে দেখল একপলক। এর আগে ছবিতে অথবা টেলিভিশনে কিছু সভা সেমিনারের ফুটেজে যেটুকু দেখেছিল, সামনাসামনি তার থেকে অন্যরকম লাগে।
ব্যাক্তিত্বের প্রখরতা ভালোমতো অনুধাবন করা যাচ্ছে, আর সত্যিকারের বয়সের চেয়ে অনেক কম লাগছে। মনে হচ্ছে এখনো তারুণ্যেই বিচরণ তার। এই প্রখর ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন চিরতরুণ লোকটির সামনে কিছুটা মৃয়মান লাগছে নিজেকে, সেটা ঢাকা দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। কিছুতেই নিজের ভাবমূর্তি খর্ব হতে দেয়া যায় না, তাই একটু ডাট দেখিয়ে ঠাঁট বজায় রাখার চেষ্টা। আবিদ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী যেন তোমার নামটা? আমার একটা বদ অভ্যাস হচ্ছে আমি স্বল্প পরিচিত কারো নাম মনে রাখতে পারি না।”
অন্বেষার দৃঢ় জবাব, “আমি নামটা আপনাকে এর আগে বলিনি, তাই মনে রাখার প্রশ্ন এখানে আসছে না। আমি অন্বেষা আহমেদ। ”
“তো অন্বেষা, বলো কী বলবে?”
পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল আবিদ। কারো দৃষ্টি যে এতটা প্রখর হতে পারে জানা ছিল না ওর। মনে হচ্ছে উত্তর না দিলেও কিংবা প্রশ্ন না করলেও নিজে নিজেই সেসব বুঝে নিয়ে উত্তর দিতে পারবে বুঝি। ওর ভেতরের বিচলিত ভাবটা হয়তো বেশিক্ষণ লুকানো যাবে না।
“আপনার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অনেক কিছু জানার আছে, তাই একটা ইন্টারভিউ করতে চাই আপনার?”
আবিদ ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,
“অন্বেষা, দেখো, তুমি হয়তো জানো যে আমি এসব থেকে দূরে থাকি বরাবরই। আমি নিভৃতচারী মানুষ, আড়ালে থাকতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তোমাকে নিরাশ করতে হচ্ছে বলে আমি অত্যন্ত দু:খিত। কফিটা শেষ করে চলে যাও।”
ঠোঁটের কোণের হাসিটা কিঞ্চিৎ বিস্তৃত এখন, অন্বেষা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এই লোকের হাসি এতটা মারাত্মক যে সহসা চোখ ফেরানো দায়! কত শত তরুণী যে এই হাসিতে মরবে লোকটা নিশ্চয়ই এটা সম্পর্কে অবগত নয়! অবগত হলে এতটা গাম্ভীর্য ধরে রাখতো না নিশ্চয়ই!
কিন্তু পরমুহূর্তেই আবিদের বলা কথাটা বোধগম্য হলো, আর মুগ্ধতা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। মুগ্ধতা সরিয়ে জায়গা দখল করে নিল ওর চিরন্তন আবেগী রাগ আর জেদ।
“তাহলে আমাকে ভেতরে কেন ডেকেছেন? তামাশা করার জন্য? আমি ইন্টারভিউ না নিয়ে এখান থেকে ফিরব না।”
হাসি ধরে রেখে আবিদ বলল, “কিশোরী মেয়েদের মতো জেদ করছো কেন? এতটা ছেলেমানুষী করার বয়স কি তোমার আছে এখন?”
“আমি অনেক কিছুই পারি, মানালো নাকি বেমানান হলো সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আপনি ইন্টারভিউ দেবেন, এটাই শেষ কথা!”
সাংবাদিকতার খোলস থেকে বেরিয়ে খেলনার জন্য বায়না ধরা শিশুর মতো আচরণ করছে ও। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আবিদ বলে,
“তোমার বয়স কত?”
“যতই হোক, কারও বয়স জিজ্ঞেস করা অভদ্রতা আপনার জানা থাকার কথা নয় কি?”
“আরও অনেক কিছুই অভদ্রতা। এই যে তুমি এভাবে আমার পিছু নিয়ে চলে এলে, আমার প্রাইভেসি নষ্ট করলে, সেটাও অভদ্রতা। আমি ইচ্ছা করলেই লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে পারি। আমি ইন্টারভিউ না দিলে তুমি আমাকে ফোর্স করতে পারো না, এটাও কোন ভদ্রতা নয়।” কঠিন স্বরে বলল আবিদ।
“দেখুন, একটা ইন্টারভিউই তো, দিলে কী এমন ক্ষতি হবে আপনার?” কাতরতা ঝরল গলায়।
“শোনো মেয়ে, এই কয়েকদিনে তোমার অনেক তামাশা সহ্য করেছি। কিন্তু এখন তুমি সীমা পেরিয়েছো। তুমি এই মুহূর্তে তোমার ওই বন্ধুকে নিয়ে বিদায় হবে। আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না।”
অন্বেষার সম্বিৎ ফিরল যেন, এতক্ষণ ওর করা কাণ্ডগুলো মনে হতেই মাটিতে মিশে গেলো লজ্জায় আর অপমানে। নিজের উপরেই চরম মেজাজ খারাপ হলো, নিজেকে এতটা খেলো করল ভেবে৷
কেন যে এরকম হুটহাট রোখ চেপে যায়, আর এমন আচরণ করে ফেলে, পরে নিজেকেই লজ্জিত হতে হয়! এই বিষয়টা এখনো ঠিক বোধগম্য হয় না ওর। কিন্তু হিতাহিত জ্ঞান থাকে না সেসময়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মেজাজের। চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চেপে রাখা কান্না কিছুতেই লুকাতে পারলো না। অশ্রু গড়িয়ে পরল গাল বেয়ে। ওর মা যখন চলে যায় তখন কয়েকদিন কেঁদেছিল, আস্তে আস্তে যখন বুঝতে শিখেছে তারপর আর কোনোদিন কাঁদেনি।
আজ এতগুলো বছর পর অশ্রুর সাথে নতুন করে সাক্ষাৎ হলো। আশ্চর্য, এত জল সঞ্চিত ছিল চোখে! প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।
সাত.
অন্বেষা বেরোনোর পর দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল নয়টা সাতাশ বাজে। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুটো, এখন যাওয়াটা একদমই নিরাপদ নয়। আবিদের মনে হচ্ছে, এতটা রূঢ়ভাবে না বললেও হতো। মেয়েটি তার জন্যই এতদূর এসেছে, কিছুটা হলেও দ্বায়িত্ব বোধ বর্তায় তার উপরেও। যদিও প্রফেশনাল কারণেই এসেছে, তবুও প্রচন্ড জেদি আর একরোখা মেয়েটির জন্য কিঞ্চিৎ বিচলিত বোধ করলো। সোহানকে ডেকে ওকে আটকাতে বলল।
আবিদের এই সিদ্ধান্তে সোহান নাখোশ হলো ভীষণরকম। বলেই ফেললো,
“স্যার, আপদ যখন নিজে নিজে বিদায় হয়েছে, তারে আবার ইনভাইটেশন কার্ড দিয়ে নিয়ে আসার কী দরকার? তাছাড়াও মেয়েদের প্রধান অস্ত্রই হলো গিয়ে কান্নাকাটি। এরা আরকিছু পারুক আর না পারুক কিছু বললেই চোখ দিয়ে পানির কল চালু হয়।”
“তুমি কি জানো যে তুমি বেশি কথা বলো?” উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রাগত স্বরে বলল আবিদ।
“জ্বি স্যার, জানিতো। আব্বা বলে সবসময়, মাও বলে, আরও…… ”
বাকিটা বলতে না দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আবিদ বলল, “তোমার ফালতু কথা শোনার কোনো ইচ্ছে কিংবা সময় কোনোটাই নেই। দ্রুত যাও আর ওকে থামাও, বলো যে আমি ইন্টারভিউ দেব।”
দ্বিতীয় বারের মতো ওর চোখ কোটরাগত হলো, ওর স্যারের মতিভ্রম হলো কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। আজ পর্যন্ত যেই সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছে আজ সেখান থেকে সরে এসেছে, তাও একটা ফাজিল মেয়ের কান্নাকাটিতে। এত ভালো হবার কী প্রয়োজন ছিল বুঝতে পারে না! কিন্তু ওর এখন কিছু করার নেই, এই লোকটাকে ও অতি পছন্দ করে, সমীহটাও এসেছে শ্রদ্ধা থেকেই। ভগ্ন হৃদয়ে তাই থামাতে যায় অন্বেষাকে।
অন্বেষা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছিল, আর আনন্দকে খুঁজছিল আশেপাশে। হঠাৎ চোখ গেল সোহানের দিকে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে ওর দিকেই। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,
“স্যার আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন, উনি ইন্টারভিউ দেবেন।”
অন্বেষা সহসা কথাটা বুঝে উঠতে পারল না, কিছুটা সময় লাগলো ব্যাপারটা অনুধাবন করতে। কতটা কাঠখড় পুড়িয়ে তবে এলো কাঙ্ক্ষিত সুযোগ! ভেতরে ভেতরে উল্লাসে ফেটে পরলেও বাইরে প্রকাশ করল না। অপমানটা যে এখনো বড্ড তাজা!
ভেতরে আসতেই আবিদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস সন্তর্পণে গোপন করল।
“জার্নি করে এসেছো, নিশ্চয়ই ক্লান্ত, ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। ডিনার শেষে আমরা বসব বরং। তোমার বাসায় আর অফিসে জানিয়ে দাও নাহয়।”
“আমি থাকব না। ইন্টারভিউ নিয়েই চলে যাব, তাই বিশ্রামের কোনো প্রয়োজন নেই। ”
আবিদের বিরক্তি এবার আকাশ ছুঁয়েছে যেন,
“এখন দশটা বাজে প্রায়। কোনো বাজে কথা শুনতে চাইছি না।”
সবিতা নামের একজনকে ডেকে ওকে থাকার জায়গা দেখিয়ে দিতে বলল।
“ওর নাম সবিতা, এখানকার দ্বায়িত্বে আছে। আজ রাতটা ওর সাথে থাকলে খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। অন্তত রাস্তাঘাটে থাকার চেয়ে ভালো থাকবে।” বলেই বেরিয়ে গেলো।
আশ্চর্য, এতটা অধিকার কোথায় পেলো এই লোকটা! ভাবতে ভাবতে সবিতার সাথে গেলো।
রাতে ওরা বাইরে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে বসল, দুই পাশের সিঁড়িতে কিছুটা দূরত্ব রেখে মুখোমুখি। আকাশে তখন পরিপূর্ণ চাঁদ, জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। জোছনার বৃষ্টি যেন! ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কানে ঝিম ধরে আসছে। ওইতো পুকুরের পাশের ঝোপের ভেতর সহস্র জোনাকির মেলা বসেছে যেন! সব মিলিয়ে পরিবেশটা অপার্থিব, অতিপ্রাকৃত লাগছে। অদ্ভুত সুন্দর আবহ তৈরী হয়েছে।
মোহাবিষ্টের মতো প্রকৃতির সম্ভাষণ উপভোগ করছে। দূরে কোথাও কতগুলো শেয়ারের হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো অন্বেষা। এই অদ্ভুত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেবার জন্যই শুধু এই লেখক সাহেবের বৈরী আচরণ ক্ষমা করে দিল মনে মনে।
আর আবিদ ভেবে চলছে এতদিন চেপে রাখা সত্যটা সবার সামনে এবার হয়তো প্রকাশ করতেই হবে নাকি জীবনের নির্মম সত্যিটা পাশ কাটিয়ে কথোপকথন শেষ করবে!
কিন্তু মিথ্যে বলতে যে একেবারেই অপারগ ও। আবার একটা মেয়ের অমানবিক পরিনতির দায় কীভাবে প্রকাশ করবে সেটাই ভেবে যাচ্ছে!
কারো তুমুল আহবানে সাড়া দিলে হয়তো বা পরিণতিটা এড়ানো যেতো, ওর বসন্তও রঙিন হতো তবে। কিছুটা দ্বিধা আর সংকোচ এসে ভর করলো আবিদের মনে।
……..
(ক্রমশ)