#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ২) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা
তিন.
সোহান আজ প্রায় তিন বছর আবিদ শাহরিয়ারের ম্যানেজার হিসেবে আছে। এখন সে ইতস্ততভাবে দাঁড়িয়ে আছে আবিদের লাইব্রেরি ঘরের সামনে। এতগুলো বছরেও জড়তাটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কেন জানি এই লোককে দেখলেই বুক ঢিপঢিপ করে, অথচ কখনো উঁচু গলায় কথাও বলেনি ওর সাথে। কিছু কিছু লোক থাকে যাদের দেখলে একদম হৃদয়ের গভীর থেকে সমীহ চলে আসে, শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। আবিদ, সোহানের জন্য ঠিক তেমনই একজন । দ্বিধা কাটিয়ে নক করল দরজায়, আবিদ তখন নিবিষ্ট চিত্তে কলম চালানোয় ব্যস্ত। মুখে বরাবরের মতই ধরে রাখা গাম্ভীর্য। কী এক গভীর বিষাদে নিমজ্জিত থাকে সবসময়! এত ভালো একটা লোকের এতটা কষ্ট কেন থাকবে ভেবে পায় না ও!
লিখতে লিখতেই প্রবেশের অনুমতি দিল, কাচুমাচু মুখে কাছে এসে দাঁড়ালো সে।
আবিদ জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে?”
‘স্যার, ওই রিপোর্টার মেয়েটা ত্যক্ত করেই যাচ্ছে। কোনো কথাই শুনছে না, কী করবো স্যার? ”
আবিদ নীরস ভঙ্গিতে চোখ তুলে বলল,
“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? তুমি নিজেই সমাধান করো। আর দ্রুত বিদায়ের ব্যবস্থা করো।”
“স্যার, যদি বলেন তাইলে একটা রামধমক দেই? এরা ভালো কথার মানুষ না, থাপড়ায়ে বিদায় করতাম, কিন্তু তার ভাগ্য ভালো সে মেয়ে তাই অল্পের উপরেই ছেড়ে দেওয়া লাগবো, কী বলেন, স্যার?”
“এই মুহূর্তে তোমার এইসব উদ্ভট কথাবার্তা শুনতে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই। এক্ষুণি বিদায় হও।” গলায় ঝাঁঝ।
“জ্বি স্যার। বিদায় নিতেছি। কিন্তু স্যার রামধমক কি দিবো?”
কথা শেষ করে আবিদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বাড়ানোর সাহস পেল না, সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো।
আবিদ এই ছেলেটিকে বেশ পছন্দ করে, একটু হম্বিতম্বি করলেও অত্যন্ত বিশ্বস্ত, নিশ্চিন্তমনে ভরসা করা যায়, কিছুটা বোকাসোকাও। মেয়েটাকে বিদায় করার পরেও অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। কীভাবে এই মেয়েকে নিরস্ত করা যায় তাই ভেবে অস্থির সে!
সোহান বেরিয়ে যাবার পরপরই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও মগ্ন হলো লেখাতে, যে লেখায় ঝরছে ওর হৃদয়ে জমানো গভীর বিষাদ। হৃদয়ে কী এক পাথর চাপা যন্ত্রণা ওকে অনবরত দগ্ধ করে! মর্মপীড়ায় পোড়ায় তীব্র অনুশোচনা। ক্ষণে ক্ষণে চোখে ভেসে উঠে কোন এক অষ্টাদশীর অশ্রু সজল চোখ, যে চোখে ছিল তীব্র আকুতি আর গভীর চাওয়া।
সেই অতল ভালোবাসা হাত বাড়িয়ে নেয়া হয়নি তার, নিতান্ত অনিচ্ছায় কিংবা অপারগতায়! সেই ছিল শেষ দেখা। অপরাধবোধ দগ্ধ করে প্রতিনিয়ত, এতগুলো বছর ধরে এই দহন তার নিত্যকার সঙ্গী।
চার.
তিন দিন পার হলেও আনন্দ এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো খবর দিতে পারেনি। লেখক সাহেব নাকি বেরই হয় না। আনন্দকে লাগিয়ে রাখলেও নিজে হাল ছাড়েনি, অনবরত কল করেই যাচ্ছে অন্বেষা। এখন নিজের উপরেই বিরক্ত লাগছে, একটা ইন্টারভিউ নেবার জন্য এতটা ডেস্পারেট হওয়া ওর ব্যাক্তিত্বের সাথে যায় না। কিন্তু নিজের জেদ বজায় রাখতে হাল ছাড়েনি। নিজেকে কেমন যেন ছ্যাচড়া মনে হচ্ছে। আশ্চর্য, এতটা হ্যাংলা তো কখনো ছিল না ও! ব্যর্থতা কী তা কখনো দেখেনি ও, দেখতেও চায় না। তাই এই লেগে থাকা।
তার উপর ম্যানেজার ব্যাটার উপরে অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ, এই মাথামোটা লোকটা ওকে আজকেও অনেক কথা শুনিয়েছে৷ আনন্দকে তাই এই লোকের উপরেও নজর রাখতে বলেছে।
অফিস থেকেও জানিয়েছে ওরা কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না । উল্টাপাল্টা কিছু করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, কোনো মামলার মুখোমুখি হতে চায় না কর্তৃপক্ষ। অন্বেষা মনে মনে বলল,
“কোনো দায় নেবে না আবার ফলটা ঠিকই নিতে পারবে।”
ষষ্ঠ দিনের মাথায় আনন্দের ফোন পেল,
“শোন, তোর এই ইনভেস্টিগেশনের চক্করে খালি ঘুরতেছি, কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। একটু আগে উনার ম্যানেজার বের হইছিল, ওরে ফলো করলাম। সে একটা উইমেন ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে গেছিল। হয়তো ডোনেশন দিতে। ও বের হওয়ার পর আবার ফলো করলাম, আরেকটা ফাউন্ডেশনে গেলো, এরপর আরেকটাতে।”
“সেখানে জিজ্ঞেস করিস নাই? ”
“করছিলাম, কিন্তু ওরা ডোনারের পারমিশন ছাড়া কনফিডেনসিয়াল ব্যাপার লিক করে না, কিন্তু একটাতে আমার ফ্রেন্ডের ওয়াইফ আছে। ওকে জিজ্ঞেস করার পর প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করলো যে আবিদ শাহরিয়ার সেখানে মোটা অংকের টাকা ডোনেশন দেয় কয়েক বছর ধরেই।”
“এত লুকোচুরি কেন? এতে এতোটা গোপনীয়তা কেন বুঝতেছি না!”
“শোন, সোর্স প্রকাশ করিস না, বেচারি বিপদে পড়ে যাবে। ওদের এগ্রিমেন্টের মেজর কন্ডিশনই ছিল এটা।”
“আরে না! ওর নাম আসবে না। কনফিডেনসিয়াল ফ্যাক্ট আমরা অনেক ডিল করি। তুই টেনশন নিস না। তুই তোর কাজ করতে থাক।”
ফোন রেখে চিন্তায় ডুবে যায় অন্বেষা, কিছু একটা তো আছেই। দুইয়ে দুইয়ে চারটাই মেলাতে পারছে না!
পরের দিন বিকেলে হঠাৎ আনন্দ জানায় প্রতিদিনের মতো ফলো করছিল, কিন্তু ওদের গন্তব্য এবার শহরের বাইরে। লেখক নিজেও আছেন, সাথে ড্রাইভার আর ম্যানেজার।
“তুই চেজ করতে থাক, আর আমাকে জানা, আমিও আসছি।”
“মানে কী! তুই আসবি কেন? একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হবে। এটা তোর খামখেয়ালি করার জায়গা না, অনেক রিস্কি!”
“তুই তোর গার্ডিয়ান মার্কা কথা আমার সাথে বলবি না। আই ক্যান প্রটেক্ট মাইসেল্ফ। আর তাছাড়া তুই তো আছিসই। ” উত্তেজিত গলায় বলল ও।
“অন্তত অফিসের কাউকে সাথে নে!”
“অফিস থেকে তো বলেই দিয়েছে কোনো সাপোর্ট দেবে না। এইসময় বললে হয়তো দেবে। কিন্তু এটা আমার আত্মসম্মানের প্রশ্ন, এত কথা শোনার পরে ওদের কাছে কিছুতেই সাপোর্ট চাইব না।”
“কিন্তু তুই ওদের এমপ্লয়ি, তোর সেফটি দিতে ওরা বাধ্য। ”
“দিলেও নেবো না, তুই লোকেশন জানাতে থাক।”
“তোর জেদ এত বেশি কেন? এতে ক্ষতিটা কার?”
ওর কথা কানেই তুললো না অন্বেষা, ফোন রেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো।
গাড়ি যখন শহর ছেড়ে মফস্বল পেরিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল, তখন গোধূলির রক্তিম আভা পুরো আকাশ জুড়ে, মাগরিবের আযান ভেসে আসছে দূরের মসজিদ থেকে। চারপাশে যান্ত্রিকতা নেই খুব একটা। এসি বন্ধ করে গ্লাস নামিয়ে দিতেই একরাশ নির্মল বাতাস ঢুকে পরল হুহু করে। সহসা মন ভালো হয়ে গেলো অন্বেষার।
গন্তব্যের কাছাকাছি এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন, ওইতো আনন্দ দাঁড়িয়ে আছে।
পাঁচ.
সোহান দাঁড়িয়ে ছিল একটা পাকা দেয়ালের টিন শেড ঘরের বাইরে, হঠাৎ করেই সামনে অন্বেষাকে দেখে হকচকিয়ে গেল ব্যাপকভাবে। কত্তবড় শেয়ানা এই জার্নালিস্ট, রাত-বিরেতে এখানে চলে এসেছে! ওর খুব রাগ হলো আবিদের উপরে, রামধমক দিলে এতক্ষণে বাপ বাপ করে পিছু ছাড়তো, আবিদের জন্য সেটা পারলো না। ভীষণ আফসোস হচ্ছে ওর। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেউ থেবড়ে দিয়েছে, এক্ষুণি রাগে ফেটে পরবে যেন!
“কী খবর সোহান সাহেব, কেমন আছেন? আপনার হাসিটাতো খুব সুন্দর! ”
সোহানের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল অন্বেষা। এই লোক ওকে কথা শুনিয়েছে, কিছুটা ফাঁপড় তো নেয়াই যায়।
“আপনার স্যারকে ডাকেন, একটু কথা বলি, নাকি অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন? এখানে নিশ্চয়ই সিনক্রিয়েট চাইবেন না তিনি?” তাচ্ছিল্যের সুরে প্রশ্ন ছুড়লো।
সোহান হা হয়ে যাওয়া মুখটা বন্ধ করে কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। ওকে প্যারাটা কিছুটা হলেও ফেরত দিতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছে অন্বেষা।
আবিদ কয়েকটা শিশুর সাথে সময় কাটাচ্ছিল, কিছুটা সময়ের জন্য পারিবারিক আবহ তৈরী করতে চেষ্টা করছিল পরিবারহীন বাচ্চাদের জন্য। এরমধ্যেই হন্তদন্ত ভাবে সোহানের আগমন, বুঝতে পারে গুরুতর কিছু অবশ্যই।
“কী ব্যাপার, কোনো সমস্যা? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
“শুধু সমস্যা না, একেবারে মূর্তিমান আতঙ্ক। স্যার, ওই জার্নালিস্ট এখানে এসে পরছে।”
“কী বল, তার তো জানার কথা নয়?” কিছুটা বিস্ময় গলায়।
“স্যার, সে বলছে আপনার সাথে কথা না বলে সে যাবে না। তাড়ানোর চেষ্টা করলে সিনক্রিয়েট করবে!”
বাচ্চাদের ভেতরে যেতে বলে সোহানকে বলল, “ভেতরে আসতে বল, কথা বলি। শুনি কী বলতে চায়!”
শুধুমাত্র ইন্টারভিউ নেবার জন্য যে এতটা ডেস্পারেট হতে পারে তাকে তো দেখতেই হয়, কৌতুহল বোধ করল আবিদ। এই মেয়ের লেগে থাকার ব্যাপারটা কেন যেন ভালো লেগেছে ওর। মনে করিয়ে দিচ্ছে ফেলে আসা কাউকে, যে প্রগাঢ় হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল তাকে, যাকে হারিয়ে ফেলেছিল নিতান্ত অবহেলায়। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চিঁড়ে, যা এখন তার নিত্যসঙ্গী।
বিস্ময়ে দুচোখ কোটরাগত সোহানের, “স্যার, আপনি কথা বলবেন? বলেন তো আমি খেদানোর ব্যবস্থা করতেছি?”
ঠান্ডা গলায় আবিদ বলল, “তোমাকে কিছুই করতে হবে না, উনাকে ভেতরে পাঠাও। বাকিটা আমি নিজেই দেখছি।
সোহান মাথা নেড়ে বাইরে বেরোতে বেরোতে মনে মনে বলল,
“এত ভালোমানুষি দেখানোর দরকার ছিল না। এই ফাজিল মেয়েকে আমি একাই সাইজ করতে পারতাম! কত্তবড় সাহস, আমারে দৌড়ের উপরে রাখছে।”
যদিও কিছুই করতে পারবে না, মনে মনেই ওর যত আস্ফালন!
নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে কিছুক্ষণ সময় নিল অন্বেষা, এত কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সফল হলো তবে! ভেতরে প্রবেশের সময় মনে দোলাচল, কয়েক দিনে জমানো সকল প্রশ্নের উত্তর মিলবে কিনা, নাকি এড়িয়ে যাবে নির্দ্বিধায়!
……….
(ক্রমশ)