গল্প

পর্ব পাঁচ এবং শেষ পর্ব

নীল ধ্রুব তারা

শাহানা জেসমিন
_______________________

আমি বসে আছি টিভি রুমে।একটা টক শো চলছে।লাল গোলাপ টক শো।এখানে একজন কর্মজীবী মায়ের সঙ্গে গল্প হচ্ছে। এ মায়ের জীবনের গল্প। একজন মা চাকুরী , সন্তান লালন পালন,সংসারের যাবতীয় কাজ কর্ম করে অফিস, বাসা সামলাচ্ছে। অনেক মায়েরা শুধু সন্তান কার কাছে রেখে যাবেন এ ভরসা থাকেনা। এজন্যই চাকুরী ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যথেষ্ট পরিমানে ডে কেয়ার নেই কিংবা ডে কেয়ার এ ভরসাও করা যায় না। দেশের উন্নয়নে সামগ্রিক ভাবে মেয়েদের ও ভুমিকা অনেক। আজকাল এক জনের ইনকামে সংসার চালানো কঠিন এসব বিষয় আলোচনা হচ্ছে। একজন কর্মজীবী মা কত নিগ্রহের শিকার হন,এসব উত্তরনের কি উপায়।এসব আলোচনা হচ্ছে।

আমি অনেক ক্ষন অনুষ্ঠান দেখলাম। হঠাৎ করে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গেলো। আহা মা কতকাল তোমাকে দেখি না। কত কাল তোমার স্পর্শ নেই মা জননী!!

যদি ও আমার ফুপ্পি আমাকে নিয়ে তার সন্তানের সাধ মিটিয়েছেন। আমি তার শূন্য স্থান পূরণ করেছি কিন্তু আমার শূন্যতা রয়েই গেছে। আমার মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো।তামান্না এলো আমার কাছে।
বলল,

তুই মন খারাপ করে আছিস,এসব টকশো আর দেখবি না বললাম কিন্তু। তুই অন্য রকম হয়ে যাস । কালকে ক্লাসে ম্যাম যে গল্প বলল,আমাকে সে গল্পটা বল।চল নিচে যাই, সাইকেল চালাবো দুজনে আর গল্প শুনবো।

তামান্না অন্য সেকশনে পড়ে।

তামান্না ইদানীং সাইকেল চালানো শিখে গেছে। আমি আর তামান্না মাঝে মাঝে জো বাইকে চলি। আমাদের হলের সামনে ভিতরে বেশ খোলা জায়গা আছে।সেখানে সাইকেল চালাই।আজ ফকফকা জোৎস্না । আমি বললাম চল।

আমি গল্প টা শুরু করলাম।

রাজা প্রতাপাদিত্য তার রাজ্যের চন্দ্র দাসকে প্রধান বিচারক বানাতে চাইলেন।কিন্তু তিনি বললেন,
আমি উপযুক্ত লোক নই। কারণ আমি বিচার কার্য শুরু হলে হয় আমি থাকবো নয়তো আপনার আইন কানুন সমাজ ধর্ম থাকবে। তবুও রাজা তাকে বিচারকের দ্বায়িত্ব দিলেন।

তামান্না বলল,

তারপর কি হলো,

——-একদিন এক লোক কে ধরে আনা হলো চুরির অপরাধে।চোর এক ধনীর অর্ধেক সম্পদ সে চুরি করছে। চোর এবং সেই ধনী লোক কে ছয় মাস করে জেল দেয়া হলো। ধনী লোকটি বলল,
আমার কি অপরাধ?

বিচারক বললেন,
চোরের প্রতি অবিচার হচ্ছে,সে চুরি করেছে কারণ তার কিছু নেই বলে।

_____বলিস কি তামান্না বলল,

——বিচারক বললেন,

—–আপনি যা জমিয়েছেন, তা কাউকে না কাউকে বন্চিত করে। অবশ্য আইন আপনার পক্ষে ছিল। সমস্যা টা আইনের চোরের নয়। কারন আপনার অধিক সম্পদ জমানোর লোভ এদের কে চোর বানিয়েছে। অপরাধ টা আপনার ও।

—–কি আশ্চর্য , এতো সুন্দর একটা গল্প। ম্যাম তোদের শুনিয়েছে।

আমি বললাম, হুম।

তামান্না অনেক জোরে সাইকেল চালাচ্ছে। আমি ও তামান্না র সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি, কিন্তু মনটা পরে আছে ম্যাম এর কাছে। আমি আর তামান্না প্রায় ই জো বাইকে করে কার্জন হলের সামনে পর্যন্ত যাই।

**

আজকে আমি সেই ডাক্তার ম্যাম এর চেম্বারে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
________কি আশ্চর্য তুমি এসেছো। অথচ দেখো তোমার নামটা সেদিন শোনা হয় নি। কি নাম তোমার ? আর তোমার যে নামই হোক না কেন, আমি তোমাকে নীল বলেই ডাকবো, কেমন।

আমি বললাম,
—— ম্যাম আমি দেবযানী, আমার আর একটা নাম আছে মুগ্ধ। আমি আমার বাবার দেয়া নামটা পাল্টে ফেলেছি। সে গল্প আর এক দিন এসে বলব আপনাকে। আমি একটা নক্ষত্র খুঁজছি অনেক বছর, নীল নক্ষত্র।

———– কি আশ্চর্য , নাম পাল্টে দিয়েছো। আচ্ছা সব গল্প শুনবো তোমার। আর আমাকে তুমি মম ডাকবে,কেমন। আমি ভিষন একা, নিঃসঙ্গ। আমার কেউ নেই। আমি বড় হয়েছি একটা হোমসে। নীল ও চলে গেলো। সে তখন খুব ছোট। এখন তোমার বয়সের হতো। তখন নীল আট বছর বয়সী। খুব মেধাবী ছিল। একদিন বাথরুমে গেলো। হঠাৎ পড়ে যায়। ব্রেন হেমারেজ হয়। মৃত বের করে আনা হয়,দরজা ভেঙে।

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মম কে জড়িয়ে ধরে থাকলাম অনেক ক্ষন। আমি বিরবির করে বললাম,
—-মম আপনার নীলের বাথরুমে পরে মৃত্যু র সঙ্গে অঋব অনুসুর্যের অবিকল মিল আছে। ছোট্ট অঋব ও খুব মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল। সেও আপনার নীলের মতো প্রচুর গল্পের বই পড়তো। সেও একদিন বাথরুমে পরে মারা যায় অথচ ছোট্ট অঋবের কোন অসুখ ছিল না। সে কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা ডঃ মাসুদ পথিক এর একমাত্র ছেলে। মাসুদ পথিক একজন কবি আর সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাঁর মায়া দ্য লস্ট মাদার, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রাপ্ত। নেক্কাবরের মহা প্রয়ান তার চমৎকার সৃষ্টি চলচ্চিত্র। কি আশ্চর্য অনুসুর্য নামে আমার এক ক্লাসমেট আমাকে ভিষণ পছন্দ করে, এ পছন্দ অন্য রকম পছন্দ। আমিও ক্রমশই অনুসুর্যের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। আমিও মনে হচ্ছে তাকে অন্য রকম পছন্দ করি। আর অনুসুর্য ও চমৎকার কবিতা লিখে। অনুসূর্যের অনু কবিতা খুব সুন্দর হয়। আচ্ছা মম,আপনিও কি মাঝে মাঝে কবিতা লিখেন,যা অপ্রকাশিত।

আমাকে তিনি নিজে হলে পৌঁছে দিলেন,আর চিনে এলেন আমার ঠিকানা। বললেন,

——– আমি তোমাকে নিতে আসবো নীল, তোমার বন্ধ হলে। আমি ভিষন একা নীল। আমার সঙ্গে তুমি থাকবে।

আমি মাথা নাড়লাম। এতো ভালবাসা আমি কোথায় রাখবো। সারা রাত আমি মম এর কথা ভাবলাম। আমার মধ্যে তিনি নীল কে পেয়েছেন।

তার আঙুল প্যাচানোর গল্প টা জানা হলো না।

আরেক দিন ডাক্তার মম এর সঙ্গে সেই ক্যাফেতে বসে তার আঙুল প্যাচানোর গল্প টা শুনবো আমি। আমার ভিষন জানতে ইচ্ছে করছে। তাকে বলব,
—– মম,আপনাকে লুছমির গল্প টা বলব,সেও আপনার মতোই অনাথ। সে একটা বিদেশি পরিবারের বড় হয় সেই লুছমি ও ডাক্তার আপনার মতোই। যদি কোনদিন লুছমি নামের ডাক্তারের সঙ্গে আপনার দেখা হয় আপনি জেনে নেবেন সে ও কি অনাথ আশ্রমে ছিল কোন দিন, কিংবা এক লন্ডনিয় পরিবারে সে কি বড় হয়।
আর আপনি কি জানেন, অরুন্ধতীর আম্মু ও আপনার মতো আঙুল প্যাচিয়ে রাখে। তিনি আমার বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে তিনি খুব নামকরা একজন লেখিকা। কিন্তু তিনি কখনো কোন সাক্ষাৎকার দেন নি,আর দিতেও চান না। কিন্তু আমি তাঁর একটা ইন্টারভিউ নিব।

*********

আমি বিকেলে ম্যাম এর ডরমিটরি তে গেলাম।ড্রইং রুমে দেখলাম চমৎকার বাঁধানো ছবি। ম্যাম এর সঙ্গে অরুন্ধতী র, জড়িয়ে ধরে আছে মা কে।অরুন্ধতী ইলেভেন ক্লাসে পড়ছে। আমি ড্রইং রুমে বসে আছি।ম্যাম আসেনি তখনো। অরুন্ধতী এলো,তার হাতে একটা গল্পের বই, ম্যাম এর লিখা। গল্প সমগ্রএটা।আমি বললাম,

—-এই বইটা আমি পড়েছি, চমৎকার লিখা গল্প গুলো জীবনের গল্প।

অরুন্ধতী হাসলো,সে বলল,

—-মায়ের সব লিখাই চমৎকার আর আমার খুব পছন্দ। মার কবিতা গুলো ও অদ্ভুত রকম সুন্দর, আমাকে কাছে টানে।

আমি বললাম,

ঠিক বলোছো অরুণ।আমিও খুব পছন্দ করি কবিতা।

ম্যাম আসলো,হাতে কফির মগ। আমাকে কফি দিল।আমি কফির মগে চুমুক দিলাম।

তিনি তার অতীত ইতিহাস বললেন। তার জীবনের গল্প, তার হোমসে বড় হওয়ার গল্প। তার পছন্দ , তার বিয়ে,সংসার।
বাকি ঘটনা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। আমি স্পষ্ট ই সে দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পেলাম। আকাশ পাতাল চিৎকারে আমার কান তালা লেগে গেলো। দম বন্ধ হয়ে আসলো আমার। মার একটা আঙুল বিচ্ছিন্ন করে দিল বাবা। আর এজন্যই আমি বাবাকে দেখলেই চিৎকার করতাম। ফুপ্পি আমাকে তার কাছে নিয়ে যায়।

আমি বললাম,

আমি আপনার হাতের আঙুল ছুঁয়ে দেখতে চাই। ব্যান্ডেজ করা কেন?

ম্যাম বললেন,
এটাই তো আমার জীবনের গল্প। আমার লেখালেখির গল্প। আমি লেখালেখি করি তা একজন চাইতো না।আমি লেখালেখি করে পরিচিতি পাই এটা সে কখনো চাইতো না। সে চাইতো অন্য দশ পাঁচটা মেয়ের মতো ঘরে থাকি রান্না বান্না করি সন্তান লালন পালন করি এসব। আমার নিজস্ব কোন চাওয়া পাওয়া থাকবে না। আমি চলবো তার ইচ্ছের সঙে, এসব নিয়ে আমাদের বনিবনা হচ্ছিল না। আমার অন্য কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। শুধু লেখালেখি র একটা তিব্র আকাঙ্খা ছিল এতটুকু ই। আমি খুব সিম্পল জীবন ধারণ করতাম।

আমি বললাম,

আপনার কি আরেক টা মেয়ে আছে? তার কথা কি আপনার মনে আছে?আমাকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন ম্যাম? আমার নাম পাল্টানো র গল্প কি বুঝতে পেরেছেন আপনি?

ম্যাম আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম।বললাম,

আমাকে কেন তোমার সঙ্গে করে আনোনি? এখন তো অনেক ভালো আছো অরুন্ধতী কে নিয়ে , তোমার নতুন সংসার নিয়ে। তুমি এতো নিষ্ঠুর আমাকে রেখে এলে কি ভাবে?

ম্যাম আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।বললেন,

অরুন্ধতী ও তোমার বোন দেবযানী। আমি যখন চলে আসি তোমাকে আটকে রাখে, আর অরু ছিল আমার পেটে মাত্র কিছু দিনের।আমার আর অরুন্ধতী র দুজনের সংসার। অনেক ঝড় বয়ে গেছে আজকের এ আমি হতে। আমার চাকুরী আমার লেখা লেখি , আমার কেরিয়ার , এতো স্বপ্নের মতোন দেবযানী।

আমি মাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম।আর আমি চোখের সামনে সে দৃশ্য টা দেখলাম, কি ভাবে একটা মানুষের শরীর থেকে একটা অংশ বিচ্ছিন্ন করে।

আমি কতক্ষন যে মাকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম আমার মনে নেই। মা আমাকে ডাকলো
দেবযানী , দেবযানী।

অরুন্ধতী আমাকে ডাকলো,দিদি,দিদি, দেখো আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে।

আমি সব সময় আকাশে একটা নীল ধ্রুব তারা খুঁজতাম। সে তারাটি ছিল আমার মা। আজকে আমাকে সে জড়িয়ে ধরে আছে। আজকে ডাক্তার মম এর কথাও মনে হচ্ছে বার বার। আচ্ছা অনুসুর্য কি করছে এ মুহুর্তে। ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কেন? এর নাম কি মায়া,এ-র নাম কি টান, এর নাম কি ভালবাসা।

**

সমাপ্ত।

৭/১১/২২

২০ পর্বের ধারাবাহিক গল্প আছে, দেব কি ভাবছিলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here