নীল ধ্রুব তারা
পর্ব এক
শাহানা জেসমিন
————————————-
আজ বিশ্ব বিদ্যালয়ের অর্থ নীতি ডিপার্টমেন্ট এর প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাস, প্রথম দিন মেহজাবিন ম্যাম এর ক্লাস। আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে ম্যাম এর ক্লাস শুনলাম। কি চমৎকার তাঁর কথার ধরন।কি সুন্দর করেই না তিনি গল্প বলেন।অথচ তিনি বাংলা বিষয়ে না, অর্থ নীতি পড়াবেন। তাঁর গল্প একেবারে আমার ভেতরে ছুঁয়ে গেলো।
ম্যাম খুব পরিপাটি। সুন্দর মাড় দেয়া ইস্ত্রি করা তাঁতের শাড়ি পরে আছেন। কোন সাজগোছ নেই অথচ মনে হচ্ছে তিনি সেজেগুজে আছেন। তাঁর সব কিছুই ভালো লেগে গেলো আমার। কিন্তু একটা জিনিস আমার খটকা লাগলো তিনি বাম হাতে লিখেন।ডান হাতের একটা আঙুল প্যাচানো নতুন ব্যান্ডেজ দিয়ে।
আমার বন্ধু তামান্না বলেছে,ম্যাম সব সময় আঙুল প্যাচিয়ে রাখেন নতুন ব্যান্ডেজ দিয়ে। আমিও সেটাই খেয়াল করলাম।
ম্যাম যখন গল্প বলেন,পুরো ক্লাসই পিনপতন নীরবতা। ক্লাস শেষে তিনি বললেন,
কাল থেকে তোমাদের ক্লাস চলবে রীতি মতো। আমার ক্লাসে কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না।ফাঁকি দিলে তোমরা নিজেরা ফাঁকিতে পরবে। আজকে গল্প দিয়ে শুরু করলাম । তিনি মিস্টি করে হাসলেন, তারপর চলে গেলেন।
আমি তার চলে যাওয়া দেখলাম। আমি অনেক ক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। আমি তাকিয়ে থাকলাম যতদূর তাঁকে দেখা যায়।
বিকেলে ক্যাম্পাসে বসে আছি। ম্যাম এর গল্প টা একবারে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছে। তার রেশ এখনো আছে।আমার ভেতরটা কেমন যেন অস্থির লাগছে।চোখের সামনে কতগুলো স্মৃতি ভেসে উঠলো।কেমন যেনো স্পষ্ট হয়ে আবার ও অস্পষ্ট হয়ে গেলো। আমি অনেক কিছুই মনে করতে পারি না, আবছা আলোর মতোন লাগে।
অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম,গল্প টার নাম কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছি না। মফিজ মাস্টার এর কাহিনি। এ স্যার ছিলেন ফাঁকিবাজি টাইপের। তিনি গনিতের ক্লাস নিতেন। মফিজ স্যার ক্লাস সেভেনে গনিত নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি অনেক ক্ষন স্টুডেন্ট এর সঙ্গে খোশগল্প করছেন,মাঝে মাঝে উদ্ভট টাইপের ধাঁধা ধরছেন। যা গনিতের সঙ্গে কোন সম্পর্কের না। আসলে তিনি সময় পার করছেন।অথচ তিনি গনিতের খুব ভালো শিক্ষক। হঠাৎ হেড টিচার এসে তার কান্ড কারখানা লক্ষ্য করলেন। তিনি বললেন,
—–কি আশ্চর্য , আপনি বাচ্চাদের গনিত না শিখিয়ে ধাঁধা শিখাচ্ছেন কেন?
মফিজ স্যার বললেন,
এটাও দরকার জ্বনাব,শিশুদের আনন্দ আর মজা না দিলে গনিতের প্রতি ভীতি ঢুকে যাবে।
—–আপনি কি ফাঁকিবাজি করছেন না তাহলে?,
——জ্বী না জ্বনাব,আমি মোটেই ফাঁকিবাজি করছি না এটা এক ধরনের আনন্দ আর মজা।
—-এটা কি মজা করার জায়গা মফিজ স্যার!
অথচ এই মফিজ স্যারের গনিতের সব বাচ্চাদের নম্বর ১০০তে ৯০ কিংবা ৯৮ পেতো। কোন স্টুডেন্ট গনিতের,কম নম্বর পেত না,অথচ ইংরেজিতে কিংবা বাংলা তে ফেল ও করতো। কি আশ্চর্য কাহিনি তাকে সবাই ফাঁকিবাজ বলে খেপাতো।
আমার এক বন্ধু গল্প করছিল, সে থাকতো দিনাজপুর। তিথি নাম তার, সে আমার রুম মেট। তিথি বলতো,
—–জানিস আমরা আমাদের এক ইংরেজি শিক্ষক কে
বল্টু স্যার বলে ডাকতাম আড়ালে। কিন্তু স্যার জানতো তাকে আমরা বল্টু স্যার বলে ডাকি। আর এক স্যার ছিলো দেখতে অনেক টা নায়ক টাইপ চেহারা । আমরা তাকে প্রিন্স বলতাম গোপনে। এটাও জানতো যে তাকে আমরা প্রিন্স বলি।
জগতে কত কাহিনি ই ঘটে। এ নায়ক স্যার তার চেয়ে হাঁটুর বয়সি এক ছাত্রী কে নিয়ে ভাগে।
আজকে মাথার মধ্যে স্যার দের নিয়ে যত উদ্ভট গল্প মনে হচ্ছে কেন? এই বল্টু স্যার এর এক রূপবতী মেয়ে ছিল। সে পরবর্তী তে তার চেয়ে কম বয়সী কাজিন কে বিয়ে করে রীতিমতো হইচই ফেলে দেয়।
এই বল্টু স্যার প্রচুর সিগারেট খেতেন। বল্টু স্যার এর রূপবতী মেয়ের সঙ্গে তিথির খুব ভাব ছিল।
অথচ এখন এটা খুব ই স্বাভাবিক বিষয় কোন মেয়ে তার চেয়ে কম বয়সী ছেলেকে বিয়ে করা। ,কিংবা কোন মেয়ে,অনেক বয়স্ক কে বিয়ে করা। এটা এখন এক ধরনের স্টাইলে পরিনত হচ্ছে।
********
ম্যাম ক্যাম্পাসের ডরমিটরি তে থাকেন।তাঁর সাথে থাকে মেয়ে অরুন্ধতী। কি চমৎকার নাম অরুন্ধতী।
“দ্য গড অফ স্মল থিংস ” লিখেছেন অরুন্ধতী রায়। বিশ্ব নন্দিত অরুন্ধতী রায় এ বইটির জন্য ১৯৮৭ সালে বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত। এ বইটি বেস্ট সেলার।
জামাল উদ্দিন খাঁয়ের এ বইটি অনুবাদ করেছেন।
অরুন্ধতী আমার চেয়ে চার কিংবা পাঁচ বছরের ছোট হবে। তামান্না অরুন্ধতী কে প্রাইভেট পড়ায়।
আমি লেখক অরুন্ধতী রায় এর একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম, খুব সুন্দর লেখিকা কোকঁড়ানো চুল,বয় কাট,। খুব সুন্দর হাসি।ছবিতে দারুণ দেখাচ্ছে!
আমার কাঁধে হাত রাখলো তামান্না। বলল,
কি রে আর কতক্ষণ বসে থাকবি?চল হলে যাই। রাত হয়ে এলো।
আমি তামান্না র সঙ্গে পা বাড়ালাম।
রাতে একটুও ঘুম হলো না। আজ আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। আজকের চাঁদ টা একেবারে ই কাছাকাছি। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।
আমি অনেক ক্ষন জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থাকলাম,অবারিত জোৎস্নায় ভড়ে আছে চারপাশে। জোৎস্না র ফুল হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছে মনে হলো।
তামান্না আমার জীবনের অনেক গল্প ই জানে। অনেক ছোট থেকে আমি হোস্টেলে থেকে বড় হয়েছি।তখন বয়স কত হবে প্লে তে পড়ি। তখন থেকেই আমি হোস্টেলেই থেকে পড়ি।
আমাকে টেক কেয়ার করে আমার এক দূর সম্পর্কের ফুপু।আমি ক্লাস সাসপেন্ড হলে কখনো বাবার কাছে যাই না।ফুপুর কাছেই চলে যাই।আগে ফুপ্পি নিতে আসতো। এখন একাই চলাফেরা করি।
বাবার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয় না। আমি তাকে দেখতে ও চাই না। এক সময় হোস্টেলে বাবা আসতো দেখা করতে। বাবাকে দেখলেই চিৎকার শুরু করতাম। এখন বাবা আর আসে না। বাবার চেহারা ভুলে গেছি কিন্তু তার অন্ধকার চেহারা কখনো ভুলবো না।
আমার এ ফুপু নিঃসন্তান। তিনি জোর করেই আমাকে নিয়ে যান। কারণ আমি তখন প্রচুর কান্না করতাম। ফুপ্পি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি তে জি এম।
সেদিন দেখলাম ম্যাম তার মেয়েকে নিয়ে ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন তাঁর ডরমিটরি তে। সাথে তাঁর মেয়ে অরুন্ধতী। খুব সুন্দরী অরুন্ধতী। অবিকল ম্যাম এর মতোই দেখতে। সে ম্যাম এর আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটছে। এ দৃশ্য দেখে আমার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠলো।
******
আজকে ম্যাম ক্লাস নিলেন আন্তর্জাতিক অর্থ নীতি বিষয়ে। মনেই হলো না যে তিনি পড়াচ্ছেন। মনে হলো তিনি গল্প করছেন। কঠিন বিষয় কি ভাবে যে মস্তিষ্কে ঢুকে গেলো,বুঝতে পারলাম না। আর তিনি মাঝে মাঝে বলেন, —-বুঝতে পেরেছ!
ম্যাম কে আজ অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগলো, কালো মিশেল ব্লক প্রিন্টের শাড়িতে। চমৎকার মানিয়েছে শাড়িতে। মাঝে মাঝে ভাবি কেন যে মানুষ শাড়ি বাদ দিয়ে অন্য ড্রেস পড়ে।
তিনি হাতে সাদা কাঁচের চুড়ি পড়েছেন। অথচ কোন শব্দ ই হলো না।রিনিঝিনি চুড়ির শব্দ মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। কি জাদুকরী কথা , অনেক ক্ষন সে কথার মাধুর্য আমাকে ভর করে থাকলো। মাঝে মাঝে তিনি মিস্টি করে হাসলেন। এতো সুন্দর তাঁর হাসি।
ম্যাম ক্লাস নিয়ে চলে গেলেন তাঁর চেম্বারে। আমি তাঁর পিছু পিছু আসলাম।
পিওন চাচা আকরাম কে বললাম,
—চাচা আমি ম্যাম এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
চাচা বললেন,
এখন ম্যাডাম রেস্ট করছেন।একটু পরে তাঁর ক্লাস আছে। দেখা করা যাবে না।
আমি চাচাকে অনেক রিকোয়েস্ট করলাম।বললাম,
—–আপনি শুধু বলবেন মুগ্ধ নামে একটি মেয়ে দেখা করতে চায়।
পিওন চাচা ভেতরে আমার কথা বলল,
আমি স্পষ্ট ই শুনতে পেলাম তিনি বললেন,
—ওকে ভেতরে আসতে বলো।
আমি ভেতরে গেলাম।খুব সুন্দর করে তাঁর রুমটা সাজানো। দেয়ালে কতগুলো পেইন্টিং। কতগুলো তৈল চিত্র ঝুলে আছে। আলমিরা, ল্যাপটপ,
,কম্পিউটার সব গোছানো। তাকে তাকে বই সাজানো। অর্থ নীতি র উপর বই গুলো অন্য আলমারিতে। আর একটা আলমারিতে গল্পের বই। রবিন্দ্র গল্প সমগ্র, শরৎচন্দ্রের বই,নজরুল সমগ্র। আরও অনেক বিখ্যাত লেখক এর বই।কতগুলো কবিতার বই।
আমি ম্যামকে দেখলাম,তিনি বসে আছেন। চশমাটা টেবিলের উপর। খালি চোখে তাঁকে অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছে। তাঁর হাতে একটা রেফারেন্স বই। তিনি আমাকে দেখে বললেন,
ক্রমশ ০০০০
গল্পটি পাঁচ পর্বে শেষ
৩/১১/২২