মেঘের_আড়ালে_মেঘ”৪”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

বৃষ্টির পর সত্যিই পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে যায়। আর এরকম পরিবেশে মেহরীনের মন সব সময় ভালো থাকে। হাজার মন খারাপের মাঝেও এমন দিন তার সব মন খারাপ দূর করে দেয়। আজ তো পরিবেশটাও তার মন মতন। আর পাশে ভালোবাসার মানুষটাও রয়েছে। অনন্তর সাথে পাশাপাশি হাঁটছে মেহরীন। অনন্ত চা বানাতে গিয়ে দেখে বাড়িতে তো চা পাতাই নেই। মেহরীন তখনই প্রস্তাবটা দিয়েছিল অনন্তকে।

“চা পাতা তো নেই। বাড়িতে চা খাওয়া হবে না। তাহলে চলো না আজ বাইরে থেকে চা খেয়ে আসি।”

কথাটা শুনে অনন্ত চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

“তোর না জ্বর! গায়ে একশো ডিগ্রি জ্বর নিয়ে তুই এখন বাইরে চা খেতে যাবার কথা বলছিস। আজ সারাদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। এখন থেমেছে। কিন্তু একটু পরই দেখবি আমরা বের হলে আবার শুরু হবে।”

“হোকনা সমস্যা কী?”

“মাথাটা একেবারেই গেছে তোর, না? শরীরে জ্বর নিয়ে তুই বৃষ্টিতে ভিজবি?”

“তোমার সাথে ভিজতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু তারপর নিউমোনিয়া হলে তোমাকেই আবার আমার সেবাযত্ন করতে হবে। তাই আমরা ভিজব না। বৃষ্টি শুরু হলে কোথায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করব। চলো না হাঁটতে বেরুই।”

“এই শরীরে হাঁটতে কষ্ট হবে তোর।”

“হবে না।”

“হবে। তর্ক করিস না।”

“আচ্ছা হলে হবে।”

কপাল কুঁচকে অনন্ত তাকালে মেহরীন সাথে সাথে যোগ করল,

“আমার হাঁটতে কষ্ট হলে তুমি আমাকে কোলে তুলে নিও। মুভিতে দেখো না হিরো কীভাবে হিরোইনকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে। নাকি তুমি আমার ওজন বইতে পারবে না। না পারলে তা অন্য ব্যাপার।”

“যতই উস্কানি দিস না কেন, আমি তোর কথার মাঝে আসব না।”

মন খারাপ করে মেহরীন বলেছিল,

“সব সময় এমন করো কেন তুমি? আমাকে একটুও সময় দাও না। যেদিন আমি থাকব না, সেদিন বুঝবে আমি তোমার জীবনে কী ছিলাম। হারিয়ে বুঝলে কখনও খুঁজে পাবে না। তখন আফসোস করবে আর কষ্ট পাবে।”

মেহরীনের এই কথাগুলো তীরের মতো অনন্তর বুকে গিয়ে বিঁধেছে। অনন্ত মেহরীনকে কতটা ভালোবাসে তা সে মেহরীনকে বোঝাতে পারে না। বোঝাতে চায়ও না সে। ঢাকঢোল পিটিয়ে ভালোবাসার কোন মানে নেই। মনে মনে নীরবে ভালোবেসে যাওয়াই বড় কথা। শেষমেশ অনন্ত মেহরীনের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে ফেঁসে গিয়ে ওকে নিয়ে বের হয়। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা এখনও ভেজা। কয়েক জায়গায় ছোট ছোট গর্তে পানি জমে আছে। এখন বিকেল হলেও দিনের অবস্থা দেখে মনে হয় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস এসে শীত লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মেহরীন অনেক্ষণ ধরে চুপচাপ আছে দেখে অনন্ত আড়চোখে বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। এখন বাতাসে মেহরীনের চুল, জামাকাপড় উড়ছে। সে গায়ে একটা শাল জড়িয়ে হাঁটছে। অনন্ত মুগ্ধ নয়নে লুকিয়ে লুকিয়ে তার প্রেয়সীকে দেখছে। হঠাৎ অন্যমনস্ক গলায় মেহরীন বলল,

“আচ্ছা, ধরো আমাদের গল্পটা পূর্ণতা পেল না। আমি তোমার থেকে হারিয়ে গেলাম। তখন তুমি বাকি জীবনটা কীভাবে পার করবে? আমার শোকে দেবদাস হয়ে মদ ধরবে? নাকি আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে কারো প্রেমে পড়তে চাইবে? উম না, নতুন করে প্রেমে পড়ার কথাটা বেশি হয়ে গেল। কারণ আমি জানি তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না। আচ্ছা, আমাকে মনে রেখে অন্য কারো সাথে সংসার বাঁধবে তুমি? নাকি আমার স্মৃতি বুকে নিয়ে সারাজীবন একা একাই কাটিয়ে দিবে?”

মেহরীন কথাগুলো বলেই উত্তরের জন্য অনন্তর মুখের দিকে তাকাল। মেহরীন যতটা সহজ ভাবে কথাগুলো বলেছে, অনন্ত ঠিক ততটাই শীতল গলায় উত্তর দিল।

“তুই গল্প সিনেমার মত জীবনটা দেখলেও আমি দেখি না। বাস্তবতা তোর গল্প সিনেমা থেকে অনেক ভিন্ন। আমাদের ভাগ্যে পূর্ণতা লেখা আছে কি-না তা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন। তোর কথা মত ধর পূর্ণতা পেল না। তাহলে যে তুই আমার থেকে হারিয়ে যাবি এমনটা ভাবছিস কেন? আমিও তো তোর থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারি। তখন তুই কী করবি? যেই প্রশ্ন গুলো একটু আগে আমাকে করেছিস তা নিজেকেও কর এবার। আচ্ছা ধরে নিচ্ছি তুই-ই হারিয়ে গেলি। তখন আমি তোকে ভুলতে পারবো কি-না জানি না। আসলে আমি কখনও তোকে ভুলতে চাইব না। কিন্তু মেহু, জীবনটা তো অতটা সহজ না। একটা মানুষের বাঁচতে গেলে কাউকে না কাউকে পাশে লাগবেই। একা একা কেউ বাঁচতে পারে না। আমি তখন ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করব। ওকে তোর কথা জানিয়ে রাখব। ওকে সুখে রাখার চেষ্টা করব। ও যেন কোনদিনও তোকে দোষতে না পারে। বলতে না পারে, তোর জন্য ও তার স্বামীর ভালোবাসা পায়নি। আমাদের বাচ্চা কাচ্চা হবে। সময় যাবে, আমরা বুড়ো হব। এখন যেমন তোকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছি, তখন বউকে নিয়ে বের হব। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটব। মনে মনে হয়তো আজকের দিনের কথা মনে করে বউয়ের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলব। আমার বউ বাইরে থেকে আমাকে দেখে ভাববে, ওর ভালোবাসা দিয়ে আমার মন থেকে তোকে পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পেরেছে। এটা ভেবে মনে মনে সে-ও খুশি হবে। আমি তার খুশি নষ্ট করব না। নিজেও নাটক করে যাব। কিন্তু আমি তখনও তোকে মনে রাখব। শেষ বয়সে তোর কথা মনে করে অতটা কষ্ট অনুভব করব না। তখন স্ত্রী সন্তানের কথা ভাবব। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অনুভূতিরাও রূপ বদল করে বুঝলি।

অনন্ত হাঁটতে হাঁটতে অন্য দিকে ফিরে কথাগুলো বলছিল। মেহরীনের দিকে তাকালে সে দেখতে পেত, মেহরীনের চোখে পানি। সে কখন থেকে নীরবে কাঁদছে। অনন্ত কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারল মেহরীন পিছিয়ে পড়েছে। সে ডাকল,

“কিরে কই তুই? তোর প্রশ্নের উত্তর শুনতে পেয়েছিস। না শুনলে নাই। আমি আবার বলতে পারব না।”

অনন্ত পেছন দিকে তাকিয়ে হাসলে মেহরীন শব্দ করে কেঁদে ফেলে দৌড়ে গিয়ে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনন্তকে মারতে মারতে বলল,

“অসভ্য, পাষাণ! আমার মন রাখার জন্যও মিথ্যে বলতে পারলে না তুমি। আমাকে ভুলে গিয়ে তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করবে। বাচ্চাকাচ্চার বাপ হয়ে আমকে ভুলে থাকার নাটক করবে! তোমাকে মেরেই ফেলব আমি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অনুভূতিরাও রূপ বদল করে, না! আমাকে কষ্ট দিতে ভীষণ ভালো লাগে তোমার! আমি মরে গিয়েও ভূত হয়ে তোমার সাথে থাকতে আসব। কারণে অকারণে ভয় দেখিয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলব। তখন না পারবে আমার ভূত থেকে ছাড়া পেতে। আর না পারবে বিয়ে করতে।”

মেহরীনের কিল ঘুসি খেতে খেতে অনন্ত হাসছে। মেহরীনকে এতটা রেগে যেতে দেখে ভীষণ মজা লাগছে ওর। মেয়েরা এতটা হিংসুটে ক্যান?

“আরে থাম, থাম। তুই-ই তো বলতে বললি। মিথ্যে বলে মন রাখা যাবে সেটা আগে বলে দেস নাই। আমি বেচারা সরল বাচ্চা ভালো মানুষের মত সত্যি বলে দিলাম। এখন তুই আবার রেগে গেলি। আচ্ছা থাম একটু। আবার মিথ্যে মিথ্যে সবটা বলে তোর মন রাখি।”

মেহরীন রাগ করে মার থামিয়ে দিল। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

“থাক, তোমার ভালোবাসা আমার বোঝা হয়ে গেছে। মিছেমিছি আর কিছু বলে মন রাখতে হবে না। আমি তোমার সাথে আর কোনদিন কথা বলব না। আমার মন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছ তুমি। তুমি একটা পাষাণ।”

মেহরীন রাগে গজগজ করতে করতে উল্টো পথে হাঁটতে লাগল। অনন্ত হাসতে হাসতে ওর পেছনে আসছে।

“ওই পাগলী দাঁড়া। একা একা যাস না। আরে চা-ই তো খাওয়া হলো না। তুই দেখি ফিরে যাচ্ছিস।”

“চায়ের সাথে একটু বিষ মিশিয়ে খেয়ে ফেল তুমি। আমার জন্মের মত চা খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিয়েছ তুমি। খবরদার আমাকে পেছন থেকে ডাকবে না। আজ থেকে তুমি স্বাধীন। যাও গিয়ে ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করো। এবার ওকে আমার কথা বলতে হবে না। দোয়া করি সুখে সংসার করো তোমরা।”

“সত্যি বলছিস তো? শেষবারের মত একবার ভেবে দেখ। পরে কান্নাকাটি করলেও কিন্তু কাজ হবে না। তুই তো জানিস, আমি এক কথার মানুষ।”
.
.
ইরফান হুমায়রার সামনে বসে আছে। ভেতরে ভেতরে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। হুমায়রা সেই কখন থেকে মুখে তালা লাগিয়ে এক ধ্যানে তাকে দেখে যাচ্ছে। ইরফান হুমায়রার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। সে ঘরের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নানান কিছু দেখছে। হুমায়রা এবার শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

“এতদিন পর কোন মতলবে এসেছেন এখানে?”

ইরফান মোটেও অবাক হল না। হুমায়রার কথা বলার ধরণ এমনই। এখন তো আবার সে রেগে আছে। ইরফান হুমায়রার আঙুলের আংটির দিকে দেখে বলল,

“বাহ! বেশ সুন্দর আংটি দিয়েছে তো। ভাইরা ভাইয়ের পছন্দের তারিফ করতে হয়।”

এতক্ষণ চেপে রাখা রাগে এবার ফেটে পড়ল হুমায়রা।

“একটা কথাও বলবেন না। লজ্জা করে না আপনার! আজ ডাকি নি তবুও কেন বেহায়ার মত এসেছেন। ওই দিন আমার এনগেজমেন্ট গেল। আপনার পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম শুধু। তবুও আপনি এলেন না! এত দাম আপনার! আমার বোন বেঁচে থাকলে এমনটা করতে পারতেন আপনি? হামনা মারা গেছে বলে কি ওর সাথে জড়ানো সম্পর্ক গুলোও মারা গেছে? আমরা আপনার কেউ হই না? আয়াম কি একা আপনার ছেলে? আমার বোনের ছেলে না ও! ওকে কেন আমাদের কাছে আসতে দেন না? আপনার ছেলেকে তো কেউ নিয়ে যাবে না। হামনার জন্য আমাদের বুকে যে আগুন জ্বলে আয়ামকে দেখলে সেই আগুন একটু হলেও শিথিল হবে। আমার বাবাকে এখন আপনি শ্বশুর না-ই মানতে পারেন। যেখানে বউ নেই সেখানে আপনি শ্বশুরবাড়ি দিয়ে ঘাস কাটবেন! কিন্তু লোকটা তো আপনার বাবার বয়সী। উনার দিনগুলো কীভাবে কাটে একটা বার একটু খোঁজ নিয়েছেন আপনি? কেমন মানুষ আপনি! এত শক্ত আপনার মন! এত পাষাণ আপনি!”

হুমায়রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইরফান তাকে নিজেকে সামলে নেওয়ার সময় দিল। দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হুমায়রা একটু শান্ত হয়ে চোখ মুছছে। ইরফান এবার হালকা গলায় বলল,

“আমি সত্যিই আসতাম হুমায়রা। তোমার খুশিতে জয়েন হতে পারলে আমি নিজেকে অনেক লাকি মনে করতাম। কিন্তু কেন আসিনি জানো? তোমাদের পরিবারের লোকগুলো আমাকে, আয়ামকে দেখলেই হামনাকে নিয়ে কথা তুলে। মুখে শোকের ছায়া ফেলে আমাদের সান্ত্বনা দেয়। নানান কথার পরে আয়ামের জন্য আমাকে আবার বিয়ে করতে বলে। হামনা আমার স্ত্রী ছিল। বেঁচে থাকতে যারা ওর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সে মারা যাবার পর তারা এমন দেখায় যেন ওর মৃত্যুতে উনারাই সবচে বেশি কষ্ট পেয়েছে। এসব আমার একদম ভালো লাগে না হুমায়রা।”

হুমায়রা চোখ মুছে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

“বুঝেছি। তাই বলে আপনি অনুষ্ঠান শেষেও আসতে পারলেন না! আপনি আমার বোনের হাজবেন্ড। শালি হিসেবে দুলাভাইয়ের কাছে আমার এটুকু আশা থাকা কি অন্যায়?”

“তোমার বিয়ের দিন আসব। কথা দিলাম। কিন্তু শর্ত আছে। বিয়ের দিন কাঁদতে পারবে না তুমি। কাঁদলে তোমাকে দেখতে বিশ্রী লাগছে।”

হুমায়রা হেসে ফেলল।এবার গলায় অধিকার খাটিয়ে বলল,

“আয়ামকে কিন্তু আমার কাছে কয়েকদিন রেখে দেব।”

ইরফান চোখ কপালে তুলে বলল,

“কয়েকদিন! আয়াম আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে! ”

হুমায়রা টিটকারি মেরে বলল,

“কথাটা উল্টো ভাবে না বলে সোজা করে বললেই পারেন। বলুন, আয়াম আপনাকে ছাড়া থাকতে পারলেও, আপনি আয়ামকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। ছেলের মধ্যে আপনার প্রাণভোমরা বাস করে।”

তখনই এই রুমে আয়াম দৌড়ে এলো। হুমায়রার কোলে এসে বসে বলল,

“খালামনি, আজ আমি তোমার সাথে থাকব।”

হুমায়রা আয়ামের কপালের চুল সরিয়ে চুমো দিয়ে বলল,

“থাকবে তো বাবুসোনা। এবার তুমি আমার কাছে অনেকদিন থাকবে।
কি দুলাভাই, আপনার ছেলে নিজেই বলছে ও আমার কাছে থাকবে। এখানে আপনার আর কোন কথা চলবে না।”

ইরফান অসহায় মুখে একবার ছেলের দিকে আরেকবার হুমায়রার দিকে তাকাল।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here