#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
পর্বঃ- ২
.
সালেহা সন্তানের মুখখানি দেখার পূর্বেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যায়।
এতিম সন্তানের লালনপালনের দায়িত্ব গ্রহন করেন সালেহার মা। অনেকে অনেক কথা বলেন, কেউ বলেন অবৈধ সন্তান ফেলে দিতে আবার কেউ বলেন কাউকে দিয়ে দিতে।
সালেহার মায়ের মুখে এক কথা! তা হচ্ছে –
« আমার সন্তান চলে গেছে দুনিয়া ছেড়ে, রেখে গেছে একটা সন্তান তা বৈধ অবৈধ আমার দেখার বিষয় না। এই সন্তানকে পেলে পুষে মানুষ করে সালেহার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে বুকে আগলে রাখবো।

কিন্তু মায়ের এমন কথা সালেহার ভায়েরা অগ্রাহ্য করেন, তাঁরা এসব ঝামেলাই জড়াতে চাননি। কোথাকার কোন কুলাঙ্গারের জন্য তাঁদের বোনের আজ এই পরিনতি, যারকারনে তাঁরা কেউ মেনে নিতে প্রস্তুত না।
তবে যাইহোক! সালেহার মায়ের কথা কখনো কোনো সন্তান অমর্যাদা করেননা, যারকারনে সালেহার এতিম সন্তানকে তাঁদের মায়ের কাছে রাখার বিপক্ষে আর কোনো কথা বললেন না।
সালেহার এতিম সন্তানের নাম রাখেন হাসু।
এই হাসু আস্তেআস্তে বড় হতে লাগলো, মামা বাড়িতে পিতৃ পরিচয়হীনভাবে বড়ো হতে থাকে হাসু। তাঁর মামারা ছোটবেলা থেকেই নদীর চরে কাজকাম করান, চরে কাজ করেকরে রৌদ্রে পুড়েপুড়ে একদম নিগ্রোজাতিদের মতো কালো হয়ে গেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চরে বাদাম তিল অথবা ধানের ক্ষেতে কাজকাম, এবং বিকালে নদীতে খেয়াপার করানো কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে।
এভাবে ছোটবেলা থেকে কঠোর পরিশ্রম করে, এখন তাঁর বয়স দশ বছর। হঠাৎ তাঁর নানি মারা যায়, নানি মারা যাবার পর থেকে মামারা ঠিকমতো দেখতে পারেনা হাসুকে। নানানভাবে অপ্রিতিকর কথা সাথে জারজ সন্তান হেনতেন বলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
হাসু এখন সবকিছু পরিপুর্ন না বুঝতে পারলেও অনেকটা বুঝা শিখে গেছে। তাঁর চিন্তাচেতনা এখন আর মামাদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবেনা, কোথাও একটু তিনবেলা খাওয়া পেলে তাঁর বিনিময় চলে যেতে ইচ্ছুক।


আব্দুল মজিদের একটিমাত্র কন্যা সন্তান নাম তাহেরা ও দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী সাজেদা নিঃসন্তান, কোনো সন্তানাদি হয়নি। অনেক ডাক্তার কবিরাজ মাজারে সিন্নি সহ গাজি কালুর মাজারে মানত করেও একটা সন্তান তাঁর কোলজুড়ে আসেনি। (এগুলো করা শিরক)
মাঝেমধ্যে সাজেদা আঃ মজিদের সাথে চরমভাবে ঝগড়াঝাঁটি করেন, তাকে বলেন-
« কতো করে বল্লাম, তুমি এসব সুদি কারবার করতে যেওনা, এই সব কাজে মানুষের অভিশাপে আজ আমি নিঃসন্তান।
এটা নিয়ে তাঁদের মাঝে অনেক ঝগড়াফসাদ হয়।
তাহেরা আঃ মজিদের ছোট স্ত্রী রুবির সন্তান, এই রুবিকে নিয়ে করুণ ইতিহাস আছে যা মানুষের বিবেগ নাড়া দেই।

রুবির বাবা অতিসাধারণ একজন গরিব কৃষক, তাঁর যা জায়গাজমি ছিলো সব নদী স্রোতে ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। তখন জমির বিনিময় ফসল দেওয়ার চুক্তিতে আব্দুল মজিদের জমি নিয়ে চাষাবাদ করতো।

রুবির বাবার নাম ইসরাইল হোসেন, তো ইসরাইলের পাঁচ সন্তান। রুবি সবার বড়ো আর বাকি চারটা ভাই তাঁরা ছোট, তাঁদের লালনপালন করতে ইসরাইলের অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। এদিকে নদীর ভাঙ্গনে জমিজমা সব বিলীন, আবার প্রচণ্ড অভাব!
ইসরাইল নিরুপায় হয়ে আঃ মজিদের কাছ থেকে চড়াসুদে ফসল নিয়ে সন্তানদের মুখে আহার যোগান, এভাবে খেতে খেতে অনেক টাকা পাওনা হয়ে যায়।
আঃ মজিদ ইসরাইলের কাছে ফসল বাবোদ টাকা চাই, ইসরাইল অপারগতা প্রকাশ করেন কোথায় পাবেন এতো টাকা হেনতেন।
আঃ মজিদ হুমকি দেই, যদি টাকাপয়সা পরিশোধ না করো তাহলে তোমাকে সর্বশান্ত করে এই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিব।
তবে আরেকটি উপায় আছে, যদি রুবিকে আমার সাথে বিয়ে দাও তাহলে সব ক্ষমা করা হবে। আর অভাব অনটনের সময়ে অর্থকড়ি ও ফসল দিয়ে সার্বিক সহযোগীতা করা হবে।

এই কথায় ইসরাইল সাহেব সার্বিক বিবেচনা করে রুবিকে বিয়ে দিতে রাজি হয়। রুবি অরাজি একজন বাবার বয়সী পুরুষের সাথে বিয়ে করতে।

ইসরাইল রুবিকে খুব ভালোবাসতেন, তবুও অভাব সাথে ভিটেমাটি সহায়সম্বল সব হারানোর ভয়ে নিজ মেয়েকে একটা দুশ্চরিত্র বয়স্ক পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন, অনেকটা নিরুপায় হয়ে কারন বর্তমান আঃ মজিদ মেয়ে বা অর্থ না দিলে জীবননাশের হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে।

রুবি সব বুঝে তবুও অবুঝ, মাঝেমধ্যে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। কি করা উচিৎ তার!!
বাবার কষ্ট অভাব সবকিছু মিলে বাবার মুখের দিকে চেয়ে নিজের সুখের কথা ভুলে গিয়ে আঃ মজিদকে বিয়ে করেন রুবি।
তাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে তাহেরা নামের মেয়েটি যার চলতি বয়স নয় বছর।


আব্দুল মজিদ এভাবে গ্রাম ও চরের হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চড়াসুদে ফসলের বিনিময় অনেক অর্থকড়ি হাতিয়ে নেই। তাঁদের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, নিপীড়িত অসহায় মজলুম অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীদের দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস দুর্বহ হয়ে থাকে।
গরিবের হক ফাকি, আল্লাহর বিধান অবাধ্যতা অমান্যতা করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে আঃ মজিদ। তাঁর এই সম্পদে রয়েছে গরিবের হক, এই হক আদায় না করে বরং তাঁর বিনিময় অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন কুটকৌশলে।

কোনো এক প্রয়োজনে সন্ধার সময় আঃ মজিদের বসন্তপুর গ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো। কিন্তু তাকে একাএকা যেতে হচ্ছে আজ, নিজের নৌকা নিজেকে চালাতে হবে। তাঁর বেতনভুক্ত মাঝি প্রচণ্ড অসুস্থ।
বসন্তপুর যাওয়ার জন্য নৌকাতে উঠলো, মাঝ নদীতে যেয়ে প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। চারিদিক থেকে বড়োবড়ো ঢেউ উঠে টালমাটাল করে দিচ্ছে তাকে। সুবিশাল উত্তল তরঙ্গ এসে আঃ মজিদকে নদিতে ডুবিয়ে দিল।
সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করলো তাঁর জীবন বাঁচাতে, কিন্তু উত্তল তরঙ্গমালার মাঝে নিজেকে সফে দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় থাকলোনা।
আঃ মজিদ চোখ মেলে দেখতে পেলো একটা ১১-১২ বছর বয়সী তরুণ, তাঁর পাশে বসে ঝিমচ্ছে।
আঃ মজিদ জিজ্ঞেস করলো-
« কে তুমি?
ছেলেটি সংবৎ ফিরে তাকিয়ে বললো-
« জাগগে, আপনি তালি বেচে আছেন! ভাবিলাম মরে গিয়েছ লোকটা।
« কিডা তুমি বাবা আমাকে বাঁচালে?
« আমি হাসু, এই ঘাটের মাঝি। ঝড়ের সুমায় আপনাকে ডুবে জাতি দেখে তাড়াতাড়ি নৌকা নিয়ে আপনাকে উদ্ধার করি।
« কি কইয়ে যে তুমাকে ধন্যবাদ জানাবো, ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনে।
« কিচ্ছু কতি হবে না, আপনার বাড়ি কোন গিরামে খালি সিডা কন। আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
« সুন্দরপুর গিরামে বাবা।
« আইচ্ছা চলেন?

হাসু আঃ মজিদকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছায় দিয়ে আসলো। যখন হাসু ফিরবে, আঃ মজিদ বললো-
« বাবা দাড়াও!
« জ্বি কন চাচা, কি কতি চান।
« তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ, কি চাও বলো আমি তাই দিব?

হাসু তৎক্ষণাৎ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে কি চাবে! মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো-
« চাচা আমার চাওয়ার মতো কিছু নেই, তবে যদি আপনি আমাকে আপনার বাড়িতে খালি পেটেভাতে থাকার সুযোগ দিতেন, তালি খুব উপকার হতো আমার। আপনার সংসারে কাজকাম করে দিতাম, আর আমি সব কাজকাম পারি।

আঃ মজিদ বেশ খুশি হলো হাসুর মুখে কথা শুনে। তৎক্ষণাৎ মুখে মুচকি একটা হাসির রেখা টেনে বললো-
« কোনো সমেস্যা নেই বাপু, তুই ইচ্ছা করলে এখন থেকে আমার বাড়ি থাকতি পারিস।
« না চাচা আজ না, কাইল থেকে থাকবানে, আজ বরং আমি মামাগের কাছ থেকে একবারে বিদায় নিয়ে আসি।
« ঠিকাছে! জা তালি, কাইল সকাল সকাল চলে আসিস।


তালহা যার বয়স এবার ১২ বছর পার হলো, ৭ ভাইবোনের ভিতরে সবার ছোট। তাঁর বাবা হতদরিদ্র কৃষক, তবে হাজার দুঃখক্লিষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও অসৎপথ অবলম্বন করেননা।
গ্রামের সবার মাঝে তালহার গ্রহনযোগ্যতা প্রশংসনীয়, কারন তাঁর আচরণ ব্যবহার দ্বিনদারীতা অমায়িক। এইজন্য গ্রামের সকলের নিকট মাথার তাজ।
ছোটবেলা থেকে বাবার অভাবের সংসারের মধ্যদিয়ে বড়ো হয়েছে, গ্রামের একটি হিফজ মাদরাসা থেকে কুরআনের হিফজ করে। পাশের গ্রামের দাখিল মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করার সৌভাগ্য হয়।

আঃ মজিদ সুন্দরপুর গ্রামের মসজিদের সভাপতি, এবং যে সেক্রেটারি তিনিও আঃ মজিদের মত দুশ্চরিত্রের মানুষ। বড়ো পরিতাপের সাথে বলতে হয়, বর্তমান সমাজের কর্ণধার নেতৃত্বদানকারীগন অধিকাংশ দুশ্চরিত্রের অধিকারী।
তেমনটাই আঃ মজিদ!
মসজিদে বাচ্চাদের আরবী পড়ানোর জন্য ভালো মানের একজন হুজুর প্রয়োজন। ঘটনাক্রমে তালহা সুন্দরপুর গ্রামের মসজিদে ইমামতি করার সুযোগ পেলো।
তালহার সমস্তরকম থাকা খাওয়া ভরণপোষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো আঃ মজিদের উপরে।
একটা বিষয়ে সকলে লক্ষ্য করবেন, দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ সমাজে নাম কেনার জন্য অনেক সময়ে কিছু মহৎকর্ম করেন। তার ধারাবাহিতায় আঃ মজিদ তালহার সমস্তরকম দায়ভার গ্রহন করে।

তালহা পরিবারের কাছ থেকে বিদায় গ্রহন করে আঃ মজিদের বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হয়।
এভাবে ইমামতি সহ সকাল বিকালে মক্তব পড়াতে থাকে।


হাসু মামাদের থেকে বিদায় নিয়ে আঃ মজিদের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করে। হাসুকে বাড়ির বাইরে আলাদা একটা ঘর দেওয়া হলো, সেখানে সে থাকে।
পাশাপাশি দুইটা মাটির ঘর, একটাই তালহা আরেকটিতে হাসু থাকে।
এভাবে তাঁদের কয়েক বছর অতিবাহিত হলো, আঃ মজিদ এখন অনেকটা অবৈধ ব্যবসাপাতি ছেড়ে দিয়েছে।
এই সুদে কারবার ছেড়ে দেবার একমাত্র অবদান তালহার।
তালহা কুরআন হাদিসের আলোকে মসজিদের খুতবা এবং অবসর সময়ে বিভিন্নভাবে আঃ মজিদকে বুঝাতে মক্ষম হয় তাঁর এধরনের ব্যবসা চরমরূপে জঘন্যতম একটি পাপ, যার পরিনতি জাহান্নাম।
হাসু এখন টগবগে যুবক, আঃ মজিদের একমাত্র কন্যা তাহেরার বয়স ১৭ বছর।
হাসুর মাথায় একটি চিন্তাচেতনা কাজ করছে! যেভাবে হোক তাহেরাকে বিয়ে করে তাঁর সমস্তরকম সম্পত্তি ভোগদখল করতে হবে। আঃ মজিদের সমস্তরকম সম্পদের একমাত্র অধিপতি হাসুকে হতে হবে।
আঃ মজিদ বিগত জীবনের সমস্ত পাপের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু একটা বিষয়ে মনের ভিতরে সে কপতটা রাখে, তা হচ্ছে যারযার সম্পদ ফাঁকি দিয়ে হস্তগত করেছিল তাঁর সম্পদগুলো ফিরিয়ে দিতে নারাজ।
এবিষয়ে তালহা নিয়মিত বুঝায় কিন্তু আঃ মজিদ ইচ্ছা করেই বুঝতে চাইনা।……
(চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here