হৃদমোহিনী
পর্ব ১৮
মিশু মনি
.
২২
মিশুর চোখে ঘুম চলে এসেছে। মেঘালয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চোখ বুজে আসছিলো। মেঘালয় বাবার রুমে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে৷ একটু পরপর বাবার হাসির শব্দ কানে আসছে। বাবার সাথে এত দ্রুত মেঘালয়ের সম্পর্কটা এরকম সুন্দর হয়ে যাবে মিশু ভাবতেও পারেনি। প্রসন্ন মনে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।
মেঘালয় কথা শেষ করে রুমে এসে দেখলো মিশু ঘুমাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘মিশমিশ ঘুমাচ্ছো?’
মিশুর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মেঘালয় একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মনেমনে বললো, ‘পাগলীটা ঘুমিয়ে গেলো, কতকিছু ভেবে রাখলাম! থাক, আজকে আর ঘুম ভাঙাবো না। আরাম করে ঘুমালে শরীরটা ভালো লাগবে।’
রুমের লাইট নিভিয়ে মেঘালয় মিশুর পাশে শুয়ে পড়লো আস্তে করে। গায়ে কম্বল টেনে নিয়ে মিশুকে জাপটে ধরে রইলো। অন্ধকারেও কল্পনা করছে মিশুর মায়াবী চেহারাটা। মিশুর মুখটা ছোট্ট একটু, বয়স আঠার হয়েছে দেখলে বোঝাই যায়না। মনেহয় এইতো ষোল হবে। বড্ড ইনোসেন্ট চেহারা, মায়াও আছে ঢের। মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলো মেঘালয়।
এমন সময় ফোন বাজতে শুরু করলো। মৌনির ফোনটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে মিশু। মেঘালয় বিছানার শিয়রে তাকিয়ে দেখলো সেখানে ফোন নেই। ফোনটা কম্বলের ভেতরে বাজছে সেটা বুঝতে পেরে বিছানায় হাত দিয়ে হাতরাতে লাগলো। ফোনটা বিছানার মাঝামাঝি বাজছে, কিন্তু মেঘালয় খুঁজে পাচ্ছেনা। বাধ্য হয়েই কম্বলটা সরিয়ে মিশুর হাতের কাছে খুঁজতে লাগলো৷ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আরাফের নাম্বার থেকে কল। মেঘালয় রিসিভ করে হ্যালো বলতেই মৌনি বললো, ‘ভাইয়া আমার নাম্বারে দশ হাজার টাকা গেছে দ্যাখ? কালকে দশ হাজার পাঠাবো।’
– ‘আচ্ছা। আমার লক্ষী বোনটা, সাবধানে যাস।’
– “ওকে ভাইয়া, হ্যাপি ম্যারেড নাইট৷ হা হা হা।’
মেঘালয় ও শব্দ করে হাসলো। তারপর কল কেটে দিয়ে কম্বলটা গায়ে টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো। ফোনের মৃদু আলোয় দেখতে পেলো মিশুর পেটের উপর থেকে আঁচল সরে গেছে৷ ফর্সা পেটটা লাল রঙের ব্লাউজে কি যে অপূর্ব লাগছে! এরকম দৃশ্য দেখার পর কি আর স্বাভাবিক থাকা যায়? স্লিম মেদহীন পেট ও কোমরটা দেখে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো মেঘালয়ের। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে অনেক্ষণ পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো স্তব্ধ হয়ে। নাভীর দিকে তাকিয়ে থেকে রীতিমতো ঘোর লেগে গেলো। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে ক্রমশই৷ মেঘালয় আবেশে চোখ বুজে ফেললো। তারপর ডান হাতটা রাখলো মিশুর পেটের উপর।
মিশু পুরোপুরি ঘুমায়নি। ঘুমের ঘোর লেগে এসেছিলো মাত্র। পেটের উপর মেঘালয়ের স্পর্শ পেয়ে চমকে ঘুমটা ভেঙে গেলো মিশুর৷ শরীরটা শিউরে উঠলো। আঁৎকে উঠতে গিয়েও উঠলো না। অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। নিশ্বাস বন্ধ করে থাকার চেষ্টা করলো।
মেঘালয় চোখ দুটো পিটপিট করছে৷ চোখ সরাতে পারছে না। হাতটা একটু নড়াতেই মিশু বাঁধা দিয়ে মেঘালয়ের হাত ধরে ফেললো৷ মেঘালয় মিশুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে হাতটা সেখান থেকে সরিয়ে ফেললো৷ এরপর অন্য হাতটা দিয়ে পেটটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। মিশু এবার আর সহ্য করতে পারছে না। অস্থির হয়ে উঠে বসলো বিছানার উপর।
আবছা আলো আবছা অন্ধকারে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘কি করছেন আপনি?’
– ‘সরি মিশু।’
সরি বলেই মাথাটা নামিয়ে ফেললো৷ সরি শব্দটা মেঘালয় এমনভাবে বললো যে মিশুর নিজেকেই অপরাধী মনে হলো৷ মেঘালয়ের বাহুতে হাত রেখে বললো, ‘কি হলো আপনার? রাগ করছেন?’
– ‘না, তুমি হয়ত এসব পছন্দ করোনা। আসলে আমি কিচ্ছু করিনি বিশ্বাস করো। দেখছিলাম শুধু।’
ফিক করে হেসে ফেললো মিশু। হাসতে হাসতে বললো ‘আপনি যেন আমার কে?’
– ‘মানে!’
– ‘আজব! আপনি আমার বর সেটাও জানেন না?’
মেঘালয় নিজেও হেসে ফেললো। মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে বললো, ‘তুমি খুব সুইট একটা মেয়ে মিশমিশ।’
কথাটা বলেই মেঘালয় মুখটা এগিয়ে নিয়ে আসছিলো। মিশু বললো, ‘বন্ধ করুন।’
মেঘালয় চমকে মিশুর মুখটা ছেড়ে দিয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘ফোনের টর্চটা বন্ধ করুন।’
বলেই আবারো হাসলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে ফোনের আলোটা নিভিয়ে সেটা শিয়রে ছুড়ে মারলো। খপ করে মিশুর মাথাটা ধরে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ৭৪ কেজি ওজনের শরীরটার নিচে পড়ে মিশু ছটফট করতে শুরু করেছে। অন্যরকম ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছে। অন্ধকারে মেঘালয় এ কোন বিপজ্জনক রকমের আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো বুঝে উঠতে পারলো না মিশু৷ শুধু দুহাতে মেঘালয়ের মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে রইলো।
পেটের উপর মেঘালয়ের মাথাটা চেপে ধরে কতক্ষণ কেটে গেছে কেউই বলতে পারলো না। এক পর্যায়ে এসে মিশু বাঁধা দিয়ে বললো, ‘আমার না বড্ড ভয় করছে।’
মেঘালয় মিশুকে বুকে নিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে বললো, ‘তাহলে ঘুমানোর চেষ্টা করো৷ আমি কখনও কোনোকিছুর ব্যাপারে জোর করবো না।’
মিশু মেঘালয়কে জাপটে ধরে বললো, ‘আপনি এত ভালো কেন?’
– ‘বারে সবসময়ই তো বলো, আপনি একটা খুব খারাপ। আজকে আবার এত ভালো হয়ে গেলাম?’
– ‘না, আপনি সত্যিই একটা খুব খারাপ। কিন্তু এই খারাপটাকেই আমার ভালোলাগে, খুব ভালোলাগে। কারণ এই খারাপ মানুষটার দুষ্টুমি গুলো শুধু আমি জানি৷ আর কেউ জানেনা।’
(পাঠকরা মনেমনে বলছে, ‘আমরাও জানি’)
২৩.
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে বাবা একটা টিকেট মেঘালয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘শ্যামলী, বিকেল চারটায় ছাড়বে।’
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, ‘টিকেট ও কাটা হয়ে গেছে!’
বাবা মুচকি হেসে বললেন, ‘কালকেই হয়ে গেছে। রাতে তোমাকে দেইনি, ভাবলাম সকালে একটা সারপ্রাইজ হবে দুজনের জন্য।’
মিশু ও মেঘালয় দুজনেই হা হয়ে চেয়ে আছে বাবার দিকে। বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেছে। বাবা বললেন, ‘টিকেট তো দুদিন আগেই করে রাখতে হয়। সিটটা প্রথম দিকে নিতে পারিনি, মাঝখানের দিকে হয়েছে৷ সমস্যা হবে?’
মেঘালয় কৃতজ্ঞতার ভংগীতে হেসে বললো, ‘আরে না না। কোনো সমস্যা হবেনা। আমার তো একেবারে অবাক লাগছে।’
– ‘আর হ্যা, আমি রয়েল টিউলিপে বুকিংয়ের ব্যাপারে কথা বলে রেখেছি। তোমরা গিয়ে শুধু টাকা দিয়ে রুমে চলে যাবে।’
মেঘালয় ও মিশু হা হয়ে বললো, ‘বাবা!’
দুজনকে এভাবে অবাক করে দিতে বাবার দারুণ মজা লাগছে৷ কক্সবাজারের ফাইভ স্টার হোটেল হচ্ছে রয়েল টিউলিপ। বিলাসবহুল আর মানের দিক থেকেও সেরা। সেখানে বুকিংয়ের কথা শুনে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। সত্যিই সারপ্রাইজ ছিলো বটে।
বাবা বললেন, ‘সৌদিয়ার টিকেট কাটতাম কিন্তু রংপুর থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়ার জন্য শ্যামলীই আছে শুধু। আর এখন তো শীতকাল, এসির দরকার হবেনা।’
মেঘালয় বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এমনিতেও এত বিলাসিতার দরকার ছিলোনা বাবা। আপনি এতকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলবেন ভাবতেও পারিনি।’
– ‘মেয়ের জন্য এইটুকু তো করতেই পারি। বিয়েতে কোনো খরচই করতে পারিনি৷ আর তোমার সন্তুষ্টির একটা ব্যাপার আছে তো৷’
– ‘সত্যিই আব্বু অবাক লাগছে। আপনি অনেক মহান।’
– ‘হা হা হা।’
সবাই মিলে কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করলো৷ খাওয়াদাওয়ার পর মা মিশুকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বললেন কাপড়চোপড় কেনাকাটার জন্য। মেঘালয়ের কোনো জামাকাপড় নেই। মেঘালয় রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে এরকম আতিথেয়তা দেখে৷ বাবা গ্রামের মানুষ হলেও মিশুর চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। মার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফিরলো দুপুরবেলা। লাঞ্চ সেরে লাগেজ গুছিয়ে নিতেই বিকেল হয়ে এলো। বাসার সবার থেকে বিদায় নিয়ে নবদম্পতি বেড়িয়ে পড়লো হানিমুনের উদ্দেশ্যে৷ বাস ছাড়লো বিকেল চারটায়। বাস ছাড়ার পর মিশুর আনন্দ আর দেখে কে?
একদিকে মেঘালয়ের মত একজন সাথী, অন্যদিকে “দ্যা জার্নি”..
চলবে..