#১৯তম পর্ব মায়ার_বাধঁন

১৯. ★★★★
পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত!কারো চলে যাওয়াতে কিছু যায় আসে না!পৃথিবীর কিছুই বদলায় না।সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক নিয়মেই চলে।এই তো মাসখানেক আগে যখন আমার শাশুরী ফোন করে বললেন,সানা এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে!তখন কি রিয়েক্ট করবো বুঝতে পারছিলাম না!হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোটবেলার সেই আনন্দময় কিছু স্মৃতি! দুজনের খুনসুটির মুহূর্ত,স্কুলে যাওয়ার সময় ওর আমার কাছে করা ছোট-খাটো কিছু আবদার,কারনে-অকারনে আমাকে রাগানো,আমার জিনিস নিয়ে পালিয়ে যাওয়া।ঐসব মুহূর্তগুলো মনে করে নিরবে কিছুক্ষণ কাদঁলাম।আমি তো এমন চাই নি।আমি তো সব সময় চেয়েছি ও যাতে সুখী হতে পারে।ওকে সুখী করতেই তো আমি আমার এত কষ্ট করে সাজানো #মায়ার_বাধনঁ ছেড়ে চলে এসেছি।ও আমার সাথে যেরকম ব্যবহার করুক না কেনো আমি সব সময় ওর সাথে ভালো ব্যবহার করেছি,ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছি,ওর হেদায়েতের জন্য দোয়া করেছি!ও মারা গেছে কথাটি ভাবতেই খুব কান্না পাচ্ছে!আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।কষ্ট
সহ্য করতে না পেরে আমি হসপিটালে গিয়েছিলাম ওকে দেখতে!গিয়ে দেখি ও নিরব হয়ে চিরকালের নিদ্রায় শায়িত আছে।
ওর পাশে শুধু আমার শাশুরী মা ছাড়া আর কেউ ছিলো না।সায়ান আর বাবা হসপিটালের ফর্মালিটি পূরন করতে ব্যস্ত ছিলেন আর ভাবি উনার দুই ছেলেকে নিয়ে বাসায় চলে গেছিলেন!
মা আমাকে প্রতিবারের মতো এবারও বাসায় চলে আসতে বার বার অনুরোধ করেছিলেন।সায়ান নাকি এ কয়মাসে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছেন।উনি সব সময় জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করার চেষ্টা করেন।মার কাছ থেকে নাকি উনি প্রায়ই আমার খোঁজ-খবর নেন।গত মাসে উনি আমি যে জায়গায় থাকি সেখানের ঠিকানাও নাকি চেয়েছেন মায়ের কাছে।সানাকে নাকি উনি বুঝিয়েছিলেন আমাকে বাসায় নেয়ার জন্য।সানাও বুজি রাজি হয়েছিলো।কিন্ত মা আমি বারণ করার কারনে আমার ঠিকানা দেন নি।
মায়ের কথার প্রতিউত্তরে আমি বলেছিলাম আমি উনার মতো বেদ্বীন স্বামীর ঘরে কোনদিনও ফিরবো না!উনার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে কষ্টকর।আর তাছাড়া আমি ফিরলেও আগের মত অশান্তি নিয়েই আমার জীবন কাটাতে হবে।আমি আমার ফুপির বাসায় ভালো আছি!আমার ফুপিও একা এক মেয়েকে নিয়ে এত বড় বাড়িতে পড়ে আছেন!আমি উনার সাথে থাকায় উনি বরং আরো বেশী খুশী।ডেলিভারির পর জবের জন্য এপ্লাই করবো!এভাবে তো আর পরের উপর নির্ভর করে জীবন চলে না।পরে লোকের কত কটুকথা শুনতে হয়।
মা আমার কথাগুলো শুনে আর কিছু বলেন নি!আমি বুঝতে পেরেছিলাম মা আমার কথাগুলো শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছন।কিন্ত আমিই বা কী করবো!এত কষ্ট করে জীবনটাকে একটু গুছিয়েছি!আমি চাই না আবার কোন অশান্তির কারন হতে!আগে যদিও একা ছিলাম!এখন তো আর আমি একা নই।আমার সাথে করে আরেকজন বেড়ে উঠছে।
পুরনো কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!হঠাৎ ফোনের শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গে।ঘুম ঘুম গলায় কথা বলে উঠলাম,
-আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন আপনি ?
ওপাশ থেকে কেউ জোরে দ্রীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর আরো কিছুক্ষণ নিরবতা!আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে
ফোনটা আরেকবার চোখের সামনে ধরলাম।ঘুমের ঘোরে কে ফোন দিয়েছে তা না দেখেই ফোন ধরেছি।
কিন্ত ভালো করে দেখার পর নম্বরটা চিনতে আমার অসুবিধা হলো না! আর তখনই মুহূর্তেই
আমার ঘুমের ঘোর পুরোপুরি কেটে গেলো।স্তব্ধ বিস্ময়ে ফোনটা আমার হাত থেকে পড়ার উপক্রম হলো।এই দ্রীর্ঘশ্বাসটা আমার খুব চেনা।আমার মনে হচ্ছিলো এতগুলো নির্ঘুম রাতের ঘুমের নেশা হয়তো এখনও কাটে নি। সে কারণেই কী শুনতে কী শুনে ফেলেছি।।
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললাম,
-কী ব্যাপার আপনি
কথা বলছেন না কেনো ?
বুকের ভেতরটা ক্রমেই
কেঁপে উঠছে আমার।
ফোনের ওপাশ থেকে সায়ানের গলার স্বর এলো!
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম!কেমন আছো সাফা!শরীরটা এখন কেমন?কথাগুলো বেশ মিনমিন করে বললেন তিনি!
‘কেমন আছো’ এই কথাটা জিজ্ঞেস করতেও মনে হচ্ছিলো উনার কেমন যেন সংকোচ হচ্ছে।
উনার কথা শুনে বললাম,
– একটা মেয়ের এই অবস্থায় যখন তার স্বামী,তার সংসার তাকে ছেড়ে চলে যায়!তারপর যতটুকু ভালো থাকার কথা তার থেকে অনেক বেশীই ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।আর কিছু শুনতে চান আপনি?কি জন্য ফোন করেছেন এতদিন পর? কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।
আমার কথাগুলো শুনে উনি বললেন,
-সেদিন তুমি হসপিটাল থেকে চলে যাওয়ার পর মা তোমার জন্য খুব কান্না করেছেন!আমি আসার আগেই তুমি চলে গেলে সাফা!একটিবার আমাকে কথা বলারও সুযোগ দিলে না!মা বার বার বলছিলেন তুমি খুব অসুস্থ!তোমার এভাবে পরিবারবিহীন একা থাকা উনি মেনে নিতে পারছিলেন না!জানোই তো !মা তোমাকে কতটা ভালবাসেন।
আমি উনার কথা শুনে বললাম,
-দেখুন আমার শরীর এখন আগের থেকে ভালো।ডাক্তার বলেছে এই সময় মেয়েদের একটু-আধটু
সমস্যা হয়।মাকে বলবেন আমার জন্য চিন্তা না করতে!
আপনার কথা শেষ হলে আমি এখন ফোনটা রাখতে পারি!
আমার কথা শুনে উনি বললেন,
-না সাফা প্লিজ ফোনটা রেখো না!
তুমি তো আগের নম্বর পাল্টে ফেলেছো।
তোমার নতুন নম্বর কত কষ্ট করে মায়ের কাছ থেকে এনেছি।আমি জানতাম তোমার সাথে মায়ের যোগাযোগ আছে।
তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে সাফা!
হঠাৎ উনি কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন,
-আমাকে মাফ করা যায় না সাফা!
প্লিজ সাফা প্লিজ!ফিরে এসো না আমার জীবনে!
তুমি চলে যাওয়ার পর আমি বুঝেছি তুমি কী ছিলে আমার জীবনে!সানা তো আমার জীবনে দমকা হাওয়ার মত এসে আমার জীবনটা ওলট-পালট করে দিয়ে চলে গেলো!ওর সাথে আমি কখনো সুখী হই নি!ওর নিত্য নতুন বায়না আমি জাস্ট নিতে পারছিলাম না।তারপরও সংসারে শান্তি বজায় রাখতে ওর সব আবদার পুরণ করার চেষ্টা করেছি।
আমি উনার কথাগুলো শুনে বললাম,
-ও মারা গেছে! ওর সম্পর্কে এসব কথা বলবেন না প্লিজ….
উনি আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-তোমার সাথে যোগাযোগ করার কত চেষ্টা করেছি!কত ফোন দিয়েছি তোমার ফোনে!কিন্ত বার বার তোমার ফোন বন্ধ দেখায়!তারপর বাধ্য হয়ে তোমার ভাবির ফোনে কল করে তোমার সাথে কথা বলতে চাই!কিন্ত তোমার ভাবিও আমার সাথে খারাপ আচরণ করে ফোন রেখে দেন।তারপর একদিন তোমার বাসায়ও গিয়েছিলাম!কিন্ত বাসায় তোমাকে আমি পাই নি!তুমি তোমার ফুপির বাসায় গিয়েছিলে।শেষবারের মত ঐ দিন বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে ছিলেন!আমি নিরবে উনার সব কথা শুনেছিলাম।তারপর তো বাবা চলে গেলেন!পরের বার তো আর বাবাকে পেলামই না!বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে।কথাগুলো বলে উনি দ্রীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
আমি উনার কথা শুনে বললাম,
-আমি সবেমাত্র এইসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছি।এখন আপনি যদি আবারও এই সময় কোন রকম কথা বলে পুরনো ঘা তাজা করে তোলেন!
তো আমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বো।
এখন সানা চলে যাওয়ায় আপনি মনে হয় একা হয়ে গেছেন!তাই তো আপনার একাকিত্ব
দূর করতে এখন আমাকে প্রয়োজন !আবার প্রয়োজন যখন শেষ হবে তখন আমাকে আবার ছুড়ে ফেলে দিবেন না তার কী কোন নিশ্চয়তা আছে!
উনি চুপ করে আছেন । তার কাছে এ প্রশ্নের হয়তো কোনো জবাব নেই। অনেক সময় আমাদের কাছে, অনেক প্রশ্নের জবাব থাকে না। চেয়েও আমরা কিছুই বলতে পারি না।এই মুহূর্তটাও ঠিক তেমনই।
উনার কোনো উত্তর না পেয়ে আমি বললাম,
-আপনি খুব পাষাণ।খুব খারাপ।
উনিও অস্ফুটস্বরে বললেন,
-আই এম স্যরি সাফা। প্লিজ ফরগিভ মি।
আমি কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে বললাম,
-আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ। নেভার, এভার!
খুব কান্না পাচ্ছিলো আমার!তাই ফোনটা কেটে চুপচাপ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।কাত হয়ে শুয়ে পড়ায় বুঝতে পারলাম আমার চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।সে পানিটুকু শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলাম।কিন্তু কোনো লাভ হলো না।আবার অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ছে।
পরের দিন বিকেলে রাফার সাথে বসে গল্প করছিলাম!এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।
দরজা খুলে আমি যাকে দেখলাম তাতে আমার হাসি-খুশি মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল।


চলবে ইনশাআল্লাহ,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here