#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৮
#আসেফা_ফেরদৌস

হাতে একটা বাটি নিয়ে পাশে এসে বসল মল্লিকা। মনে মনে কিছুটা থমকে গিয়েছে, আশ্চর্য! ফয়সাল ওর দেয়া পাঞ্জাবিটা পরেছে! চমৎকার লাগছে তো! অযথাই ছেলেটা বলে মেরুন রঙে মানায় না তাকে, অথচ, বেশ সুন্দর লাগছে।
মল্লিকা বলল, বাহ্ হঠাৎ তোমার মনোভাবের এত পরিবর্তন, এই পাঞ্জাবিটা পরেছ!
হ্যাঁ, আজ ইচ্ছে হলো তাই পরলাম।
না, ভালো লাগছে, সুন্দর মানিয়েছে সত্যি।
ফয়সাল তাকিয়ে আছে। উত্তর দিলো না।
শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ একটু।
হবে না, রেস্ট নিয়েছ তুমি গত দুদিন? এক ফোঁটাও না! অফিস, তৌফিক ভাইয়ার বাসা, এখানে সেখানে যাওয়া আসা, সব করেছ, আমরা যাই বলি তার উল্টোটা করে সুখ পাও তুমি! তোমাকে আর কথা বলার দরকারটা কি, অযথাই বকবকানি! আলতো ধমক মেয়েটার কন্ঠে।
ফয়সালের ঠোঁটে ক্লান্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে আপনমনে কিছু একটা ভাবছে হয়ত।
একটু সিদ্ধান্তহীন কন্ঠে মল্লিকা বলল, আচ্ছা, কাল আবার তৌফিক ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার কিংবা সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার কী প্রয়োজন ছিল? বারবার বারবার তো নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু তুমি শুনলে না, ঠিক চলে গিয়েছ! এতটা বাড়াবাড়ি কেন, তাছাড়া, জানো না ডাক্তার কী বলেছে তোমাকে?
জানি। কিন্তু আজকাল কারো কথা শুনতে ইচ্ছে হয় না, ভালো লাগছে না কিছু!
না, তা লাগবে কেন! তুমি তো সবসময়ই এমন, খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না! মল্লিকা চটে গিয়েছে কিনা বলা মুশকিল কিন্তু কপালে ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
আমাকে তোমার মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত লাগে তাই না? ফয়সালের প্রশ্নটা তির্যক হলেও কন্ঠের গাম্ভীর্য যেন ধরা যায় না।
হাসছে মল্লিকা। বলল, হঠাৎ এ প্রশ্ন?
এমনি! আচ্ছা বাদ দাও, বলো তো, বাটিতে কী?
মালাই চপ।
আবার মিষ্টি বানিয়েছ?
হ্যাঁ, মিষ্টি এমন একটা জিনিস যা বারবার বানিয়ে প্র্যাকটিস করতে হয়, নয়ত নিখুঁত করা মুশকিল।
হ্যাঁ, দুধ কিনে তো আর কুলানো যাচ্ছে না, এই দূর্মূল্যের বাজারে তোমার শখ মেটাতে গিয়ে আমার তো বারোটা বেজে যাবে।
এভাবে বললে ফয়সাল? একদিনের জায়গায় দুদিন মিষ্টি বানিয়েছি বলে! আরে, তোমার জন্যেই তো! যাও, আর বানাব না!
উঠে বসল ছেলেটা। একটু হেসে ওর প্রশ্ন, আমার জন্য? বেশ তো! বাটি টান দিয়ে মিষ্টি খেতে শুরু করেছে সে। বলল, না, খারাপ হয়নি।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মল্লিকা, ফয়সাল সাধারণত এভাবে কথা বলে না। মেয়েটা ওর জন্য শখ করে কিছু বানালে ভীষণ খুশি হয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করাই তার স্বভাব! মাঝেমধ্যে প্রশংসাটা মিস করে গেলেও ফয়সালের খুশি বা পরিতৃপ্তি বুঝে নিতে কষ্ট হয় না একদম। অথচ আজ কী হলো!
খানিক সময় নিলো মেয়েটা এরপর সরাসরি বলল, আচ্ছা ফয়সাল, সত্যি করে বলবে কী হয়েছে তোমার, কদিন ধরেই লক্ষ করছি তোমার মধ্যে কেমন যেন কাটা কাটা ভাব, আমাকে যেন কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাও, কী যেন ভাবো সারাক্ষণ, ব্যাপারটা কী? মল্লিকার কন্ঠে স্পষ্ট সন্দেহ, কিছুটা মায়াও সম্ভবত বোঝা যায়।
ফয়সালের দৃষ্টি স্থির। বলল, যাক! আমাকে বুঝতে পারো তাহলে! খুশি হলাম। এতটা উপলব্ধি যে করতে পারবে তা অবশ্য আশা করিনি!
ওমা, এ আবার কেমন কথা? এতবছর পর এমন ভাবনা কি অবান্তর নয়?
কেন, অবান্তর হবে কেন? আমার তো আজকাল মনে হয় এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়েও আমি এখনো তোমাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারিনি!
মানে? মল্লিকার চেহারা এবং কন্ঠে স্পষ্ট হাসির আভাস!
উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফয়সাল, একপর্যায়ে চোখ নামিয়ে খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলতে শুরু করল, ভাইয়ার সাথে ভাবির প্রায় তিনবছরের বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধুত্বটা একপর্যায়ে প্রেমে গড়ায়, প্রেম থেকে বিয়ে। ভাইয়া মেধাবী ছাত্র, দেখতে শুনতে চমৎকার, তার হাজারটা গুণ! ভাবিও অবশ্য কম গুণবতী মেয়ে নন, বিয়ের পর প্রায় তিন তিনটে বছর ওদের সম্পর্কের সমীকরণটা কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, ফাওয়াজ ভাইয়া আর লতা ভাবির মধ্যে বোঝাপড়া চমৎকার, সংসার সন্তান, চাকরি এবং বর্তমান প্রবাসজীবন সবকিছু সামলেও ওদের ভালোবাসাটা এখনও সতেজ, পরস্পরের প্রতি উভয়ের হৃদয়ের টান আজও সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়।
ওর বিয়ের আগে পরে ভাইয়া প্রায়ই আমাকে দুষ্টুমির ছলে বলত, লেখা‌পড়াটা ভালোভাবে করলি না, চাকরি বাকরিও হলো না, আরে চাকরি বাকরি ছাড়, তুই তো একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারিসনি! পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষে জীবনে কখনো না কখনো পস্তাতে হবে তোকে দেখিস! আমি হাসতাম। আসলে আমি বরাবরই বাউন্ডুলে ধাঁচের, কোনো কাজে ঠিকমতো মন বসাতে পারি না, হৈ হুল্লোড়, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, অযথা দলবেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা, চায়ের দোকানের জটলায় বসা, যখন তখন ভালোমন্দ কিছু খাওয়া এসবই ভালো লাগে। ভাইয়া অবশ্য এমন নয়, তাছাড়া আমার চেয়ে ভাইয়া এবং ফাইজা অনেক বেশি সফল। ভাইয়া তো চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে গেল, ফাইজাও অনেক ভালো রেজাল্টের অধিকারী, কিছুদিন আগেও ভালো চাকরি ছিল ওর, সে সমাজে প্রতিষ্ঠিতই বলা চলে, আমি যে এমন কিছু করতে চাইনি তা নয়, কিন্তু আমার জন্য সুযোগ আসেনি।
একথার পর খানিকক্ষণ নীরবতা, হঠাৎ ফয়সাল বলল, কথাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক হলো না, আসলে আমার যোগ্যতাই নেই। আর প্রেম ভালোবাসার কথা যদি বলো, তবে আমার আশেপাশের পরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত মেয়েরা কখনো আমাকে ভাই, কখনো সহপাঠী কখনো বা বন্ধুর দৃষ্টিতে দেখেছে এর বেশি কিছু হয়নি, আমি আক্ষেপও করিনি! মেনে নিয়েছিলাম, মেনে নিয়েছিলাম যে, সম্ভবত মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ বা মন জয় করার ব্যাপারটা আমার মধ্যে খুব একটা নেই! কারণ জীবনে দু একবার দু একজনকে ভালো লাগলেও তাদের স্বাভাবিকভাবেই অন্য কাউকে ভালো লেগে গিয়েছে।
আর ভেবেচিন্তে এখন মনে হয়, আমি হয়ত পরিবারেও কিছুটা অবহেলিতই। মা, বাবা আমাদের সবাইকে সমান সুযোগ সুবিধায় বড় করতে চেষ্টা করেছেন, কখনো কখনো সাধ্যের অতিরিক্ত করেছেন, আমাকে কোনোকিছুর অভাব বুঝতে দিয়েছেন এমনটা না! তারপরও আমি জানতাম মা ভাইয়াকে একটু বেশি আদর করেন, বাবা ফাইজাকে! আর আমি সবারই সমান পছন্দের। কম বেশির বিষয়টা আমার ক্ষেত্রে নেই!
কী ব্যাপার ফয়সাল, তোমার মন খারাপ নাকি? আজ হঠাৎ এসব কী বলতে শুরু করেছ! কিছুই বুঝতে পারছে না মল্লিকা।
হাসছে ফয়সাল। বলল, না, তেমন কিছু না, এমনি! একটা বিষয় যন্ত্রণা দিচ্ছে বেশ, চেষ্টা করেও ভুলে যেতে পারছি না। তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলি, হয়ত ভালো লাগবে। আচ্ছা, তো কাজের কথায় আসি, ফাওয়াজ ভাইয়ার বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় আমারও বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো, মা তোমাকে পছন্দ করলেন। কথাবার্তা পাকা হবার আগেই বায়োডাটার সঙ্গে তোমার ছবিটা দেখেছিলাম, ব্যাস! আমার মনে ধরে গেল। কতবার যে দেখেছি তার সঠিক হিসাব নেই আসলে। এরপর তো সামনাসামনি দেখলাম, আমাদের আলাপ হলো, বলতে গেলে আকাশ থেকে পড়লাম আমি, ভাবছিলাম, একি! এই মেয়ে তো‌ দেখি লতা ভাবির চেয়েও বেশি সুন্দর, এমন একটা মিষ্টি মেয়ে কি সত্যিই আসবে আমার জীবনে? মনে তো হয় না!
কিন্তু সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং কৌতুহলের অবসান ঘটিয়ে তুমি ঠিকই জীবনে এলে, আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো অবস্থা হলো আমার, মিথ্যে বলব না, তুমি সবসময়ই আমাকে মুগ্ধ করেছ, আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্ব কিংবা আন্তরিকতায় কখনো খুব একটা অবহেলা দেখিনি।
কিন্তু তোমার পরিবারের বেলায় এমনটা হয়ত পারিনি আমি। নিজের কর্তব্য থেকে পিছিয়ে এসেছি মাঝেমধ্যেই! তুমি বাবার বাড়ি গেলে এ বাসাটা খালি খালি লাগে রীতিমতো! তাই দু একদিনের মধ্যেই তোমাকে নিয়ে আসতে আমি ও বাড়িতে গিয়ে হাজির হই।
তাছাড়া, তোমাদের বাড়ির গেট টুগেদারে খাপ খাওয়ানো আমার জন্য একটু সমস্যাই, বাবা এবং দুলাভাই দুজনেই‌ উচ্চশিক্ষিত, দুলাভাই বেশ ভালো চাকরি করছেন, বাবাও সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, তাছাড়া, দুজনের আলাপ আলোচনা বা পছন্দের গন্ডিটা এক রকম, তারচেয়েও বড়ো কথা, দুলাভাইয়ের সঙ্গে আপুর প্রেমের বিয়ে, বিয়ের আগেও অনেকবার দুলাভাই গিয়েছেন তোমাদের বাড়িতে, তিনি মিশুক প্রকৃতির মানুষ, সহজেই সম্পর্কটা গভীর করে নিতে পেরেছেন। তাই হয়ত বাবা, মা দুলাভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে, মিশতে যতটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আমার বেলায় ঠিক তেমনটা করেন না, আমি বলছি না যে, আমাকে তারা কম আদর করেন বা এমন কিছু, কিন্তু নিজেকে এমন আলাপচারিতায় বা ঐ পরিবেশে বেমানান লাগে আমার, আসলে অপারগতাটা নিজেরই, আমি দুলাভাইয়ের মতো না, এত বছরেও তোমাদের বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি। সেজন্যই তোমার পরিবারের সাথে সম্পর্কটা হয়ত স্বাভাবিকই রয়ে গেছে, তেমন একটা আন্তরিক হয়ে ওঠেনি!
সবমিলিয়ে ও বাড়িতে খুব একটা থাকা হয় না আমার, ধরে নিয়েছিলাম এত বছরে তুমি হয়ত আমার অপারগতা, অস্বস্তি, এবং ভালোবাসার সবটা বুঝে নিয়েছ, কিন্তু তেমন কিছু হয়নি বোধহয়! আচ্ছা, তোমার এই যে না বুঝতে পারা এক্ষেত্রে ব্যর্থতাটা কি শুধুই আমার?
কী বলছ ফয়সাল এসব? কেন বলছ, কী হয়েছে?
না, না, কিচ্ছু হয়নি! আচ্ছা আমাদের কথায় আসি, বিয়ের পর একসঙ্গে আমাদের জীবনের অধ্যায় শুরু হলো, টক, ঝাল, মিষ্টি মধুর চমৎকার অধ্যায়! প্রথম একটা দুটো বছর তো স্বপ্নের মতো গিয়েছে। হাসি আনন্দ, চাওয়া, পাওয়া মিলেমিশে স্বর্ণালী সময়! এরমধ্যে মুকুল এলো, মুকুলকে ঘিরে কত স্মৃতি, কত গল্প, কত অভিজ্ঞতা! প্রথম প্রথম তোমাকে আমি স্বল্পভাষী ভাবতাম, ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলাম, না, তুমি তো অনেক কথা বলতে জানো, এবং তোমার কন্ঠস্বরও বেশ জোরালো। তুমি মাঝেমধ্যেই আমার উপর চটে যাও, মল্লি বা মুকুলের মা বলে ডাকলে তোমার সহ্য হয় না, আমার কাজকর্ম এবং অভ্যাসে মাঝেমাঝেই কপালে ভাঁজ পড়ে তোমার, ব্যাপারগুলোকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়েই সুখেই ছিলাম আমরা,
আমাদের বিয়ের বেশ কবছর পর শামীম ফাইজার বিয়ে হলো, পরিবারের পছন্দেই হলো, ওদের মধ্যেও মাখামাখি প্রেম! ভাইয়া, ভাবি, শামীম ফাইজা, সবাইকে দেখলে মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমাদের মধ্যে গড়বড়টা কোথায়! সব তো ঠিকই আছে, তাহলে হৃদয়ের টানের সুতোয় ঢিলটা পড়ল কোথায়!
অনেক ভেবেচিন্তে মনে হতো, সবার প্রকাশভঙ্গি তো একরকম হয় না, তুমি অতিমাত্রায় বাস্তববাদী মেয়ে, তাই হয়ত আমাদের ভালোবাসাটা এমন!
কিন্তু সেদিন, সেদিন যখন তোমাকে আরফানের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখলাম, তখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল আসলে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here