#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০২
#আসেফা_ফেরদৌস

মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়েছে ফয়সালের। একটু বিগলিত হয়ে বলল, যাক, শেষমেশ তাহলে আমাকে মনে পড়ল! তোমার মন মেজাজের যে অবস্থা ভেবেছিলাম, আজ বুঝি নাশতা জুটবে না!
উত্তর না দিয়ে বিছানার উপর একটা পেপার বিছিয়ে ট্রেটা রাখল মল্লিকা। এরপর নিজে গিয়ে বসল ড্রেসিং টেবিলের সামনে।
এমনিতেই ছেলেটা খিদে সহ্য করতে পারে না তার উপর সারাদিনের পরিশ্রম, ফয়সাল দেরি না করে ঝটপট বাটির ঢাকনা ওঠাল, পরোটা আর সুজির হালুয়া দেয়া হয়েছে।
সুজির হালুয়া জিনিসটা ওর খুব একটা পছন্দ না। মনটা একটু খারাপ হলো, খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, সঙ্গে ঝাল‌ কিছু নেই? তরকারি টরকারি হয়নি কিছু?
উত্তর নেই। মল্লিকা ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। মাথা আচড়াচ্ছে চুপচাপ।
মিনিটখানেকের মতো অপেক্ষা করে পরোটা ছিঁড়ে খেতে শুরু করল ফয়সাল।
দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছে না, তবে ফয়সাল মল্লিকার ফোনের টুংটাং নোটিফিকেশন শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।
না এভাবে বসে থেকে লাভ নেই। কথা শুরু করার চেষ্টা করতে হবে।
ও বলল, তোমাকে বড়ো ড্রেসিং টেবলটা কিনে দিয়ে তো ভালো বিপদে পড়লাম মল্লি, আমাদেরকে ভুলে গিয়ে দিনরাত তুমি দেখি ঐ আয়নার সামনেই বসে থাকো!
কটমট চোখে ফিরে তাকিয়েছে মেয়েটা। কিন্তু চোখ ফেরাতে সময় লাগল না!
মল্লিকা আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, বিছানা থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে ফয়সাল।‌
ওর কাছাকাছি বেশ‌ একটু ঝুঁকে এসে আয়নায় চোখ রেখে বলল, বাঃ! কী চমৎকার! মল্লি, সত্যি বলছি, তুমি আজও দেখতে সেই প্রথম দিনের মতোই মিষ্টি, সৌভাগ্য বটে আমার! তবে ‌কথায় কথায় তোমার রেগে যাওয়ার অভ্যাসটা ঝেড়ে ফেললে ভালো হতো না? আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচতাম!
বিরক্ত করবে না ফয়সাল! মেজাজটা অসম্ভব তেতে আছে। তাছাড়া, বাইরের লোক আছে বাড়িতে আমি রেগে গিয়ে হাতের কাছে থাকা দু একটা জিনিস ভেঙে টেঙে ফেললে মা ছুটে আসবেন! ব্যাপারটা ভালো হবে না। প্লিজ বিছানায় ফিরে গিয়ে নাশতাটা শেষ করো! কথাগুলো বলার সময় মল্লিকা ঘাড় ঘোরায়নি কিন্তু ওরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে আয়নায়।
অট্টোহাসিতে ফেটে পড়েছে ফয়সাল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল, আরে, আরে! মুকুলের মা বলে কী! তাছাড়া, এ ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস তোমার পছন্দ, এসবের একটাও যে তুমি ভাঙবে না তা তো আমি জানি! তবে মুকুলের মা, মুকুলের দাদিকে এতটা ভয় পায় শুনে মজা লাগল!
মল্লিকার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল, দম টেনে বেশ গম্ভীর গলায় বলল, মাকে আমি ভয় পাই না, তবে শিষ্টাচার কিংবা ভদ্রতা বলে একটা ব্যাপার আছে!
-আরে, আরে, মল্লি! তুমি কেঁদে ফেলবে নাকি? আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম, দেখতে দেখতে এতগুলো বছর একসঙ্গে পার করে ফেললাম, তারপরও কি চেনোনি আমায়?
-ফয়সাল প্লিজ! আমি এখন ঠাট্টা মশকরার ম্যুডে নেই, ভালো লাগছে না! প্লিজ একটু বুঝতে চেষ্টা করো, সবসময় তামাশা জিনিসটা নেয়া যায় না! তুমি নাশতা শেষ করে বাবার সঙ্গে গিয়ে আড্ডা দাও, আমার হাতে অনেক কাজ! আর হ্যাঁ, আমার খুব সুন্দর একটা নাম আছে মল্লিকা। নামটা এমনিতেই ছোটো, এটাকে আর ছোটো করার দরকার নেই! এ কথাটা তোমাকে আমি হাজারবার বলেছি, আজ আবারও বললাম, প্লিজ কথাটা একটু শোনো, আর কথায় কথায় মুকুলের মা, মুকুলের মা বলে ডাকবে না, নিজেকে কেমন বয়স্ক, বয়স্ক লাগে!
ফয়সাল মল্লিকার ঠিক পেছনে দাঁড়ানো। ও হাসছে চুপচাপ। তবে চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় সে কষ্ট পেয়েছে।
মল্লিকা উঠে দাড়াতেই বলল, সরি মল্লিকা! কাল একবার বলেছিলাম তুমি শুনতে চাওনি, আজ আবার আবার বলছি, আমাকে আমার কথাগুলো বলার একটা সুয়োগ দাও প্লিজ!
মল্লিকা ঘুরে তাকাল। চেহারায় অভিমান স্পষ্ট। দড়াম করে দরজাটা লাগিয়েই ফয়সালকে টেনে এনে বসাল বিছানায়, এরপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, বলো কী বলবে!
-এতটা কড়া গলায় বললে কি কথা বলা যায়?
তো আর কীভাবে বলব! কীভাবে বললে আমাকে বুঝতে চেষ্টা করবে তুমি? নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের সামনে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে শিখবে! আমিও একটা মানুষ ফয়সাল, তোমার মতো আমারও কিছু চাওয়া পাওয়া আছে! মেয়েটার চাপা গলায় চিৎকারের স্বর।
-আশ্চর্য! তুমি তো এমনভাবে বলছ যেন তোমার কোনো আবদারই রক্ষা করা হয় না। এ তো অন্যায় মল্লিকা! আমি সবসময় তোমার মনের দিকে তাকাই, কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। একটু বুঝতে চেষ্টা করো, আমরা চাইলেও এবার আপু দুলাভাইয়ের সঙ্গে যেতে পারতাম না!
-কেন পারতাম না, বলো না, কেন? কারণ তোমার ইচ্ছে নেই সেজন্যই তো? ননসেন্স! তুমি সবসময় চাও, তোমার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের সাথে আমি হাসিখুশি ভাবে মিশি, তোমাদের সব ফ্যামিলি ফাংশনে মন থেকে অংশ নেই, এমনকি তুমি অফিসে যাবার সময়ও চাও যে আমি আশেপাশেই থাকি, তোমার সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসি, হাতের কাজ এগিয়ে পিছিয়ে দেই, মুখে না বললেও তুমি চাও কিন্তু! তাহলে আমি কি একবারও এমনটা চাইতে পারি না? এটা কি অন্যায়? বলো, কোন দিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে তুমি সবার সঙ্গে হাসিখুশি ভাবে মিশেছ? সবসময়ই ওখানে গিয়ে তুমি বোর হও এবং তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে চাও!
-আশ্চর্য এটা সত্য না, আমি সবসময়ই তোমার পরিবারের সাথে স্বাভাবিকভাবেই মিশি!
-স্বাভাবিকভাবে মেশা আর আন্তরিকভাবে মেশার মধ্যে পার্থক্য আছে ফয়সাল! দুলাভাই আমাদের সবার সঙ্গে কত হাসিখুশি থাকেন, আর তুমি সবসময় ও বাড়িতে গিয়ে মন কালো করে বসে থাকো!
ফিক করে হেসে ফেলল ফয়সাল। বলল, বাবা আর দুলাভাই সবসময় সমাজ, অর্থনীতি, জীবনবোধ, সাহিত্যে এসব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা শুরু করেন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমি চুপসে যাই! আমি সরল‌ সোজা মানুষ, এত কঠিন আলোচনায় অংশ নিয়ে মজা পাই না আসলে। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে এলাকার খবব, ফালতু আড্ডা,গল্প‌, গান এসবই ভালো লাগে আসলে!
হাল ছেড়ে দিয়েছে মল্লিকা। বলল, দুলাভাই মায়ের হাতের রান্নার কত প্রশংসা করে, তুমি কি এমন প্রশংসা কখনো করেছ?
ফয়সাল আবারও হাসছে। বলল, তোমাদের পরিবারে সবসময় স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করা হয়, তেলমশলা কম থাকে, এমন রান্না খেতে আমার কেমন লাগে সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো তাই না?, তারপরও তুমি ইশারা দিলে আমি প্রশংসা করি তো, একদম যে করি না তা না!
রাগে চেহারাটা জ্বলছে মেয়েটার। লম্বা একটা দম টেনে বলল, ঠাট্টা, সবসময় ঠাট্টা! কখনোই সিরিয়াস হবে না সে! আচ্ছা, কী এমন বেশি চেয়েছিলাম তোমার কাছে আমি? সারাদিন এ বাড়িতে ঘর সংসার নিয়ে খেটে মরি, আমার মনটা কি একটু বৈচিত্র্য চাইতে পারে না? এটা এমন কী অন্যায়? আপু দুলাভাই এভাবে রিকোয়েস্ট করল,মাত্র দু তিনটে দিনের ব্যাপার, ওরা কুয়াকাটা যাচ্ছে আমাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় জানোই তো, আমার ঘোরাঘুরির শখ বেশি এজন্যই তো বলেছেন দুলাভাই, মাত্র দু তিনটে দিন ফয়সাল! তাতেও তুমি বাধ সাধলে, আমাকে না জানিয়েই দুলাভাইকে নিষেধ করে দিতে হলো?
অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে ফয়সাল। খুব একটা দোষ না থাকলেও আজ নিজের স্ত্রীর দৃষ্টিতে সে অপরাধী। খানিকটা ছটফট করে বলল, তোমার কোনো অন্যায় ‌নেই মল্লি, কিন্তু প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো, ছোটো মামা আসছেন, ফাইজা, শামীম, মিনি আসছে! এখন আমরা কীভাবে যাব? মিনিটা এতদিন পর মামাবাড়ি আসছে, এরমধ্যে মামাই বাড়িতে না থাকলে কেমন দেখাবে! তাছাড়া, মামি সোনালীকে নিয়ে তার বোনের বাড়িতে গিয়েছেন এই ফাঁকে কটা দিন ছোটো মামা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসছেন। এ মুহূর্তে আমি কীভাবে চলে যাই, জানোই তো মামার সাথে আমাদের বন্ডিং কতটা ক্লোজ!
কিন্তু চটে গিয়েছে মল্লিকা। কাটা কাটা গলায় বলল, যে যুক্তি কোনো কাজের না তা দেখাবে না প্লিজ! ছোট মামা, ফাইজা, সবাই আট নদিন থাকবে, শামীম অফিস করবে এখান থেকে, আমরা মাত্র তিন চারদিনের জন্য যেতাম, বাড়িতে মা বাবা, আছেন, ফাইজা শামীম থাকবে, খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। আর মিনির কথা বলছ, ওর তো বয়সই মাত্র দুবছর, মামাবাড়ির আদর আবদার বোঝার মতো কীইবা বয়স হয়েছে তার!
-তুমি অনেক বেশি রেগে গিয়েছ মল্লিকা, কষ্ট পেয়েছ, বাস্তবতাটা তাই হয়ত বুঝতে পারছ না! এতদিন পর বাড়িতে গেট টুগেদার হওয়ার কথা, কাছাকাছির মধ্যে থাকা আত্মীয়স্বজনরা যে কেউ হুট করে চলে আসতে পারে, এ অবস্থায় আমাদের বাড়িতে থাকাটা জরুরি। বাসায় হাজারটা কাজ থাকবে, নানান রকম রান্না হবে, বাজার সদাইয়ের ব্যাপার আছে, আরো কত কাজ! এ‌ ধরনের যেকোনো প্রয়োজনে শামীম দৌড়াদৌড়ি করলে কেমন দেখাবে বলো তো? তাছাড়া, আমার বাড়িতে এত আয়োজন, আমিই বাড়ির বাইরে বিষয়টা ঠিক মানানসই না! তারচেয়েও বড়ো কথা আমি নিজে সবার সঙ্গে আনন্দটা উপোভোগ করতে চাই। ভেবেছিলাম সবকিছু তোমাকে বুঝিয়ে বলব, কিন্তু,তার আগেই মৌনী আপু ফোন করে একটা গড়বড় বাধিয়ে দিলেন!
শোনো, এটাই হলো আসল কথা, তুমি আনন্দটা তোমার পরিবারের সঙ্গে উপভোগ করতে চাও! আমি কী চাই বা না চাই তা তোমার দেখার বিষয় না! ঝাঁজের সঙ্গে বলল, মল্লিকা ও বসেছিল ঝট করে উঠে দাড়িয়ে গিয়েছে।
-মল্লি রাগ কোরো‌ না প্লিজ! আমরা পরে কখনো যাব নাহয়, তাছাড়া, একবার রাগটা পড়ে গেলে তুমিও বুঝবে যে আমি ভুল কিছু বলিনি।
-না, তুমি তো কখনোই ভুল কিছু বলো না, যত ভুল অন্যায় সব আমার!
ফয়সাল তাকিয়ে আছে। একপর্যায়ে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে নতুন কেনা শাড়ির প্যাকেটটা এনে রাখল মল্লিকার হাতে। বলল, মা বলেছিলেন ফাইজা, শামীম আর মিনির জন্য কিছু শপিং করতে, তো সেখানে গিয়ে তোমার জন্য এ শাড়িটা পছন্দ হলো, তাই নিয়ে এসেছি। দেখো তো, পছন্দ হয় কি না! ফাইজা,‌ শামীম আর মিনির জিনিসপত্রগুলো মাকে বুঝিয়ে দিয়েছি, মা বাবা কত খুশি হয়ে আমার কেনাকাটার প্রশংসা করলেন, অথচ তুমি তো একটু দেখতেও এলে‌ না! ছিলে কোথায় বলো তো?
মল্লিকা নিশ্চুপ। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে। চেহারায় একটু খুশির ঝিলিক, আগ্ৰহ নিয়েই প্যাকেটটা খুলল সে। কিন্তু খুলতেই এক চিৎকার, বলল, হায় আল্লাহ! আবারও হলুদ! কী, শুরুটা কি করেছ তুমি? হলুদ শাড়ি কাপড়ে আমার আলমারি ভরে যাচ্ছে!
লাজুক হাসল ফয়সাল। বলল, হলুদ শাড়িতে তোমাকে ভীষণ মানায়, আমরা সবাই মিলে যেদিন লং ড্রাইভে যাব, সেদিন তুমি এই শাড়িটাই পোরো, সত্যি বলছি, দারুণ লাগবে!
-আহা কী ঢং! আবদার কত! আমি যে সেদিন তোমার জন্য শখ করে মেরুন পাঞ্জাবিটা আনলাম,পরেছ?
-মল্লি, মেরুন রঙটা ফর্সাদের মানায় বেশি, আমার গায়ের রঙ তেমন‌ একটা পরিস্কার না! তাছাড়া,জানোই তো, আমি একটু কালচে রঙের জামা কাপড় পরতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি! তবে তোমার দেয়া পাঞ্জাবিটা আমি গুছিয়ে রেখেছি, কোনো একদিন ঠিক পরে সামনে আসব!
থাক, থাক, এসব আর বলতে হবে না! জানি তো, মাদা মাদা রঙের জামাকাপড় পরে, চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে, তুমি দিব্যি ঘুরে বেড়াও কী যে সুন্দর লাগে! আমি তো দৃষ্টি ফেরাতে পারি না! মল্লিকার কন্ঠে,রাগ, অভিমান, এবং কিছুটা তাচ্ছিল্য!
হাসছে ফয়সাল, মেয়েটার হাত দুটো ধরে বলল, যাকে এত ভালো করে চেনো, তার সমন্ধে এটাও নিশ্চয় জানো যে, নাশতাটা কেন খেতে পারছি না! ঝাল টাল কিছু দাও, একটা পরোটা যে অর্ধেকর বেশি শেষ হয়নি!
মুখে কপট বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। একপর্যায়ে বলল, বোসো, নিয়ে আসছি!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here