#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
#অন্তিম_পর্ব

ডেস্কে বসে কোনো একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিলো মাহমুদ। ঠিক তখনই এনাকে নিয়ে এদিকটাতে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো মেহরিনকে।
কথা বলতে বলতে হাঁটছে দুজনে।
মাহমুদকে হাসতে দেখে এনা ভ্রু কুঁচকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।
জবাবে মাহমুদ ভনিতা করে বললো,’তোমাকে দেখে হাসছি সুইটহার্ট! ইউ আর লুকিং এক্সট্রিমলি, এক্সট্রিমলি হট। টু মাচ বিউটিফুল! টেম্পারেচার রাইজ করে দিয়েছো তুমি।’

মেহরিন যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেটা যেন দেখতেই পায় নি। এনার সঙ্গে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে মেহরিনের। সোহাগ চট করে মেহরিনের দিকে চাইলো। হাতের ফাইল নিয়ে রাগত মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে হাসলো সে, আজজে কপালে নির্ঘাত শনি আছে মাহমুদের।

হাসিঠাট্টা শেষে এনা ওদের বিদায় জানিয়ে নিজের ডেস্কের দিকে চলে গেলো। সোহাগও বেরিয়ে গেলো। এতক্ষণে মেহরিনের দিকে নজর দেওয়ার সময় হলো মাহমুদের। মুচকি হেসে বললো,’কি ব্যাপার মেহরিন? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাজ নেই তোমার?’

এতক্ষণের দমিয়ে রাগকে উদ্বেলিত করার জন্য যথেষ্ট মাহমুদের এমন উস্কানিমূলক কথাবার্তা। রাগ সামলাতে পারলো না মেহরিন। ইচ্ছে করে হাই হিল সমেত মাহমুদের পায়ের পাতার ওপর ভর করে দাঁড়ালো। দাঁতেদাঁত চেপে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,’কি বলছিলে তখন? এনা কি? সুইটহার্ট? হট? এক্সট্রিমলি হট? খুব মজা লাগছিলো না? টেম্পারেচার রাইজ করে দিয়েছে? অসভ্য! নির্লজ্জ! একটুও লজ্জা করে নি তোমার?’

হীলের চাপে মাহমুদের পায়ের চামড়া ছিলে যাওয়ার মতন অবস্থা তথাপি উফ করলো না। বরং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসলো।
মেহরিন ভারসাম্য রক্ষা করতে দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে। তাঁকে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে মাহমুদ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’ইউ আর প্রভোকিং মি মিসেস শারাফাত! ডোন্ট ইউ ফরগেট দ্যাট আই অ্যাম ইউর সিনিয়র!’

-‘তাই নাকি?’

-‘হ্যাঁ। আপনি এভাবে আপনার সিনিয়র অফিসারকে প্রভোক করতে পারেন না। ইট’স আ ক্রাইম।’

-‘ওও আচ্ছা। কিন্তু আমি যে এতক্ষণ এনএস আইএর এই বিখ্যাত সিনিয়র অফিসারটিকে মানে আমার হাজবেন্ডকে একজন জুনিয়র অফিসারের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে দেখলাম। তার বেলায় কি হবে? ইজন্ট ইট আ ক্রাইম?’

-‘কিসের হাজবেন্ড? কিসের জুনিয়র? এনএস আই এ তোমার হাজবেন্ড বলে কেউ থাকে না। এখানকার মেয়েদের জন্য মাহমুদ সিদ্দিকি আজীবন সিঙ্গেল!’

-‘আচ্ছা? চেনো আমাকে? আমার নাম মেহরিন শারাফাত। গলা টিপে মেরে ফেলবো একদম!’

-‘ইউ কান্ট থ্রেট মি।’

-‘অফকোর্স আই ক্যান। বাই এন্যি চান্স আমি যদি দেখেছি তুমি আরেকবার কাজ বাদ দিয়ে এনার সাথে ফ্লার্ট করেছো তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে বলে দিলাম। সত্যি সত্যি গলা টিপে মেরে ফেলবো।

মাহমুদ গলা খাঁকারি দিলো। কন্ঠে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বললো, ‘আপনার কি ধারণা মিসেস শারাফাত? আমি সারাদিন অফিসে বসে বসে মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করি?’

-‘করোই তো!’

আবার গলা খাঁকারি দিলো মাহমুদ। বললো,’আই থিংক ইউ আর জেলাস অফ মি। আমার এত এত ক্রেজ দেখে আপনি সহ্য করতে পারছেন না। তাই এসব ভুলভাল কথা বলছেন।

-‘চোরের মায়ের বড়গলা। একে তো দোষ করেছো তারওপর আবার বড় বড় কথা বলছো। একটু যদি লজ্জা শরম থাকতো।’

-‘এক্সকিউজমি! ইউ শুড রেস্পেক্ট ইউর সিনিয়র।’

-‘দেবো না। দেবো না সম্মান। কি করবে তুমি? অসভ্য, চরিত্রহীন।’

-‘চরিত্রহীন?’

-‘অফকোর্স চরিত্রহীন।’

-‘তবে সেটা চরিত্র হননকারীনির দোষ। এখানে মাহমুদ সিদ্দিকি নিরপরাধ!’

তার বলার ঢং দেখে মেহরিনের হাসি পেয়ে গেলো। খুব নাটক করতে পারে দুষ্টটা। তথাপি ছদ্মগাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,’হ্যাঁ এখন তো তোমার কোন দোষ নেই। তুমি কিচ্ছু জানো না। কিন্তু অফিসে বসে বসে মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট ঠিকই করতে পারো।

মেহরিনের মুখের মিটিমিটি হাসিই বলে দিচ্ছে জালে আটকা পড়েছে শিকার! এতএব এখন আর কোন ভয় নেই। মাহমুদ সুযোগ পেয়ে গেলো। চট করে মেহরিনের কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,’তো আমি মেয়েদের সঙ্গে ঠিক কীভাবে ফ্লার্ট করি মিসেস শারাফাত? এইভাবে?’

কোমরে চাপ বাড়িয়ে দিলো সে। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মেহরিন। তথাপি নড়লো না। আচানক পায়ের ওপর হীলের চাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’এভাবে।’

ব্যথায় চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো মাহমুদ। মুচকি হেসে বললো,’ইয়েস। ইয়েস! আই ক্যান ফিল ইউর বডি টেম্পারেচার!’

মাহমুদের এমন অসভ্য কথাবার্তায় ‘থ’ বনে গেলো মেহরিন। ফের ধমক দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। তার আগেই ইরফান সাহেবের গলা খাঁকারির আওয়াজ শোনা গেলো। তড়িৎগতিতে দূরে সরে গেলো দুজনে। ইরফান সাহেব মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন
মাহমুদের ওপর। অফিসে এসে এসব রংতামাশা করার মানে কি? ঠিক আছে উনি মানছেন ,অনেক দিন বাদে এক হয়েছে দুজনে কিন্তু তাই বলে এমন জোঁকের মত একজন আরেক জনের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে কেন? নির্লজ্জ, বেহায়ার দল কোথাকার!
যেতে যেতে গম্ভীর মুখে বললেন,’এটা অফিস! এসবের জন্য বেতন তোমাদের দেওয়া হয় না!’

লজ্জায় অস্বস্তিতে মেহরিনের মন চাইলো এক দৌঁড়ে নিজের ডেস্কে চলে যেতে। ইরফান সাহেব এই সময় এখানে আসবেন এটা সে ভাবতেই পারে নি। এদিকে মাহমুদ দাঁত বের করে হাসছে। যেন কোটি টাকা পুরস্কার পেয়েছে সে। রাগে, বিরক্তিতে মুখ ঝামটা মেরে নিজের ডেস্কের দিকে চলে গেলো মেহরিন।


সু খুলে পায়ের আঙ্গুলে পট্টি বাঁধছে মাহমুদ। মেহরিন তাঁর পাশে সোফায় বসে আছে। দোষটা ঠিক কার ওপর চাপাবে বুঝতে পারছে না। একবার মনে হচ্ছে সব দোষ মাহমুদের। মাহমুদ যদি তখন এনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা না বলতো তাহলে একরমটা হতো না। কিন্তু পরোক্ষনেই মনে হচ্ছে মাহমুদ তো এমনই। ইচ্ছে করে তাঁকে রাগানোর জন্য এমন করে। কিন্তু তাই বলে মেহরিনের কি উচিৎ হয়েছে এভাবে মাহমুদের সঙ্গে মিসবিহেভ করা?

-‘হীল ফিল পরে রোমান্স করতে গিয়ে আমার আঙ্গুলের কি অবস্থা করেছো দেখেছো?’

-‘তোমার দোষ!’, মেহরিন ভাব ছাড়লো না।

-‘আমার দোষ?’

-‘হ্যাঁ। তোমার দোষ। কে বলেছিলো এনার সঙ্গে এমন ঢং করে করে কথা বলতে?’

মাহমুদ অবাক। সে ভেবেছিলো মেহরিন দুষ্টুমি করে তখন এনার কথা বলেছে কিন্তু এখন তো দেখছে মেহরিন সিরিয়াস। কিঞ্চিৎ বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,’আর ইউ সিরিয়াস? আমি এনার সঙ্গে দুষ্টুমি করায় তুমি আমার পায়ে পাড়া দিয়েছো?’

মেহরিন জবাব না দিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। তাছাড়া তাঁর হাবভাব দেখে স্পষ্ট বোঝা গেলো এনার সঙ্গে কথা বলার কারণেই মাহমুদের পায়ে পাড়া দিয়েছে সে।

মাহমুদ অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেললো। পুনরায় ব্যান্ডেজ করায় মনোযোগ দিয়ে বললো,’সিরিয়াসলি! তুমি এত হিংসুটে আমি জানতাম না।’

-‘এখানে হিংসুটের কি হলো? বিয়ে করেছো আমাকে। আর তারিফ করবে অন্য মেয়ের। এটা তো কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

-‘তারিফ করার মতন গুণ তোমার থাকতে হবে তো নাকি? না থাকলে আমি কি বানিয়ে বানিয়ে বলবো?’

ফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো মেহরিনের। কতটা অসভ্য হলে এমন কথা বলতে পারে! বলে কিনা তারিফ করার মতন কোন গুণ নেই! তবে বিয়ে কেন করেছিলো? ঝগড়া করতে গিয়ে তোতলানো শুরু করে দিলো সে। মাহমুদ আগের মতনই হাসছে। বললো,’তুমি এনার ব্যাপারে এত রেগে যাও কেন ডার্লিং? আমি কি তোমার সাইদকে নিয়ে কখনো কিছু বলেছি?’

-‘আমার সাইদ মানে?’

ঘায়েল সিংহীয় ন্যায় মাহমুদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো মেহরিন। ধাক্কা সামলাতে বসা থেকে শুয়ে পড়েছে মাহমুদ। তাঁর বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরেছে মেহরিন। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’বারণ করেছিলাম না? তবুও কেন? কেন নিয়েছো ওর নাম
আমার সামনে? আর আমার সাইদ মানে কি? মানে কি? বলো। বলো তাড়াতাড়ি। নইলে এক্ষুনি খুন করে ফেলবো।’

এদিকে তাঁর অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার দশা মাহমুদের। নিজের ওপর থেকে মেহরিনকে সরাবে কি, হাসির জন্য কথাই বলতে পারছে না সে। ছোট বাচ্চাদের মতন তাঁর বুকের ওপর চেপে বসেছে মেহরিন।
রাগ করে ক্রমাগত বাড়ছে মেহরিনের। অসভ্যটা এমন হাসছে কেন? এখানে হাসির কি আছে!
ধ্বস্তাধস্তি শেষে ক্লান্ত হয়ে বুকের ওপর থেকে নেমে গেলো মেহরিন। যাওয়ার সময় মাহমুদের ব্যান্ডেজ লাগানো পায়ে পুনরায় পাড়া দিয়ে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো মাহমুদ। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’নিষ্ঠুর নারী। পাপ হবে তোমার।’ মেহরিন ঠাস করে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। মাফ না চাওয়া পর্যন্ত মাহমুদের সঙ্গে আর কোন কথা বলবে না সে। কতবড় সাহস বলে কি না তারিফ করার মতন কোন গুন নেই মেহরিনের। পৃথিবীর জঘন্যতম স্বামী একটা!

দরজায় কলিংবেলে আওয়াজ শুনে মাহমুদ শোয়া থেকে উঠে বসলো। গায়ের টিশার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে উঠে গেলো দরজা খোলার জন্য। সোহাগ এবং এনা এসেছে। অফিসের এই মাসের সমস্ত ফাইল রিপোর্ট মাহমুদের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ইরফান সাহেব। তাঁকে দেখেই সোহাগ ভ্রু কুঁচকে ফেললো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,’কি ব্যাপার মাহমুদ ভাই আপনি এমন লাল হয়ে আছেন কেন?’

হাসতে হাসতে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে মাহমুদের। তথাপি হাসি যেন থামেই না। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে দরজা খুলেছে সে। কিন্তু মুখের লালিমা এখনো যায় নি। সোহাগের প্রশ্নের জবাবে গলা পরিষ্কার করে বললো,’কিছু না। এসো। তোমরা ভেতরে এসো।’
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে মেহরিনও বেরিয়ে এসেছে। তাঁকে দেখে ফের হাসি পেয়ে গেলো মাহমুদের। চুলের অবস্থা এখনো আউলাঝাউলা। পরনের সেলোয়ার কামিজ দলামোচড়া হয়ে আছে। ডাকুরানীর সেদিকে খেয়ালই নেই। চোখেমুখে তাঁর ছোট্ট কিশোরীয় ন্যায় অভিমানী ছাপ যেন এক্ষুনি পুতুল কিনে দেওয়ার বায়না ধরবে।
এদিকে মেহরিনকে এমন অবস্থায় দেখে সোহাগ এবং এনা হতবাক। সামনে দাঁড়ানো যুবতীটি তাদের সেই চিরপরিচিত সদাগম্ভীর,ভারী মেজাজি সহকর্মী মেহরিন শারাফাত কিনা তা নিয়ে যেন সন্দিহান দুজনেই। দুজনের কারোরই বুঝতে বাকি নেই বাসার ভেতরেও খোঁচাখুঁচি করছে মাহমুদ, মেহরিন। দিনদিন যেন ছোট বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। মুখটিপে হাসলো সোহাগ এবং এনা। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে মাহমুদও হাসলো। তাঁর দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোহাগ এবং এনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো মেহরিন।

বেশকিছুক্ষণ মেহরিনের সঙ্গে গল্পগুজব শেষে সোহাগ এবং এনা বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এতটা সময় ড্রয়িংরুমেই বসে ছিলো মাহমুদ। মেহরিন ভেতরে ঢুকতে দেয় নি। কিচেনে এলোমেলো বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে বেডরুমে উঁকি দিলো সে। প্রিয়তমা অভিমান করে আছে। মিষ্টি অভিমান! ভালোবাসা আদান প্রদানের অভিমান। মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকে পড়লো মাহমুদ! শুরু হলো অভিমান ভঞ্জনের পালা…

এমনি করে চলতে থাকুক দুজনার মান অভিমান ভঞ্জন পালা, হতে থাকুক ভালোবাসার আদানপ্রদান……

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here