#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২০

লাঞ্চ আওয়ারে নিজের রুমে বসে অগ্রীম কয়েকদিনের কাজ সেরে নিচ্ছিলো মাহমুদ। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কাজের ঝামেলায় জড়াতে মন চাইবে না। সেইজন্যই এই বুদ্ধি।
হঠাৎ দরজায় নক হলো। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মেহরিন। মাহমুদ ফাইল থেকে চোখ না সরিয়েই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,’কাম ইন।’

নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলো মেহরিন। মাহমুদের পেছনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলো। তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের। নিমিষেই সকল ক্লান্তি অবসাদ দূর হয়ে গেলো। তথাপি ইচ্ছাকৃতভাবে দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। সকালের পর থেকে বেশ ভালো মুডেই আছে ম্যাডাম। একটু জ্বালাতন করা দরকার।

মেহরিন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাঁর কানের কাছে দুবার ফুঁ দিলো। তথাপি কোন রিয়েকশন না পেয়ে চট করে ফাইলটা টেনে নিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

মাহমুদ যেন খুব বিরক্ত হয়েছে এমন ভাব করে বললো,’কি চাই?’

-‘আমার ছুটি লাগবে দুদিন।’

-‘ছুটি লাগবে তো আমাকে বলছো কেন? বসের কাছে যাও।’

-‘কারণ ছুটি আমরা দুজনেই নেবো।’

-‘অসম্ভব। আমি এখন কোন ছুটি নেবো না। আমার হাতে অনেক কাজ। সেগুলো শেষ করতে হবে। এমনিতেই বিয়ের চক্করে কতদিন কাজে গ্যাপ পড়বে সেটাও জানি না।’

-‘তাতে কি হয়েছে? মাত্র তো দুদিনের ব্যাপার? পরেও করে নেওয়া যাবে।’

-‘পরে করে নেওয়া যাবে, তোমার জন্য হয়তো এই কথাটা বলা খুবই সহজ। কিন্তু আমার জন্য না। আমার অন্য দুদিন মানে দুইশো দিন। কাজের পাহাড় জমে যাবে টেবিলে।’

-‘আমার জন্য সহজ মানে?’

-‘তোমার জন্য সহজ মানে তোমার দুদিন অফিসে থাকা আর না থাকার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। দুটো একই কথা। এমনিতেও খুব একটা কাজ করো না তুমি।

-‘আমি কাজ করি না?’

-‘করো? আমি তো দেখি না।’

রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো মেহরিনের। লাঞ্চের সময়টাতে মাহমুদের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাতে এসেছিলো সে। কিন্তু তার পরিবর্তে মাহমুদের এমন উস্কানিমূলক কথাবার্তা মোটেই সহ্য হলো না।
নিজের কর্তব্যে কোনদিন একফোঁটা অবহেলা করে নি সে। প্রতিটা মিশনে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে দলকে সাফল্য এনে দেওয়ার জন্য। তাঁর মত একজন ডেডিকেটেড এজেন্ট এর পক্ষে এমন কথাবার্তা সহ্য করা খুবই কষ্টসাধ্য।

-‘ইউ আর নো ওয়ান টু অ্যাসেস মাই ওয়ার্ক। এন্ড আই হ্যাভ নো অবলিগেশন টু আন্সার ইউ।’, গলা ভারী হয়ে এলো মেহরিনের। না থেমেই বললো,’আমি এনএস আইয়ের জন্য কি করেছি না করেছি সেটা এনএস আই জানে এবং আমি জানি। আর জানে আমার সহকর্মীরা। তোমাকে আমার কাজ নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।’

মাহমুদ হাতের পেপার ওয়েটটা ঘুরালো। মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি। মেহরিনের স্বভাব তাঁর অজানা নয়। একটুতেই রেগে আগুন হয়ে যায়। আগুনে আরেকটু ঘি ঢেলে দিয়ে বললো,’ঠিক বলেছো। সবাই সবটা জানে। কিন্তু তোমার বাপের ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না।’

এবারে রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো মেহরিনের। এতক্ষণ যাও শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলো কিন্তু এবার আর সেটাও পারলো না। হাতের ফাইলটা সজোরে মাহমুদের বুক বরাবর ছুঁড়ে মারলো। বিক্ষুব্ধ গলায় চিৎকার করে করলো,’কি বললে তুমি? আমার বাবার ভয়ে কেউ আমাকে কিছু বলে না? আমার নিজের কোন যোগ্যতা নেই?’

অত্যাধিক রাগে চোখে পানি চলে এলো তাঁর। এমনিতেই যথেষ্ট আত্মসম্মান বোধ। তারওপর নিজের যোগ্যতার প্রশ্নে মাহমুদ হঠাৎ ইরফান আহমেদকে টেনে আনবে ভাবতে পারে নি। মনে মনে ভীষণ ভাবে আহত হলো সে। গম্ভীর গলায় বললো,’আজকে তুমি কাজটা ঠিক করলে না মাহমুদ। বাবা তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন। তাই বলে তুমি সেই রাগ আমার ওপরে ঝাড়বে এটা আমি ভাবতে পারি নি। এরজন্য আমি তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করবো না। মনে রেখো তুমি!’

ভুল তথ্য ব্যবহার করে এয়ারলাইন্সের সহযোগীতা নেওয়ায় তিনমাসের বেতন সহ আগামী দুইমাসের সকল ছুটি ক্যান্সেল করা হয়েছে মাহমুদের। ভাইয়ের ছেলে কিংবা মেয়ের জামাই বলে কোন ছাড় দেন নি ইরফান আহমেদ। এদিকে মেহরিন ভেবেছে সেইজন্য তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করেছে মাহমুদ। কষ্টে চোখে পানি চলে এলো তাঁর।
অশ্রুভেজা চোখ নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত চেপে ধরলো মাহমুদ। মুচকি হেসে বললো,’কোথায় যাচ্ছো?’

-‘সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেবো না। ছাড়ো আমাকে।’

-‘কথায় কথায় এত রাগ দেখানোর কি আছে। আমি তো মজা করছিলাম!’

-‘ছাড়ো আমাকে। এটা কোন মজা হতে পারে না।’

-‘আচ্ছা সরি ভুল হয়ে গেছে।’

-‘ছাড়ো বলছি।’

মাহমুদ হাসলো। রেগে গেলে মেহরিন কখনো শান্তভাবে কোন কাজ করতে পারে না। বেশিরভাগ সময়ই উত্তেজিত হয়ে যায়। মেজাজ কোনমতেই কন্ট্রোলে থাকে না। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা সবসময়ই রাগের হয়।

-‘সত্যি মজা করছিলাম। তোমার সাথে ঝগড়া করতে করতে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। তাছাড়া ঝগড়া না করলে রোমান্সটাও ঠিক জমে উঠে না।’

-‘ছাড়ো আমাকে।’

-‘উঁহু!’

জোর করে তাঁকে কোলে বসিয়ে নিলো মাহমুদ। কপালের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো,’সরি!’

মেহরিন শান্ত হলো না। উলটো ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করে বললো,’আই ডোন্ট নিড ইউর সরি!’

-‘দ্যান, ওয়াট ডু ইউ নিড?’

-‘আই ডোন্ট নিড এনিথিং ফ্রম ইউ।’

-‘বাট আই উইল গিভ ইউ এভ্রিথিং।’

-‘সেটা তোমার ব্যাপার। ছাড়ো আমাকে।’

-‘আহারে! আমার বউটা! বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না? আচ্ছা সরি!’

মেহরিন জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,’বাবা ঠিকই বলেছে। অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত আমি মায়ের কাছেই থাকবো।’

কিসের মধ্যে কি? মেহরিন হঠাৎ ঐ বাসায় থাকার কথা বলছে কেন? নিমিষেই মুখের কালো গেলো মাহমুদের। বেশি ভাব দেখাতে গিয়ে বেচারা ফেঁসে গেছে। বিয়ের পর বউ ছাড়া থাকা? অসম্ভব!
তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো মেহরিন। রাগে নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করছে মাহমুদের। খামোখা মেহরিনের সঙ্গে ঝগড়া করেছে সে। এবার আর তাঁর কোনকথা শুনবে না ডাকুরানী।


বিকেলবেলা কাজ গুছিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো মেহরিন। তখনি মাহমুদ সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহরিন দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু মাহমুদ পথ আগলে আগলে দাঁড়ালো। মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে বললো,’তোমার জন্য একটা চিঠি এসেছে!’

তাঁর হাতে সত্যিই খামে মোড়ানো একটা চিঠি।

-‘চিঠি?’, বেশ অবাক হলো মেহরিন।

আজকালকার যুগে কেউ চিঠি লেখে ? প্রমোশনের কাগজপত্র নয়তো? কিন্তু সেটা হলে তো ইরফান আহমেদ মেহরিনকে জানানোর কথা! চিঠিটা হাতে নিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে চাইলো সে।

-‘লাভ লেটার! টাইপ করা।’

-‘মানে?’

-‘পড়ো। পড়লেই বুঝতে পারবে।’

ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো মেহরিন।

প্রিয় এম এস,
আমি তোমার এ.পি (অজ্ঞাত প্রেমিক)।
প্রথমেই একরাশ গোলাবারুদের শুভেচ্ছা নিও। সেই সঙ্গে আমার হৃদয়ভর্তি ভালোবাসা। জানি না কবে, কখন,কীভাবে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। পড়ে আর উঠতে পারছি না। তুমি আর দিবস রজনী সব এক করে দিয়েছো। প্রিয়, তোমার মরিচ মেশানো ঠোঁটে একবার মধুভরা চুমু খেতে চাই। তোমার বন্দুকের মত চোখজোড়ায় গুলির নিশানা হতে চাই। সবশেষে তোমার ঐ ধারালো তলোয়ারের মত দেহটাকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই…!

মেহরিন পুরোটা না পড়েই মাহমুদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’এটা নিশ্চয়ই তোমার কাজ?’

জবাবে মাহমুদ খুবই নিষ্পাপ নিরীহ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’আমি তোমাকে চিঠি লিখতে যাবো কোন দুঃখে?’

-‘চিঠির ওপরে প্রাপকের ঠিকানায় এম এস লিখা। এম এস মানে তো মাহমুদ সিদ্দিকিও হতে পারে? তুমি আমাকে কেন দিয়েছো?’

-‘কারণ স্বভাবের যা বর্ননা দিয়েছে তাতে আমি কেন পুরো বাংলাদেশ খুঁজলেও তোমার দ্বিতীয় নমুনা পাওয়া যাবে না।’, মুখ ফস্কে কথাটা বেরোতেই সঙ্গে জিভ কাটলো মাহমুদ। মেহরিনকে আবার রাগিয়ে দিচ্ছে সে।

মেহরিন চিঠিটাকে দলামোচড়া করে বিনে ফেলে দিলো। তাঁর বুঝতে বাকি নেই চিঠিটা মাহমুদই লিখেছে। কারণ মেহরিনের সঙ্গে এমন ঠাট্টা করার সাহস মাহমুদ ছাড়া আর কারো হবে না। তা সে যতই অস্বীকার করুক না কেন।

-‘তোমার এই এ.পি মানে অজ্ঞাত প্রেমিকটা কে? মি.সাইদ?’

আবারো সাইদ? রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেলো মেহরিনের। ত্বরিতে মাহমুদের কলার চেপে ধরে বললো,’তোমাকে আমি কতবাদ নিষেধ করেছি সাইদের নাম আমার সামনে উচ্চারণ না করতে? তবুও কেন করেছো? আর একবার ওর কথা বললে আমি তোমাকে খুন করবো।’

এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলো মাহমুদ। কালক্ষেপণ না করে সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে ধরলো মেহরিনকে। জোরপূর্বক গালে চুমু খেয়ে বললো,’তুমি বাসায় যাবে না বলেছো কেন? তাই।’
মেহরিন ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস শুরু করে দিলো।

-‘ছাড়ো আমাকে। আমি কিন্তু মেরে তোমার নাক ফাটিয়ে দেবো বলে দিলাম।’

-‘ছাড়বো না। আগে বলো আমার সঙ্গে বাসায় যাবে।’

-‘যাবো না।’

-‘না গেলে আমিও ছাড়বো না।’

-‘দরজা খোলা। কেউ এসে পড়বে।

-‘আসুক। সবাই দেখুক আর বুঝুক মাহমুদ সিদ্দিকি তাঁর বউকে কত ভালোবাসে। সারাক্ষণ বউয়ের সাথে লেগে থাকে।’

মেহরিন বিপাকে পড়ে গেলো। শক্তিতে মাহমুদের সঙ্গে পেরে ওঠা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সাপের মতন পেঁচিয়ে ধরেছে অসভ্যটা। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’ঠিক আছে যাবো। ছাড়ো আমাকে।’

-‘এইতো লক্ষ্মী মেয়ে।’, বলে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহমুদ।

তাঁর নাটক দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো মেহরিনের। ধমকে উঠে বললো,’আই সয়্যার! এইমুহূর্তে যদি তুমি আমাক না ছেড়েছো আগামী একমাস আমি ঐ বাসায় যাবো না। যাবো না মানে যাবোই না।’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই মাহমুদ ছেড়ে দিলো। মুচকি হেসে বললো,’দিয়েছি। এবার তুমি তোমার কথা রাখো।’
বাধ্য হয়ে মাহমুদের সঙ্গে বাসায় হতে হলো মেহরিনকে। যাওয়ার সময় মাহমুদ সারারাস্তা তাঁকে জ্বালিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here