#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৯

কালরাত এত ভালোবাসাবাসির পর সকালে আবার ঝগড়া হয়েছে দুজনের। মেহরিন যতই চেষ্টা করছিলো ঝগড়া করবে না মাহমুদ তত বেশি করে খোঁচানো শুরু করে দিলো। তাঁর ক্রমাগত খোঁচানি মেহরিনকে বাধ্য করলো প্রতিউত্তর করতে। সাইদের ব্যাপার নিয়ে আবারো তাঁকে খোঁটা দিয়েছে মাহমুদ। ঝগড়ায় না পেরে ওর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলো মেহরিন। চুপচাপ অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়লো। মাহমুদও পেছন পেছন বেরোলো। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বললো না। বেরোনোর সময় মাহমুদ অবশ্য চেষ্টা করেছিলো সব মিটমাট করে নেওয়ার। কিন্তু মেহরিন পাত্তা দিলো না। ইচ্ছে করে ঝগড়া করে আবার সরি বলতে এসেছে। একদম কথা বলবে না মেহরিন।

অফিস গেট দিয়ে একসঙ্গে ঢুকলো দুজনে। লিফটের কাছে আসতেই একসঙ্গে সোহাগ, এনা এবং অন্যান্য সব সহকর্মীদের জোট বেধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। ওদেরকে দেখে খানিকটা অবাকই হলো দুজনে। এনা মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালো। তারপর মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে ঠাট্টাসুরে বললো,’কি মাহমুদ? রাতটা ভালো কেটেছে তো? না মানে ঘুম হয়েছে ঠিকমত?’

মাহমুদ ঠোঁট কামড়ে মিটমিট করে হাসলো। তারপর মেহরিনের দিকে তাকিয়ে গান গাওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
‘চাঁদমুখে চাঁদ দেখে কেটে গেলো রাত!
কাল সারারাত ছিলো স্বপনেরও রাত
ঘুম ছিলো না দুটি চোখের পাতায়
মন ছিলো তন্ময় ভালোবাসায় ভালোবাসায়!
কাল সারারাত ছিলো স্বপনেরও রাত..আহা!’

তার কান্ড দেখে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। কেবলমাত্র মেহরিন বাদে। সে হাসলো না। ফাইল হাতে নিয়ে ট্যারাচোখে মাহমুদের দিকে চেয়ে রইলো। আর যাই হোক অফিসে নিজের গম্ভীর স্বভাবটা তাঁকে বজায় রাখতেই হবে। মাহমুদ সেসবের ধার ধারলো না।ইচ্ছাকৃত ভাবে মেহরিনকে রাগানোর জন্য দুষ্টু হেসে বললো,’কালরাতে রাতে তুমি যেন আমাকে কি বলেছিলে ডার্লিং? ও হ্যাঁ…মনে পড়েছে। চরিত্র হ…’

চট করে তাঁর মুখ চেপে ধরলো মেহরিন। ইচ্ছে করলো মাহমুদকে মেরে ভর্তা করে বানিয়ে দিতে। জুনিয়রদের সামনে ইচ্ছে করে এমন অসভ্যতা করছে শয়তানটা। সকালের প্রতিশোধ নিচ্ছে। তাঁর অবস্থা দেখে মাহমুদ চেপে চেপে হাসলো। রাগলে মেহরিনকে দারুণ লাগে। ওর রাগত মুখটাতেও আলাদা একটা মায়া আছে যেন। এত মায়া আর কারো মুখে দেখে নি মাহমুদ। ঠোঁটজোড়া পাউট করে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলবো না। এবার ছাড়ো!’

ছেড়ে দিলো মাহমুদ। কিন্তু সোহাগ এবং এনা ছাড়লো না। বারবার করে জিজ্ঞেস করলো কিসের কথা বলছে মাহমুদ। কালরাতে মেহরিন তাঁকে কি বলেছিলো। মেহরিনের দিকে তাঁকিয়ে ভয়ে আর বলার সাহস হলো না মাহমুদের। তাড়াহুড়ো করে বললো,

-‘কিছু না। তোমরা থাকো আমি যাচ্ছি।’
লিফটের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলো মাহমুদ।
সঙ্গে সঙ্গে আটকে দিলো এনা। হাত দুটো মেলে ধরে বাধা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,’আজকে তোমরা লিফট ইউজ করতে পারবে না মাহমুদ।’

-‘কেন?’

-‘কারণ আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি মেহরিন আপুকে কোলে নিয়ে উঠতে হবে তোমার।’

-‘তাই নাকি?’ মাহমুদের চোখেমুখে আবারো হাসি ফুটে উঠলো। যেন এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলো সে। পারলে এখনই মেহরিনকে কোলে তুলে নেয়।

-‘হ্যাঁ। ইট’স আ চ্যালেঞ্জ। তিনমিনিট সময় দেওয়া হবে তোমাকে। এর ভেতরে যদি তুমি মেহরিন আপুকে নিয়ে সাততলা বেয়ে আমাদের হেডকোয়ার্টারে উঠতে পারো তবে তোমাদের হানিমুন ট্রিপের পুরো খরচ আমরা দেবো।’

মাহমুদ হো!হো! করে হেসে উঠে মেহরিনের দিকে চাইলো। মেহরিন এখনো নিজের সেই মুডি ভাব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এনার দিকে চাইলো মাহমুদ। ইশারায় মেহরিনকে রাজি করাতে বললো।
কিন্তু মেহরিন রাজি হলো না। বারণ করে দিয়ে বললো,’জুনিয়রদের সামনে এসব ছেলেমানুষি সে করতে পারবে না।’

এনা এবং সোহাগ বারবার তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলো এটা জাস্ট একটা মজা। সবাই মিলে আনন্দ করার জন্য প্ল্যানটা করেছে ওরা। কিন্তু মেহরিন কিছুতেই রাজি হলো না। তাঁর এক কথা। এসব ছেলেমানুষি তাঁকে দিয়ে হবে না। অতঃপর কোনরকম কথাবার্তা ছাড়াই তাঁকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো মাহমুদ।

হাসি ফুটে উঠলো এনা এবং সোহাগের মুখে। একসঙ্গে সিটি বাজালো সবাই। মেহরিন লজ্জায় অস্বস্তিতে চুপ হয়ে গেলো। লাজুক প্রিয়তমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো মাহমুদও। সকালের খুনসুটির পর এমন একটা মিষ্টি মুহূর্তের আসলেই দরকার ছিলো দুজনার।

প্রত্যেক তলায় একজন করে দাঁড়িয়ে রইলো তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য! সুতরাং মেহরিনকে কোল থেকে নামানোর কোন সুযোগ নেই।

চারতলা বেয়ে উঠার পর মেহরিন নামিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। মাহমুদ শুনলো না। পাঁচতলায় উঠে মিষ্টি হেসে বললো,’চট করে একটা চুমু দাও তো। এনার্জি লাগবে।’

সব অভিমান ভুলে গিয়ে হেসে ফেললো মেহরিন। প্রিয়তমের ওষ্ঠাধরে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো,’হানিমুনের টাকা আমি দেবো। তুমি আমাকে নামিয়ে দাও।’

আকস্মিক হতাশায় মাহমুদের মনটা তেতো হয়ে গেলো। এত রোমান্টিক একটা মুহূর্তে এটা কি বললো মেহরিন? সে হানিমুনের টাকা বাঁচানোর জন্য মেহরিনকে কোলে নিয়েছে? রিয়েলি? মেহরিন কি করে এই কথা বলতে পারলো? ধ্যাত! পুরো মজাটাই মাটি করে দিয়েছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে তাঁর। বিড়বিড় করে বললো,’একটা মাথামোটা গবেটকে বিয়ে করেছি আমি। যার মাথায় শুধু গোবর পোরা।’
কথা শেষ করে পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো সে। এবার আগের চেয়ে দ্রুত দ্রুত গতিতে পা ফেললো।
মেহরিন হাসলো। গভীর অনুরাগের দৃষ্টি নিয়ে অপলক চেয়ে রইলো ভালোবাসার মানুষটির দিকে। অনুতপ্ত কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,’সরি। আরো একটা চুমু পাওনা রইলো তোমার।’

দুই মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ডে মেহরিনকে নিয়ে সাততলায় এনএসআইয়ের হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো মাহমুদ।
মেহরিনকে কোল থেকে নামিয়ে বেশ কিছুক্ষন দম নিলো। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,’ডান! চ্যালেঞ্জ হেরে গেছো তোমরা। সুতরাং চুক্তি অনুযায়ী হানিমুন ট্রিপের খরচ তোমরা দেবে।’

সবাই খুশিতে হাতে তালি বাজাচ্ছে। মেহরিন লজ্জায় কারো দিকে চাইলো না। এনা মিষ্টি হেসে মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ওকে ডান। এবার বলো কোথায় যেতে চাও?’

-‘নাসায়!’

পুরো করিডোর জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেলো। মাহমুদ ওদের সঙ্গে হাসিতে তাল মিলিয়ে বললো,’মেহরিনের অনেকদিনের শখ নাসায় হানিমুন করবে!’

তঁর কথা শুনে আরেকদফা হেসে নিলো সবাই। মেহরিন হতাশভাবে মাহমুদের দিকে চাইলো। বিয়ের পরেও একফোঁটাও বদলালো না মাহমুদ। সব কিছু বাদ দিয়ে মেহরিনের পেছনেই লাগতে হবে তাঁকে। মনে মনে নিজের কপালকে দোষারোপ করে ডেস্কের দিকে পা বাড়ালো।
সেই মুহূর্তেই করিডোর ধরে ইরফান আহমেদকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। ভয়ে সবাই যার যার কাজে ঢুকে পড়লো।


এদিকে ব্যক্তিগত স্বার্থে এয়ারলাইন্স থেকে সহযোগীতা নেওয়ায় মাহমুদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন ইরফান আহমেদ। খবরটা শুনে অফিসের সবার হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতন অবস্থা! মাহমুদ নিজেও হেসে ফেললো। সোহাগকে উদ্দেশ্য করে কৃত্রিম অভিযোগের সুরে বললো,’দেখলে সোহাগ? কান্ডটা দেখলে? একেই বলে জোর যার মুল্লুক তাঁর। টাকলুর মেয়ে যে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এজেন্সি ছেড়ে পালাচ্ছিলো তাতে কোন দোষ হলো না। যত দোষ সব আমার।’

জবাবে সোহাগ হো!হো! করে হেসে উঠে বললো,’সেটা আপনাদের জামাই শ্বশুর ব্যাপার। এখানে আমার কি বলার আছে!’

খবরটা শুনে মেহরিনও মুখটিপে হাসলো। বেশ হয়েছে। মেহরিনকে জ্বালানোর প্রতিশোধ ইরফান আহমেদ নিয়ে নিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here