#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৮

ইরফান সাহেব এবং লায়লা শারাফাত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো সবাইকে। তাঁরা এলে নির্বিঘ্নে বিয়ের কার্য সমাধা হয়ে গেলো। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার জন্য একবারের বেশি দুইবার আর বলা লাগলো না মেহরিনকে। বাধ্য মেয়ের মত চুপচাপ সাইন করে দিলো।
বিয়ে পড়ানোর শেষে মাহমুদ গম্ভীর মুখে তাঁর পাশে বসে রইলো।
ইরফান সাহেব এবং লায়লা শারাফাতের নিজেদের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছেন। সোহাগ এবং এনা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এইসুযোগে মেহরিন আলতো করে একটা হাত রাখলো মাহমুদের হাতের ওপর। বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের আনন্দ হচ্ছে। এইমুহূর্তে মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে একশো একটা চুমু খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে হাত রাখতেই মাহমুদ ঝট করে উঠে গিয়ে সোহাগের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিলো। পাত্তাই দিলো না মেহরিনকে। এনা সেটা দেখতে পেয়ে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হাসলো।

কথাবার্তা শেষে মেহরিনেরকে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন ইরফান আহমেদ।মাহমুদও সম্মতি জানিয়ে অফিসের দিকে রওনা হলো। সোহাগ এবং এনাও তাঁর পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো। মেহরিন হতবাক! নতুন বউকে এভাবে ফেলে রেখে কি করে যেতে পারে মাহমুদ? যাওয়ার সময় একটাবার মুখের দিকে তাকায় নি পর্যন্ত! লজ্জায় নিজেও মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারলো না।

অগত্যা ইরফান সাহেবের সঙ্গে বাসায় ফিরে যেতে হলো। এরপর সারাদিন আর মাহমুদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ হলো না। বাসায় এসে জানতে পারলো বড় করে বিয়ের অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত এই বাসাতেই থাকতে হবে। নিমিষেই মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাহমুদের নাম্বারে ডায়াল করলো দুবার। রাগ করে দুবারই ফোন কেটে দিলো মাহমুদ। মেহরিন মুখ ভার করে বসে রইলো।


সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাত দশটায় দিকে মাহমুদ যখন বাসায় ফিরলো তখন ফ্ল্যাটে কারেন্ট জেনারেটর কিছুই নেই। পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকার। মোবাইলের টর্চ অন করতে যাবে এমন সময় রিংটোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে সোহাগের নম্বর ভেসে উঠেছে। রিসিভ করতেই সোহাগের উদ্বিগ্ন স্বর শোনা গেলো,’হ্যাঁ মাহমুদ ভাই আপনি কি বাসায় ফিরেছেন?’

-‘এই তো মাত্র ফিরলাম। কেন কোন সমস্যা? তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?’

-‘না মানে, একটা গোপন খবর আছে!’

-‘গোপন খবর? কি সেটা?’

-‘আসলে বস এইমাত্র আমাকে ফোন করে জানালেন সায়েদের বাবা নাকি উনাকে হুমকি দিয়েছেন তাঁর ছেলের অপমানের প্রতিশোধ সে নেবে। এর পরিণাম ভালো হবে না। তাই আপনাকে সাবধান করার জন্য ফোন করেছি।সবাই ভীষণ চিন্তায় আছে। বোঝেনই তো বেশ পাওয়ার লোক এরা।’

মাহমুদ পাত্তা দিলো না। মুচকি হেসে বললো,’ঠিক আছে। এবার তুমি ফোন রাখো। আমি ফ্রেশ হবো।’

-‘এতটা হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। আপনি প্লিজ সাবধানে থাকবেন। আপনার ওপরেই ওদের বাপ ছেলের ক্ষোভ বেশি।’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে থাকবো। তুমিও সাবধানে থেকো।’

-‘ঠিক আছে। রাখছি আমি। কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবেন।’

সোহাগ ফোন কেটে দিলে টর্চ অন করলো মাহমুদ। রান্নাঘর থেকে হাতড়ে হাতড়ে মোম বের করলো। কিন্তু হঠাৎ করে ড্রয়িংরুম থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো।
শব্দটা পরপর দুবার শোনা গেলো। সতর্ক হয়ে গেলো মাহমুদ। মোমটা নিভিয়ে, টর্চ অফ করে দিলো। কোমরের ভাঁজ থেকে রিভলবার টা বের করে পা টিপেটিপে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলো। মোবাইলের হালকা আলোতে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটির দিকে রিভলভার তাক করতেই চাপা হাসিতে ফেটে পড়লো কেউ একজন। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে কুটিকুটি ছায়ামূর্তিটি।

-‘মেহরিন!’, রিভলভার নামিয়ে নিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। তাঁর অবস্থা দেখে মেহরিনের হাসি যেন থামেই না।

রিভলবারটা আলতো করে সোফার ওপর থ্রো করলো মাহমুদ। বামহাতে টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে বললো,’এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি? যদি গুলিটুলি লেগে যেতো?’

-‘বেশ হতো। তুমি তো সাজা দিতেই চেয়েছিলে!’

-‘এটা মোটেও মজা করার মত কোন বিষয় নয়।’

এগিয়ে গিয়ে মাহমুদের পায়ের পাতার ভর করে দাঁড়ালো মেহরিন। দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে আলতো করে চুমু খেলো। নেশাতুর কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,’আমি একদমই মজা করছি না। তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলে, কি চাও নি বলো?’

মাহমুদ অসাড়! সকালের সমস্ত রাগ নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো! মন্ত্রমুগ্ধের মতন স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাঁর ডান হাতটা সন্তর্পণে নিজের কোমরে স্থাপন করলো মেহরিন। মিষ্টি হেসে বললো,’অপরাধিনী হাজির। সকল শাস্তি মঞ্জুর!’
দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো মাহমুদ। সস্নেহে চুমু খেলো প্রেয়সীর দুইগালে।

চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আদুরে কন্ঠে বললো,’তুমি সত্যিই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’

মেহরিন আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। অভিযোগের সুরে বললো,’সকালে আমাকে রেখে কেন চলে গিয়েছিলে?’

-‘তুমি যে আমাকে ছেড়ে পালাচ্ছিলে?’

-‘সে তো তোমার কথা ভেবেই পালাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম আমি না থাকলে এনাকে নিয়ে সুখে সংসার করবে!’

মাহমুদ হাসলো। বললো,’তুমি ভাবলে কি করে সবকিছু জানার পরেও আমি তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো?’

-‘ভাবতে দোষ কি?’

-‘অবশ্যই দোষ আছে। আজ পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া অন্যকাউকে নিয়ে একটা চুমু খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভাবিনি আমি।আই নেভার থট অফ হেভিং আ কিস উইথ সামওয়ান এলস্। এক্সেপ্ট ইউ। সেখানে বিয়ে তো অনেক দূরের কথা।

-‘ইশশ! তবে যে সকালে ফেলে রেখে এলে?’

-‘সে তো তোমাকে শাস্তি দেবো ভেবেছিলাম।’

-‘এখন ভাবছো না?’, ফোঁড়ন কাটলো মেহরিন।

-‘ভাবছি কিন্তু তাঁর আগে একটা কথা বলো ফ্ল্যাটের চাবি পেলে কোথায়?’

-‘মাস্টার কী। বাবা দিয়েছিলেন।’

মাহমুদ হাসলো। সবাই মিলে যুক্তি করেই মেহরিনকে তাঁর বাসায় পাঠিয়েছে। ইরফান সাহেবও এতে যুক্ত আছেন ভেবে ভালো লাগলো। বুদ্ধিটা মন্দ নয়। বিয়ের রাতে বউ ছাড়া থাকা সত্যিই কষ্টকর হতো।

-‘এইজন্যই বুঝি সোহাগ আমাকে ফোন করে ভয় দেখিয়েছে?’

জবাবে তাঁকে ছেড়ে দিয়ে শব্দ করে হাসলো মেহরিন। তাঁর বুদ্ধিতেই কাজটা করেছে সোহাগ। নতুবা মাহমুদের রাগ ভাঙ্গানো এত সহজ হতো না।

মাহমুদ অতি আদুরে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তাঁর রাগী, অভিমানী প্রিয়তমার মুখের দিকে। বহুকাল বাদে এমন হাসিমুখ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। খামোখা রাগ দেখিয়ে এই সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করতে চাইলো না। দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’দেখি কাছে এসো। তোমাকে একটু ভালোবাসি।’

হাসি থামিয়ে লাজুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইলো মেহরিন। হঠাৎ করেই একরাশ লজ্জা এসে ভীড় করলো তাঁর সমস্ত শরীরে।
তার পরণে লাল জামদানি শাড়ি। হালকা সাজ, তারসাথে খোঁপায় বেলি ফুলের মালা। উদ্দেশ্য ছিলো যেভাবেই হোক মাহমুদের রাগ ভাঙ্গাবে।
কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে। শাড়ির কোনা চেপে ধরে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহমুদ সামান্য ঝুঁকে কাছে টেনে নিলো। কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বললো,’কি ব্যাপার বলতো? আজকে দেখছি লজ্জার লহর বইছে একেবারে।’

মেহরিন লাজুক মুখে মাথা নিচু করে ফেললো। লজ্জায় মাহমুদের চোখের দিকে সরাসরি চাইতে পারলো না সে।

মাহমুদ মুচকি হেসে বললো,’আজকে আমি খুব খুশি। তুমি যা চাইবে তাই দেবো। বলো কি চাও?’

প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মেহরিন। কিন্তু মাহমুদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে মুখ খুললো। অনুচ্চস্বরে ফিসফিস করে বললো,’এই বাসাতে থাকতে চাই।’

শব্দ করে হেসে ফেললো মাহমুদ। তাঁর নাকটা টেনে দিয়ে বললো,’সকালে তো খুব পালিয়ে যাচ্ছিলে। এখন এই বাসায় থাকতে চাই?’

মেহরিন জবাব দিলো না। আচমকাই চোখে পানি চলে এলো তাঁর। সে যে মাহমুদের ভালোর জন্যই মাহমুদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছিলো একথা বোধহয় কোনদিন বুঝবে না মাহমুদ। এই খোঁটা তাঁকে সারাজীবন শুনতে হবে।
মাহমুদ তাঁর কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে ফের হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। কান্নাকাটি থামাও! এই বাসাতে থাকতে চাও তো? থাকবে। একশোবার থাকবে। হাজার বার থাকবে। কিন্তু অনুষ্ঠানের পর। নইলে তোমার বাপ আমার মাথা ফাটিয়ে দেবে।’

-‘বাবার সঙ্গে যা বোঝার আমি বুঝবো।’

-‘এত তাড়া?’, সুযোগ পেয়ে মাহমুদও ফোঁড়ন কাটলো।

ফের লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মেহরিন।

-‘বলো। বলো। তাড়াতাড়ি বলো। আর? আর কি চাও?’

-‘আর তোমার ভালোবাসা!’, লজ্জাসত্ত্বেও মুখ ফস্কে কথাটা বলে ফেললো মেহরিন।

হাসি থেমে গেলো মাহমুদের। গাঢ় অনুরাগ, স্নেহের দৃষ্টিতে বেশকিছুক্ষণ চেয়ে রইলো প্রিয়তমার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে মুচকি হেসে বললো,’সেটা তোমাকে কখনো চেয়ে নিতে হবে না। তুমি অনেক আগেই আমার সমস্ত ভালোবাসা পেয়ে গেছো। আমার হৃদয়টা যে তোমার কাছেই জমা পড়ে ছিলো। অন্যকাউকে দেওয়ার সুযোগই হয় নি।’

-‘সে আমি জানি। আমি অন্য ভালোবাসার কথা বলছি।’

-‘আচ্ছা?’ অবাক হওয়ার ভান করলো মাহমুদ। বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,’তারমানে তুমি আমার চরিত্র হনন করতে চাইছো? কি তাইতো?’

অত্যাধিক লজ্জায় মেহরিনের মরণদশা। ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলো সে। চট করে তাঁর হাত ধরে ফেললো মাহমুদ। হাসি থামিয়ে বললো,’পালাচ্ছো কোথায়? চরিত্র হনন করবে না? আমি তো ভাবছি আগামী একমাস ছুটি নিয়ে নেবো। এই একমাস মাহমুদ সিদ্দিকি কোন কাজ করবে না। এই একমাস শুধু চরিত্র হনন চলবে।’

কান লাল হয়ে গেলো মেহিরিনের। লজ্জায় অস্বস্তিতে মাথা তুলতে পারলো না সে। মাহমুদের ধরে রাখা হাতটা মোচড়ামুচড়ি করলো ছাড়া পাওয়ার জন্য।

-‘কি হলো ডাকুরানী হঠাৎ এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? সে কি আমার প্রস্তাবে রাজি?’

-‘জানি না ছাড়ো।’

মাহমুদ ছাড়লো না। কোমরে চাপ দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,’পালালে তো হবে না। চরিত্র হননের দায়িত্বটা যে তোমার ওপরেই দিয়েছি।’

মেহরিন কাতর দৃষ্টি মাহমুদের মুখের দিকে চাইলো। লজ্জায় দিয়ে দিয়ে আজকে তাঁকে মেরে ফেলবে অসভ্যটা। অনুনয় করে বললো,’দোহাই তোমার। ছাড়ো। হাতে অনেক কাজ আছে আমার।’

‘কাজ?’, সম্মতিতে মাথা ঝাঁকালো মাহমুদ। চোখেমুখে হাসি! মেহরিনের দ্রুত ছাড়া পাওয়ার জন্য কোমরে আঁচল গুঁজে নিয়ে বললো,’ফ্রেশ হয়ে এসো। খাবে।’

-‘তারপর?’, মাহমুদের চোখেমুখে তখনো হাসি।

-‘জানি না।’

-‘না জানলে আমি বলছি। তারপর তোমার আমার চরিত্র হন..’
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না সে তার আগেই মেহরিন মুখ চেপে ধরলো। মাহমুদ তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বললো,’তারপর কেন? চলো এখনই শুরু করি!’

সে কথা শেষ করার আগেই মেহরিন ছুটে রান্নাঘরের দিকে পালিয়ে গেলো। মাহমুদ অট্টহাসি ঠেকিয়ে মৃদু হেসে বললো,’সাবধানে। পড়ে ব্যথা পাবে!’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here