#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৩

সেদিন রাতে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বাসা পর্যন্ত মেহরিনকে এগিয়ে দিলো সোহাগ। যাত্রাপথে সে জানতে পারলো খুব শীঘ্রই চাকরী ছেড়ে দিয়ে দেশের বাইরে সেটেল হওয়ার প্ল্যান করছে মেহরিন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের সাথে কোনভাবেই একমত হতে পারলো না সোহাগ। আপত্তি জানিয়ে বললো,’আমার মনে হয় মাহমুদ ভাইকে সবটা খুলে বলা উচিৎ।’

মেহরিন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললো,’আই ডোন্ট থিংক সো!’

সোহাগ হাল ছাড়লো না। মেহরিনকে পুনরায় বোঝানোর চেষ্টা করলো সে। শান্ত, কোমল কন্ঠে বললো,’দেখো মেহরিন, অ্যাজ আ ফ্রেন্ড আমি সবসময়ই তোমার একজন ওয়েলউইশার। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। সেই জন্যই বলছি তুমি প্লিজ একটা বার কথাগুলো মাহমুদ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে দেখো। তাঁর দুজনে মিউচুয়াল একটা ডিসিশন নাও। উনাকে অন্ধকারে রেখে এভাবে একা একা ডিসিশন নেওয়াটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।’

মেহরিন হাসলো। সোহাগের কথার সারমর্ম করলে ইনডাইরেক্টলি তাঁকে মাহমুদের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে সে। যেটা মেহরিনের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,’একটা মানুষ ছোটবেলা থেকে কখনো তাঁর বাবা মাকে কাছে পায় নি। মা, বাবার আদর কি জিনিস অনুভব করার সৌভাগ্য তাঁর হয় নি। চাচার কাছে মানুষ হয়েছে। এসবকিছুর পরেও তাঁর নিজের একটা সন্তান থাকবে না, এটা তো তাঁর প্রতি অবিচার হয়ে যাবে সোহাগ!’

কিছুক্ষনের জন্য বাকশূন্য হয়ে গেলো সোহাগ। মেহরিনের জটিল চিন্তাভাবনা গুলো তাঁর মস্তিষ্ক যন্ত্রণা ধরিয়ে দিচ্ছে। অসহ্য লাগছে! মানুষের জীবনে কেন এত জটিলতা! আরেকটু সহজ হলে কি এমন ক্ষতি হলো। গম্ভীর গলায় বললো,’এটা তো তোমার পার্সেপশন। হতে পারে ওপরদিকের মানুষটার কাছে তুমিই সব?’

মেহরিন ফুঁপিয়ে উঠলো। দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেললো সে। নিজের অক্ষমতা প্রতিটা মুহূর্তে তাঁকে মৃত্যু যন্ত্রণার চাইতে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তাঁর সেই যন্ত্রণার ছিটেফোঁটাও আন্দাজ করতে পারছে না সোহাগ। সবাই কেবল তাঁর বাইরের কঠোর রূপটাই দেখছে ভেতরের কি চলছে তা কেবল সে-ই জানে। সোহাগ তাঁর কান্নারত মুখ পানে চেয়ে বললো,’মাহমুদ ভাই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে মেহরিন। মানুষটা সবসময় সবার অগোচরে সেইফগার্ড হয়ে তোমাকে রক্ষা করেছে। নিজের সেইফটি বাদ দিয়ে সবার আগে তোমার কথা ভেবেছে। তাহলে সেই মানুষটার জীবনে তুমি থাকবে না এর চেয়ে বড় অপ্রাপ্তি তাঁর জন্য আর কি হতে পারে? তুমি প্লিজ আরেকবার ভেবে দেখো।’

কান্না থামিয়ে আত্মসংবরণ করে নিলো মেহরিন। চোখ মুছে বললো,’অপ্রাপ্তি আর আফসোস দুটো আলাদা জিনিস। সব মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু অপ্রাপ্তি থাকে! আমার জীবনে আছে, তোমার জীবনেও আছে। তেমনি মাহমুদের জীবনেও নাহয় কিছু রইলো। এতে ক্ষতি কিছু নেই। কিন্তু আফসোস বড় বেদনাদায়ক। এটা মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। আমি চাই না মাহমুদের জীবনে কোন আফসোস থাকুক!’

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো সোহাগ। হাল ছেড়ে দিলো। মেহরিনকে বোঝানো অসম্ভব! নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়বে না সে। মৌনমুখে তাঁকে বিদায় জানিয়ে বাসায় দিকে পা বাড়ালো সে।।

পরেরদিন সকালের ঘটনা,
ইরফান সাহেবের বেডের পাশে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন। কেবল সে নয় মাহমুদ, এনা, সোহাগ এরা সবাই আছে। ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং তাঁর ছেলে এসেছেন ইরফান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। এইমুহূর্তে ছেলেটির নজর মেহরিনের দিকে। আসার পর থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেহরিনকেই দেখছে সে। মেহরিনের পরনে নীল রংয়ের ফুলস্লিভ গেঞ্জি আর কালো জিন্স। মাথার চুলগুলো বেনী বাধা। ধীরস্থির চাহনি আর গম্ভীর মুখোভঙ্গি! সবমিলিয়ে মুগ্ধ পরিদর্শনকারী যুবকটি।

ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করলো মেহরিন। যুবকটি মন্ত্রীর ছেলে না হয়ে অন্য কেউ হলে ইতোমধ্যে একচোট হয়ে যেত তাঁর সঙ্গে। কিন্তু এইমুহূর্তে একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সহ্য করে নিতে হচ্ছে তাঁকে। না করে উপায়ও নেই। মন্ত্রীর ছেলে বলে কথা!
এদিকে যাওয়ার আগে যুবকটি হঠাৎ করেই মেহরিনকে পার্সনালি কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলো। মন্ত্রী মহোদয়ের জরুরী মিটিং থাকায় উনি আগেভাগেই বেরিয়ে গেছেন। যুবকটির নাম মিনহাজ বিন সায়েদ। মন্ত্রীর ছেলের পরিচয় ছাড়াও তাঁর আরো একটি পরিচয় আছে। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট। সদ্য আইন পাশ করে বেরিয়েছেন। অল্পকিছুদিন হলো রাজনীতিতেও যোগদান করেছেন। আটাশ বছর বয়সী অবিবাহিত যুবক।

ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও প্রফেশনালি ব্যপারটাকে হ্যান্ডেল করতে চাইলো মেহরিন। বিনয়ী কন্ঠে বললো,’সরি স্যার। আই কান্ট! দিস ইজ নট সেইফ!’
সরাসরি প্রত্যাখানে খানিকটা বিব্রত হলো সায়েদ। আফটার অল হি ইজ গুড লুকিং, হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান! কারো মুখ থেকে না শুনতে অভ্যস্ত নয় সে। কিন্তু মেহরিনের পরের কথাগুলো শুনে মুখের হাসি পুনরায় উদয় হলো। মেহরিন হালকা হেসে বললো,’কিছু মনে করবেন না স্যার। আসলে হস্পিটালে অনেক ধরণের মানুষ আসা যাওয়া করে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা আপনার জন্য নিরাপদ নয়। তাছাড়া একজন এজেন্ট হিসেবে সবার আগে আপনার সিকিউরিটি এনসিউর করাই আমার দায়িত্ব!’

প্রশংসার দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী, কনফিডেন্ট দায়িত্বশীল মেয়েটির দিকে চাইলো সায়েদ। মুচকি হেসে বললো,’ডোন্ট ওরি মিস মেহরিন। উই হ্যাভ পার্সোনাল সিকিউরিটি ফোর্স। ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।’

মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো মেহরিন। এ কোন মুসিবতে পড়ছে সে! এইমুহূর্তে প্রস্তাব নাকচ করার মতন অন্য কোন উপায় মাথায়ও আসছে না। মৌনমুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তাকে চুপ থাকতে দেখে সায়েদ পূর্বের কথার রেশ টেনে বললো,’আশাকরি এবার আর আমার সঙ্গে যেতে আপনার কোন আপত্তি নেই?’

-‘ঠিক আছে চলুন।’, বাধ্য হয়ে রাজি হতে হলো মেহরিনকে। অসম্ভব বিরক্ত লাগছে তাঁর! গায়েপড়া লোক! সোহাগ, মাহমুদ, এনা তিনজনেই আড়চোখে ব্যপারটা লক্ষ্য করেছে কিন্তু তিনজনেই চুপ। ইরফান সাহেব একটু আগে নিজে সায়েদের সঙ্গে মেহরিনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এনএসআই প্রধানের মেয়ের সঙ্গে মন্ত্রীর ছেলের কথোপকথন অন্য কারো হস্তক্ষেপ করার অবকাশ নেই। কিন্তু মাহমুদের ব্যপারটা একদম ভালো লাগছে না। সায়েদকে খুব একটা সুবিধের লাগছে তাঁর। অভিজাত চেহারার মাঝেও কোথায় যেন একটা অসৎ ভাব। আড়চোখে মেহরিনের দিকে চাইলো সে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেহরিন বেশ বিরক্ত। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের।নিশ্চিন্ত মনে ব্যপারটা পুরোপুরি মেহরিনের ওপর ছেড়ে দিলো সে।


দুইতিন দিন পরের ঘটনা। নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিলো মাহমুদ। আগামী মাসে তাদের নতুন করে একটা মিশন আছে। সেটার কাজ নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে তাঁকে। কাজের মাঝখানে সোহাগ হঠাৎ ছুটে এসে জানালো সায়েদ মিসিং। তাঁর কল লিস্টে সর্বশেষ নাম্বার মেহরিনের। আজকে সকালে অফিস থেকে মেহরিনকে পিক করে নেয় সে, তারপর থেকেই মিসিং। মাহমুদ হাঁ করে কিছুক্ষন সোহাগের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মেহরিনকে পিক করে নিয়েছিলো মানে? দুদিনে নিশ্চয়ই মেহরিনের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে যায় নি যে অফিস থেকে তাঁকে পিক করে নেবে। তাহলে ঘটনা টা কি? মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাঁর! হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে দ্রুত প্রশ্ন করলো সে,’ফোন ট্র‍্যাক করা গেছে?’

-‘জি। একটা রেস্টুরেন্টের লোকেশন। পুলিশ সেখানে গিয়েছে কিন্তু সায়েদ কে পাওয়া যায় নি।’

মাহমুদ আতঙ্কিত মুখে ফের প্রশ্ন করলো,’মেহরিন? মেহরিন কোথায়?’

আকস্মিক চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেলো সোহাগেরও। টিভি নিউজে কেবল সায়েদের মিসিং হওয়ার খবরই প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু মেহরিনের কথা কেউ বলছে না। এই কথাটা সোহাগের মাথায়ও আসে নি। মলিন মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিলো মাহমুদ তাঁর উত্তর বুঝতে পেরে বললো,’জলদি, মেহরিনের ফোনের লোকেশন ট্র‍্যাক করার ব্যবস্থা করো! কুইক!’

তাঁর কথামত কাজ শুরু করে দিলো সোহাগ। মাহমুদ হাতের কাগজ পত্র রেখে দ্রুত কন্ট্রোল রুমের দিকে ছুটলো। অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই লোকেশন ট্র‍্যাক করা হলে অবাক হয়ে একে অপরের দিকে চাইলো মাহমুদ এবং সোহাগ। মেহরিনের বাসার লোকেশন শো করছে। তারমানে মেহরিন বাসায়। একসঙ্গে অফিস থেকে বেরোলো দুজনে।

বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে লাগাতর বেল টিপছে মাহমুদ। সোহাগও শঙ্কিত মুখে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দুয়েক বাদে হেলেদুলে দরজা খুললো মেহরিন। বাইরে সোহাগ এবং মাহমুদ দুজনকে দেখে অবাক হয়ে বললো,’কি ব্যপার তোমরা?’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মাহমুদ। গম্ভীর গলায় বললো,’এতক্ষণ লাগলো যে?’

-‘ঘুমিয়ে ছিলাম!’

সোহাগ এবং মাহমুদ ফের আরেকবার একে অপরের দিকে চাইলো। দুজনেই কনফিউজড! মেহরিনকে কি সায়েদের মিসিং হওয়ার খবরটা পায় নি? এই অবস্থায় সে ঘুমাচ্ছে কি করে?

-‘জলদি চেইঞ্জ করে এসো। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।’

-‘মানে? সিরিয়ার কিছু?’

-‘মি.সায়েদ মিসিং!’

-‘হোয়াট? আমার সঙ্গে তো সকালেই দেখা হলো।’

-‘দুজনে কি একসঙ্গেই বেরিয়েছিলে রেস্টুরেন্ট থেকে?’

-‘না। আসলে একটু ঝামেলা হয়েছিলো। তাই আমি আগেই বেরিয়ে গেছিলাম।’, খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলো মেহরিন। সায়েদ আজকে রেস্টুরেন্টে খুবই জঘন্য দুটো প্রস্তাব দিয়েছে তাঁকে।প্রথমে প্রেম তারপর একেবারে সরাসরি রুম ডেট! লজ্জায় মাহমুদের সামনে কথাগুলো বলতে পারলো না সে। কিন্তু মাহমুদ ছাড়লো না। কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো,’ঝামেলা?’

-‘ভদ্রলোক আমাকে প্রপোজ করেছিলেন। উই হ্যাড এন আর্গুমেন্ট! হি ইউজড সাম ভালগার ওয়ার্ড, দ্যান আই স্লেপড হিম!’,বিব্রত মুখে জবাব দিলো মেহরিন।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ! সে ধারণাই করতে পারে নি এত অল্প সময়ে সায়েদ এতদূর এগোবে। সোহাগ দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’ভদ্রলোক? একটা মেয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্কেন করা একটা অসভ্য, বদমাশকে তুমি ভদ্রলোক কেন বলছো মেহরিন? আমি তো প্রথম দিনই বুঝেছিলাম ব্যাটার চরিত্রের দোষ আছে!’

জবাবে মেহরিন কিছু বলতে যাচ্ছিলো মাহমুদ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’এটা আর্গুমেন্টের সময় নয়। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো প্লিজ। আমাদের খুব দ্রুত সায়েদ সাহেবকে খুঁজে বের করতে হবে।’

তাঁর কথামত চুপচাপ চেইঞ্জ করতে চলে গেলো মেহরিন। সোহাগ বিরক্ত মুখে বললো,’আমরা কেন শয়তানটাকে খুঁজতে যাচ্ছি মাহমুদ ভাই? এরকম শয়তান দুই একটা মিসিং হলে দেশ বেঁচে যাবে। এদের জন্যই তো দেশের এত অধোপতন। আমি তো খুশিই হবো না পাওয়া গেলে।’

-‘বোকার মতন কথা বলো না তো সোহাগ। ওর কিছু হলে মেহরিন ফেঁসে যাবে। তাই যেভাবেই হোক ওকে আগে খুঁজে বের করতে হবে।’
আচমকাই চুপসে গেলো সোহাগ। মাহমুদ ঠিকই বলেছে সায়েদের কিছু হলে সত্যি সত্যি ফেঁসে যাবে মেহরিন। কললিস্টে সবার শেষে মেহরিনের নাম্বার। তারওপর সর্বশেষে মেহরিনের সঙ্গেই দেখা গেছে তাঁকে। তাই যেভাবেই হোক সায়েদকে খুঁজে বের করতে হবে। মেহরিন রেডি হয়ে একসঙ্গে বেরোলো তিনজন। তিনজনের চেহারাতেই দুশ্চিন্তার ছাপ! কি হবে সায়েদকে খুঁজে না পাওয়া গেলে?
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here