#হৃদয়_জুড়ে_তুমি
#এক
ইমেইল চেক করতেই সুখবরটা পেয়ে গেল শোভন। চাপা আনন্দে রীতিমতো লাফিয়ে উঠলো।
কাকে জানাবে? বাসায় কেউ নেই এখন বাবা ছাড়া। বাবাকে এখনই জানাবে কি? না থাক, সন্ধ্যার পর সবাই একসাথে হলে তখন মিষ্টিসহ খবরটা দিবে।
একটা চাকরী মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অনেক কিছুর সমাধান।
শোভনদের পরিবারে খুব একটা অভাব নেই। আসলে অভাবটাকে মেনে নিয়ে চললে হয়তো তা আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। বাবার পেনশনের টাকা আর তিনভাই বোন মিলে টিউশনি করে চলে যাচ্ছে দিন। দিনশেষে একত্রে ভালোবাসাময় পরিবারটাই সাচ্ছন্দ্য।
শোভন পরিবারের বড় ছেলে। দায়িত্বশীল ও মেধাবী।মাস্টার্স শেষ করে অল্পতেই ভাল চাকরী পেয়ে গেল।
বোন শান্তা শোভনের চেয়ে তিন বছরের ছোট, ভার্সিটি পড়ছে। সবার ছোট শুভ কেবল কলেজে উঠলো। মধ্যবিত্তদের সন্তানরা মেধাবীর পাশাপাশি দায়িত্বশীল হলে হয়তো জীবনের বাধা অতিক্রম করা অনেকটা সহজ হয়।
শান্তা যখন রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছে শোভন সে সময় মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকে।
হঠাৎ মিষ্টির কারণ জানতে চাইলে শোভন চাকরীর সুসংবাদটা জানায়।
ঘরে একমাত্র মেয়ে মানুষ শান্তা। সে কি আর বসে থাকে? ঠিক ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ছোট শুভটাও বোনের নেওটা। সেও সাথে যোগ দেয়। শোভন আর বাদ যাবে কেন। তিন ভাইবোন বাবাকে জড়িয়ে কাঁদে। আনন্দের কান্না কি সহজে থামে?
সকল কৃতিত্ব মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়ানো বাবা নামক মানুষটার। এ মানুষটা কিভাবে যেন একা হাতে নীরবে চাকরী সামলেও তিনটা বাচ্চাকে বড়ো করেছে, মানুষ করেছে।
মায়ের অনুপস্থিতি সবাই মেনে নিলেও মনকে ঠিকই বিষন্ন করে তুলে। বড্ড অসময়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে মা। শুভটা মাত্র আট বছরের ছিলো তখন।
ওর স্কুল থেকেই বাবার কাছে কল গিয়েছিল কেউ শুভকে ছুটির পর নিতে আসেনি বলে।
মা যে কখন গাড়ি চাপা পড়ে মর্গে পড়ে ছিল কেউ তা জানত না।
মুহুর্তে সাজানো গোছানো হাসিখুশি পরিবারটা নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
সবার আদরের ছোট্ট শুভ হঠাৎই যেন বড় হয়ে যায়। শুভর সকল দায়িত্ব মায়ের মতো কাঁধে তুলে নেয় কিশোরী শান্তা। আর ছোট ভাইবোনের সকল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় ষোলোবছর বয়সী শোভন। সবাইকে আকড়ে ধরে জীবনযুদ্ধ একা হাতে চালিয়ে যান বাবা।
চাচা ফুফুরা দূরে সরে যায় বাবার দ্বিতীয় বিয়ের অনাগ্রহ শুনে। পাছে দায়িত্ব যদি ওদের ওপর বর্তায়।
প্রতিবেশী পরিবারগুলোর সহযোগিতা আর ভালোবাসা ছিল ভিষন আন্তরিক।
প্রেম- ভালোবাসা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাজে আড্ডা দেয়া কিংবা সিগারেট খাওয়া এমন কোনো অভ্যাসই নেই বলে পাড়ার মুরব্বীদের কাছে স্নেহের পাত্র আর দৃষ্টান্ত এই তিন ভাই বোন।
রাতের খাবারে বাবা আত্মতৃপ্তির সুরে বলেন, এবার তোর বিয়ে দিবো শোভন। ঘরে একটা মিষ্টি বউ চাই। যার দায়িত্বে সংসার দিয়ে আমি একটু অবাধ্য বাপ হবো। এটা সেটা খাওয়ার বায়না ধরবো, নাতি নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পরবো।
শুভ খেতে খেতে বলে, ঘরে বাচ্চা এলে মন্দ হয় না। আমি দায়িত্বশীল চাচ্চু হবো।
শান্তা হি হি করে হেসে ওঠে।
— ঘরে কেবল চাকরীর মিষ্টি এসেছে আর সবাই ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে বাচ্চা সমেত ঘুরছে।
— আরে আপু, একটার সাথে আরেকটা কানেক্টেড বুঝলি । চাকরী হয়েছে এখন ভাবী আসবে তারপর বাচ্চা। তাই না বাবা?
— একদম। শোভন তোর কোনো পছন্দ আছে? বল, আমরা কাল গিয়েই বউ নিয়ে আসবো।
বরাবর চুপচাপ থাকা শোভন স্মিত হেসে বলে, বাবা ব্রেক ধরো। আপাতত চাকরী হজম করো। বিয়ে আগে শান্তার হবে।
— আরে আমি মাঝখানে এলাম কেন? আমি বিদায় হলে বাবার খেয়াল রাখবে কে? আগে ভাবী আসবে, সংসার সামলাবে, আমি একটু টিপিক্যাল ননদের রূপ দেখবো তারপর বিদায় হবো।
সবাই হেসে উঠলেও শোভন চুপ থাকে।
***
নিজের রুমে আধশোয়া হয়ে শোভন ভাবে, বিয়ে কি আদৌ করবে সে? যে মেয়েটা সমস্ত হৃদয় জুড়ে আছে তাকে তো কখনো বউ করার স্বপ্ন দেখে না।
কেন যে একটা ছটফটে ফড়িংকে ভালোবাসতে গেল? পরিবারের আদরের রাজকন্যা কি এমন দরিদ্র পরিবারে ম্লান হয়ে যাবে না? মা বিহীন সংসারে যে বউ হয়ে আসবে তাকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল, অনেক সমঝদার হতে হবে। বাবার ছোট ছোট চাওয়াগুলো যদি পূরণ করতে না পারে? পরিবারের বড় ছেলে হয়ে কেবল নিজের কথা ভাবলে চলবে না। তাছাড়া যে মেয়ে আসবে তার প্রতিও তো দায়িত্ব আছে। শুধু ভালোবাসা দিয়েই কি জীবন চলে?
তন্ময়ের অতি আদরের ছোট বোন তটিনী। একটা ফুলের টোকাও ফেলতে দেয় না বোনের গায়ে। বাবা সরকারী চাকরী শেষে ইলেক্ট্রনিকসের দোকান দিয়েছে। যা ইনকাম হয় তাতে সাহস করে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে এ পাড়াতেই। টাকা পয়সার খুব একটা হিসেব করে চলতে হয়না তাদের।
বন্ধু তন্ময়কে কি করে বলবে, তার আদরের বোন তটিনীকে শোভন তার ছোট আঙ্গিনার বউ করতে চায়!
তটিনীকে নিয়ে তন্ময়ের কত স্বপ্ন। বড় পরিবারে সুযোগ্য ছেলের সাথে বিয়ে দেবে।
সকল ভাইয়ের ই এমন চাওয়া থাকে। শোভনেরও ইচ্ছে শান্তার ভালো, সনামধন্য পরিবারে বিয়ে হোক। ছেলে ভালো ইনকামওয়ালা হোক।
তটিনীর নিজেরও তো অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে। ভালো পাত্র, ভালো বিয়ে, হানিমুনে দেশের বাইরে যাওয়া, বড় ফ্ল্যাটে সংসার করা।
শোভনের সীমিত স্বপ্নের সাথে তটিনী কি করে খাপ খাবে!
এই ছোট ভাড়া বাসা, পরিবার, ভাই বোনের দায়িত্ব এসবের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না শোভন। মাথায় প্রথমেই আসে শান্তার মুখ, শুভর মুখ আর বয়সের ভারে কুজো হওয়া ক্লান্ত বাবার মুখ। এসব বাদ দিয়ে তটিনীকে নিয়ে ভাবতে কেবল কল্পনাতেই ভালো লাগে কিন্তু বাস্তবে তা পূরণ করার দুঃসাহস কখনো করবে না সে।
তটিনী আর শান্তা জানের বান্ধুবী। একসাথেই স্কুল কলেজ এখন ভার্সিটি।
স্কুল ছুটি হলে তন্ময়ের তার বোনকে আনতে যাওয়া চাই-ই চাই.। সাথে শোভনকেও ধরে নিয়ে যেত। বলতো তোরও তো বোন পড়ে। তোর দায়িত্ব নেই?
মা হীন সংসারে ছোট শান্তাই তো মায়ের ভূমিকা পালন করে আসছে। স্কুল থেকে আনার তো প্রয়োজন পড়ে না। উল্টো ফেরার পথে মেয়েটা ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ফিরতো।
কিন্তু তন্ময়কে কে বোঝাবে। উল্টো গম্ভীর সুরে বলতো, তুই না গেলে না কিন্তু আমার দুই বোনকে আমি একা ছাড়বো না।
এখানেও শোভনের নিজেকে ছোট মনে হয়। তন্ময় যেখানে শান্তাকে তটিনীর মতো বোনের চোখে দেখে সেখানে শোভন কখন কিভাবে তটিনীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লো! ছটফটে চঞ্চল তটিনী সামনে এলেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে।
তন্ময়ের খোঁজে কতবার সময়ে অসময়ে শোভন ঐ বাসায় গিয়েছে। তটিনী দরজা খুললেই শোভন বিচলিত হয়ে পড়ে। ঘরোয়া চেহারা, এলোমেলো চুল কিংবা সদ্য ঘুম থেকে জাগা ফোলা ফোলা চোখ সবকিছুই শোভনকে প্রবল নাড়া দেয়। চোখ নামিয়ে স্বাভাবিক গলায় তন্ময় কোথায় জিজ্ঞেস করে। ভেতরের তোলপাড় বার বার মনকে সাবধান করে, প্রেমময় চোখ যেন তটিনীর চোখে ধরা না পড়ে।
একদিন সন্ধ্যায় শান্তা, শুভ আর তটিনী আড্ডা দিচ্ছিল। সাথে বাবাও ছিলেন। কি যে হাসাহাসি! শোভন নিজের রুমে বসে আকাশ কুসুম ভাবে, সম্ভব কি, পরিবারের পাশে এভাবে ভালোবাসার মানুষটিকে বউ হিসেবে পাওয়া?
দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে মন থেকে।
বিষন্ন মনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।
শান্তা পথ আটকে জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া কোথায় যাচ্ছিস? আমি তো পাকুরা ভাজছি। সবাই এখন ছাদে যাবো। মজা হবে। তুই ও চল।
— তোরা যা। আমি তন্ময়ের কাছে যাই।
তটিনী নরম সুরে বলে, ভাইয়া তো এখানেই আসছে।
শোভন উত্তর খুঁজে পায় না। একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
আচ্ছা তটিনী কি বুঝতে পারে শোভনের মনের হালচাল? সবার সাথে এতো চঞ্চল ছটফটে অথচ শোভন সামনে এলেই কেমন লাজুকলতা হয়ে পড়ে।
কতদিন এমন হয়েছে শান্তার খোঁজে এসেছে কিন্তু শান্তা ঘরে নেই জেনেও শোভনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে তটিনী।
প্রয়োজনীয় কথা শেষ হওয়ার পরও কল কেটে দেয়নি। কিছু বলার বা শোনার প্রতীক্ষায় ছিল যেন।
শোভন সে সুযোগ দেয় নি।
বিপদের সময় যে পরিবারটি সবসময় সাথে থেকেছে, যে বন্ধুটি ভাইয়ের মতো পাশে থেকেছে সে পরিবারের রাজকন্যার দিকে দৃষ্টি দেয়া তো অন্যায়। কখনো তন্ময় যদি বলে বসে আমি তোকে বন্ধু ভেবেছিলাম, তখন কি উত্তর দেবে শোভন?
মধ্য বিত্তের ভালোবাসা যে সামর্থের ওপর নির্ভর করে।
সন্ধ্যায় ছাদে বসে সে আড্ডাটা অনেক জমেছিল। শান্তা তটিনীর চাপে পড়ে তন্ময় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে সে স্বর্ণার সাথে।
সবজানা শোভন কেবল মুচকী হেসেছিলো।
ভালোবাসা বাসির আলোচনা ছিল তুঙ্গে।
বিভিন্ন কাজে অকাজে সব একে একে ছাদ থেকে সরে গেলে কেবল রয়ে গিয়েছিল তটিনী আর শোভন। । সে সুযোগে তটিনী ধীর লয়ে শোভনকে প্রশ্ন করেছিল, আপনি কাউকে ভালোবাসেন না?
শোভন মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলো, বাসি তো, পরিবারকে।
লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে মাতাল দক্ষিণা হাওয়ায় খানিক দূরে বসা তটিনী যেন জ্বলজ্বল করছিলো।
শোভন ছিলো এলোমেলো কিংবা সাহসী।
— পরিবার ছাড়া আর কাউকে?
–হুম! বৃষ্টিকে, পাহাড়কে, সমুদ্রকে।
— কোন জড় পদার্থের কথা বলছি না। কোনো জীবনকে ভালোবাসেন না?
— তুমি যাদের জড় বলছো আমার কাছে তারা অনেক বেশি জীবন্ত।
তটিনী সঠিক উত্তর না পেয়ে আশাহতের শ্বাস ফেলে।
শোভন আড়চোখে তা দেখে বলে, হুম! একটা ফড়িং কে ভালোবাসি। চঞ্চল, ছটফটে রঙিন ফড়িং।
চোখ তুলে তটিনী বলে, সে ফড়িং কে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না?
শোভন কিছুটা কেঁপে ওঠে। এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না। মন অবাধ্য হয়ে উঠছে। উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।
শোভনকে নিশ্চুপ দেখে তটিনীও আকাশের দিকে তাকায়।
বিশাল আকাশে অজস্র তারা ঝিকিমিকি করছে।
— জানেন আমি কাকে ভালোবাসি?
শোভন চমকে তাকায়।
–নীল আকাশকে। খুব ইচ্ছে, নিজেকে নীল আকাশের কাছে সঁপে দেয়ার। কিন্তু কেন জানি আকাশ আমাকে দুহাত মেলে তার বুকে ডাকেই না।
— তোমার ভালোবাসাও দেখি জড় পদার্থ?
— মোটেও না। সে একটা নাম। চোখের আড়ালে প্রেম লুকানো রহস্যঘেরা এক মানবের নাম।
অন্ধকারে হাজারো তারার মাঝে দুজনের ভাবাবেগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে তন্ময় এসে তাড়া দেয় বাসায় ফেরার জন্য।
তটিনী চলে গেলে একবুক শূন্যতা নিয়ে একা বসে থাকে শোভন। ইচ্ছে হয় অভিলাষী হতে। গাঢ় নীল আকাশ হয়ে দুহাত মেলে চঞ্চল ফড়িংটিকে বুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে।
চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।।