#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#সপ্তম_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস

দুপরে খাবার জন্য আবীর যখন টেবিলে এলো মৃদুলা ততক্ষণে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে, আবীর দেখতে পাচ্ছে টেবিলে মুগডাল দিয়ে মুরগি, চিংড়ি মাছ ভাজি,পনির ভাজা সাজানো আছে। মৃদুলা গরম গরম ভাত এনে টেবিলে রাখলো। এরপর নিয়ে এলো রসমালাই। সবগুলো আবীরের প্রিয় আইটেম। দেখেই খাওয়ার ইচ্ছেটা বেড়ে গেছে চতুরগুন!
মৃদুলা বললো, বসে পড়ো আবীর।
ঠিক তখনই অবনী এলো। ও চেয়ার টান দিয়ে আবীরের পাশে বসলো। আবীর বললো, আমার হাতে খাবে আম্মু?
সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো অবনী। মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। সকালের তুলনায যথেষ্ট স্বাভাবিক সে।
ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো আবীর।
সঙ্গে সঙ্গেই মৃদুলা বললো, না আম্মু,নিজ হাতে খাও। তোমাকে খাওয়াতে গেলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাবা খেয়ে মজা পাবেনা। সকালেও বাবার খেতে দেরি হয়েছে তোমার জন্য।
অবনী বললো, থাক বাবা আমি বরং নিজের হাতেই খাই, তুমিও খেতে শুরু করো পরে মজা পাবেনা।
আবীর আর জোর করলো না। ও বললো, আম্মু জানো, টেবিলে যে আইটেম গুলো দেখছো সব আমার প্রিয় আইটেম।
আমারো, আমারো! অবনী লাফাতে লাফাতে বললো।
ওর আনন্দ দেখে আবীর এবং মৃদুলা দুজনেই হেসে ফেললো।
মৃদুলা বললো, আচ্ছা আবীর, মা যদি তোমাকে ফোন করে প্রশ্ন করেন, দুপুরে ঠিকমতো খেতে পেরেছো কিনা, তুমি প্লিজ বোলো যে তুমি যথেষ্ট তৃপ্তি করে খেয়েছো, প্লিজ!
-তৃপ্তি করে যদি খেতে না পারি, মিথ্যে মিথ্যে কেন বৃলবো?
মৃদুলা একটু থেমে গেলো। এরপর বললো, তুমি কি মার কাছে কখনো মিথ্যে বলো না? ওর কন্ঠটা আহত!
আবীর ধীরে ধীরে না সূচক মাথা নাড়লো। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
-ঠিক আছে! তুমি বরং মাকে এটাই বোলো যে,মৃদুলার রান্না মোটেই মজা হয়নি, আমি একটুও খেতে পারিনি!
আগে খেয়ে দেখি, তারপর বিচার করবো কি বলবো! তূমি যা শিখিয়ে দেবে তোতা পাখির মত তাই বলবো নাকি?
ওর কথা শুনে অবনী খিলখিল করে হাসছে। মৃদুলা তাকিয়ে আছে চুপচাপ, চেহারায় রাগের ছাপ।
আবীর চিংড়ি মাছ আর মুরগি থেকে একটু চেখে বললো, বাহ্ রান্না তো আসলেই মজা হয়েছে মৃদুল! এ কথাটা তো মাকে বলতেই হবে! বলতেই হবে যে, মৃদুল তো পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছে!
-থাক আর ঢং দেখাতে হবে না। মৃদুলা হালকা ধমকের সুরে বললো। ওর রাগ দেখে আবীর এবং অবনী প্রাণোচ্ছল হাসিতে ফেটে পড়লো।
বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। এমন সময় আবীরের ঘুমটা ভাঙলো। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই ওর। কিন্তু আজ দুপুরে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হয়েছে। এরপর মৃদুলার সঙ্গে বসে সিনেমা দেখেছে, সিনেমা দেখতে দেখতেই কখন‌ যে ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারবেনা আবীর।
সে যাইহোক, চোখ মেলেই ও দেখতে পেলো, মৃদুলা কার সাথে যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। হঠাৎ আবীরের দিকে চোখ পড়তেই আচ্ছা রাখি বলে ফোনটা রেখে দিলো।
আবীর ধীরে ধীরে উঠে বসলো, বললো কার সাথে কথা বলছো?
মৃদুলা লজ্জ্বায় লাল হয়ে বললো, আছে একজন।
-কে সে? মৃদুলার বলার ধরনে আবীর কিছুটা চিন্তিত!
-আমার জীবনে প্রতিদিন যাকে প্রয়োজন পড়ে, নানা সমস্যায় যাকে পাশে পাই, আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
-এমন কে আছে তোমার জীবনে? আবীরের কন্ঠটা কেঁপে গেলো।
-ভেবে দেখো।
– আশ্চর্য! আমি কি করে বলবো? আবীরের কন্ঠটা চড়ে গেছে।
মৃদুলা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
-আহ্ বলছো না কেন? আবীর অধৈর্য!
বুয়া, বুয়া, বুয়া। মৃদুলা হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছে।
আবীর তবুও সন্তুষ্ট হতে পারছেনা।
মৃদুলা মোবাইল বের করে বললো, এই যে দেখো বুয়া। হাসি থামছে না ওর।
আবীরকে দেখে মনে হচ্ছে, মাথায় বাজ পড়তে পড়তে বেঁচেছে।
-কি ছিলো এটা মৃদুল? আবীর প্রচন্ড রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলো।
-তুমি সারাদিন আমার সাথে যেমন দুষ্টুমি, ঠাট্টা করছো, তারচেয়ে একটু উপরের লেভেলের ছিলো। আমাকে নিয়ে এমন ঠাট্টা করলে আমি পাল্টা আঘাত করবো না,ভাবলে কি করে? মৃদুলা হাসতে হাসতে বললো।
আবীরের হার্টবিট এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ও রাগ করে মৃদুলার দিকে তাকিয়ে আছে।
মৃদুলা বললো, তুমি যে আমাকে আজো এতটা ভালোবাসো জানা ছিলো না আবীর, চেহারাটা দেখো আয়নায়, কি অবস্থা হয়েছে তোমার!
আমার সাথে কি এমনই করতে হলো?জানোনা, আমি অসুস্থ? আবীর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।
-সরি,সরি। তুমি যে এতটা ঘাবড়ে যাবে বুঝতে পারিনি।
-বুয়ার সাথে এভাবে কে কথা বলে?
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো তাই। ভাবলাম, জোরে কথা বললে তোমার ঘূমটা ভেঙে যাবে।
-কথা বলবো না তোমার সাথে যাও!
-আচ্ছা কথা বলতে ইচ্ছে না হলে বোলো না। চা করে নিয়ে আসি? খাও।
-তুমি কি সুযোগ পেলেই রান্নাঘরে যাওয়ার বাহানা খোজো?
-ফালতু কথা বাদ দাও, খাবে কিনা বলো?
-না ইচ্ছে নেই।
-মনে আছে আবীর, বিয়ের পরপর আমরা যখন কলাবাগানের বাসায় থাকতাম সবাই মিলে, সেসময় সন্ধ্যের চা টা আমিই করতাম সাধারণত, এবং সেই চা খাওয়ার জন্য তুমি প্রায়ই অফিস ফাঁকি দিয়ে শেষ বিকেল বাসায় ফিরতে।
কলিংবেলটা বাজলেই আঁখি যেতো দরজা খুলতে, ওকে দেখলেই তুমি বোকার মত অপ্রস্তুত হেসে বলতে, চা খেতে এসেছি। তোমার উত্তর শুনে ও কখনো উচ্ছল, কখনো মুচকি হাসতো।
বাবা মা সে সময়টায় কাছাকাছির মধ্যেই থাকতেন, বাবা ড্রইং রুমে বসে পত্রিকা পড়তেন,মা হয়তো তার পাশে বসে পান বানাতেন কিংবা টিভি দেখতেন, তোমাকে ঢুকতে দেখলেই বাবা তীর্যক দৃষ্টিতে মার দিকে তাকাতেন, যেন তিনি বলতে চাইতেন,চা খাওয়ার জন্য কি আর কোন জায়গা নেই?
আবীর এতক্ষণ মুচকি হাসছিলো, এবার শব্দ করে হেসে ফেললো।
মৃদুলা বললো, আমি আসলে ঐ সময়টায় বাবা মায়ের সামনে পড়তে চাইতাম না। ভীষণ লজ্জা লাগতো। আবার তোমাকে দেখে যেমন চরম আনন্দিত হতাম, তা তাদের কাছে আড়াল করাটাও কঠিন ছিলো।
একদিন কি কারণে যেন ড্রইং রুমে এসেছি, শুনলাম, বাবা মাকে বলছেন, তোমার ছেলেকে দিয়ে কিছু হবেনা। ও জীবনে উন্নতি করতে পারবে কিনা সন্দেহ!
এ কথার পর আবীর মৃদুলা দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো।
আবীর বললো, এখন হয়তো বাবার সে আক্ষেপ ঘুচেছে।
মৃদুলা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় অবনী ঘরে ঢুকলো। কান্না কান্না মুখ করে বললো, মা, হৃদি বললো, ও নাকি আজকে আসবেনা?
হ্যাঁ। তুমি কি করে জানলে?
-ও একটু আগে ল্যান্ড ফোনে ফোন করেছিলো, আমি ধরেছি তখন শুনলাম।
-ঠিকই শুনেছো।
-মা প্লিজ, প্লিজ তুমি হৃদিকে ফোন করে আসতে বলো না। আমি আগে থেকে ভেবে রেখেছি ও এলে কতকিছু করবো।
-না, মা আজকে না। আজকে বাবা বাসায় না, অন্য কোনো দিন।
না, না আজকে, আজকেই! অবনী কান্না কান্না ভাব করে বললো।
-অবনী আম্মু জেদ করেনা, মার কথা শোনো। প্লিজ!
অবনী মুখ কালো করে ফেললো।
আবীর বললো,আসুক না ওরা বাসায়, সমস্যা কি?
-আরে তুমি বুঝতে পারছো না, হৃদি যথেষ্ট দুষ্টু মেয়ে। কোন কথা শুনতে চায়না। তাছাড়া উর্মি ভাবিও মেয়েকে শাসন করতে চাননা। ওরা বাসায় এলে দারুন হৈচৈ হয়। তুমি দু মিনিটে বিরক্ত হয়ে যাবে। এমনিতে আমার খারাপ লাগেনা, কিন্তু আজ তোমাকে একা রেখে আমি ওদেরকে সঙ্গ দিতে পারবোনা। ইচ্ছে করছে না। অনেক কায়দা করে না করেছি, এখন তুমি আর কোন কথা বলতে পারবেনা বলে দিলাম।
আবীর অবনীর দিকে চাইলো। মেয়েটা কাঁদবে কাঁদবে ভাব, আবীর বললো, আমার সাথে পার্কে যাবে মামনি?
অবনী খুশি হয়ে মাথা ঝাকালো।
মৃদুলা বললো, না, না, না! তোমার এখন রোদে যাওয়ার দরকার নেই।
আবীর মৃদুলাকে উপেক্ষা করে অবনীকে বললো, তুমি গিয়ে কিছুক্ষণ খেলো। আমি মাকে রাজি করাই।
অবনী মিষ্টি হেসে ছুটে বেরিয়ে গেলো। মৃদুলা বললো, না আমি কোন কথা শুনবো না। বললেও লাভ হবে না। তোমার শরীর কতটা দুর্বল তুমি বুঝতে পারছো না, আমি দেখতে পাচ্ছি। আজ সিনেমাটা একটুও দেখতে পারোনি। সব সময় তো দৌড়ের উপর থাকো, আজকে বাসায় রেস্ট করবে তুমি।
-যথেষ্ট রেস্ট করেছি আর কত ঘুমাবো? শুয়ে বসে থাকতে থাকতে হাত পায়ে জঙ ধরে গিয়েছে। চলো না যাই! কতদিন আমরা তিনজন একসঙ্গে বের হই না। আর তাছাড়া দূরে কোথাও তো যাচ্ছি না, বাসার কাছেই তো পার্ক।
-কিন্তু তোমার শরীর খারাপ হয়ে গেলে তখন কি করবো?
কিছু হবে না, এত চিন্তা কোরো না তো! আমি তো আর এমন অসুস্থ না যে কোথাও গেলেই একেবারে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। আর যদি শরীর খারাপ হয়েই যায়, তাহলে তুমি দেখে রাখতে পারবেনা? কাল যখন বাসায় এসেছিলাম, ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে দেখে শুনে রাখবে, ব্যতিব্যস্ত হয়ে সেবা শুশ্রূষা করবে, সে আশা তো পুর্ন হয়নি, আজ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেটুকু না হয় পুষিয়ে নেবো।
-একদম ফালতু কথা বলবেনা বললাম। মৃদুলা রেগে গেলো।
ওর চেহারার ভাব দেখে মনে হচ্ছে হয়তো কেঁদেও ফেলবে। আবীর বললো, মৃদুল, জীবন মানে কিন্তু শুধু খাওয়া দাওয়া নয়।
কথাটা শুনে মৃদুলা হেসে ফেললো। বললো, কথাটা তোমার মাকে বোলো। তাঁর তো ধারনা উনার ছেলেকে আমি ভালো কিছু রেঁধে খাওয়াতে পারিনা, না খেয়ে খেয়ে দিনদিন ছেলেটা শুকিয়ে যাচ্ছে।
ওর কথা শুনে আবীর শব্দ করে হেসে ফেললো। বললো, মা কি তোমাকে এসবই বলেন?
মৃদুলা হেসে মাথা ঝাকালো।
-খারাপ লাগে না?
প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। এখন অতোটা লাগে না।

চলবে।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here