#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#শেষ_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
-ইয়ে মানে মৃদুল, বলছিলাম কি, চলো শুধু আমরা দুজন যাই। আমি আর তুমি।
মৃদুলা বেশ একটু ধাক্কা খেয়েছে। ও হেসে ফেললো। বললো, কি বললে? শুধু আমি আর তুমি? হঠাৎ?
আবীর নিজের চেহারা যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেছে। বললো, এমনি।
মৃদুলা ওর পাশে এসে বসলো। চোখ হাসি হাসি। চেহারায় একটা দুষ্টমি ভাব বললো, চলো যাই।
আবীর হেসে বললো, যাও, রেডি হও।
কিন্তু অবনী? সে কোথায় থাকবে? মৃদুলা সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গেই বললো।
-যাওয়ার সময় তোমাদের বাসায় রেখে যবো। তোমাদের বাসা তো বেশি দূরে ন।
-কটা বাজে খেয়াল আছে? প্রায় রাত নটা। এখন রেডি হতে গেলে কম করে হলেও আধা ঘন্টা লাগবে। তারপর আমাদের বাসায় যেতে যেতে আরো আধা ঘন্টা। এরপর আইসক্রিম খেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা বেজে যাবে। আমাদের তো গাড়িও নেই। কিভাবে হবে সবকিছু?
-আরে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। গাড়ি না থাকাটা কোন সমস্যা না।
বললেই সব কিছু হয়না আবীর। তাছাড়া অবনীর কথাটা একটু ভাবো, মা বাবা ওকে রেখে আইসক্রিম খেতে যাচ্ছে, ঘুরতে যাচ্ছে, ব্যপারটা ওকে কষ্ট দেবে।
কেন? কষ্ট পাওয়ার কি আছে, আমরা যাই খাই ওর জন্য তো নিয়েই আসবো!
খাওয়াটা ব্যপার না। কিন্তু ওকে বাদ দিয়ে আমরা এনজয় করতে যাচ্ছি, এটা ও মেনে নিতে পারবে না। ওর ছোট্ট মনে অনেক প্রশ্ন জাগতে পারে। অবনী আর আগের মত ছোট নেই যে ওকে একটা কিছু বুঝিয়ে যেকোনো জায়গায় রেখে যাওয়া যাবে, তুমি যে আমার সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছো, ব্যপারটা বোঝার মতো বয়সে তার হয়নি, কিন্তু মা বাবা ওকে বাদ দিয়ে আনন্দ করতে পারে এটুকু ভুল বুঝে কষ্ট পাওয়ার মতো বড় সে হয়েছে। তাছাড়া, আম্মু আব্বুও ব্যপারটা নিয়ে বেশ মজা পাবে। আম্মু জানে তুমি অসুস্থ, দিনে দু তিনবার ফোন করে তোমার খোঁজ খবর নিচ্ছে, আব্বুও তোমার সাথে দুবার কথা বলেছে। তাঁরা এটাও জানে আজকে মা বাবা এসেছিলেন, এখন আমি রাত দশটার সময় গিয়ে বলবো, আমরা আইসক্রিম খেতে যাচ্ছি, অবনীকে রাখতে এসেছি, কথাটা আমি আসলে বলতে পারবোনা আবীর, খুব লজ্জা লাগবে।
কিছুই করার নেই তাহলে? আবীর মনে খারাপ করে বললো।
মৃদুলা ওর হাতটা ধরে বললো, সরি, আসলে, আমার মনে হয়, জীবনের একটা সময় হয়তো এমন থাকে, যখন আমি তুমির চেয়ে আমরাটাই বেশি প্রাধান্য পায়।
আবীর চুপ করে গেলো।
মৃদুলা বললো, আচ্ছা, সকালে তোমার বেশ কষ্ট হয়েছে বলছো, তারপর তো মা বাবাই এলেন, তাদের সাথে বেশ সময় কাটলো, তোমাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে তুমি খুব ক্লান্ত এবং কাল তোমার অফিস, তো এই সময়ে তো তোমার রেস্ট করার কথা, অথচ তুমি আমাকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইছো, ব্যপারটা কি? কি গোপন করে যাচ্ছো আমার কাছ থেকে?
আবীর হেসে ফেললো। বললো,
এভাবে গোপন করে যাক না চলে অনেকটা দিন,
কখনো আঁধার নিয়ে, কখনো আশা রঙিন,
না বলেই যাবো বলে,
কত না কথার ছলে,
যে কথায় আছে লেখা আমার কবিতা।
-শ্রীকান্তের গান না?
-বাহ চমৎকার।
-প্রথম লাইনটা যেন কি?
-যদি জানতে, যদি জানতে, কি যে আমার মনের কথা, তাহলেই ফুরিয়ে যেতো তোমার আকুলতা!
এটুকু বলে আবীর উঠে গেলো।
-আরে কোথায় যাচ্ছো?
টিভি দেখা শেষ করে তুমি তো আমার কাছেই আসছো তাইনা?
মৃদুলা হেসে মাথা ঝাকালো।
-তাহলে এই কতক্ষন আমিও নিঃসঙ্গতার মাঝে সঙ্গ আর একাকিত্বের মাঝে আনন্দ খুঁজে দেখি কেমন লাগে!
মৃদুলা কিছুই বুঝতে পারছেনা।
পরদিন সকাল এগারোটা। মৃদুলার ফোনটা বেজে উঠলো। মৃদুলা একটু ব্যস্ত, ফোনটা ধরতে ধরতে দেরি হয়ে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদুলা একটু অবাক, আবীরের ফোন। ও তো এসময় ফোন করেনা আজ অনেক দিন। মৃদুলা ফোন ধরে বললো, কি ব্যাপার আবীর? শরীর ভালো নেই?
ওর কন্ঠ শুনেই আবীর বুঝতে পারছে, ফোন করাটা বৃথা হয়েছে। যা দেখার কথা তা এখনো দেখেনি মৃদুলা।
ও বললো মৃদুল, আমার ঘড়িটা মনে হয় বাসায় রয়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছিনা। তূমি একটু বিছানার পাশে বক্সের ড্রয়ারটা খুঁজে দেখো না।
-কি বলছো, অফিসে যাওয়ার সময় তো আমি নিজে তোমার হাতে ঘড়িটা দিলাম, তাহলে ওখানে থাকবে কেন?
আবীরের মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভাবছে, দিনের মধ্যে তো চব্বিশ বার ড্রয়ারটা খোলে মৃদুলা, অথচ, আজ খুললো না!
ও বললো, মৃদুল প্লিজ তর্ক না করে একটু খুজে দেখো না,
-আচ্ছা যাচ্ছি, যাচ্ছি। কি যে করো না মাঝে মাঝে, বুঝতে পারিনা একদম।
আবীর বললো, আচ্ছা মৃদুল, আমি একটু ব্যস্ত আছি। এখন রাখতে হচ্ছে। তুমি খুঁজে পেলে আমাকে ফোন কোরো কেমন?
-আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন রেখে মৃদুলা ওর রুমে ঢুকলো। বিছানার পাশের এই ড্রয়ার গুলোতে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে। এখানে আবীর ঘড়ি রাখতে যাবে কেন! খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই!
ড্রয়ার টান দিয়ে খুললো মৃদুলা, একটু অবাক হলো। ওর ডায়রিটা এখানে কে রেখেছে? এটা তো থাকে সামনের টেবিলে।
মৃদুলা ডায়রিটা টান দিয়ে বের করলো। খুঁজে দেখলো ঘড়ি নেই। ও ডায়রিটা নিয়ে গুছিয়ে রাখতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ দেখলো ডায়রির ভেতর একটা কলম ঢোকানো। আশ্চর্য তো! কে ঢোকালো? ওতো কখনো এভাবে ডায়রির ভেতর কলম গুঁজে রাখেনা। মৃদুলা ডায়রিটা খুললো কলমটা বের করার জন্য। কলম সরাতে গিয়ে দেখে ডায়রির পাতায় আবীর লিখেছে,
প্রিয় মৃদুল,
অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো তোমাকে একটা চিঠি লিখবো। কিন্তু কখনো সুযোগ হয়নি। আসলে বর্তমান যুগে চিঠি লেখার অবসর কারো হয়না হয়তো, প্রয়োজনও পড়েনা। কিন্তু আমার প্রয়োজন পড়ে গেলো। তাই চিঠিটা তোমাকে তোমার ডায়রিতেই লিখতে হচ্ছে। তুমি এক অন্তর কষ্ট নিয়ে সুখের সংজ্ঞা খুজছো, আমি ব্যস্ততার ভীড়ে সাচ্ছন্দ্যের চাবিকাঠি। আমাদের ভালোবাসা, আর স্বপ্ন গুলো কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে জানো, আমাদেরকে। তারা শুধু চায় আমাদের পরস্পরের প্রতি একটু মনোযোগ।
সুখের সংজ্ঞা খুঁজে ডায়রির পাতায় মনের ভাবনা লিখলে কি হবে? না, কথা গুলো তার সঙ্গে খুলে বলতে হবে যার সঙ্গে সুখী হতে চাও।
তুমি প্রত্যাশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনে মনে মনে ভাবো উপেক্ষিত হয়েছো, আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে যন্ত্রনায় স্বস্তি পেতে তোমার হাসিমুখ খুজি, কিন্তু আকাঙ্ক্ষাটা আকাঙ্ক্ষাই থেকে যায় বেশিরভাগ। তারপর আমাদের কথা হয়না, আমাদের একাকিত্বে অভিমান আমাদের সঙ্গ দেয়। পরস্পরের প্রতি ভূল ধারণা জন্মে। এমন অনেক ভুল ধারনার ধূলো জমে আছে আমাদের মনে। ধূলোর স্তরটা দিন দিন পুরু হচ্ছে। এবং আমাদের দুজনকেই ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।
অথচ আমরা তো আমরাই আছি। জীবনের পথচলায় পাশাপাশি হাঁটছি। আমাদের ভালোবাসাও আমাদের মাঝে আছে। তাহলে এই ভুল ধারণা গুলো হৃদয়ে লালন করে আর একা একা কষ্ট পাওয়া কেন? চলো না, দুজনে মিলে এই ভুল গুলো ভেঙ্গে দেই। আমাদের মাঝে অভিমান নয়, ভালোবাসা বেঁচে থাকুক তার আপন মায়ায়। আচ্ছা মৃদুল, তোমাকে বলা হয়নি, সন্ধ্যের চায়ের অভ্যাসটা আমি ছেড়ে দিয়েছি। সন্ধায় বাসায় ফিরতে পারিনা তো তাই। আর শত ব্যস্ততার মাঝেও কম করে হলেও দশ বার আমি মোবাইল চেক করি, কিন্তু কেন যেন তোমার মেসেজ গুলো দেখতে পাইনা। তোমাকে ভীষণ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কেন পাইনা?
লেখা শেষ।
মৃদুলার চোখ জলে ভরে গেছে। ও সঙ্গে সঙ্গে আবীরকে ফোন করলো। দু তিনটা রিং হতেই আবীর ফোনটা ধরলো, বললো, হ্যাঁ মৃদুল ঘড়ি পেয়েছো?
তুমি কি ঘড়ি রেখে গিয়েছো যে পাবো?
আবীর হেসে ফেললো। কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারছে যে কাঁদছে মৃদুলা।
আবীর বললো, তাহলে কি পেয়েছো?
-যা তুমি চেয়েছো যে আমি খুঁজে পাই।
আবীর আবার হেসে উঠলো। বললো, আমার সঙ্গে হেঁয়ালি করছো কেন মৃদুল? সরাসরি উত্তর কি দেয়া যায়না?
-কারণ তুমি সেটাই ভালবাসো, সরাসরি কথা শুনতে চাওনা।
আবীর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, মৃদুলা থামিয়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা বাসায় এত বই থাকতে খুঁজে খুঁজে সবসময় তুমি আমার ডায়রিটাই কেন পড়ো, এতবার নিষেধ করেছি তবুও কাজটা কি তোমার করতেই হয়? জানো না, কারো অবর্তমানে তার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিতে নেই?
-কি করবো বলো মৃদুল, ভীষণ ভালো লাগে। তোমার মনের কথা গুলো জানতে ইচ্ছে হয়, নিজেকে সংবরণ করতে পারিনা। তাছাড়া, তুমি আমার কাছে অন্য কেউ নও, চির আপন, হৃদয়ের ঘরে বসবাস করা কাছের মানুষ। তোমার সাথে এমনটা তো আমি করতেই পারি, এটুকু অধিকার কি দেবে না?
-হয়েছে, হয়েছে আর ঢং দেখাতে হবে না! সেই কখন থেকে কাঁদছি।
আবীর হেসে বললো, আচ্ছা শোন,আজ বিকেলে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে হবো, কাল চেয়েছিলাম, তুমি তো সুযোগ দিলে না, আজ কিন্তু আবদার রক্ষা করতে হবে। তোমার সাথে আমি একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে চাই। যে সময়টা হবে শুধু আমাদের দুজনার। কোথায় যেতে চাও, কি খেতে চাও সবকিছু তুমি ঠিক করবে। সব ঠিক করে আমাকে জানিয়ে দিলেই হবে। আমি ঠিক সময়ে জায়গা মত পৌঁছে যাবো। তুমি এসে আমার সঙ্গে মিট করবে।
-আর অবনী, তাকে কি বলবো?
-সেটা তো তুমি আমার চেয়ে ঢের ভালো জানো, অবনীকে কি বললে ওর মনে আঘাত লাগবে না, কোথায় থাকলে সে নিরাপদে থাকবে, আনন্দে থাকবে। কিভাবে সবকিছু সামলে নিতে হবে, যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করো।
-সমস্ত দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপাচ্ছো?
-আমাদের সংসার, আমাদের সন্তান, সবকিছু তুমি আগলে রেখেছো, আমার ঘর, আমার পরিবারকে আগলে রেখেছো, তাহলে, আমার স্বপ্ন স্বাধ গুলোকে কি মূল্য দেবে না?
-যদি কোন কারণে আসতে না পারি আবীর?
-কিছু তো করার থাকবেনা মৃদুল, তবে আমি তোমার কাছ থেকে হ্যাঁ শোনার অপেক্ষা করবো, শুনতে চাইবো যে তুমি আসছো।
মৃদুলা হেসে বললো, আচ্ছা, একটু সময় দাও। ভেবে চিন্তে একটা কিছু ঠিক করি। তুমি তো আবদার করে বসে আছো, কিন্তু প্ল্যানটা তো আমাকেই করতে হবে!
আবীর শব্দ করে হাসলো। এরপর একটু থেমে থেকে বললো, মৃদুল, আমি কিন্তু এখনো আগের মতই আছি, তোমাকে ঠিক তেমনি ভাবেই ভালবাসি যেমনটা তুমি সবসময় উপলব্ধি করেছো।
মৃদুলা কেঁদে ফেললো। ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দশ্রু। বললো, আমিও আগের মতোই গভীর ভালোবাসায় তোমাকে হৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছি আবীর।
এরপর ফোনের দুপ্রান্তই নীরব। আবীর মৃদুলা দুজেনের চোখেই অশ্রু টলমল। হয়তো অনেক কিছুই বলা হয়ে গেছে। যা শোনার অপেক্ষা ছিলো দুজনেরই।
শেষ