#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#দশম_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, এ আক্ষেপ কি শুধু আমার একার? না, তা হয়তো নয়! আবীরেরও নিশ্চয়ই অনেক আক্ষেপ আছে। আমিও তো আজকাল আগের মতো ও বেরিয়ে যাবার সময় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই না। ও হয়তো আমাকে খোঁজে, সকাল বেলা কাজের চাপে হুলুস্থুল অবস্থা, অবনীকে ঘিরেও ব্যস্ততা থাকে, তাই হয়তো আবীরের দিকে ততোটা খেয়াল করা হয়না যতটা সে আশা করে। ব্যপারটা ওকে কষ্ট দেয় হয়তো, মানে অভিমানে আজকাল আর আগের মতো অফিসে একটু পরপর ফোন করে ওর কুশল জানা হয়না। তাই হয়তো আমার ওপর আবীরেরও অনেক রাগ, তাইতো আজকাল আমাকে সে অনেক কিছুই খুলে বলতে চায়না, কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া শুরু হলে ও চুপ করে যায়, যেন এড়িয়ে যেতেই ভালোবাসে। ওর এই কৌশলে এড়িয়ে যাওয়াটা আমাকে তীব্র আঘাত করে। মনে হয় আবীর যেন আমাকে বুঝতে চাইছেনা। ওর দৃষ্টিতে এই চিৎকার চেঁচামেচি অকারণ, অনর্থক! আমি জানি অভিমান যেমনই হোক না কেন, আমাদের ভালোবাসা এরচেয়ে বেশি প্রগাঢ়। মাঝে মাঝে একাকী বসে ভাবি, কখনো পরস্পরের সামনে এ অভিমানের খাতা আমরা খুলবো কি?
পাতার শেষ লাইনটা পড়ে আবীর পৃষ্ঠা উল্টালো। এরপর দু পাতা খালি। তারপর আবার দিনলিপি লেখা হয়েছে। আবীর আবিষ্কার করলো ওর চোখ ভিজে গেছে।
ঠিক এমন সময ওর ফোনটা বাজলো। তাকিয়ে দেখলো মৃদুলা ফোন করেছে। আবীরের এক হাতে ফোনটা ধরা, অন্য হাতে ডায়রি। ওর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ সময় লাগলো ফোনটা ধরতে, কন্ঠ ঠিক করতে, এরপর বললো হ্যালো,
আবীর, ঘুমাচ্ছো নাকি? মৃদুলা রীতিমত হাপাচ্ছে!
কি হয়েছে মৃদুল? কোন সমস্যা? আবীরের কন্ঠে শংকা!
আবীর জলদি বাসা গোছাও! মা, বাবা আর আঁখি আসছে। মা ফোন করে বললেন, ওনারা বেরিয়ে গেছেন, আঁখি উনাদের সাথে মিলিত হয়ে একসঙ্গে আসবে। শুনে আমি বলতে গেলে দৌড় দিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। এদিকে উর্মি ভাবিও ফোন করে জানালেন, হৃদিকে নিতে আসছেন। মনে মনে উনাকে ধন্যবাদ দিলাম বুঝলে, মা বললেন, আসতে এক দেড় ঘন্টার মত লেগে যাবে, রাস্তায় যানজট। প্লিজ দোয়া কোরো আমি যেন এর আগে পৌঁছে যাই।
আবীর মনে মনে হাসছে। মুখে কিছু বললো না।
মৃদুলা বললো, আচ্ছা আবীর, উনাদের জন্য কি চাইনিজ আনবো, নাকি বিরিয়ানি, রোস্ট, এ জাতীয় কিছু নিয়ে আসবো?
-যেটা তুমি ভালো মনে করো নিয়ে এসো মৃদুল।
এটুকু পরামর্শও কি দিতে পারছো না? মৃদুলা রেগে গেলো।
আবীর হেসে বললো, আমাদের দুজনেরই হাতে অনেক কাজ। অযথা ঝগড়া করে সময় নষ্ট করার সুযোগও নেই। তাই রাখতে হচ্ছে মৃদুল।
ওহ্ সরি, সরি। আচ্ছা রেখে দিচ্ছি। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, ঘরটা ঠিকঠাক মতো গোছাও।
রাত সাড়ে আটটা। মা বাবা আর আঁখি মাত্রই বের হয়ে গেলেন। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মা, বাবা কিছুতেই থাকতে চাইলেন না, মার এক অজুহাত বাসা খালি। তাছাড়া, আঁখিকেও বাসায় ড্রপ করতে হবে। উনাদের কে বিদায় করে আবীর ওর রুমে এসেছিলো একটা প্রয়োজনীয় কল করতে। মৃদুলা বসে গেছে টিভির সামনে। ওর প্রিয় সিরিয়ালের একটা মিস হয়ে গেছে। অন্যটা মিস করতে চায়না।
ফোন শেষ করে আবীর ঘড়ি দেখলো। নাটক শেষ হতে আরো বিশ মিনিট। মনে মনে ভীষণ রাগ লাগছে ওর। আরে একদিন নাটক না দেখলে কি হয়? কিন্তু এ কথাটা মৃদুলার সামনে বলা যাবেনা। বললেই ঝগড়া হবে নির্ঘাত!
এরমধ্যেই আজকের কথা মনে হতেই ওর ঠোটের কোণে হাসির রেখা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আসলে যখনই মনে পড়ছে, না হেসে থাকতে পারছেনা আবীর। আজকের দিনটা মা বাবা আর আঁখির সঙ্গে দারুণ কেটেছে। অনেক দিন পর পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পেরে শরীর, মন ঝরঝরে লাগছে আবীরের।
বিশেষ করে মৃদুলা যখন বাসায় ফিরলো,ও রীতিমত হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকছে। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টাতে যেটুকু সময় লেগেছে সেটুকুই বাড়তি সময়।ও পুরো বিদ্যুৎ বেগে পুরো বাড়ি চষে বেড়িয়েছে, কোথাও কোন সমস্যা আছে কিনা বুঝতে। মৃদুলার দৌড়াদৌড়ি হুলুস্থুল দেখে হাসি আটকাতে পারেনি আবীর।
মৃদুলা একপর্যায়ে প্রশ্ন করলো, কি ব্যাপার হাসছো যে?
-না মানে ভাবছি, তুমি আমাকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিলে, কিন্তু নিজে এরচেয়ে বড় বেকায়দায় পড়ে গেছো!
-একদম ফালতু কথা বলবেনা বলে দিলাম! পারো তো শুধু ভুল বুঝতে। ঘরটাও তো ঠিকমত গোছাতে পারোনি!
আরে অসুস্থ শরীরে দুটো বাচ্চা সামলে এটুকু যে করেছি সেজন্য ধন্যবাদ দাও! আর তাছাড়া ভুলে যাচ্ছো কেন, তোমার শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ আসছে, সব কাজ আমি করে ফেললে হবে? তোমার জন্য কিছু রাখতে হবেনা?
মৃদুলা কেঁদেই ফেললো। বললো, ও মজা পাচ্ছে, পুরো ব্যাপারটায় ভীষণ মজা পাচ্ছে!
আবীর ভীষণ জোরে হেসে উঠলো।
দেখো না কি হাসি! মৃদুলাক এ মুহূর্তে পুরোই অবনীর মতো মনে হচ্ছে। যেন ছোট বাচ্চা!
আবীর বললো, আচ্ছা সরি,সরি। বলো, আর কি করতে হবে? নিজের বুদ্ধি থেকে এটুকুই পেরেছি। তুমি এবার বলো আর কি কি করা লাগবে।
-কিচ্ছু করার দরকার নেই। তুমি শুয়েই থাকো, যাও।
-আচ্ছা মৃদুল, আমি কি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বো? মা বাবা তো আমাকেই দেখতে আসছেন তাইনা?
ঠাট্টা করবেনা আবীর! নিতে পারছিনা।
আবীর আবার হেসে ফেললো।
মৃদুলা পৌঁছানোর আধাঘণ্টা পর মা বাবা এসে পৌঁছেছেন। আবীর ভাবছিলো, ব্যপারটা যদি উল্টো হতো, তখন কি হতো? যদি মা বাবা আগে চলে আসতেন, কিংবা ভাগ্যচক্রে ওনারা যদি মৃদুলা যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যেতেন, কাউকে কিছু না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চাইতেন, তবে কি হতো? ওনারা জেনে আসছেন, আবীর অসুস্থ, বাসায় রেস্টে আছে, কিন্তু এসে দেখতে পেতেন, মৃদুলা বাড়িতে নেই, আবীর বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত, যার মধ্যে একজনকে দস্যি বললেও খুব একটা ভুল হবেনা। দূজনে মিলে পুরো বাড়ি এলোমেলো করে ফেলেছে, আবীরকে বারবার এদিক ওদিক করতে হচ্ছে ব্যপারটা মা দেখে ফেললে কি হতো? আর ভাবতে চায়নি আবীর, আসলে হাসি ঠেকিয়ে রাখা দায়!
মৃদুলা বাসায় আসার সময় বিরিয়ানি,রোস্টের পাশাপাশি অল্প করে চাইনিজও এনেছিলো, বাবা চাইনিজ খেতে ভালোবাসেন। সঙ্গে ছিলো মিষ্টি এবং ফলমূল। কিন্তু মা এবং আঁখিও আসার সময় আবীরের পছন্দের অনেক কিছু রান্না করে এনেছেন। এজন্য মৃদুলাকে আবার ভাতও বসাতে হয়েছে। সবাই মিলে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হয়েছে। খেতে বসে আবীর দেখলো, মা ওর দিকে তাকিয়ে আছেন।
ও বললো, কি ব্যাপার মা তাকিয়ে আছো কেন?
কতদিন তোকে নিজে বেড়ে খাওয়াই না! কি খাচ্ছিস, না খাচ্ছিস বুঝতেও পারিনা। খা না বাবা, আমি একটু তোর পাশে বসি বেড়ে দেই।
আবীর ঝট করে মৃদুলার দিকে তাকালো। ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আবীর জানে মায়ের কথাটা ওকে কষ্ট দিয়েছে।
ও বললো, আমি একা কেন মা, আমরা তিনজনই তো কি খাই, না খাই তূমি তদারক করতে পারো না। আর তাছাড়া, তুমি আজকে কত কিছু নিজে রান্না করে এনেছো, তোমার নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকাটা অস্বাভাবিক না, অ্যাই মৃদুল বসে পড়ো, অবনী আম্মু খাও তো, মা আমাদেরকে আজকে নিজ হাতে সার্ভ করবেন, এবং তৃপ্ত হবেন।
ওর কথা শুনে আঁখি হেসে উঠলো। এমন কি বাবা নিজেও হাসি চাপতে পারলেন না।
মা রেগে গিয়ে বললেন, আ্যই তুই এত বেয়াদব কেন বল তো, মার সঙ্গে ঠাট্টা করিস? বাবাকে বললেন, কি দিনকাল পড়েছে দেখেছো! ছেলে মেয়ে মা বাবার সঙ্গে ঠাট্টা করছে! দাদীর কথা শুনে অবনী হাসছে।
বাবা বললেন, আহ্ ধমকাধমকি করে খাওয়ার টেবিলের পরিবেশটা নষ্ট কোরো না তো!
মৃদুলা বললো, মা আপনি খেতে বসুন তো, আমি সার্ভ করছি, বসুন, আর আবীরের কথা বলবেন না, সে আজকাল এভাবেই কথা বলে। মৃদুলা হাসছে।
থেকে থেকে আবীরের এসব কথাই মনে হচ্ছে। ও আবার ঘড়ি দেখলো, কম করে হলেও আরো দশ মিনিট লাগবে নাটক শেষ হতে। কিন্তু আবীর আর অপেক্ষা করলো না, সোজা ড্রইং রুমের দিকে দিকে হাঁটা দিলো। এসে দেখলো, মৃদুলা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। আবীরের মনে হলো, পারলে ও টিভির ভেতর ঢুকে যাবে। আবীর গিয়ে ওর পাশে বসলো। আস্তে করে কেশে গলা পরিষ্কার করলো।
মৃদুলা ঝট করে টিভি স্ক্রীন থেকে চোখ ফেরালো। বললো, কিছু বলবে আবীর?
-কাল থেকে আবার আমি অফিসে যাচ্ছি জানো তো, এমন ফ্রি সময় আবার কবে পাবো জানা নেই। অন্ততঃ এখন তো তোমার কিছুটা সময় টিভি কে না দিয়ে আমাকে দাও।
সরি,সরি। বলো কি করবো তোমার জন্য?
আবীর চট করে বললো, চলো না আইসক্রিম খেয়ে আসি?
মৃদুলা ঘড়ি দেখলো। ন’টা প্রায় বেজে এসেছে। ও বললো, তুমি কি দুষ্টুমি করছো আবীর?
আবীর নীরবে মাথা নেড়ে না বললো।
-সত্যি বলছো?
আবীর এবার নীরব সম্মতি দিলো।
মৃদুলার চোখ মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। বললো, একটু অপেক্ষা করো, আমি রেডি হবো, অবনীকে রেডি করতে হবে, একটু সময় লাগবে। তবে চেষ্টা করবো যতোটা সম্ভব জলদি আসতে
চলবে