গল্প: হৃদয়ের বন্ধন।
পর্বঃ ২০।
লেখাঃ #মেহের।

এতো আদর আর ভালবাসা দিব যে তুমি আমার দেওয়া সব কষ্ট ভুলে যাবে।
কিন্তু আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করিনি তার জন্য তুমি আমায় ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিবে না তো?
আচ্ছা বৌ তুমি আমার অপরাধ গুলো মাফ করতে পারবে তো?

মারুফ যখন এসব কথা ভাবছিল সে সময়ে চাঁদনী বানু মারুফকে বলে, দাদু ভাই অসুস্থ্য বৌকে এখন সুস্থ্য করার দায়িত্ব কিন্তু তোমার।
আর আমি যেনো না শুনি এই দায়িত্বের অবহেলা হয়েছে।

এরপর চাঁদনী বানু জেসিকার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,শুন উকিল জেসিকা আগে সুস্থ্য হোক তারপরে দুজনে একসাথে তোমার ওখানে থেকে বেরিয়ে আসবে।
এখন জেসিকার পাশে মারুফ থাকলেই ভালো হবে।
আর এখানে তোমাদের মেয়ের চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হবে না।
সেটা আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি।

মারুফ তার দাদুর কথা শুনে বলল, আব্বু চিন্তা করবেন না ওঁর যত্নের কোন ত্রুটি হবে না।
আর দাদু তুমিও চিন্তা করো না।
তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি হাঁসি মুখেই পালন করবো ।
সে বিশ্বাস নিশ্চিয় আমার উপরে আছে।

চাঁদনী বানু মারুফের কথা শুনে বলল, তোমার উপরে বিশ্বাস আছে বলেই তো নাতবৌকে ওঁর বাবার বাড়িতে এখন দিতে রাজি হয়নি।
আমাদের বাড়ির বৌ সুস্থ্য হয়ে বাবার বাড়ি আনন্দ ফুর্তি করতে যাবে তবে রোগীর মত নয়।

জেসিকার এই মুহূর্তে কোনো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।
শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে।
ওঁর মনে হচ্ছে চোখে ঘুম নেমে এসেছে।
শরীরটাকে টেনেটুনে নিয়ে এখন একটু বিছানায় মেলে দিলে কিছুটা ভালো লাগতো।
ইদানিং শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছে না।
সারা শরীরে শুধু ব্যথা করে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারছে না।
এই যে এখানে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে তাই জেসিকা ওঁর মা’কে বলল,মা আমায় একটু রুমে নিয়ে যাবে আমি বসে থাকতে পারছি না ।

জেসিকার মা মেয়ের কথা শুনে মেয়েকে রুমে নিয়ে গেল।
সে দেখছে মেয়ে কয়দিন ধরে কেমন কষ্ট পাচ্ছে।
প্রথমে তো ওঁর বাবা ও মারুফের সাথে রাগ করে কোন ঔষুধ খেতোই না।
ব্যথা সহ্য করতে না পেরে কান্না কাটি করতো তবু ঔষুধ খাবে না।
তবে গত দুইদিন ধরে ঔষুধ খাচ্ছে।
কারণ তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে জেসিকা এ বাড়িতে থেকে চলে যেতে চায়।
আচ্ছা ওঁর দাদু শাশুড়ি যখন ওকে এখানে থাকতে হবে বলল।
জেসিকা কোন প্রকার প্রতিবাদ করলো না কেন?
মেয়েটার মনে কি চলছে জেসিকা আমাদের সাথে রাগ করে না বলেই কোথাও দূরে চলে যাবে না তো।
মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝা যায় ভিতরে কত কষ্ট বন্ধী করে রেখেছে।

এসব চিন্তা ভাবনা করে শেষে জেসিকার মা মনে মনে দোয়া করলেন জেসিকা যেন , তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যায়।
তার মেয়ে রাগে ক্ষোভে যেনো কোন ভুল সিদ্ধান্ত না নেয়।
মারুফের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে না চায়।
সন্তানেরা সুখে শান্তিতে থাকুক এটাই তো একমাত্র চাওয়া মা বাবার।

জেসিকার বাবা মেয়ের চোখে নিজের জন্য অভিমান দেখেছে।
অবশ্য সে কাজেই করেছে এমন।
পরের কথা শুনে মেয়েটাকে মারা একদম উচিত হয়নি।
এসব ভেবে মনে মনে কষ্ট হচ্ছে।
তাঁর আদরের মেয়েটা দেখতে পুতুলের মত ছিল।
কিন্তু জেসিকার যে অবস্থা এখন কেউ দেখলে মনে করবে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে থাকতে মেয়েটা দেখতে এমন হয়েছে।
আচ্ছা মেয়েটা কি আমার সাথে রাগ করে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
আমার কাছে নিয়ে যেতে চাইছি কিন্তু মারুফের দাদু নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলো না।
মেয়েটাও যাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলল না।
এত কষ্ট করে মেয়ে বড় করলাম।
কিন্তু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে এখন বাবার বাড়িতে নিয়ে যেতেও শ্বশুর বাড়িতে থেকে অনুমতি নিতে হয়।
সমাজের কি আজব রীতিনীতি।
মেয়েদের বিয়ের পরে মা বাবার বাড়ি হয় পর শ্বশুর বাড়ি আপন।
জেসিকার বাবা এসব ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।

জেসিকার মা মেয়েকে রুমে নেওয়ার পরেই জিজ্ঞাসা করলেন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না কি?
জেসিকা মায়ের কথা শুনে বলল,মা এখন কিছুই খাবো না খেতে একটুও ভালো লাগছে না।

জেসিকার মা মেয়ের মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে আর বলছে,মারে এমন অল্প অল্প খেলে শরীরে ভালো হবে কী করে?
ঠিক মত দাঁড়িয়ে থাকতে পারিস না।
আর দাঁড়িয়ে থাকবি কিভাবে না খেলে তো শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে শক্তিই পাবি না।
এখন তো তোর শক্তির দরকার।
জেসিকার মা অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে জেসিকার দিকে তাকিয়ে দেখে
জেসিকার চুলে বিলি কেটে দেওয়াতে আরাম পেয়ে মেয়ে তার ঘুমিয়ে গেছে।

এদিকে আলো কান্না কাটি করে সবার কাছে মাফ চাচ্ছে।
সে ভুল করেছে তা স্বীকার করেছে।

ওঁর কথা শুনে দোলা বলল, ছিঃ ছিঃ আলো তুমি এতো খারাপ আগে ভাবিনি।
নাহ্ বাবা তোমার আশেপাশে থাকাও বিপদের।
আম্মা তোমাকে কত ভালোবেসেছে সেই তুমি আম্মাকে ছাড় দেওনি সেখানে আমাদের সাথে কি না কি করে বসবে বুঝতেও পারব না!

আলো এসব কথা শুনে মনে মনে বলল, আমার সাধ্য থাকলে তোদের সবাইকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তাম।
তোদের মত স্বার্থপর
মানুষগুলোকে মারুফ ভাই ভালোবাসে কিন্তু আমি যে তার জন্য কারো জীবন নিতেও পারি সেই আমাকে একটুও ভালোবাসে না।
আমার দিকে ফিরেও তাকিয়ে দেখে না।
আমার কাছে কী নেয়?
রূপ যৌবন সবকিছুই তো আছে তারপরও কেন মানুষটা আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।
আলো এখনো নিজের ভুলগুলো দেখতে পাচ্ছে না।

এদিকে মায়া বেগম রুমে যাওয়ার আগে আলোকে গেষ্ট রুমে বসে থাকতে বলেছে।
তার বাবা না আসা পর্যন্ত রুমে থেকে বের হতে নিষেধ করে দেয়।

ড্রইং রুমে বসে চাঁদনী বানু জেসিকার বাবার সাথে টুকটাক কথা বলছে।

মারুফ বাসায় নেই কিছুক্ষণ আগে বাহিরে গেছে ।
অবশ্য যাওয়ার আগেই কাকিকে বলছে , বুয়াকে নিয়ে রান্না করতে।
জেসিকার বাবা মাকে না খেয়ে যেতে দিবে না।

এক ঘন্টা পরে মারুফ বাহিরে থেকে দুহাত ভর্তি প্যাকেট নিয়ে বাসায় ঢুকে।
দূরে থেকে কোমল তা দেখে ভাইয়ের কাছে এগিয়ে এলো।

মারুফ টেবিলে ব্যাগগুলো রেখে কোমলকে বলল, ছুটকি এখানে ফলমূল আছে সবার জন্য।
মা আর দাদুকে তুই নিজেই খাওয়াবি।
এবং নিজেও খাবি।
এ কথা বলে মারুফ ওখানে থেকে দুটো প্যাকেট নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

রুমে এসে দেখে শাশুড়ি জেসিকার মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।

মারুফ ফলের ব্যাগ দুটো টি টেবিলের উপর রেখে কোন কথা না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়।
ওয়াশ রুমে থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে নির্শব্দে শাশুড়ির পায়ের কাছে বসল এরপর তার পা ধরে আছে।
হঠাৎ করে পায়ে কারো হাত পরায় জেসিকার মা হকচকিয়ে গেল।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে মারুফ তার পা দুটো ধরে বসে আছে।

মারুফ শাশুড়ির পায়ে ধরেই বলতে থাকলো ,মা আমি ভুল করেছি।
ওকে নির্দয় পাষাণের মত মারা আমার উচিত হয়নি।
আমি বুঝতে পারছি ওঁর অবস্থা দেখে আপনার কত কষ্ট হচ্ছে।
যেখানে কোমলের জ্বর হলেই মা আর আমি পাগল হয়ে পড়ি ওকে সুস্থ্য করতে।
আর সেখানে আমি ওকে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছি।
একজন মা’কে কষ্ট দিয়েছি।
আমার এমন করা উচিত হয়নি
আমায় ক্ষমা করে দিন।
তবে মা বুঝতে পারিনি এতো লেগেছে ওঁর ।
রাগে তখন মাথা কাজ করছিলো না।
সবকিছু না জেনে ওঁর গায়ে হাত তুলে আমি ভুল করেছি।
মা আমার এখন সেই দিনের কথা ভাবতেই অনুশোচনায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি।

মারুফের কথা শুনে এবং ওঁর মুখটা দেখে জেসিকার মায়ের মায়া লাগছে ।
ভুল করেছে সেজন্য মেয়ের জামাই হয়েও শাশুড়ির পা ধরে মাফ চাচ্ছে।
জেসিকার মা বলল, মারুফ পা ছাড়ো । তুমি জামাই মানুষ পা ধরতে হবে না।

শাশুড়ির কথা শুনে মারুফ বলল, ভুল করেছি যেহেতু তাই ছেলে হয়ে মায়ের পা ধরতেই পারি।
মা দয়াকরে এবারের মত আমাকে মাফ করে দেন।
আমি কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে এমন কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ।
মারুফের শাশুড়ি মারুফের দিকে তাকিয়ে দেখে জামাইয়ের মুখটা শুকনো লাগছে ।
মারফের মুখে দিকে তাকিয়ে দেখে নিজের করা ভুলের জন্য ছেলেটা অনুশোচনায় ভুগছে।
চোখে কেমন অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে ।
জেসিকাকে আঘাত করে মারুফ যে ভালো নেই তা জেসিকার মায়ের একটু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না।
তাই মেয়ে জামাইকে মাফ করে দিলো।
মারুফ খুশি হয়ে বলল, মা আমাকে মাফ করার জন্য ধন্যবাদ।
আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন এটাই আমার কাছে বড় বিষয়।
আপনাকে কথা দিচ্ছি ,আল্লাহর রহমতে আমি থাকতে জেসিকার আর কোন অসুবিধা হতে দিবো না।
ওকে সবসময় সব বিপদে থেকে আগলে রাখতে চেষ্টা করবো।
মারুফের কথা শুনে জেসিকার মায়ের চোখে পানি এসে গেল।
মারুফ সে পানি দেখার আগেই তিনি তা সযত্নে মুছে ফেলল।

মারুফকে বিছানায় বসতে দেখে ওঁর শাশুড়ি বাহিরে গেছে।
মারুফ বিছানায় বসে জেসিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ইস্ কি অবস্থা হয়েছে বৌয়ের।
চোখের এক সাইডে ও কপালের এক পাশেও নীলচে দাগ হয়ে গেছে।
জেসিকাকে দেখে মারুফের বুকে ব্যথা অনুভব হচ্ছে।
ওঁর দিকে তাকিয়ে বৌটা এতদিন কত কষ্ট সহ্য করেছিল,যে মেয়ে বাবার বাড়িতে পানি ঢেলে খায়নি সে মেয়েটা কিনা ওঁর খুশীর জন্য ছোট বড় সব কাজ করেছে নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করেছে।
আর সে কি করেছে বৌয়ের জন্য?
হ্যাঁ করেছে তো বিনা দোষে বৌকে মেরে রক্তাক্ত করেছে।
বৌকে মেরে কাপুরুষের মত কাজ করেছে সেজন্য মারুফ মনে মনে নিজেকে দীক্ষা দিচ্ছে ।

রাতে মারুফের মামা এসে তার মেয়েকে নিয়ে যায়।
আলো বাবার সাথে যেতে চায়নি ।
এটা দেখে আলোর বাবা জোর করে মেয়েকে নিয়ে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না ‌।
কিন্তু সবার কাছে মেয়ের কুকর্মের কথা শুনে
আলোকে মেরে জোর করেই সাথে করে নিয়ে যায়।
এবং যাওয়ার আগে সবার কাছে মেয়ের হয়ে ক্ষমা চান।

অন্যদিকে রাতে খাওয়া
দাওয়ার পরে জেসিকার মা ও বাবা বাসায় চলে যান।
মারুফ তাদের থাকতে বলেছিল কিন্তু ওনারা থাকেনি।
মারুফ শ্বশুর ও শাশুড়িকে বিদায় দিয়ে রুমে এসে দেখে জেসিকা ঘুমে থেকে জেগে গেছে।
বিছানা থেকে নামছে।
মারুফ তা দেখে তাড়াতাড়ি এসে জেসিকার হাত ধরল যাতে পড়ে না যায় ‌।
কিন্তু জেসিকা মারুফের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।
মারুফ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না বৌ তার রেগে আছে ।
সেজন্য মারুফ জেসিকার হাত ছেড়ে দিয়ে জেসিকাকে হালকা করে জরিয়ে ধরল।

জেসিকা সরে যেতে নিলে মারুফ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,সরি সোনা বৌ ।
আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও লক্ষীটি।

জেসিকা মারুফের মুখে হঠাৎ করে এমন মধু মিশানো কথা শুনে কিছুই বলল না।

মারুফ বৌকে নিজের সাথে পিষে ফেলতে চাইছে।
কিন্তু জেসিকার শরীর ব্যথা থাকাতে মারুফের শক্ত বাঁধনের জন্য আহ্ করে উঠল।
মারুফ বুঝতে পারল তার বৌ ব্যথা পাচ্ছে তাই জেসিকাকে বাঁধন ছেড়ে দিয়ে দুই হাত দিয়ে জেসিকার মুখ কিছুটা উপরে তুলে গালে কপালে ছোট ছোট চুমু খাচ্ছে আর সরি বলছে কিন্তু জেসিকা মনে হয় পণ করেছে মারুফের সাথে কোন কথা বলবে না।
তাই মারুফের আদর পেয়েও কেমন নির্লিপ্ত হয়ে আছে।
মারুফের মনে হচ্ছে ওঁর বৌ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here