গল্পঃ হৃদয়ের বন্ধন।
পর্বঃ৭।
লেখাঃ মেহের।

সামনে দুজনের জীবন পারবে কী এক সুতোয় বাঁধতে?

সেদিনের ঐ ঘটনার পরেই জেসিকা নিজেকে অনেকটা বদলে ফেলেছে।
জেসিকা ভালো মত বুঝতে পেরেছে তার দোষের কারণে একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্বল হচ্ছে ইজ্জত তাই হারাতে বসেছিলো।
এ যাত্রায় আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
উশৃঙ্খল চলাফেরা জীবনে কখনো খারাপ ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনে না।
মারুফ তাকে কয়েকবার সাবধান করেছিল কিন্তু সে তখন বুঝতে পারেনি বা কিছুই বুঝতে চেষ্টা করেনি।
নিজের বেপরোয়া চলাফেরায়তো সর্ব নাশের কারণ হচ্ছিল।
এসব ভেবে এখন বাহিরে যেতে ইচ্ছে করে না।
জেসিকা সারাদিন বাসায় নিজের রুমে থেকেও কেউ বুঝতে পারবে না ভিতরে কেউ আছে কি নেই়!
আগের মত করে তার রুমে থেকে মিউজিকের শব্দও কেউ আজকাল শুনে না।

জেসিকা খুব প্রয়োজন ছাড়া রুমে থেকে তেমন একটা বের হয়না।
রুমে থেকে বাহিরে আসা বলতে নিজের রুমের দরজার বাহিরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আর কি!
তবে আগে রুমে থাকলে দরজা লক করতো ভিতরে থেকে।
এখন রুমে থাকে ঠিক কিন্তু আগের মতো রুমের দরজা লক করেও রাখে না।
জেসিকা আশায় বসে থাকে তার রুমে কোমল, ঝর্না বা মারুফ কেউ তো আসবে।
যাদের সাথে একটু কথা বলতে পারবে।
কিন্তু না কেউ আসে না।
আর তার কৃতকর্মের জন্য সেও লজ্জায় সবার কাছে যেতে পারে না।
জেসিকা এই কয়দিন ধরে পরিবারের সদস্যদের খেয়াল করে দেখেছে ।
এই পরিবারের সবাই খুব ভালো মানুষ ।
কিন্তু জেসিকার দাদু শাশুড়ি একটু জেদি মহিলা।
তাকে সবাই খুব সমীহ করে চলেন।
আর মারুফ সে তো অন্য রকমের একজন মানুষ।
সবার দিকে তার নজর আছে ‌শুধু এই জেসিকা ছাড়া।
এই বাসার প্রতিটা লোক যেনো মারুফকে ছাড়া অচল।
সবার ভালো মন্দ সুখ দুঃখ সব কিছুই যেনো মারুফকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।

একটা জিনিস কয়দিন ধরে জেসিকার বেশ নজর
কেড়েছে ।
সেটা হচ্ছে এই বাসায় একটি মেয়ে নতুন এসেছে।
নতুন এসেছে এজন্য বলছে কারণ জেসিকা এই মেয়েকে আগে কখনো দেখেনি তাই। মেয়েটিকে সবাই আলো বলে ডাকে।
মেয়েটা দেখতে মোটেও কোন কাজের মেয়ে মনে হচ্ছে না।
পরিবারের সবার সাথে পরিবারের একজনের মত করে মিশে থাকে।
বুয়া তো সারাদিন আলো মেয়েটার সুনাম করতে ব্যস্ত হয়ে থাকে।
আলো এটা করতে পারে।আলো ওটা করতে পারে।
আলো আর আলো এ নাম এতো বার শুনে অসহ্য লাগছে।
আলো এই বাসায় আসার পরে থেকেই সংসারে ভার সেচ্চায় নাকি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে ।
আরও কতকিছু!

জেসিকা খেয়াল করে দেখেছে মারুফ বাসায় এলেই মেয়েটা মারুফের পিছনে ঘুরঘুর করে।
কোমল ও ঝর্না তো আলো বলতে পাগল।
জেসিকার কেন যেনো মেয়েটাকে একটু ভালো লাগে না।
মারুফের আশেপাশের আলোকে দেখলে হিংসে হয়।
ঐ মেয়েকে দেখলেই অদ্ভূত কারণে জেসিকার শরীর রাগে ক্ষোভে জ্বলে উঠে।
মনে চায় আলোকে পিটিয়ে এই বাসায় থেকে তাড়িয়ে দিতে।

কিন্তু সে এখন কারো সাথে ‌আর কোন খারাপ আচরণ করতে চায় না।
তাই সব চুপচাপ দেখে যায়।

এদিকে দেখতে দেখতে একে ওপরের থেকে আলাদা হওয়ার ‌মূহূর্ত এসে গেছে।

মারুফ জেসিকার বাবাকে আজকে রাতে আসতে বলেছিল কিন্তু সে বলছে, এখানে এসে মেয়ের এমন জঘন্য কাজের সাক্ষী হতে চায় না।

মারুফ জেসিকাকে বলেছিল তোমার পক্ষে কেউ থাকলে আসতে বলতে পার।
আজকে সন্ধ্যায় আমাদের ডিবোর্স হবে।

জেসিকা মারুফকে বলে, আমার কেউ লাগবে না।

সন্ধ্যার একদিকে মারুফের পরিবারের সবাই বসে আছে অন্য দিকে জেসিকা একা বসে আছে।

মারুফ এসে পরিবারের কাছে বসে বলে, কাজী সাহেব তালাকের পেপার্স দিন আমি আগে সাইন করে দেয় তারপর নাহয় জেসিকার সাইন নিন ।
আমি আজকের মধ্যেই ঝামেলা শেষ করতে চায়।

মারুফের কথা শুনে কাজী সাহেব বললেন,সাইন করে তারপরে ধর্মমতে মৌখিক ভাবে তিন তালাক দিলেই হবে।
মারুফের দাদু বলল,হ্যাঁ দাদা ভাই আজকেই বাড়িতে থেকে এই জঞ্জাল সাফ করতে হবে।

মারুফের চাচ্চু বলল, জামিল ভাই এতো ভালো লোক তার মেয়ে এমন হবে কল্পনায়ও আসেনি।
কিন্তু তা বাস্তবে দেখে নিয়েছি।

এতোক্ষণ ধরে জেসিকা সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
এরপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, আমি এই ডিবোর্স চাচ্ছি না।
আমি মারুফকে সাথে সংসার করতে চায়।
একথা শুনে রুমে মধ্যে বসা সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেছে।

যে মেয়ে দিন রাত ঝগড়া ঝাঁটি করছে তালাকের জন্য সে আজকে বলছে তালাক চাই না।
এটা কিভাবে সম্ভব!

কাজী সাহেব বললেন, কিন্তু মা তুমি নাকি সংসার করতে ইচ্ছুক না।
আমাকে তো এটাই বলা হয়েছে।
জেসিকা বলে, আমি সংসার করতে চাচ্ছি।

মারুফ জেসিকার এইসব কথা শুনে রেগে চিৎকার করে বলল,এই মেয়ে সব কিছুকে তোমার মজা মনে হচ্ছে?
ইচ্ছে হলো ছেড়ে দিব ইচ্ছে হলো থাকবো এসব কি পেয়েছো!
জেসিকা মারুফের চিৎকারে ভয় পেলেও মারুফকে বলল, আগের সব কথা বাদ আমি আপনাকে ছাড়তে পারব না।
দয়াকরে আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করবেন না।

জেসিকার কথা শুনে চাঁদনী বানু বলেন,শুনো তুমি জামিলের মেয়ে দেখে এতো দিন কিছু বলেনি কিন্তু আর না।
তোমার মত মেয়ের আমার বাড়িতে জায়গা নেয়।
এইসব নেকা কান্না বন্ধ করে তালাকের কাগজে সাইন করে বিদায় হও বাপু।

জেসিকা মারুফের দাদুর কাছে এসে বলল,প্লিজ এমন করবেন না।
আমি আর কখনো আপনাদের সাথে খারাপ আচরণ করবো না।
আপনারা যে ভাবে বলবেন সে ভাবেই থাকবো তাও আমায় তাড়িয়ে দিয়েন না।

মারুফের দাদু জেসিকাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বলে, অভিনয় তো ভালোই জানো তা কোন মতলবে এখানে থাকতে চাচ্ছ তা ভেবেছো আমি বুঝি না।
যাই মতলব করো না কেন কোন লাভ হবে না।
আলো জেসিকার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল।
আলোর এতদিনের স্বপ্ন এক মূহুর্তে মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
একা আলো মানতে পারছে না।
তাই আলো জেসিকা কে বলে,এই মেয়ে তুমি কি ভেবোছো দাদু নরম মনের বলে তাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে এই বাড়িতে থেকে সবার মাথায় ছড়ি ঘুরিয়ে দমিয়ে রাখবে।

বিশেষ করে আমার ফুফুকে তিলে তিলে কষ্ট দিবে তা চেষ্টা করেও পারবে না।
আমাদের দাদু তা কখনো হতেই দিবে না।
জেসিকা আলোর কথা শুনে বলল,এই মেয়ে তুই চুপ কর।
তুই আমাদের ব্যাপারে কথা বলার কে?
কোন অধিকারে কথা বলছিস?
আমার সাথে বেশি কথা বলতে আসলে তোর দাঁত ভেঙে দিব।

জেসিকার কথা শুনে চাঁদনী বানু জেসিকার কাছে এসে ওঁর গালে থাপ্পড় দিয়ে বলে,তোর সাহস কি করে হয় আমার সামনে আলোর দাঁত ভেঙে দেওয়ার কথা বলার।
আর অধিকার জানতে চায়ছিস তো তাহলে শুনে নে আলোই হবে আমার মারুফের বৌ।
তুই না।
এই মূহুর্তে সাইন করে এখানে থেকে চিরদিনের জন্য চলে যা।

জেসিকা থাপ্পর খেয়ে রেগে যাচ্ছিল চাঁদনী বানু ওপড়ে কিন্তু সময় থাকতেই নিজের রাগকে কন্ট্রোল করলো এই বলে, যে এটা মারুফের পরিবার ।
এই পরিবার কষ্ট পেলে মারুফও কষ্ট পাবে।
আগে না বুঝে জীবনে অনেক ভুল করেছে এখন আর সেই ভুলের পাল্লা বাড়াতে চায় না
জেসিকা এসব ভাবছে।
জেসিকা আমি তোমার সাথে থাকতে চায় না।

মারুফের কথায় জেসিকা ভাবনা থেকে ফিরে আসে ।

মারুফ বলছে,দেখো জেসিকা তোমার আমার কখনো মিলবে না।
তাই আমি তোমার সাথে থাকতে চাচ্ছি না।
প্লিজ তামাশা না করে সাইন দাও।

জেসিকা মারুফের কথা শুনে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে শুরু করে।
হঠাৎ জেসিকা নজর পড়ে টেবিলে রাখা ফল কাটা ছুরির উপরে।
জেসিকা তাড়াহুড়ো করে টেবিলে থেকে ঝটপট ছুরি হাতে নিয়ে নেয়।
এতে মারুফের বাসার সবাই ভয় পায়।
তারা ভাবে জেসিকা তাদের আঘাত করবে।
কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে ছুরি জেসিকা নিজের পেটের উপরে চেপে ধরে বলল, আমাকে সাইন করতে বললে বা বাড়িতে থেকে তাড়াতে চায়লে এখনেই নিজেকে শেষ করে দিব।

মায়া জেসিকার কথা শুনে ও তার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে বলল, মা তুমি নিজেকে শেষ করো না।
কেউ তোমাকে তাড়াবে না তবুও এমন করো না।

চাঁদনী বানু বলে,বড় বউ তুমি সুপারিশ করলেও এই মেয়ের এইখানে কোন জায়গা নেই।

এদের কথা শুনে মারুফ চিন্তায় পড়ে গেল।
এদিকে জেসিকা যে ভাবে পেটে ছুরি চেপে ধরেছে কখন আবার কোন অঘটন ঘটে যায়‌।
তাই মারুফ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েও পারছে না।
জেসিকা যেমন মেয়ে এতে ওকে জোর করলে নিশ্চয়ই
বড় কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
তাই মারুফ বলল,দেখো জেসিকা অযথা জেদ করোনা। তোমাকে এই বাড়িতে থাকতে হলে, বাড়ির বৌয়ের সব কাজ করতে হবে।
রান্না বান্না ধোয়া মোছা সব করতে হবে।
সবার মন মতো চলতে হবে।
আমাদের অনুমতি ছাড়া বাহিরে যেতে পারবে না।
এমনকি বাড়ির ছোট বড় সকলের খেয়াল রাখতে হবে।
যা তোমার পক্ষে সম্ভব না।
তাই এমন না করে সাইন করে দাও।
জেসিকা মারুফের কথা শুনে বলল, আপনি যা বললেন আমি সব করবো তো প্রথমে সব ঠিকঠাক না পাড়লেও আস্তে আস্তে শিখে যাব
তাও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েন না।
মারুফ দেখে এই মেয়ে জেদ ধরে বসে আছে।
তাই কাজী সাহেবকে চলে যেতে বলল।
চাঁদনী বানু রাগে কাঁপতে থাকেও জেসিকা কে তাড়াতে না পেরে।
এখন নাতিকে কিছু বলতে পারে না।
মারুফের ছোট ভাই কোমলকে বলল,এই ওনাকে ঘরে দিয়ে আয়।
মারুফ বলল, দরকার নেই ও একাই যাবে।
আস্তে আস্তে সবাই যে যার ঘরে চলে গেল।
জেসিকার নিজের রুমে চলে গেল।
অন্যদিক আলো চিৎকার করে কাঁদছে।
তার আশা পূর্ণ হয়নি বলে।
তার কান্না দেখে মায়ার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু জেসিকা তো তার স্বামীর সান্নিধ্যে ছাড়তে চায় না তাহলে তা জেনেও কি করে তাকে এই বাড়ি থেকে বের দিবো।
মায়ার এসব চিন্তা ভাবনা করে শরীর আগের মতোন আরও অসুস্থ্য লাগছে।
আলোর কান্না দেখে দোলা ও চাঁদনী তাকে নানা রকম শান্তনা দিচ্ছে।
চাঁদনী বানু তো আলোকে বলে,যে করেই হোক তোর বিয়ে মারুফের সাথে দিবো তুই দেখে নিস।
শাশুড়ি কথা শুনে মায়া ভয় পাচ্ছেন আবার কোন নতুন অশান্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে বাতাসে।
জেসিকা নিজের রুমে এসে শুয়ে আছে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
জেসিকার মনে মনে দুইদিন আগের কথা ভাবছে একটা সত্য হানা দিয়ে ওঁর জীবনে সব কিছু বদলে ফেলেছে।
দুইদিন আগেও সে মারুফকে মুক্তি দিতে চেয়েছে কিন্তু ,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here