হৃদমোহিনী
পর্ব ৫১
মিশু মনি
.
৭২
দুদিন পর

অবশেষে আজ সেই কাংখিত বিয়ের দিন। বহুল ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে শেষ অব্দি বিয়ের প্রোগ্রামটা হচ্ছে। সেদিন রাতে তন্ময় আর কোনো ঝামেলা করেনি। সারারাত ফোনালাপ করেই কাটিয়ে দিয়েছিলো মেঘ মিশু।

আজ বরযাত্রী’রা সকালেই রওনা দিয়েছে। একটা গাড়িতে মেঘালয় আর ওর বন্ধুরা, আর বাকি গাড়িগুলোতে বাবা মা ও নিকটাত্মীয় স্বজনরা। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই মেঘালয়ের বন্ধুরা গান জুরে দিয়েছে। মাঝেমাঝে সবাই মিলে তুমুল হাসিঠাট্টাও চলছে। মেঘালয় অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে মিশুকে দেখার জন্য। আজকের রাতটা ওর জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ রাত হবে।

সারাদিন শেষে সন্ধ্যায় বরযাত্রীরা এসে পৌঁছলো বিয়েবাড়িতে। ‘বর এসেছে’ শব্দটা শোনামাত্র মিশু’র পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। এতগুলো দিন একসাথে কাটিয়ে আসার পরও আজকের দিনটাকে অনেক বেশি স্পেশাল মনেহচ্ছে।

বরকে বরণ করার সময় মিশুর ছোট বোন ও বান্ধবীদের সাথে মেঘালয়ের বন্ধুদের বেশ যুক্তি তর্ক হয়ে গেলো। গেটের টাকা নিয়ে, মিষ্টি খাওয়ানো, জুতা চুরি সবকিছু মিলে বিয়ের আনন্দটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে যেন। মিশু ভাবছিল, সেদিন রাতে তন্ময় কোনো ঝামেলা বাঁধালে আজকের দিনটা আর দেখা হতো না। সবার এই হাসিমুখ টাও আর থাকতো না।

মেঘালয় কিছুক্ষণ বসে থাকার পর অস্থির হয়ে উঠলো। এখনো মিশু’র মুখ দেখা হয়নি, ব্যাপারটা কি মেনে নেয়া যায়? কিন্তু বিয়েবাড়িতে এত এত লোকে গিজগিজ করছে যেন মেলা বসেছে। এতগুলো লোকের সামনে কিছু বলাও যাবে না, আর উঠে চলে যাওয়াও যাবে না। ও মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো একেবারে বাসর ঘরে ঢুকেই আজ বউয়ের মুখ দেখবে, তার আগে নয়।

অতঃপর মেঘালয়ের বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনের সামনে আরেকবার বিয়ে পড়ানো হলো। মিশুকে মেঘালয়ের পাশে বসিয়ে রাখা হলো টানা তিন ঘন্টা। সবাই মিলে একসাথে খাওয়াদাওয়া, ফটোশুট, সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় সহ সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। মিশু একবার মেঘালয়ের পাঞ্জাবি খামচে ধরে বললো, ‘আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?’
– ‘বাসর ঘরে ঢুকে ঘোমটা তুলে দেখবো বলে।’

কথাটা শোনার পর ইয়া বড় ঘোমটা টেনে রেখেছে মিশু। আজকে কি যে শান্তি লাগছে। মনেহচ্ছে পৃথিবীতে স্বর্গসুখ নেমে এসেছে। আজকের পর থেকে প্রত্যেকটা সেকেন্ড মেঘালয়কে সাথে সাথে রাখবে ও। ভালোবাসার অন্য এক রাজ্য সৃষ্টি করবে।

বন্ধুদের হাসিঠাট্টা, বিভিন্ন শাস্ত্র পালন সবকিছু শেষ করে মিশু’কে বাসর ঘরে রেখে যাওয়া হলো। মিশু’র রুমে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। রংপুর থেকে গাড়ি ছাড়লে পৌঁছাতে সকাল হবে বলে বরপক্ষ আজ এ বাড়িতেই থেকে যাবে। কিন্তু বাসর ঘর তো বাদ দেয়া যায় না। যদিও একবার বাসর ঘর সাজানো হয়েছিলো, তবুও ফুলশয্যার মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার থাকে। আজ রাতে এখানে বাসর হবে, আগামীকাল রাতে মেঘালয়ের বাসায় বাসর। পরপর তিনবার ফুলশয্যা করবে, এটা নিয়েও অনেক হাসাহাসি হলো বন্ধুদের মাঝে। সবশেষে মেঘালয়কে ছেড়ে দেয়া হলো অপেক্ষারত মিশু পাগলীটার কাছে।

মিশু বিশাল ঘোমটা টেনে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। শাড়ির ওজন ওর নিজের ওজনের চেয়েও বেশি মনেহচ্ছে। মেকাপ আর্টিস্টকে মেঘালয় সাথে করে এনেছে। মেয়েটার সাজানোর হাত বেশ পাকা। মিশুকে পাক্কা পুতুলের মত লাগছে। যেন পুতুল বউ সেজেছে।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো মেঘালয়। তারপর বিছানার দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই দীর্ঘশ্বাসের সাথেই দূর হয়ে গেলো সমস্ত বেদনা ও ক্লান্তি। মেঘালয় যত কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো, মিশু’র বুকটা তত জোরে ঢিপঢিপ করতে লাগলো। এ যেন অন্যরকম একটা পৃথিবী। অজানা পৃথিবী’র অদেখা স্বর্গ।

মেঘালয় বিছানার উপর ধপ করে বসে বললো, ‘খাট ভাংবে না তো?’

হো হো করে হেসে উঠলো মিশু। হাসির শব্দ শুনে মেঘালয় হেসে বললো, ‘এই তুমি হাসছো কেন? আমি অন্যকিছু বোঝাই নি। বলছিলাম যে, খাট টা দেখতে অনেক পুরনো কিনা?’
মিশু হেসে বললো, ‘ওসব পরে। আগে ঘোমটা তুলে দেখে আমাকে উদ্ধার করুন তো।’
– ‘সেকি! এত তাড়া কেন? মাত্র তো রাত শুরু।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে কি পা ছুঁয়ে সালাম করতে হবে? নাকি আমার জায়গা আপনার পায়ে নয়, আপনার বুকে?’

মেঘালয় শব্দ করে হাসলো। হাসি থামিয়ে বললো, ‘থাক, কিছু করতে হবে না। আমার না খুব হাসি পাচ্ছে মিশু।’
– ‘আর আমার বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করছে।’
– ‘আজ তোমার সমস্ত অস্থিরতা থামিয়ে দিবো।’

মিশু শিউরে উঠে চুপ হয়ে গেলো। ছেলেটার কণ্ঠে কি যেন মিশে আছে। কথা শুনে একেবারে কলিজায় টান লাগে। ও লজ্জায় মাথাটা নিচু করে থুতনিটা হাঁটুর সাথে লাগিয়ে ফেললো।
মেঘালয় মিশুর সামনে বসে মুখটা কাছে এগিয়ে আনলো। তারপর আলতো করে ঘোমটা টা তুলে মায়াবী মুখটার দিকে তাকালো। মিশু তখন সুখের সাগরে ভাসছিলো। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। এতবার দেখা হওয়ার পরও মনেহচ্ছে আজ প্রথম দেখা। মেঘালয় ওর থুতনিতে হাত রেখে মুখটা তুলে ধরে বললো, ‘তোমার উপর আল্লাহ’র রহমত বর্ষিত হোক।’

চমকে উঠে চোখ মেলল মিশু। এত সুন্দর করে কে কবে বলেছে ওকে! অবাক হয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু।

মেঘ এগিয়ে এসে মিশু’র কপালে আলতো চুমু একে দিলো। আবেশে চোখ বুজে এলো মিশু’র। চোখ মেলে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলো। বরবেশে মেঘালয়ের যৌবনদীপ্ত চেহারাটা একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আর মিশু? সে তো অনবদ্য এক সতেজ ফুটন্ত গোলাপ। প্রত্যেকটা পাপড়িতে সমানভাবে সৌন্দর্য ঈর্ষান্বিত ভাবে লেগে আছে। দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

মিশু চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই আছে। মেঘালয় মাথা থেকে পাগড়ীটা খুলে রেখে বললো, ‘তোমার স্পর্শ পেয়েই যেন আমার জীবনের প্রত্যেকটা সকাল আসে। আর সন্ধ্যা নামুক তোমার শুভ দৃষ্টিমাখা ভালোবাসায়।’

মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ওকে দু বাহুর বন্ধনে বাঁধতে বাঁধতে বললো, ‘আমি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে গো। সবচেয়ে সুখী মেয়ে।’
– ‘আমি ধন্য তোমার সুখের কারণ হতে পেরে। আজীবন যেন আমাদের ভালোবাসা অটুট থাকে। মিশু, তোমাকে কিছু কথা বলার আছে। পোষাক বদলে ফ্রেশ হয়ে আসবে চলো।’
– ‘এত তাড়াতাড়ি? আর কিছুক্ষণ বউ সেজে বসে থাকি?’

মেঘালয় মুচকি হেসে বললো, ‘আচ্ছা থাকো। আমার ইচ্ছে করছে এমন পুতুলটাকে কলিজার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলতে।’
– ‘আরো শক্ত করে আমাকে ধরে রাখো মেঘমনি, খুব শক্ত করে। কোনো ঝড় যেন আমাদের আলাদা করতে না পারে।’
– ‘আর আলাদা হবো না রে পাগলী। এই বুকের পশমে তোমার ঘর বানাচ্ছি, সেখানে ঢুকে বসে থাকো। কেউ খুঁজে পাবে না তোমাকে।’

অনেক্ষণ মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বসে রইলো মিশু। দুজনেই চোখ বন্ধ করে এক অনাস্বাদিত সুখের স্বর্গ অনুসন্ধান করে নিলো। প্রিয় মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে রাখাতেই অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য। আর প্রিয়জনের বুকে মাথা রাখলেই মনেহয়, আমি এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে আছি। এত প্রশান্তি এই বুকে!

মিশুর সমস্ত গয়না খুলে দিলো মেঘালয়। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘ফ্রেশ হয়ে আসো।’

মিশু শাওয়ার নিয়ে একটা লাল টকটকে সুতি শাড়ি পড়লো। ওর স্নিগ্ধ চেহারায় লাল ব্লাউজ আর আঁচলে মিশে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। পরিপূর্ণা নারী মনেহচ্ছে ওকে। ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে রুমে এসে বসলো। মেঘালয় একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘সাংঘাতিক রকমের রূপবতী লাগছে।’

মিশু কিছু বললো না। মেঘালয় দু মিনিটের মধ্যেই গোসল সেরে সতেজ হয়ে এলো। ওর রোমশ ভেজা বুকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই মেঘালয় বললো, ‘দু কাপ চা বানিয়ে আনি, বসো।’

মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এই মুহুর্তে চা দিয়ে হবে টা কি? এত রাতে ওনার আবার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে? কোনো বর বাসর রাতে চা বানাতে গিয়েছে? তাও আবার শ্বশুরবাড়িতে?
মেঘালয় গায়ে একটা পাঞ্জাবি পড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। বসার ঘরে বসে থাকা লোকজনরা সবাই হা করে দেখছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের মধ্যে মেঘালয়ের বাপ ও শ্বশুর দুজনেই আছেন। ওনারা গল্প করছিলেন। জামাই এত রাতে বউকে রেখে রান্নাঘরে কেন যায় সেটা ভেবে কয়েকজন মহিলা কৌতুহলী হয়ে তাকাচ্ছিলেন।

সায়ান ও পূর্ব ছুটে এসে রান্নাঘড়ে ঢুকলো। পূর্ব বললো, ‘দোস্ত তুমি কি হাসের ডিম সেদ্ধ করতে এসেছো?’
– ‘তোর মাথা। হারামিরা সুযোগ পেলে জব্দ করতে ছাড়ো না তাইনা?’
– ‘বন্ধু তো। কোনো হেল্প লাগবে বাবুহ?’
– ‘জ্বি না। আমরা সুখী দম্পতি।’

সায়ান ও পূর্ব মাথা ঝাঁকালো। এর উপরে আর জবাব হয় না। দুই বন্ধু হা হয়ে দেখলো মেঘালয় চা বানাচ্ছে। ওরা সেটা ভিডিও করতে করতে হাসছিলো। মেঘালয় ট্রেতে করে কয়েক কাপ চা নিয়ে সোজা বসার ঘরে এলো। এক কাপ ওর শ্বশুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আব্বু চা খান।’

মিশুর বাবা অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলেন। কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, ‘মিশু কি ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা?’
– ‘না আব্বু। দুজনে গল্প করবো, সাথে চা হলে মন্দ কি?’

সায়ান ও পূর্ব হেসে ফেললো। মেঘালয় আরেক কাপ চা ওর বাবার হাতে দিয়ে বললো, ‘নাও খাও।’
পূর্ব বললো, ‘আংকেল, চা খেয়ে আপনার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। মেঘু যেন ওর বাপের মতই একজন বাপ হতে পারে।’
হেসে উঠলো সবাই। মেঘালয় বললো, ‘মিশু’র মত একজন মা ই আমার সন্তানের জন্য যথেষ্ট।’

কথাটা বলে সোজা রুমে চলে গেলো। কিন্তু অনেক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না। দারুণ একটা জবাব দিয়েছে মেঘালয়। স্ত্রী’র সম্মান বাড়াতে ওর তুলনা হয় না।

৭৩
মেঘালয় রুমে এসে দেখলো মিশু বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। স্নিগ্ধতা ভর করেছে ওর পুরো শরীরে। মেয়েটা হুট করেই কেমন বড় হয়ে গেলো না? মুগ্ধতায় ডুবে গেলো মেঘালয়।

মিশু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললো, ‘থ্যাঙ্ক ইউ…’

মেঘালয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো, ‘মিশু, বাসর রাতটা আমার কাছে অনেক স্পেশাল। এটা শুধুমাত্র দুজন মানুষের শরীর মিলিত হবার রাত নয়, দুটো আত্মা মিশে যায় এ রাতে। দুটো দেহ মিলে একটা আত্মা হয়, দুটো শরীর একই আত্মায় বাস করে। এ রাতে বাকি জীবনের স্বপ্নগুলোর প্রস্তুতি শুরু হয়, দুজন মানুষের স্বপ্ন এক হয়ে একটা শক্তিশালী স্পৃহা তৈরি হয়। বিয়ে মানুষের লাইফ শেষ করে না, বরং বিয়েতে জীবনটা নতুনভাবে শুরু হয়। বিয়ের পূর্বের জীবনের প্রতি আমাদের সবসময় হাত থাকে না, সেটা বাবা মায়ের ইচ্ছেমত চলে। কিন্তু বিয়ের পরের লাইফে তুমি আমি যেভাবে চাইবো, ঠিক সেভাবেই চলবে।’

মিশু চায়ে চুমুক দেয়ার বদলে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা এত সুন্দর করে কথা বলে কেন!

মেঘালয়ের কথা শুনে চমকে উঠলো, ‘চা ভালো হয়নি?’

মিশু হেসে বললো, ‘অন্নেক ভালো হয়েছে। আপনার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিলো। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
– ‘সেজন্যই চা করে আনলাম। চায়ের সাথে আমার কথাগুলোকেও গিলে খেয়ে ফেলো।’

মিশু মুচকি হাসলো। মেঘালয় আবারো চা’য়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘ফুলশয্যা মানে কিছু অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ, কিছু এলোমেলো স্বপ্নকে একত্রিত করা। আমার কিছু স্বপ্ন আছে, সেসব ই বলবো তোমাকে। চা টা শেষ করো।’
মিশু চায়ের কাপ রেখে বললো, ‘শেষ। এখন খুব চাঙা লাগছে।’

মেঘালয় টেবিলের কাছে গিয়ে মিশুকে ডেকে বললো, ‘এখানে আসো।’

মিশু শাড়ি তুলে ধরে মেঘালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেঘালয় চায়ের কাপ দুটো ওর হাতে দিয়ে বললো, ‘এগুলো ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে আসো।’
– ‘এখনি?’
– ‘হ্যা। তোমার ক্লাস এখন থেকেই শুরু হোক। এর মোরাল হচ্ছে, সবসময় দুজন দুজনকে কাজে হেল্প করবো। আর দ্বিতীয়ত, কোনো কাজ পরে করার জন্য ফেলে রাখবা না। যখনকার কাজ, তখন করবা।’

মিশু ফ্যালফ্যাল করে তাকালো, কিছু বললো না। চায়ের কাপ রান্নাঘরে রেখে রুমে আসলো। দরজায় পা দেয়ামাত্রই ওর হাত ধরে হেচকা টানে ভেতরে টেনে নিলো মেঘালয়। দরজাটা একহাতে লাগাতে লাগাতে মিশুকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। দরজা আটকিয়ে দিয়ে মিশুর কোমরে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে ওকে উপরে তুলে ধরলো। মিশু ভয় ভয় চোখে তাকানো মাত্র মেঘালয় ওর চুলের পিছনে মুঠো করে ধরে মুখটা এগিয়ে আনলো। মিশু চোখ বন্ধ করামাত্র মেঘালয় দুহাতে মুখটা ধরে মিশু’র নিচের ঠোঁটে আলতো চুম্বনের ছোঁয়া লাগিয়ে দিলো। কেঁপে উঠে মেঘালয়ের পাঞ্জাবি খামচে ধরলো মিশু। মিশু’কে কোলে নিয়ে লাইট নিভিয়ে বিছানায় এগিয়ে এলো মেঘালয়। মিশুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে নিজে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। তারপর মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘এখানে চুপ করে থাকো। একটুও নড়াচড়া করবা না, আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনবা।’
– ‘হুম।’

মেঘালয় বললো, ‘আমার জন্য কঠিন কিছু কাজ করতে হবে তোমাকে। পারবা তো?’
মিশু আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘পারবো। বলুন।’

মেঘালয় বললো, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে পবিত্র আর শক্তিশালী বন্ধন হচ্ছে স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার শরীর ও আত্মার অংশ। এখন থেকে দুজনের প্রত্যেকটা কাজ একসাথে হবে। কাল থেকে একটা নতুন ভোর দেখবো আমরা। মিশু, আমার জীবনে আমি কখনো কোনো খারাপ কাজ করিনি। সবসময় অন্যের উপকার করে গেছি। সবসময় ইবাদত বন্দেগি করেছি, সর্বাবস্থায় আল্লাহ’র উপর বিশ্বাস রেখেছি। এ জীবনে অনেক আমল করেছি আমি, তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমার থেকে পিছিয়ে থাকতে পারো না। কাল থেকে প্রতিদিন ফজরের নামাজ আমরা একসাথে আদায় করবো। মসজিদে নামাজ পড়লে তুলনামূলক সাওয়াব বেশি। এ কারণে বেশিরভাগ সময় মসজিদেই আদায় করার চেষ্টা করেছি। যতক্ষণ বাসায় থাকবো, প্রতি ওয়াক্ত নামাজ তুমি আমার সাথে পড়বে। আর নামাজের পর তোমাকে একটা আমল করতে হবে, আল্লাহ তা’য়ালার পবিত্র গুণবাচক ৯৯ টি নামই মুখস্থ করবে পাশাপাশি প্রত্যেকটা নামের কি কি আমল আছে, কি কি ফজিলত আছে সব জানতে হবে তোমাকে। এরপর আমি যখন যে আমল ধরবো, আমার সাথে তুমিও সেটা করবে। প্রত্যেকটা দরুদ আমার সাথে আমল করতে হবে।’

মিশু হা হয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ পিটপিট করে বললো, ‘আচ্ছা।’

মেঘালয় বলল, ‘এখন থেকে কক্ষনো তোমার চোখে জল দেখতে চাইনা। তোমার চোখের প্রতি ফোঁটা জল সৃষ্টিকর্তার জন্য হোক। একমাত্র নামাজে বসে কাঁদবা। আমি তো বলেছি অন্যথায় তোমার চোখের জল মাটিতে পড়ার আগেই ওষ্ঠে তুলে নিবো।’

মিশু হাত বাড়িয়ে মেঘালয়ের মুখটা ধরে বললো, ‘তুমি মানুষ না ফেরেশতা!’

মেঘালয় হেসে বললো, ‘আমি তোমার বর রে পাগলী। শোনো, সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবা। সাজগোজ করবা প্রতিদিন রাতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে। তোমার সাজগোজ শুধুমাত্র আমার জন্য হোক। আর বাইরে যাওয়ার সময় সবসময় শালীন পোষাকে দেখতে চাই। পড়াশোনার ক্ষেত্রে গা ছেড়ে দিলে চলবে না। সারাদিন বসে বসে পড়াশোনা করবা, টিভি সিরিয়াল ভূলেও দেখা যেন না হয়। আমাদের বাড়িতে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করি, যেখানেই যাওনা কেন খাবারটা বাসায় খাওয়ার চেষ্টা করবা। তোমার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে আমার বাবা মাকে নিজের বাবা মায়ের মত আপন করে নেয়া। তুমি এখনো যথেষ্ট ইমম্যাচিউর, কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে যে তুমি মেঘালয়ের স্ত্রী। সবার সামনে যা মুখে আসে, বলা চলবে না। আব্বু আম্মুর সামনে ভদ্রতা বজায় রাখবা, আর সবসময় যেন মাথায় ওড়না থাকে। আম্মুর প্রত্যেকটা কাজে নিজ দায়িত্বে হেল্প করবা, বড়রা কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করবা, ‘আমি কি থাকবো নাকি চলে যাবো?’ আর অবশ্যই যে কারো রুমে ঢোকার সময় অনুমতি নিয়ে ঢুকবা।’

মিশু মাথা দুলিয়ে বললো, ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

মেঘালয় বললো, ‘তোমার কোনো ইচ্ছায় কেউ বাঁধা দেবে না। যা খুশি করতে পারো কিন্তু শালীনতার সাথে। সবার সাথে কথা বলার সময় শুধুমাত্র সেটাই বলবা, যেটা প্রয়োজনীয়। অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করবা না। নিজের উন্নতির পিছনে এত সময় ব্যয় করবা যেন অন্যের সমালোচনা করার সময় অবশিষ্ট না থাকে। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলবা, আর যত উপরে ওঠ না কেন কখনো অহংকার কোরো না। অন্যের সাফল্য দেখে খুশি হবা, অন্যকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিবা।’

একটু থেমে মেঘালয় বললো, ‘ আমার বিজনেসের ব্যাপারে মাথা ঘামাবা না। আমি যখন নিজে কিছু নিয়ে আলোচনা করবো, মন দিয়ে শুনে তোমার মতামত দিবা। ব্যবসায়ীক ঝামেলায় আমার মাথা গরম থাকলে তোমাকে দু একদিন সময় দিতে সমস্যা হবে। দেখা যাবে তোমার সাথে ভালোমত কথাও বলতে পারছি না। তখন কান্নাকাটি না করে আমার পাশে থাকবা, নিজেকে বোঝাবা আমি প্রচুর ঝামেলায় আছি। সবকিছু নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে করার চেষ্টা করবা। বোকামি করলে শুধরে নিবা, ভূল করলে স্বীকার করবা। আর ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনো অন্যায় করবা না।’

মিশু চুপ করে শুনছে। মেঘালয় নিচু হয়ে এসে ওর ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘আর আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসবা।’

মিশু শক্ত করে চেপে ধরলো মেঘালয়কে। মনেমনে বললো, ‘হুম ভালোবাসি, প্রচণ্ড ভালোবাসি। এমন একটা মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here