হৃদমোহিনী
পর্ব ৪৫
মিশু মনি
.
রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে মেঘালয়। মহারাণী মিশুর আজ্ঞা বলে কথা। মিশু আড়চোখে দেখছে আর মুচকি হাসছে। শ্বাশুরি মায়ের সাথে রুটি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ও।

মিশু ঝটপট রুটি বেলছে। ওর হাতের গতি দেখে মা বললেন, ‘বাব্বাহ! এত দ্রুতগতির রুটি কিভাবে বানাচ্ছো মিশমিশ? দেখো আবার যেন ছিঁড়ে না যায়।’
– ‘দেখুন আমি কত সুন্দর রুটি বানিয়েছি, একটাও কি ছিঁড়েছে?’
– ‘তা হয়নি। বলে রাখলাম আরকি। রুটির দোকান ছিলো নাকি তোমার?’

মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘আমাকে আপনার রুটিওয়ালী মনেহচ্ছে?’
– ‘তা তো হচ্ছে ই। এত দ্রুতগামী এক্সপ্রেসের মত আপনি রুটি বানাচ্ছেন।’
মিশু চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘ইহ সুন্দরমত কাজ করলেও দোষ! যদি না পারতাম তখন তো বলতেন মেয়েটা কোনো কামের ই না।’

মা হেসে বললেন, ‘আমি ওরকম বলতাম না মোটেও। ঠিকাছে বাবা তুই রুটি বানা।’
– ‘আমি বানাই আপনি ভাজুন।’

মিশুর কাজ আর কথার ধরণ দেখে দরজার আড়াল থেকে হাসলো মেঘালয়। একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিলো মিশু। রুটি বানাতে বানাতে বললো, ‘আমি প্রতিদিনই আম্মুর কাজে হেল্প করতাম বুঝলেন মা? আগে তো আম্মু সারাক্ষণ চেঁচাতো, কিচ্ছু করিস না, শ্বশুরবাড়ি গেলে ডালি ডালি কথা আসবে।’

মা শব্দ করে হেসে বললেন, ‘হুম। কাজ না পারলে তো ডালিতে কথাবার্তা ভর্তি করে পাঠাতাম।’
– ‘আম্মুর চাপে পড়ে অনেক কিছুই শেখা হয়ে গেছে। তাছাড়া রান্নাবান্নাটা আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে করি, ভালো লাগে।’
– ‘হুম। অনেক কাজ করেছো, এবার রুমে যাও। মেঘের বোধহয় কিছু লাগবে। অনেক্ষণ থেকে কিছু বলতে চাচ্ছে।’
– ‘না মা ওর কিছুই লাগবে না, আমি জানি।’
– ‘তুমি কিভাবে জানো? মেঘ বারবার আসছে কিছু বলার জন্য। হয়ত আমাকে দেখে বলতে পারছে না। একটু যাও না, দেখো ওর কি দরকার?’
– ‘আরে ওর কিচ্ছু দরকার নেই। আমি জানি তো। আমি ই তো ওনাকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে বলেছি।’

শ্বাশুরি মা হা হয়ে তাকালেন মিশু’র দিকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেললেন। মিশু নির্দ্বিধায় নিজের কাজ করে যেতে লাগলো। লজ্জার কোনো বালাই নেই ওর মাঝে। যেন কিছুই বলেনি সে।

মেঘালয় কথাটা শুনে লজ্জায় রুমে গিয়ে বসে আছে। মিশুর জ্ঞান বুদ্ধি কম নাকি লজ্জা কম বুঝতে পারেনা ও। রুটি গুলো শেষ হওয়ার পর শ্বাশুরি মা মিশুকে বললেন, আপাতত তোর কাজ শেষ। মিশু হাত ধুতে গিয়েও কি যেন ভেবে না ধুয়েই রুমের দিকে ছুটলো।

রুমে এসে দেখে মেঘালয় বিছানায় বসে ফোনে গেমস খেলছে। ও কাছে এসে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পাশে সরিয়ে রাখলো। তারপর মেঘালয়ের কোলের উপর বসে বললো, ‘আপনি আর গেলেন না কেন?’
– ‘কাজ শেষ, অমনি এসে কোলের উপর বসে গেলে?’
– ‘আমার এখন এটাই কাজ। গেলেন না কেন আর?’
– ‘তুমি যা লজ্জায় ফেলে দিয়েছো, আবার কি করে যাই? তুমি এত নির্লজ্জ কেন?’
মিশু ক্ষেপে বললো, ‘ছি এভাবে বললেন? আমি ছোট মানুষ না? আমাকে কিউট করে বলবেন।’
– ‘কিউট করে আবার কিভাবে বলে?’

মিশু মেঘালয়ের মুখটা ধরে দুই গালে ময়দা লাগাতে লাগাতে বললো, ‘মিশুউউ তুমি এত পিচ্চি কেন?’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘ঢং করো? এত ঢং কই শিখছো শুনি?’
– ‘বেশি আদর পেলে মেয়েরা ঢংগী হয়ে যায়। শাবনূরের মত।’
– ‘তাই তো দেখছি। এখন আবার আমার গালে ময়দা লাগিয়ে দিচ্ছো কেন? মাত্র শাওয়ার নিয়ে আসলাম।’

মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘আপনি এত আনরোমান্টিক হলেন কবে? এইগুলো ময়দার মত দেখতে হলে কি হবে? এইগুলা তো ময়দা না। কাজ করতে করতে আমি যতগুলো মিস করেছি, যতগুলো ভালোবাসা জমিয়েছি এখন সেগুলো আপনার গালে লাগিয়ে দিলাম বুঝেছেন?’
– ‘ওহ আচ্ছা।’
– ‘ধেৎ, কেমন যেন করছেন। আমার তো মনেহচ্ছে আর কয়েকদিন গেলে আমাকে আর আপনার ভালোই লাগবে না।’

মেঘালয় মিশুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘পাগলী রে। মজা করছিলাম তো। তোকে ভালো না লেগে উপায় আছে? আমার কাছে তো প্রতিটাদিন ই তোমাকে নতুন লাগে। সবসময় নতুনভাবে আবিষ্কার করি তোমায়। এই ভালোবাসায় আমার কোনোদিনো একঘেয়েমিতা আসবে না রে।’
– ‘তাই যেন হয়।’

মিশু মেঘালয়ের কোলে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে রইলো। মেঘালয় চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে ওকে। মেয়েটা ধীরেধীরে ওর সবটা দখল করে নিতে আরম্ভ করেছে। সদ্য প্রেমে পড়ার অনুভূতিগুলো বুঝি এরকমই হয়। মিশুর শরীর থেকে ঘামের একটা উন্মাদনাময় গন্ধ আসছে, যা চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে মেঘালয়কে। ও কাঁধে মুখ ডুবিয়ে সেই ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

৬৭
ওয়েডিং প্লানারের সাথে ঘুরে ঘুরে সাজসজ্জার কাজগুলো দেখছে মিশু। গায়ে হলুদের মঞ্চটা কেমন হবে সেটা নিজেই বলে দিলো। রাতে বিয়ের শপিংয়ে বের হবে সবাই মিলে। আগামীকাল মিশু চলে যাবে নিজের বাসায়। যখন বিয়েবাড়ির ডেকোরেশন নিয়ে কোমর বেঁধে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মিশু, এমন সময় একটা ফোন এলো।

কথা বলা শেষ করে কিছুক্ষণের জন্য চোখের পলকও পড়ছিলো না। সবকিছু যেন হঠাৎ করেই থেমে গেলো। এমন একটা খবরে আজকে আনন্দের বদলে কষ্ট হচ্ছে। কি হবে এখন?

মিশু যে স্কলারশিপের পরীক্ষাটা দিয়েছিলো সেটা পেয়ে গেছে। এখন অভিভাবক সহ হাইকমিশনার অফিসে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হয়েছে। এমন একটা স্কলারশিপ পাওয়াটা নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। কিন্তু মিশুর পক্ষে এখন দেশের বাইরে যাওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব না। প্রথমত শ্বশুরবাড়ির লোকরা যেতেই দেবে না, আর দ্বিতীয়ত মেঘালয়ের থেকে দূরে গিয়ে দুজনের কেউই থাকতে পারবে না। চুপচাপ হয়ে মেঝেতে বসে রইলো মিশু। শ্বাশুরি মা এসে জিজ্ঞেস করলেন কোনো সমস্যা কিনা? মিশু কোনো উত্তর না দিয়ে ঠায় বসে রইলো।

মেঘালয় অফিস থেকে ফিরলো বিকেলবেলা। মিশুকে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কেউ কিছু বলেছে কিনা?
মিশু একবার মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। মেঘ কাছে এসে ওর হাতটা ধরে বললো, ‘কি হয়েছে মিশু? এভাবে মন খারাপ করে বসে আছো কেন?’
– ‘আমার স্কলারশিপটা এসে গেছে।’

মেঘালয় চমকে উঠে মুচকি হেসে বললো, ‘সেটা তো অনেক ভালো খবর। এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবা?’
– ‘আমি ওটা ক্যানসেল করে দেবো।’
– ‘সেকি! কেন?’
– ‘আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হবে। আর এখন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না।’

মেঘালয় কিছুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে মৃদু স্বরে বললো, ‘এত মন খারাপ কোরো না। যেহেতু সেটা এখন সম্ভব না, কাজেই মন খারাপ করে লাভ নেই।’

মিশু করুণ সুরে বললো, ‘এটা আমার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। বিয়েই একটা মেয়ের জীবনে সবকিছু নয়। আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতাম না। একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতাম, সামাজিক কর্মকাণ্ডলোতে নিজেকে জড়াতাম। জীবন নিয়ে তো সবারই ভাবনা থাকে তাইনা বলুন?’

মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘হুম। তাহলে এখন কি করতে চাচ্ছো? বাইরে যাবে?’
– ‘আমাকে কোন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন দেয় সেটা আগে দেখি। ওদের ভার্সিটি গুলোতে গবেষণার সুযোগ অনেক বেশি। দেশের বাইরে গেলে বিশ্বের যেকোনো দেশে ঘোরাটা আমার জন্য সহজ হতো। তাছাড়া অন্য দেশের, অন্য সংস্কৃতির মানুষ গুলোর সম্পর্কেও জানার সুযোগ পেতাম।’
– ‘আমার সাথে কি বিশ্বের সব দেশ ঘুরতে পারবে না? সবখানে আমি ই তোমাকে নিয়ে যাবো। আর কোনো দেশ সম্পর্কে জানার জন্য সেখানকার মানুষদের সম্পর্কে কিছুদিন মিশলেই, একটু রিসার্চ করলেই জানা যায়। এর জন্য কয়েক বছর থাকতে হবেনা।’

মিশু আর কিছু বললো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। মেঘালয় ব্যাপারটা খেয়াল করে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘তুমি তো ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়তে চেয়েছিলে তাই না? একটা ভালো ভার্সিটিতে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ো। আমরা একসাথে একটা সুন্দর সংসার গড়তে পারি। আর তোমার তো পড়াশোনা শেষ করে চাকরী করার প্রয়োজন নেই, আমি তো বলেছি বিজনেসের ব্যাপারে যা করতে হয় আমি হেল্প করবো। তাছাড়া ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার পর তুমি চাইলে নিজেরই একটা কোম্পানি খুলে ফেলতে পারো। তুমি ইউনিক ডিজাইন করতে পারলে আমাদের গার্মেন্টস এর প্রোডাক্ট, দেশে বিদেশে কতটা চাহিদার হবে ভাবতে পারো? সবদিক ভেবে আমি তোমাকে এটাই করতে বলবো।’

মিশু মাথাটা নিচু করে বললো, ‘আপনার পরিবারের ক্রেডিট নিয়ে এগুলো করতে হবে আমায়। কিন্তু আমি চাইছিলাম নিজেই কিছু করে দেখাতে।’
– ‘আজব কথা বললে! আমার পরিবারের ক্রেডিটের কথা বলছো কেন? আমি তোমার আয়না, তোমার একটা সত্তা। আর আব্বু আম্মু তোমার বাবা মায়েরই মত। এতকিছুর পরও তোমার নিজের চেষ্টায় কেন পড়াশোনা করতে হবে? স্কলারশিপ নিলে তো সরকারের টাকায় পড়তে হবে তাইনা?’
– ‘সেটা আমার মেধাকে মূল্যায়ন করে। আজকে যদি বিয়েটা না হতো, আমি ঠিকই স্কলারশিপ নিয়েই পড়তে যেতাম। একটা বিয়েই জীবনের সবকিছু ওলট পালট করে দিলো।’

মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।

তারপর টাই খুলতে খুলতে বললো, ‘ওকে। তাহলে তোমার যা ভালোলাগে তুমি তাই করো। আমি তোমাকে শুধুমাত্র ভালোটাই সাজেস্ট করবো। আমি আছি, ফেরেশতার মত দুজন বাবা মা আছে তবুও যদি দেশের বাইরে গিয়ে একা থাকাটা তোমার জন্য বেশি আনন্দের মনেহয় তাহলে যাও। আমার ফ্যামিলি তোমার সাথে রুড বিহ্যাভ করলে অন্য কথা ছিলো। তারা তোমাকে মৌনির মত ই আপন করে নিয়েছে। আমি তোমাকে আর কিছুই বলবো না। সিদ্ধান্ত তোমার, যা ডিসিশন নেবে আমরা তাই মেনে নেবো। তবুও কোনোদিনো যেন বলতে না পারো বিয়ের কারণে তোমার লাইফটা শেষ হয়ে গেছে।’

মিশুর চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। নিজের মেধাশক্তি দিয়ে অর্জিত একটা স্কলারশিপ পেলে ইচ্ছে তো করবেই সেটা গ্রহণ করতে। একান্তই নিজের মত বাঁচতে চাওয়াটা প্রত্যেক মেয়েরই ইচ্ছে। আর এটাও সত্যি যে মেঘালয় আর ওর পরিবারকে ছেড়ে যাওয়াটাও নিতান্তই বোকামি হয়ে যাবে।

মেঘালয় বললো, ‘এখনি বললে বিয়েটা তোমার সবকিছু ওলট পালট করে দিয়েছে। বিয়ে না হলে তুমি অনেক কিছুই করতে পারতে। সারাজীবন এটাই বলবে হয়ত। মেয়েদের একটা স্বভাবগত অভ্যাস হচ্ছে, কোনোকিছু মনের মত না হলেই ওরা বলবে, বিয়ের জন্য এটা হলো। বিয়েটা করে আমার লাইফটা শেষ হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বিয়েটা একটা মানুষের জীবন শেষ করেনা। বরং একটা নতুন জীবন শুরু করে। আগের জীবনে আমাদের কোনো হাত ছিলোনা, বাবা মায়ের ইচ্ছামত চলতে হয়েছে। কিন্তু বিয়ের পরের জীবনটা আমরা দুজন যেভাবে চাইবো, ঠিক সেভাবেই চলবে। আমরা চাইলেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী কাপল হতে পারি।’

মিশুর চোখে পানি টলমল করছে। দু এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। মেঘালয় উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। দু হাতে ওর কোমরটা ধরে ওকে উঁচুতে তুলে ধরে জিভ দিয়ে চোখের জল শুষে নিয়ে বললো, ‘আজীবন আমার সাথেই থাকিস। তোর চোখের জল কখনো মাটিতে পড়তে দিবো না, পড়ার আগেই সে জল ওষ্ঠে তুলে নেবো।’

মিশু নিশ্চুপ। এতকিছুর পরও কেন যেন মনেহচ্ছে মেঘালয়ের থেকে দূরে সরে যেতে হবে ওকে। বিয়েতে বারবার বাঁধা আসছে, হয়তো প্রকৃতি একসাথে থাকতে দেবে না। কিন্তু মেঘালয়ের কথাটাই কানে বাজতে লাগলো, ‘আজীবন আমার সাথেই থাকিস। তোর চোখের জল মাটিতে পড়ার আগেই ওষ্ঠে তুলে নিবো।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here