হৃদমোহিনী
পর্ব ৩৯
মিশু মনি
.
মিশু উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত মেঘালয়ের রুমে চলে এলো। বাইরে এসে ডাকতেই দরজা খুলে দিলো মেঘালয়। মেঘালয়ের সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনেরই বুকটা ধুকধুক করে উঠলো। একই কষ্ট দুজনেই পাচ্ছে যে। মিশু দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘আমি থাকতে এসেছিলাম কিন্তু আরেকবার আমাকে প্রমাণ করে দেয়া হলো যে আমি আপনার যোগ্য নই।’

মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মিশু চোখ মুছে জোরগলায় বললো, ‘আমরা সত্যিই আলাদা হয়ে যাবো। তবে আমি তন্ময়ের কাছে যাবো না। কারণ আমি কখনো ওকে ভালোই বাসিনি। আপনি আমাকে ভূল বুঝলেন।’

মেঘালয় নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। ঠাণ্ডা হওয়ার চেষ্টা করে বললো, ‘প্লিজ বসো। শান্ত হও, আমি আসলে রাগের মাথায় তন্ময়ের হাতে তোমাকে রেখে এসেছি। আশাকরি বুঝতে পেরেছো সেটা?’

মিশু বললো, ‘হুম। কিন্তু একটা কঠিন সত্য কি জানেন? মানুষ কখনো ঠাণ্ডা মাথায় বউকে তালাক দেয়না। রাগের মাথাতেই তালাক দেয়। আপনি যদি আজকে রাগের মাথায় ডিভোর্স দিয়ে দিতেন? আপনি কিভাবে বললেন অধিকার ছেড়ে দিচ্ছেন? এতটুকু কাঁপলো না গলাটা?’

মেঘালয় রেগে বললো, ‘অনেক বলেছো। এবার আমাকে বলতে দাও। সবসময় চুপ করে তোমার কথাগুলোই শুনে এসেছি, তোমার পাগলামি সহ্য করে এসেছি। আমার ভেতরে কি হয়ে যায় তুমি বোঝোনা? কতটা মাথা খারাপ হলে একটা মানুষ এই রাতেই পাগলের মত ছুটে ঢাকা থেকে রংপুর চলে যায়? কতটা অনুভব করলে টায়ার্ড শরীরেও তোমাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খায়? আমি তোমার জন্য আমার আমিটাকেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি তুমি বোঝোনা? ভালোবাসা এমনই একটা জিনিস যেটা মানুষকে শিশুর মত বানিয়ে দেয়। যে ভালোবাসা তোমাকে শিশুসুলভ বানাতে পারবে না সেটা ভালোবাসাই নয়। ভালোবাসার ধর্মই হচ্ছে ম্যাচিউর মানুষকেও শিশুসুলভ বানিয়ে দেয়া। এখন ভাবো কতটা রাগ উঠলে তোমাকে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে আসতে পারি?’

মিশু চুপ করে শুনলো। কষ্টের মুহুর্তেও ভালোবাসার কথাগুলো শুনে ভালো লাগছে। কিন্তু মিশু তো তন্ময়কে কখনো ভালোবাসেনি। সেটা কিভাবে বুঝাবে মেঘালয়কে?

মিশু একটু সময় নিয়ে বললো, ‘আমি আপনাকে ভালবাসি।’

মেঘালয় চমকে উঠে তাকালো মিশুর দিকে। এই প্রথম ভালোবাসি কথাটা শুনলো মিশুর মুখ থেকে। মিশু কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, ‘সবাই আমার বাহিরটা দেখে। আমি ইনোসেন্ট, আমি অনেক লেইম কাজ করি, আমি অনেক বোকা, অনেক পাগলাটে ধরণের, সবাই শুধু এই ব্যাপারগুলো ই দেখে। আমার ভেতরে একটা মিশু আছে, যে মিশুটা আপনার প্রেমে একটু একটু করে পড়েছে, ভালোবেসেছে গভীরভাবে। সেই মিশুটাকে কখনো ফিল করেছিলেন আপনি?’

মেঘালয় চোখ বড়বড় তাকালো। মিশু হঠাৎ ই খুব বড় হয়ে গেছে মনেহচ্ছে। কণ্ঠে অসম্ভব দৃঢ়তা।

মিশু বললো, ‘জানেন আমি কখনো তন্ময়কে দেখিনি, কখনো ওর চোখ দেখিনি, কখনো ওর স্পর্শ পাইনি। কক্ষনো শুনিনি ওর হৃদস্পন্দনের শব্দ। মাত্র কয়টা মাস ফোনে কথা বলার পর আমি ওকে যতটা অনুভব করেছি, প্রথম রাতে আপনার চোখের দিকে তাকিয়েই আমি তারচেয়ে বেশি অনুভব করেছি আপনাকে। প্রথম রাতেই সিএনজিতে, ট্রেনে, ট্রাকে আপনার বুকে মাথা রেখে যে শান্তিটা পেয়েছিলাম, কয়েক মাস ফোনে তন্ময়ের মুখে ভালোবাসি শুনেও এই শান্তিটা পাইনি। প্রথম রাতেই আপনার বুকে জায়গা পেয়ে মনেহচ্ছিলো এখানেই আমি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। আপনার বুকে যখন আমাকে আগলে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলেন, আমার মনেহচ্ছিলো আমি আমার বাবার কোলে আছি। একটা মেয়ে তার বাবার বুকেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সেই বিশ্বাস আমি আপনাকে করেছি।’

মেঘালয় নিশ্চুপ। অবাক হয়ে শুনছে মিশুর কথাগুলো।

মিশু বললো, ‘আমি আসলে কখনো এত কাছ থেকে কাউকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখিনি। তন্ময়ের কষ্ট দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিলো সেটা শুধুমাত্র এই মৃত্যু যন্ত্রণাটাকে দেখে। ভালোবাসার জন্য নয়। একটা মানুষ মৃত্যুর আগে কিভাবে ছটফট করে সেটাই বারবার ফিল করছিলাম। আপনি খেয়াল করেননি আমি বারবার বলছিলাম, তন্ময় কি মরে যাবে? আপনি আমাকে বোঝেন না? জানেন না আমি কাকে ভালোবাসি? আমার সামনে একটা মানুষ দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার মত অবস্থা হচ্ছে। এখানে অন্য কোনো অনুভূতি কাজ করেনি আমার। আমার বারবার মনেহচ্ছিলো একটু পাশে থাকলে যদি মানুষটা ভালো হয়ে যায়। ওর তো কেউ নেই। বাবা মাও মরে গেছে। অনেক কাছের একটা মানুষ ছিলো আমার। আমার কষ্ট হচ্ছিলো ওর কষ্ট দেখে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে আমি আপনাকেই ভালোবাসি, আপনাকেই চাই সেটা কেন বোঝেন না আপনি?’

মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে শুনছে। কোনো মেয়ে নিজের ভালোবাসার কথা এভাবে বলতে পারে ও জানতো না। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো আর অনুভব করে যেতে লাগলো মিশুকে।

মিশু আবারো বলতে শুরু করলো, ‘আমার ভেতরে একটু একটু করে কাঁপন ধরিয়েছেন আপনি। আত্মার জন্য আত্মার ছটফটানি যেমন হয়, ঠিক তেমনটাই। আপনার স্পর্শ আমাকে পাগল করে ঠিকই, কিন্তু এসবের বাইরেও আমার বুকটা যে আপনার জন্যই অস্থির হয়ে ওঠে, আপনার জন্যই আমার মনের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় জানেন না সেটা? যদি তন্ময়কেই ভালোবাসতাম, দুদিন আগে যখন তন্ময় আমার বাসায় গিয়েছিলো তখনই ওকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু আমি বটি হাতে ওর সামনে গিয়েছিলাম। আব্বু তো বলেছিলো দ্রুত আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু আমি বাসায় ফোন দিয়ে বলেছিলাম কিছুদিন সময় দাও। সবার সাথে সময় কাটানোর জন্য এটা বলিনি। আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে পারবো না বলেই বলেছিলাম। ওই কয়েকটা দিন আপনি এক সেকেন্ডের জন্য বাইরে গেলেও আমার ছটফট লাগতো। এক পলক দেখার জন্য পাগল পাগল লাগত। এত কাছে পেয়েও আমার অস্থির লাগতো, কারণ ভালোবাসারা এমনই।’

মেঘালয় এগিয়ে এসে মিশুকে ধরলো। বাহু ধরে কাছে টেনে নিলো। মুখটা দুহাতে ধরে বললো, ‘এত ভালোবাসিস অথচ কখনো বুঝতে দিস নি কেন পাগলি?’

মিশু চোখের জল ছেড়ে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমি বুঝতে দিতে চাইনি। আগে বুঝতে চেয়েছিলাম আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন। ঠিক এ কারণেই আমি দশদিন যোগাযোগ বন্ধ রাখতে বলেছিলাম। তাতে করে আপনার ভালোবাসাটাও বুঝতে পারতাম। আমি জানতাম আপনি একদিন পরেই ফোন দিতেন।’

মেঘালয় মিশুর নাকের সাথে নিজের নাকটা ঘষে দিয়ে বললো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি রে, অনেক ভালোবাসি। আমি এর ভাগ কাউকেই দিতে পারবো না। তোমার শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ ও আমার।’
– ‘তাহলে কেন তখন ওই কাজটা করলেন?’
– ‘মাফ করে দাওনা আমায়। রাগটা সামলাতে পারিনি। আমি নিজে না খেয়ে তোমার জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে রেখে আমার গলা দিয়ে খাবার নামতো না। তুমি ওভাবে বলায় রাগ উঠে গিয়েছিলো।’
– ‘এটাকেই কি ভালোবাসা বলে মেঘ?’

মেঘালয় বুকে জাপটে ধরলো মিশুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদতে লাগলো। মিশুও কাঁদছে। আজ সব ভূল বুঝাবুঝির অবসান হয়ে গেলো। সবশেষে একটাই ইউনিভার্সাল ট্রুথ, মিশু ও মেঘালয় একজন আরেকজনের জন্যই। কেউই কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে। তবুও বোধহয় শান্তি হবেনা।

মিশু বললো, ‘জানেন তিস্তা নদীতে ভাসতে ভাসতে আমার কতটা সুখসুখ লাগছিলো। আমি প্রকৃতির মাঝে ছিলাম না, প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারিনি। শুধু আপনাকেই অনুভব করেছি। আমি জানতাম আমাদের জুটি হওয়া কখনো সম্ভব না। নিজেকে বোঝাতাম প্রেমে পড়িস না। তবুও আমি প্রেমে পড়ে গেছি। ভালোবাসার শুরুটা প্রথমদিন থেকেই শুরু। ট্রাকে যখন আপনার বুকে মাথা রেখেছিলাম, ইচ্ছে করছিলো আজীবন এভাবেই থাকি। এই ভালোবাসার জন্যই হয়ত প্রকৃতি এক্সিডেন্টলি হলেও আমাদেরকে এক করে দিয়েছে।’

মেঘালয় মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে বললো, ‘এই ব্যাপার হুম? আমিতো ভেবেছিলাম আমি একাই ভালোবাসি, তুমি শুধু মজাটা উপভোগ করো।’
– ‘ধুর। আপনাকে ইমপ্রেসড করার জন্য সবসময় সাজগোজ করে থাকতাম খেয়াল করেননি হয়ত।’

মেঘালয় কান্নাভেজা মুখেও হাসি ফুটিয়ে বললো, ‘পাগলী রে, এত ভালোবাসিস?’
– ‘আপনার শরীরেরও প্রতিটা লোমকূপ আমার। যেদিন হোটেলে ওই মেয়েটাকে প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, আমি জাস্ট সহ্য করতে পারিনি। মিথ্যে হলেও আপনি কাউকে এরকমভাবে বলতে পারবেন না। আপনি শুধু আমার, শুধু মিশুর।’

মেঘালয় মিশুকে বুকে চেপে ধরে একেবারে বুকের সাথে পিষে ফেলতে চাইছে। তবুও বুঝি শান্তি লাগবে না। বললো, ‘মিশু রে, তোকে কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে পারতাম যদি। কতটা কাছে পেলে আর কষ্ট হবেনা বলতো?’

মিশু কোনো উত্তর দিলোনা। দুই ভালোবাসার পাগল এতদিন পরে যেন সত্যিকার সুখী মানুষ হতে পেরেছে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে। মিশু মেঘালয়কে ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘শেষবারের মতন একবার কপালে চুমু দেবেন?’

মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, ‘মানে!’
– ‘আমি মাকে বলেছি আপনার ছেলের জীবন থেকে সরে যাবো। আমিতো এই পরিবারের যোগ্যই নই।’
– ‘মিশু, তুমি জানো তুমি বলছো?’
– ‘জানি। আমার আর এই অপমান ভালো লাগেনা। আমিতো কোনো অপরাধ করিনি। তবুও বারবার একই কথা, যোগ্য নও, আমাদের একটা স্ট্যাটাস আছে। যে কথা তন্ময় বলেছে,সেই কথা আপনার মা ও বলেছে। এমনকি আপনিও একদিন বলবেন।’

মেঘালয় একটু চুপ থেকে বললো, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমাকে ছেড়ে যেতে পারোনা তুমি।’

মিশু উত্তরে বললো, ‘হ্যা বাসি। সেটা তো আজকে জানলেন। আমি না জানালে সেটাও জানতেন না। আপনি আমাকে বুঝতেই পারেন না।’
– ‘মিশু, সরি। প্লিজ এমন কোরো না।’

মিশু বলল, ‘করতাম না। যদি মা কথাগুলো না বলতেন। আমি নাকি লেইম কাজ করি। সেটা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যই বলেছেন। আমি আসলেই অনেক বেশি ইমম্যাচিউর। আপনার পাশে আমাকে মানায় না। আপনার সাথে, আপনার পরিবারের সাথে দাঁড়ানোর মত যোগ্যতা আমার নেই। আপনিও বলেছেন আমাকে আপনার সমান সমান হতে হবে। আপনার সাথে চলতে হলে আপনার মতই নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। আমি যদি না পারি, একদিন আপনিও বিরক্ত হয়ে যাবেন।’

মেঘালয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘হুম। কথাগুলো সত্যি বলেছো। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি বলছি, তুমি যেমন আছো সেরকমই আমি খুশি। তুমি আমার থেকো, তাতেই হবে।’
– ‘আজ ভালোবাসা আর দূরে যাওয়ার জ্বালাটা বুঝতে পেরেছেন বলেই এটা বলছেন। আমি আপনার কিংবা এই পরিবারের কারো বিরক্তির কারণ হতে চাইনা। আপনি তো জানলেন আমি আপনার। যদি ভাগ্যে থাকে, কোনোদিনো আবার এক হবো।’
– ‘মিশু, পাগলামি কোরোনা।’

মিশু একটু পিছিয়ে এসে দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘যতদিন না আমার নিজেকে এই পরিবারের যোগ্য মনে হবে, যতদিন না আপনার বাবা মা নিজে আমাকে ডেকে এই বাড়িতে আনবে ততদিন আমি আসবো না। বিয়ের প্রোগ্রামটা আর হচ্ছেনা। আপনি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন কিনা তার প্রমাণ এবার হবে। যদি ভালোবাসেন, আপনার ফ্যামিলির কাছে আমার জন্য সাপোর্ট করবেন। আর আমি যদি আপনাকে ভালোবাসি, তাহলে নিজেকে প্রমাণ করে দেখাবো যাতে আপনার পরিবার সম্মানের সাথে আমাকে নিয়ে আসে। আত্মসম্মান আমারও আছে।’

মেঘালয় মিশুর হাতদুটো ধরে বললো, ‘আমি আব্বু আম্মুকে ম্যানেজ করে নিবো। ওদের বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। বিয়ের প্রোগ্রামটা হোক, প্লিজ। আমি থাকতে পারবো না তোমাকে ছাড়া।’
– ‘সেটা আপনার সমস্যা,আমার না। বারবার অপমানিত হওয়ার চেয়ে নিজে একা একা সম্মান নিয়ে বাঁচাও ভালো। আমাকে এখন আমার মত থাকতে দিন। আমি কি করতে পারি নিজের যোগ্যতায় দেখিয়ে দিতে চাই। আমি আপনার সাহায্যে কিছু করতে চাইনা।’

মেঘালয় ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘তোমার আত্মসম্মানকে আমি স্যালুট জানাই। কিন্তু তুমি আমার থেকে আলাদা হয়ে যেওনা প্লিজ?’
– ‘আপনাদের সমান হতে হবেনা? আমার জন্য আমার ফ্যামিলিকে শুনতে হয়, তাদের কোনো স্ট্যাটাস নেই। আমার কলিজায় লাগে কথাটা। আপনার পরিচয়ে নয়, আমাকে আমার পরিচয়ে পরিচিত হতে দিন।’
– ‘এরজন্য আমাকে কেন শাস্তি দেবে?’
– ‘কারণ আপনি ই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। শেষবারের মত একটা চুমু দিতে বলেছিলাম।’

মেঘালয় থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। মিশুর মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু যা বলছে সবই সত্যি বলছে। যোগ্যতা প্রমাণের প্রয়োজন অবশ্যই আছে কিন্তু অনিশ্চিত সময়ের জন্য দুজনে আলাদা হয়ে যাবে এটা ভাবা যায়না। মিশু নিজেই এগিয়ে এসে মেঘালয়ের শার্টের কলার টেনে ধরে কাছে টেনে নিলো। মেঘালয় হা হয়ে তাকিয়ে আছে। মিশু শক্ত করে একবার জাপটে ধরে মেঘের চুলগুলো দুহাতে খামচে ধরে পা দুটো উঁচু করলো। মেঘালয়ের কোনো সাড়া না পেয়ে ছেড়ে দিলো মিশু। বললো, ‘থাক। এটা নাহয় পরেরবার দেখা হলে দিবেন। আমি চলে যাচ্ছি।’

মেঘালয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলো মিশু।

৫৬
বাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলো কি করবে এখন? কোথায় যাওয়া যায়?

এমন সময় মেঘালয় এসে পাশে দাঁড়ালো। মিশু জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এলেন কেন? আমার সাথে যাবেন নাকি?’
– ‘নিয়ে গেলে যাবো।’
– ‘আমি আপনাকে নিয়ে যাবোনা।’
– ‘তবুও যাবো।’

মিশু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জানতে চাইলো, কেন?

মেঘালয় বললো, ‘আমি তন্ময়ের মত দায়িত্বহীন নই যে রাস্তায় ফেলে যাবো। তুমি চলে যেতে চাইছো যাবে। কিন্তু একা একা এখন কোথায় যাবে খেয়াল রাখাটা আমার দায়িত্ব। কোথায় যেতে চাও বলো, আমি নিজে গিয়ে রেখে আসবো।’

মিশু ফিক করে হেসে বললো, ‘এই দায়িত্ববোধ জিনিস টার জন্যই আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।’
– ‘আমার আর কিছু ভালো লাগেনা?’
– ‘এখন ইয়ার্কির সময় না। আমি ছোট চাচার বাসায় যাবো।’
– ‘সেখানে আবার মাসুদের মত ভাই নেই তো? তোমার চাচাতো ভাইয়েরা আবার ঘরে শত্রু বিভীষণের মত।’
– ‘না, আমার বোন খুব ভালো মেয়ে।’
– ‘গাড়িতে ওঠো, রেখে আসছি।’

মিশু কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। মেঘালয় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো, ‘যা করছো ভেবে করছো তো?’
– ‘হ্যা। আমি যা করছি একদম সঠিক করছি সেটা আপনিও বুঝতে পারছেন।’
– ‘আবারো ভাবো।’

মিশু তেজের সাথে বললো, ‘মা আমাকে বলেছে এক পা ফেলার আগে আমাকে ভাবতে হবে আমি কার ছেলের বউ। একটা মেয়ে আজীবন এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই বাঁচে। বিয়ের আগে সবাই জানতে চায়, তুমি কার মেয়ে? আর বিয়ের পর তুমি কার বউ কিংবা কার ছেলের বউ? একটা মেয়ের নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই। মাকে সবাই চেনে একজন ভালো ডক্টর হিসেবে, তারপর উনি অন্যের স্ত্রী। আমিও নিজের একটা পরিচয় চাই, তারপর আপনাদের।’

মেঘালয় শান্ত হয়ে ভাবলো কথাটা। বেশ বলেছে মিশু। কথাটা অনেক মনে ধরেছে ওর। গাড়ি থামিয়ে মিশুর দিকে তাকালো মেঘ। মিশু বললো, ‘কি? গাড়ি থামালেন যে?’
– ‘একটা কথা বলবো মিশু?’
– ‘হুম বলুন।’
– ‘তোমার এই কথাটাকে আমি স্যালুট জানাই। তবে একটা আদেশ থাকবে তোমার প্রতি। দূরেই যখন থাকবে তাহলে আমার এই কথাটাও তোমার সত্যতে রূপান্তর করতে হবে। পারবে?’
– ‘কি রকম?

মেঘালয় মিশুর চোখে চোখ রেখে বললো, ‘তোমার নিজেকে এমন একটা জায়গায় দাড় করাতে হবে যেন সবাই তোমাকে তোমার পরিচয়ে চেনে। একদিন তুমি লাইভ প্রোগ্রামে যাবে, টকশো তে যাবে। তখন আমি কিংবা আমার পরিবার যাবো তোমার পরিচয়ের সুবাদে। সবাই যেন আমাদের দেখলে বলে এটা মিশুর হাজব্যান্ড কিংবা মিশুর শ্বাশুরি। তোমার বাবা যেন গর্বের সাথে বলতে পারে আমি মিশুর বাবা। তখন বাবা তোমার পরিচয়ে পরিচিত হবে। এরকম কিছু করে দেখাতে পারবে?’

উদ্দীপনা খেলে গেলো মিশুর চেহারায়। চেহারা দৃঢ় হয়ে উঠলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘আমি পারবো।’
– ‘এই আত্মবিশ্বাস টাই এনাফ। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।’

তারপর মিশুর হাতের উপর হাত রেখে বললো, ‘আমি সবসময়ই তোমার। নিজের একটা স্থান গড়ে তারপর আমার স্ত্রী হয়ে ওঠো। সবসময় পাশে আছি। ভরসা রেখো।’

মিশু প্রসন্ন হাসি দিলো। মেঘালয়ও হাসার চেষ্টা করলো। মিনিট বিশেক গাড়ি ড্রাইভ করে গেলো কিন্তু কেউ কোনো কথা বললো না। নিরবতার ও একটা ভাষা আছে। নিরবেই বলা হয়ে গেলো কত কথা। মেঘালয় মিশুকে ওর চাচার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রসন্ন হাসি দিয়ে বিদায় দিলো মিশু। দুজনের মুখটাই হাসি হাসি কিন্তু অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দূরত্বের কথা ভেবে বুকটা কিভাবে ফাটছে তা কাউকে দেখানো যায়না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here