হৃদমোহিনী
পর্ব ৩৮
মিশু মনি
.
৫৪
ডাক্তার এসে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলেন। তন্ময় গলাকাটা পশুর মত ছটফট করছে। শারীরিক যন্ত্রণার সাথে মানসিক যন্ত্রণাও যুক্ত হয়েছে। মৃত্যুও হচ্ছেনা, বাঁচার শান্তিও পাচ্ছেনা। দুটোর মাঝামাঝি অবস্থায় পড়ে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তন্ময়ের কষ্ট দেখে মিশু পাগলের মত কাঁদছে।
মেঘালয় মিশুর হাতটা শক্ত করে ধরলো। মিশুকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো এমন সময় মিশু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তন্ময়ের পাশে গিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ডাক্তারকে বারবার বললো, ‘তন্ময় ভালো হয়ে যাবে তো? ওকে ভালো ওষুধ দিন না। যেন তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়।’
কথাগুলো বলার সময় মিশুর চোখেমুখে যে মায়া ফুটে উঠেছিলো সেটা দেখেই ভয় হচ্ছে মেঘালয়ের। একদিকে রাগও হচ্ছে, অন্যদিকে অসহ্য দহন। মিশু কেন কাঁদবে ওর জন্য? কাঁদলেও ও এতটা পাগল কেন হচ্ছে? ও কি জানেনা মেঘালয়ের কষ্ট হয় অন্য কারো প্রতি ভালোবাসা দেখলে? তবুও রাগ সামলে নিশ্চুপ হয়ে রইলো মেঘালয়।
মিশু তন্ময়ের হাত শক্ত করে ধরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। ডাক্তারের সাথে তার চেম্বারে গিয়ে আলোচনা করলো। তারপর আবারো এসে বেডের পাশে বসে রইলো শান্ত হয়ে। মেঘালয় শুধু থ হয়ে দেখছে মিশুর কর্মকাণ্ড। তন্ময় একটু পরপর হাসফাস করে ওঠে। এ্যাজমা রোগীর মত হাফাতে থাকে। মিশুর খুব কষ্ট হয় এটা দেখলে। পাগলের মত কাঁদতে থাকে। মেঘালয় মিশুকে বুকের সাথে জাপটে ধরলে মিশু কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তন্ময় এমন করছে কেন? ওর বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে মেঘ। খুব কষ্ট হচ্ছে। তন্ময় কি মরে যাবে?’
বলতে বলতে মিশু মেঘালয়কে জাপটে ধরে শক্ত করে। মিশুর গলা শুনে মেঘালয়ের বুকটা ফেঁটে যায়। তবুও সহ্য করছে চুপ করে। মেঘালয়ের কষ্টটা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব না। খারাপ লাগা, যন্ত্রণা, হিংসে, ভালোবাসা সবকিছুর অনুভূতি একইসাথে হানা দিচ্ছে। মিশুর মনে কি এখনো তন্ময়ের জন্য ভালোবাসা আছে? সেটাই তো মনেহচ্ছে। নয়তো এভাবে কেন কষ্ট পাবে। মেঘালয়ের মাথাটাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ভাবলে।
একটা দিন হাসপাতালেই কাটালো ওরা। মিশু প্রত্যেকটা সেকেন্ড তন্ময়ের পাশে বসে রইলো খুঁটির মত। এমনকি কিছু খায়ও নি। মেঘালয় ওকে একা রেখে বাসায় যেতেও পারছে না। একবার মিশু নিজেই বলেছিলো বাসায় গিয়ে গোসল করে খেয়েদেয়ে রেস্ট নেয়ার জন্য। মেঘালয় অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাসায় যাওয়ার জন্য বের হলো। এভাবে চোখের সামনে নিজের স্ত্রীকে অন্যের জন্য ছটফট করতে দেখলে সহ্য করা যায়না। বাসায় গিয়ে অনেক্ষণ শাওয়ারের নিচে বসে রইলো। মাথাটা ঠাণ্ডা হচ্ছিলো না কিছুতেই।
গোসল সেরে রুমে এসে শার্ট পড়ে নিলো। আম্মুকে বলে দিলো বাটিতে খাবার তুলে দেয়ার জন্য। খুব ক্ষুধা লাগলেও মিশুকে রেখে খেতে পারবে না ও। খাবার নিয়ে হাসপাতালে চলে এলো। রাত থেকে না খেয়ে আছে দুজনে। হাসপাতালে এসে মিশুকে খেতে বলামাত্রই মিশু বললো, ‘আমার খাওয়ার রুচি নেই। রেখে দিন।’
মেঘালয় ঠাণ্ডা স্বরেই বললো, ‘আমিও খাইনি। একসাথে খাবো বলে নিয়ে এলাম।’
– ‘আপনি খাননি কেন?’
প্রশ্ন শুনে মেজাজ চড়ে গেলো মেঘালয়ের। প্রচণ্ড রাগে চোখে অগ্নিবর্ষণ হতে লাগলো। রাগটা কোনোমতে সামলে নিয়ে আচমকা খাবারের হটপট ট্রের উপর রেখে মিশুর হাতটা শক্ত করে ধরলো। এরপর যেটা করলো সেটা একেবারেই অকল্পনীয়। মাথায় রক্ত উঠে গেছে ওর। রাগ সামলাতে না পেরে মিশুর হাতটা নিয়ে তন্ময়ের হাতের উপর রেখে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ও আসলে তোমাকেই ভালোবাসে। তোমার পাশে এই মুহুর্তে মিশুকেই প্রয়োজন। ওকে আগলে রেখো, আমি চলে যাই।’
মাথায় বাজ পড়লো মিশুর। আচমকা এরকম কথা শুনে থ হয়ে গেলো। মেঘালয়ের চোখেমুখে এমনকি পুরো শরীরেই যেন রাগ ফেটে পড়ছে। অন্য কোনো ব্যাপার যতই সিরিয়াস হোক রাগ সামলানোর ক্ষমতা ওর আছে। কিন্তু ভালোবাসা এমনই এক জিনিস, হয় আমার হোক নাহয় অন্য কারো হোক। কিন্তু আমার সাথে থেকেও অন্য কারো জন্য ছটফট করবে এটা সহ্য করা যায়না। রাগ সামাল দিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো মেঘালয়ের। মিশুর দিকে একবার তাকিয়ে বললো, ‘তোমার তো ভালোবাসা প্রয়োজন ছিলো তাইনা? তোমার ভালোবাসা পেয়ে গেছো। হোপফুলি, খুব সুখী হবে। যেকোনো হেল্প লাগলে আমাকে বোলো। ডিভোর্স চেয়েছিলে না? খুব দ্রুত তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে।’
কথাটা বলে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না মেঘালয়। ছুটে বেড়িয়ে এলো হসপিটাল থেকে। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেলো যে মিশুর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো। মেঘালয় এটা কি করলো? এভাবে ভূল বুঝলো মেঘ! ডিভোর্স দেয়ার কথা মুখে আনলো কিভাবে? সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে শুরু করেছে মিশুর। একই অবস্থা মেঘালয়ের ও। রাগের মাথায় মিশুকে তন্ময়ের কাছে রেখে গেলো ঠিকই কিন্তু গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আত্মা ফেটে কান্না আসতে চাইছে। রাগের চোটে খুব জোরে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো।
মিশু দুহাতে নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে টেনে ছিঁড়ছে। মেঘালয় ভূল বুঝে চলে গেলো! কিন্তু সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হচ্ছে তন্ময়ের হাতে তুলে দিয়ে গেছে। এটা রীতিমত অপমান। কিন্তু মেঘালয় নিজেও যে অপমানিত হয়েছে সেটাও বুঝতে পারছে মিশু।
অনেক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থেকে মিশু চোখের পানি মুছলো। তন্ময়ের কাছে এসে বললো, ‘মেঘালয়ের আচরণে কিছু মনে কোরোনা। ও একটু বেশি কষ্ট পেয়েছে। ওর জায়গায় তুমি থাকলে তুমিও কষ্ট পেতে। আমি চলে যাচ্ছি, আমি সত্যিই ওই মানুষটাকেই ভালোবাসি। আমার লাইফে আর কোনোভাবে আসার চেষ্টা কোরোনা প্লিজ। আজকে হাতজোর করে বলছি, আমার সাথে কখনো আর যোগাযোগ কোরো না। তুমি ভালো থেকো। সুস্থ হয়ে যাবে, টেনশন কোরো না। আসছি…’
কথাটা বলে একবার তন্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে এলো মিশু। নার্সকে ভালোভাবে বলে দিলো তন্ময়ের ঠিকমত সেবা করার জন্য। মনটা অনেক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মেঘালয়ের জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মেঘালয়ের রেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিলো। ভূলটা ভাঙিয়ে দিতে হবে ওর। দ্রুত শ্বশুরবাড়িতে চলে এলো মিশু।
৫৫
শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার মুহুর্তেই শ্বাশুরির সামনে পড়ে গেলো। হাসিমুখে মিশু জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন মা?’
– ‘কেমন রেখেছো? এসব কি শুরু করেছো তুমি?’
মিশু চমকে উঠে বললো, ‘কি করেছি মা?’
– ‘মেঘ প্রচণ্ড রাগে বাসায় এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। আমাকে বললো সবকিছু শেষ করে দিয়ে এসেছি। মানে কি এসবের?’
মিশু মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘উনি আমাকে ভূল বুঝেছেন।’
মা রেগে বললেন, ‘শোনো পরিষ্কার করে একটা কথা বলি। আগে তুমি কি ছিলে বা কি করে বেড়িয়েছো সেটা তোমার ব্যাপার। আমাদের ফ্যামিলিতে থাকতে হলে আমাদের মত করে থাকতে হবে। আমাদের একটা স্ট্যাটাস আছে এটা মনে রাখা উচিৎ তোমার।’
তিক্ত কথাগুলো শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে ফেললো মিশু। আবারো একই কথা, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস। এই একই কথা বলে তন্ময় ছেড়ে গিয়েছিলো, আজকে আবারো সেই একই কথা। কিন্তু মিশুর অপরাধটা কি?
মিশু বললো, ‘আপনিও আমাকে ভূল বুঝছেন।’
মা বললেন, ‘শোনো, তুমি হসপিটালে কি পরিমাণ পাগলামি করেছো আমি জানি। মেঘ বলেনি কিছু। তবে সব আমার কানে এসেছে। এই হসপিটালের প্রত্যেকটা ডক্টর মেঘালয়কে চেনে যে ওটা আমার ছেলে। ডাক্তারের কাছেও তুমি কান্নাকাটি করেছো। এতটা ইমম্যাচিউর মেয়ে আমাদের ফ্যামিলির সাথে ইন ফ্যাক্ট আমার ছেলের সাথে যায়না। এরকম লেইম কাজ করবে আর আমি সহ্য করবো এটা ভাবলে কি করে? এক পা ফেলার আগেও তোমাকে ভাবতে হবে তুমি কার ছেলের বউ।’
মিশু চোখ বন্ধ করে ফেললো। এসেছিলো মেঘালয়ের ভূল ভাঙাতে। কিন্তু এখানে এসে নিজেই বারবার অপমানিত হচ্ছে। এই কথাগুলো যেকোনো মেয়ের জন্যই চরম অপমানের। মাটিটা যদি দুইভাগ হয়ে যেতো, ভেতরে ঢুকে পড়তো মিশু। চোখ ফেটে অশ্রু গড়াতে লাগলো।
মা আবারো বললেন, ‘তোমার জন্য আমার ছেলে অনেক সাফার করেছে। বারবার অপমানিত হয়েছে। এমনকি আমাদের ফ্যামিলিটাকেও সোসাইটির কাছে আলোচিত বানিয়ে দিয়েছো। কি যে ঝামেলা হয়ে গেলো একটার পর একটা। সবকিছুর পরও আমরা তোমাকে মেনে নিয়েছি। আমার ছেলের জন্য ওর মতই একটা মেয়ে নিয়ে আসতাম। শুধুমাত্র ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি বলেই তোমাকে নিজের মেয়ের মত গ্রহণ করেছি। তারমানে এই নয় যে তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে। সবকিছু ক্ষমা করলেও আমার ছেলেকে কষ্ট দিবে, সেটা আমি ক্ষমা করতে পারবো না। হয় পুরোপুরি থাকো, নয়তো মেঘের লাইফ থেকে চলে যাও।’
মিশু ঢোক গিলে বললো, ‘মা, আমি এসেছিলাম ওনার ভূলটা ভাঙাতে। এসেছিলাম সবসময়ের জন্য থাকতে। কিন্তু এখন কষ্ট হচ্ছে। আপনারা আমার গুনের জন্য আমাকে ভালোবাসেননি। আদর দেখিয়েছেন ছেলের ভালোবাসার পাত্রী বলে? সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। ভেবেছিলাম আপনারা আমাকে নিজের সন্তানের মত আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু আজকে সত্যিটা জানলাম। আমার আচরণ আপনাদের ভালোবাসা অর্জন করতে পারেনি। আপনারা শুধুমাত্র ছেলের জন্যই আমাকে রেখেছেন? বারবার সবাই মিলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আমি আপনাদের কারোরই যোগ্য না। আপনার ছেলেরও না, আপনাদের পরিবারের ও না। আমি চলে যাবো। এই অযোগ্য মেয়েটাকে কখনোই জোর করে ভালোবাসতে হবেনা। আপনার ছেলে জোর করে মানিয়ে নিয়েছে, আপনারাও তাই। এই দয়া, এই করুণাগুলো আমি আর নিতে পারছি না। আপনাদেরকে অনেক বাজে পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছি, এজন্য মাফ চাইছি। আমাকে মাফ করে দেবেন সবাই। আজ থেকে আপনার ছেলে, আপনারা সবাই কিংবা তন্ময় কেউই আর এই মেয়েটার মুখ দেখবে না। শেষবারের মত একবার কথা বলতে দেবেন আপনার ছেলের সাথে?’
চলবে..