হৃদমোহিনী
পর্ব ৩৩
মিশু মনি
.
তন্ময়কে দেখেই ভয়ে কেঁপে উঠলো মিশু। শরীরটা কাঁপতে লাগলো রীতিমত। একদিকে পাগলের মত ভালোবাসা, প্রতারণা, সেই রাতের ভয়াবহ ঘটনা সবকিছু ভেবে শিউরে উঠলো ও। এই কাপুরুষ টাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে একইসাথে অনেক ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। ডুকরে কান্না আসছে, আবার ঘৃণায় ওর গালে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মিশু জানে ওটা করতে পারবে না ও। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। তন্ময় হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে মিশুর মুখটা একহাতে ধরতেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল মিশু।

তন্ময় ওকে ধরে জোরে মিশুর মাকে উদ্দেশ্য করে আন্টি আন্টি বলে ডাকতে শুরু করে দিলো। মা ছুটে এসে মেয়েকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আঁৎকে উঠলেন। উনি এসে মিশুকে ধরার চেষ্টা করার আগেই তন্ময় ওকে কোলে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলো।

আন্টি পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে বললেন, ‘কে তুমি? তোমাকে দেখে ও সেন্সলেস হয়ে গেলো কেন?’
তন্ময় মিশুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললো, ‘আন্টি আমি তন্ময়।’

মা নিজেও শিউড়ে উঠলেন নাম শুনে। এই মুহুর্তে বাসায় ওনার স্বামীও নেই। এই ছেলেটার জন্য একটার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। মান সম্মান ধূলায় মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। সমস্ত ঘটনার উৎস এই তন্ময় থেকেই। আর সে এখন সামনে দাঁড়িয়ে আবার মিশুকে ছুঁয়েও দেখেছে? খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

আন্টি রাগ সামলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে মিশুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। তন্ময় বললো, ‘একটু পানি আনুন আন্টি। ওর কিছু হয়নি।’

তন্ময় পাশেই টেবিলের উপর রাখা গ্লাস থেকে কিছু পানি ছিটিয়ে দিলো মিশুর মুখে। আন্টি মিশুর হাতের তলা ও পায়ের তলা মালিশ করছেন। মিতু এসে তন্ময়কে দেখেই আঁৎকে উঠলো। তন্ময়ের ছবি দেখেছিলো ও। মিতুও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। তন্ময় মিশুর পাশে বসে বারবার ডাকতে লাগলো, ‘মিশু…’

খানিক বাদেই চোখ মেললো মিশু। কিন্তু চোখ মেলে সামনে তন্ময়ের মুখ দেখে ভয়েই আড়ষ্ট হয়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো সেই ভয়াবহ রাতের কথা। একটা ভয়ংকর মুখ সামনে এগিয়ে আসছিলো, তার হিংস্র থাবা গ্রাস করে ফেলতে চাইছিলো মিশুর কোমল দেহটা। মিশু শিউড়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো।

তারপর পরই পাশে রাখা বালিশটা নিয়ে নিজের মুখে চাপা দিয়ে বললো, ‘ওকে চলে যেতে বলো। সামনে থাকলে বটি দিয়ে ওর মাথাটা কেটে ফেলবো আমি। চলে যেতে বলো ওকে।’

তন্ময় বললো, ‘মেরে ফেলো আমাকে তবুও প্লিজ চলে যেতে বলোনা। আমি তোমার কাছে মাফ চাইতে এসেছি।’

তন্ময়ের গলাটা যেন বিষের মত বিঁধছে। মিশু দুহাতে কান চেপে ধরে বললো, ‘ওকে চলে যেতে বলো কেউ। প্লিজ বলো। আমি ওর মুখ দেখতে চাইনা, ওর গলাও শুনতে চাইনা। আমার শরীর খারাপ লাগছে। প্লিজ ওকে চলে যেতে বলো।’

কেঁদে ফেললো মিশু। মিশুর মা তন্ময়ের হাত ধরে টেনে এনে দরজায় দাড় করিয়ে বললো, ‘মিশুর যে অবস্থা তুমি করেছিলে তার জন্য ও কোনোদিনো তোমাকে ক্ষমা করবে না। আমিও করবো না। কেমন মা তোমাকে পেটে ধারণ করেছিলেন আমি জানিনা তবে সে খুব দুর্ভাগা তোমার মত সন্তান জন্ম দিয়ে।’

তন্ময় মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জানি। আমার মাও আমাকে হয়ত ক্ষমা করবে না। অভিমান করে চলে গেছে। সেজন্যই মিশুর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আন্টি মিশু যেদিন চলে আসে সেদিন রাতেই আমার বাবা মা এক্সিডেন্টে মারা যায়।’

মা অনেক্ষণ কিছু বলতে পারলেন না। নিশ্চুপ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তোমার অনেক কঠিন শাস্তি হয়ে গেছে। এবার চলে যাও। আর হ্যা, মিশুর বিয়ে দিয়েছি। বিয়ের প্রোগ্রাম আর পনেরো দিন পর। তুমি আর কোনো ঝামেলা কোরোনা। আল্লাহর কাছে মাফ চাও নিজের ভূলের জন্য।’

তন্ময় অবাক হয়ে বললো, ‘বিয়ে মানে!’

আন্টি আর কিছুই বলার সুযোগ দিলেন না। তন্ময়কে হাত ধরে বাইরে বের করে দিয়ে বললেন, ‘আমার মেয়েটা এখন সুস্থ আছে বাবা। ওর মাথা খারাপ হলে খুনোখুনি হয়ে যাবে। তারচেয়ে তুমি চলে যাও।’
– ‘আন্টি ওকে বলুন না আমাকে খুন করতে। তাহলে শান্তি নিয়ে মরতে পারবো।’
– ‘আমার মেয়ে তোমার মত খুনী নয়।’

কথাটা বলেই আন্টি তন্ময়ের সামনে থেকে চলে গেলেন। মিতুকে বলে দিলেন দরজা লাগিয়ে দেয়ার জন্য। তন্ময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললো। খুনী শব্দটা যেন বাবা মায়ের মৃত্যুটাকেই ইংগিত করে বলা। কথাটা শুনে আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না ও। মাকে বড্ড মনে পড়ছে। আর মায়ের আত্মাও দূর থেকে দেখবে আর কাঁদবে ছেলেকে মানুষ করতে পারেনি ভেবে। মা কি ক্ষমা করবে? মায়ের থেকে ক্ষমা চাইতে হলে আগে মিশুর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মিশু ক্ষমা না করলে কেউ করবে না। মায়ের আত্মাও শান্তি পাবেনা।

অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তন্ময়। মিতু এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। মিতুকে জিজ্ঞেস করলো সত্যিই মিশুর বিয়ে হয়েছে কিনা? কিন্তু মিতু কোনো জবাব দিলোনা। এখন কিভাবে মিশুর সাথে একবার কথা বলা যায়? বিয়ের ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা ওর। মিশুর বাবা মাকে ও যতটা চেনে, ওনারা এত তাড়াতাড়ি মেয়ে বিয়ে দেবেন না। আর মাত্র এই কয়েকদিনে বিয়ে হওয়ার ও কথা নয়।

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো তন্ময়।

৪৭.
ডুকরে কান্না করেই চলেছে মিশু। মায়ের মুখে শুনেছে তন্ময়ের বাবা মা মারা গেছে। খারাপ লাগছে ওর। কিন্তু এই সময়ে এসেই নিজের ভূলটা বুঝতে পারলো ও? ওর আগে কোনো ছেলের সাথে কথাও বলেনি মিশু। সেই মানুষ টাকেই ভালোবাসতে চেয়েছিলো পাগলের মত। এখন মেঘালয়কে ছাড়তেও পারবে না, তন্ময় নতুন করে এসে মাথাটা এলোমেলো করে দিতে শুরু করে দিলো। তন্ময়কে এই কয়েকদিনে চরম ঘৃণা করেছে মিশু। কিন্তু ওর অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া চেহারাটা দেখে আর রেগে থাকতে পারছে না। মনেমনে ভাবছে, যদি আবারো তন্ময়ের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়? তাহলে মেঘালয়ের কি হবে? মেঘালয়কেও ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে ও। এদিকে তন্ময় এসে এ কোন দোটানায় ফেলে দিলো ওকে? জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এখন।
পাগলের মত কাঁদতে লাগলো মিশু। মেঘালয় ফোন করলে মিতু রিসিভ করে সবকিছু বলে দিলো।

সবটা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো মেঘালয়ের। তন্ময় নিজের ভূল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে? তারমানে মিশু এখন ওর হয়ে যাবে। মেঘালয় আপন মনেই বললো, ‘যেহেতু আমাদের মধ্যে এখনও ভালোবাসা হয়নি, কাজেই তন্ময় একবার মাফ চাইলেই মিশু সবকিছু ভূলে গিয়ে ওকেই আপন করে নেবে। কারণ তন্ময় ওকে অনেক ভালোবাসা দেখিয়েছিলো। অবশ্যই আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসা দেখিয়েছে। তাহলে মিশু যদি তন্ময়ের সাথে চলে যায়? আমি মানতে পারছি না এটা।’

বুকটা চিনচিন করছে মেঘালয়ের। একটা অজানা ব্যথা এসে ভর করেছে বুকে। অথচ এর আগে কক্ষনো এমন হয়নি। শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, ‘আমি তো মিশুকে বলেছি আমি এখনো তোমাকে প্রিয়জনের মত ভালোবাসতে পারিনি। তারমানে তন্ময় একবার ভালোবাসি বললেই মিশু ওর হয়ে যাবে। মিশু তো বলেছে দশদিন পর যদি ভালোবাসা না হয় তাহলে আর কখনো আসবে না। এখন যদি তন্ময় ওকে কেড়ে নিয়ে যায়? এটা কিছুতেই হতে পারেনা।’

বুকের চিনচিনিনি টা বাড়ছে। একটা সেকেন্ডও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না মেঘালয়। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মিশুর কাছে। কিন্তু এত দূরত্বের পথ এখনি যাওয়াও অসম্ভব। ফ্লাইট এত রাতে আছে কিনা কে জানে আর টিকেট ও পাওয়া যাবেনা। তাহলে? কিন্তু একটা কথা মেঘালয় কিছুতেই বুঝতে পারছে না, মিশুকে যদি ভালো নাই বাসবে তবে এরকম ছটফট লাগছে কেন? অন্য একজন পুরুষের আগমন সত্যিই যন্ত্রণা ধরিয়ে দিয়েছে। আর সাথে হারানোর ভয়টাও পেয়ে বসেছে। ভালোই বাসেনা তাহলে হারানোর ভয় কেন? উফফ মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসি কিংবা নাই বাসি, মিশু আর কারো হতে পারেনা।

আপন মনেই বলতে বলতে দেয়ালে মাথাটা বাড়ি দিলো মেঘালয়। এমন সময় মৌনি ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বললো, ‘ভাইয়া তুই এমন করছিস কেন? মাথাটা দেয়ালে আঘাত করছিস কেন? কি হয়েছে তোর?’
– ‘মিশুকে আর কেউ ভালোবাসবে না। শুধু আমি বাসবো। মিশু শুধু আমার। ওকে অন্যকেউ ছুঁলে আমি তাকে খুন করে ফেলবো।’
– ‘এসব বলছিস কেন?’
– ‘ওকে শুধু আমি কোলে নেবো। অন্যকেউ কেন নেবে? আমি ওই কুত্তার বাচ্চাকে মেরে ফেলবো। আমার মিশুকে কোলে নেয়ার সাহস ওকে কে দিলো? মিশুর শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপও আমার।’

মৌনি হা হয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি হলো মেঘালয়ের? এমন করছে কেন? কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে কোলে নিলো আবার?’

মেঘালয় রেগে বললো, ‘চুপ। ওকে কেউ ছোঁবে না। আমি সহ্য করতে পারবো না। মৌনি আমি এক্ষুনি ওর কাছে যেতে চাই। প্লিজ কি করবো বল?’
– ‘মিশুর কাছে?’

মেঘালয় সবকিছু খুলে বললো মৌনিকে। সবটা শুনে মৌনি বলল, ‘তুই এখনই ড্রাইভারকে নিয়ে বেড়িয়ে পড় ভাইয়া। বাসে গেলে সকাল হয়ে যাবে। গাড়িতে গেলে আশাকরি শেষরাতে পৌঁছাতে পারবি।’
– ‘ওকে। ভাইয়ার জন্য দোয়া করবি।’

মৌনি মেঘালয়ের চুলগুলো একহাতে ঠিক করে দিয়ে বললো, ‘এত ভালোবেসে ফেলেছিস?’

মেঘালয় নিজেও অবাক হয়ে গেলো একটু আগে করা পাগলামি গুলোর কথা ভেবে। মুচকি হেসে বললো, ‘জানিনা রে। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, মিশু পাগলীটা আমার হৃদমোহিনী। আমার কলিজাটা। পিচ্চিটাকে আর কেউ কোলে নিলে আমি প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়বো।’

মৌনি হেসে বললো, ‘পাগল ভাই আমার। সাবধানে থাকবি কেমন?’

অবশেষে দ্রুত বেড়িয়ে পড়লো মেঘালয়। সম্পর্কের মাঝে কাটা ঢুকে পড়েছে। ব্যথা হওয়ার আগেই কাটা উপড়ে ফেলে দিতে হবে। মিশুকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা, বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। সকালেই তো চলে গেলো অথচ রাত হতে না হতেই বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পৌঁছাতে হবে ওর কাছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here