হৃদমোহিনী
পর্ব ২২
মিশু মনি
.
২৬
আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেকে বদলানো প্রয়োজন। মেঘালয় যে কাউকে দ্রুত আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে তার অনন্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা। এটা আপনা আপনি গড়ে ওঠেনি। এরকম আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য যথেষ্ট শ্রম দিতে হয়েছে। রেগুলার সময়মতো ঘুমানো, ঘুম থেকে ওঠা, এক্সারসাইজ করার জন্য রেগুলার জিমে যাওয়া, বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা, পড়াশোনা করা, প্রচুর বই পড়া, শৈল্পিক কাজে অংশ নেয়া, প্রার্থনায় সময় দেয়া, ক্যারিয়ারের পেছনে ছোটা, একটা আনন্দময় পারসোনালিটির জন্য নিজেকে সময় দেয়া, সবসময় নিজেকে উন্নত করার চেষ্টায় সময় ব্যয় করা। এরকম শত পরিমশ্রমের ফলেই তার এমন অনিন্দ্য সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে।
মেঘালয়ের ইচ্ছে করতো সবার কাছে একটু আলাদা প্রাধান্য পেতে, সব শ্রেণির মানুষের সাথে মিশে সবাইকে দ্রুত নিজের ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত করতে৷ ইচ্ছেকে সম্পূর্ণ করতেই নিজেকে বদলে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়েছে। মেঘালয়ের গলার স্বরে স্পষ্টতা, ভাষায় সহজবোধ্যতা, এমনকি হাঁটাচলায় অন্যরকম একটা ভাব ফুটে উঠে। যত কঠিন মানুষই হোকনা কেন, মেঘালয় কথার মাধ্যমে দ্রুত মানুষটাকে আয়ত্তে আনতে পারার ক্ষমতা রাখে। আর ক্যারিয়ারের পেছনেও যথেষ্ট সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করতে হয়েছে মেঘালয়কে। বন্ধুরা যখন ঘোরাঘুরিতে সময় ব্যয় করেছে, মেঘালয় তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত রেখেছে নিজেকে। রেগুলার জিমে দেড় ঘন্টা সময় ব্যয় করার ফলে একটা এথলেটদের মত ব্যায়ামপুষ্ট বডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মোটকথা মেঘালয় নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যার দ্বারা কেউ সহজেই আকৃষ্ট হবে। এ ধরণের ব্যক্তিরা সবার কাছে সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় ও ভালোবাসার যোগ্য৷ সব বয়সের মানুষ ই মেঘালয়ের প্রসন্ন হাসিতে গলে যায়। কাজেই মেঘালয় অবশ্যই চাইবে তার জীবনসাথীও তার মত না হলেও অনেকটা অনন্য হবে। মেয়েটা যদি জায়গা বুঝে কথা বলতে না পারে তাহলে সম্মান ক্ষুন্ন হবে। লজ্জায় পড়তে হবে মেঘালয়কে৷ এরজন্য প্রচুর ভালোমানের বই পড়া দরকার। কারণ ইতিবাচক জিনিস পড়তে পড়তে আর পসেটিভ মাইন্ডের লোকজনের সাথে মিশে সেরকম ভাবেই ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে৷ এরা সবার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে নেগেটিভ কিংবা নেতিবাচক মানসিকতার মানুষদের সাথে মিশে তাদের মতই ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। সবার সাথেই মেশা উচিত কিন্তু বন্ধু নির্বাচনে অবশ্যই সতর্ক হতে হয়। আমরা কার সাথে মিশি সেটা দিয়েও আমাদের চরিত্র মাপা যায়।
মেঘালয় যখন নিজের সম্পর্কে আর এসব কথা বলতে বলতে থামলো তখন খেয়াল করে দেখলো মিশু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। মিশুর কথা বলার ভাষা নেই, যা বলবে সেটাই কম হয়ে যাবে৷ মেঘালয় একহাতে মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘কি গো টুনিবউ, এভাবে চেয়ে আছো কেন?’
– ‘আপনি এত সুন্দর করে কথা বলেন কিভাবে!’
– ‘আমি প্রচুর শিক্ষামূলক বই পড়েছি লাইফে। আর এক্সপেরিয়েন্স থেকেও কিছু জ্ঞানার্জন করেছি। সব কপচাচ্ছি তোমার কাছে। বুঝলে?’
– ‘আপনি অনেক অদ্ভুত ধরণের সুন্দর।’
– ‘সুন্দর আবার অদ্ভুত হয়?’
– ‘হ্যা হয়। ভয়ংকর সুন্দর।’
– ‘আরেকটা ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্য দেখবে?’
– ‘হুম দেখবো। কি?’
– ‘চোখ বন্ধ করো।’
মিশু চোখ বন্ধ করতেই মেঘালয় ওকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা বেলকুনিতে চলে এলো। বারবার বলে দিলো যেন কিছুতেই চোখ না খোলে। মিশু চোখ বন্ধ করেই রইলো। মেঘালয় বেলকুনিতে এসে মিশুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো, ‘চোখ খোলো।’
মিশু টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয়ের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে তাকালো সামনের দিকে। সামনে বিস্তৃত আকাশ, আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র। বিশাল চাঁদ তার অপরূপ জোৎস্না ছড়িয়েছে! চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ এখানে একটুও কুয়াশা নেই। নিচে সুইমিংপুল, তার জলেও চাঁদের আলো চিকমিক করছে। সামনে শুধুই শূন্য অর্থাৎ আকাশ এসে সমুদ্রে মিশেছে। নক্ষত্রভরা আকাশ বিশাল সমুদ্রে এসে মিশেছে! কি অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে সবখানে!
সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা, শুধু শূন্যতা সামনে। আর সমুদ্রের বিশাল গর্জন কানে আসছে। মিশু অনেক্ষণ মুগ্ধতার চোটে কথাই বলতে পারছিলো না। অনেক্ষণ পর মেঘালয় খেয়াল করে দেখলো মিশু কাঁপছে। মেঘালয় ওকে শক্ত করে ধরে বললো, ‘বেশি সুন্দর দেখলে তোমার কান্না পায় তাইনা?’
– ‘হুম, প্রচন্ড কান্না পায়। আপনিও কিন্তু বেশি সুন্দর। আপনাকে দেখলেও আমার কান্না পায়।’
– ‘এমা তাই! আমাকে তো সবসময় দেখো।’
– ‘সবসময় পায়না। যখন ঘুম আদুরে চেহারাটা দেখি তখন, স্নিগ্ধ চেহারাটা আর… ‘
– ‘আর?’
মিশু লাজুক স্বরে বললো, ‘বলবো না। আপনি সবসময়ই সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর।’
– ‘আচ্ছা, এবার আমার বউটাকেও তো ভয়ংকর সুন্দর হতে হবে।’
– ‘কিরকম?’
– ‘চেহারাগত সুন্দরী নয়, অনন্য ব্যক্তিত্বের। যখন কথা বলবে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনবে। যখন প্রসন্ন হাসি দেবে, সবাই সুখী অনুভব করবে। যখন সবাইকে প্রভাবিত করতে শুরু করবে, চারিদিকেই তোমার সুনাম ছড়াবে। সম্মানিত হতে হবে তোমাকে। বোঝা গেলো?’
মিশু অবাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘হুম। জানিনা কতটা সফল হবো। আমার সত্যিই নিজের প্রয়োজনে নিজেকে বদলানো প্রয়োজন। আমি যেখানে সেখানে পাগলামি করে ফেলি।’
– ‘উহু, এটা তোমার বৈশিষ্ট্য। বদলাতে হবেনা, শুধু আচার আচরণে একটু মাধুর্যতা ফুটিয়ে তুলবা ব্যস। নিজের স্বকীয়তা কখনও বদলাবে না। স্বকীয়তা বজায় রাখা সবচেয়ে বড় স্মার্টনেস।’
মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বুঝিনি।’
মেঘালয় বললো, ‘নিজের বৈশিষ্ট্য হারাবে না। শুধু নিজেকে নিজেই বিশ্লেষণ করে নিজের গুণগুলোর খোঁজ করো। তারপর সে অনুযায়ী নিজেকে প্রকাশ করো। ভালো বই পড়ো, আচরণে আপনা আপনি মাধুর্যতা ফুটে উঠবে। এটাই বোঝাতে চাইছিলাম।’
মিশু মেঘালয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো, ‘ভয় পাচ্ছি, হারানোর।’
– ‘পাগলী, সমুদ্রে যাবা?’
মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘এত রাতে সমুদ্রে!’
– ‘রাত বেশি হয়নি। মাত্র নয়টা। রাত তিনটাতেও সমুদ্রে গেলে কিছু হবেনা। এখানে কড়া সিকিউরিটি থাকে। তুমি একা গেলেও তোমাকে কিছু বলার সাহস কারো নেই।’
– ‘সিরিয়াসলি?’
– ‘হুম। তাই বলে একা যাওয়ার কথা ভেবোনা। চলো এই জোৎস্নায় সমুদ্রের তীরে হাঁটবো। আমার এক আংকেল আছেন এখানে ডিফেন্সে, আগে ওনার সাথে কথা বলে নেই।’
মিশু হেসে বললো, ‘সবখানেই আপনার কেউনা কেউ থাকে৷ সেদিন যমুনা ব্রীজেও ট্রাকের ব্যবস্থা করে ফেললেন। আবার তিস্তায় নৌকা। এখন কিসের ব্যবস্থা করবেন শুনি?’
– ‘ আপাতত সমুদ্রের তীরে হাঁটার প্লান করি? আংকেলকে বললে সিকিউরিটি নিয়ে কোনো সমস্যা হবেনা।’
– ‘মেঘ..’
– ‘উম বলো?’
– ‘জীবনটাকে স্বপ্নের মত লাগছে।’
– ‘আচ্ছা, এই স্বপ্নে সমুদ্রের তীরে একটা বাড়ি করলে কেমন হয়? ধরে নাও সমুদ্রের পাড়ে আমাদের একটা কাঠের বাড়ি। একদিকে পাহাড়,একদিকে সমুদ্র। সমুদ্রের গর্জন কানে ভেসে আসে, ঘরে শুয়ে কাঁচের দেয়াল দিয়ে জোৎস্না উপভোগ করা যায়।’
মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যিই! আপনি খুব সুন্দর করে বলতে পারেন!’
– ‘হুম। একদিন এরকম একটা বাড়ি বানাবো তোমার জন্য৷ কাঠের বাড়ির বিশাল দেয়ালের অনেকটা জুড়ে থাকবে কাঁচ, জোৎস্না সরাসরি আমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে।’
– ‘সত্যি!’
– ‘হুম এখন দ্রুত চুলটা ঠিক করে নাও, বের হবো।’
মিশু রুমের ভেতরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়েছে এমন সময় মেঘালয় ওর হাতটা টেনে ধরে বললো, ‘একদিন সত্যিই এরকম একটা বাড়ি বানাবো তোমার জন্য, দেখে নিও। বাড়িটার নাম দিবো “হৃদমোহিনী”।’
মিশু চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বললো, ‘হৃদমোহিনী!’
পরের পর্ব আগামীকাল..