হৃদমোহিনী
পর্ব ১৬
মিশু মনি
.
২১.
মৌনিকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলো মিশু। মৌনিও বিস্ময়ের সুরে বললো, ‘তুমি!’
কি বলবে বুঝতে না পেরে মিশু বললো, ‘আপু ভেতরে আসুন। এটা আমাদেরই বাড়ি।’
বাড়ি মানে! অনেকটা হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলো মৌনি। মিশুকে এখানে দেখতে পাবে সেটা আশাও করেনি সে। সকালবেলা কল দিয়ে মেঘালয় এখানকার ঠিকানা দিয়ে বলেছিলো একটা সমস্যা হয়ে গেছে, দ্রুত আরাফ কে নিয়ে চলে আসতে। কিন্তু এখানে এসে মিশুকে এভাবে দেখতে পাবে সেটা কল্পনাও করেনি ওরা। আরাফ নিজেও অবাক বনে গেছে। মৌনি মিশুর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে ভাবতে লাগলো নানান আঁকিবুঁকি। মেয়েটা শাড়ি পড়ে আছে আর এটা ওদেরই বাড়ি, মেঘালয় এখানেই আছে। তারমানে একটা ঘটনা নিশ্চয়ই আছে এখানে। কি ঘটতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলো মৌনি।
মিশু আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভাইয়া আসুন।’
আরাফ বিস্ময়ের সাথে বললো, ‘মেঘ কোথায়?’
– ‘উনি গোসলে গেছেন একটু। এক্ষুনি আসবেন হয়ত।’
আরাফ ও মৌনি একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। মিশু ভেজা চুলে শাড়ি পড়ে বউয়ের মত সেজেছে, মেঘালয়ও গোসলে গেছে, ওদের মধ্যে কিছু…. মৌনির অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। চঞ্চল হয়ে বললো, ‘ভাইয়া ভালো আছে তো?’
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ্যা আপু ভালো আছে। আপনারা ভেতরে আসুন না।’
মৌনি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মিশুকে ভালো মত খেয়াল করছিলো। মেয়েটাকে এখন অনেক সুশ্রী লাগছে। ট্রেনে নিতান্তই বাচ্চাদের মত লাগছিলো। এখন দেখে কিশোরী বউ বউ লাগছে৷ অন্যরকম স্নিগ্ধতা ছেঁয়ে আছে ওর চেহারায়।
মিশু মৌনি ও আরাফ কে বসার ঘরে বসতে বলে নিজে গেলো মেঘালয়কে ডাকতে৷ ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলো, ‘এইযে শুনছেন?’
– ‘এভাবে বললে শুনবো না। শাবানার মত বলো ওগো শুনছো?’
– ‘তারাতারি গোসল শেষ করে বাইরে আসুন।’
মেঘালয় দরজা খুলে মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘একটু গোসল করতেও দেবেনা? গোসলের সময়েও কাছে চাও তাইনা?’
মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, ‘এত খারাপ কেন আপনি?’
মেঘালয় হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিশুর বাহু ধরে টেনে নিলো বাথরুমের ভেতরে। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে মিশুকে দরজায় ঠেস দিয়ে দাড় করিয়ে দিয়ে বললো, ‘এবার একসাথে শাওয়ার নেবো।’
মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘আমি গোসল করেছি মাত্র। আগে আমার কথাটা শুনুন।’
– ‘উহুম’
মেঘালয় দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে ফেললো। মিশু বাধা দিয়ে বললো, ‘আপু আর আপনার একজন বন্ধু এসেছেন।’
চমকে উঠে মিশুর মুখটা ছেড়ে দিলো মেঘালয়। তারপর আবারও ধরে মুচকি হেসে মিশুর নাকের সাথে নাক ঘষে দিয়ে বললো, ‘যাও আমি আসছি।’
মিশু বাইরে এসে মুচকি হাসলো। মেঘালয় সত্যিই অনেক রোমান্টিক আর দুষ্টুও বটে। সবার জন্য নাস্তা রেডি করতে মিশু খাবার টেবিলের দিকে যেতে লাগলো।
মৌনি বসার ঘর থেকেই খেয়াল করছিলো মিশু কোন রুমে ঢুকছে। মিশু সেখান থেকে বেড়িয়ে আসার পর মৌনি উঠে ধীরেধীরে হাঁটতে হাঁটতে সেই ঘরের দিকে এগোলো। দরজা ঠেলে ভেতরে তাকাতেই চমকে উঠলো। এত বড় চমক দেখবে সেটা ভাবতেও পারেনি ও। বিছানাটা দেখেই মনেহচ্ছে খুব সুখী দুজন মানুষ ঘুমিয়েছে এখানে। চাদরটা এলোমেলো হয়ে আছে, দুইটা বালিশের জায়গায় একটা মাত্র বালিশ৷ ঘরের মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি, বিছানাটাও ফুল দিয়ে সাজানো৷ বিছানার উপর শত শত ফুলের পাপড়ি। দেখলেই ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। এরকম একটা বিছানায় শুয়ে মুখোমুখি হয়ে কাউকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু কার বাসর হলো?
মৌনির বুঝতে বাকি নেই আসলে কাদের বাসর হয়েছে৷ মিশুকে দেখেই নতুন বউ মনেহচ্ছে। শাড়ি পড়ে স্নিগ্ধ মেয়েটাকে নতুন বউয়ের মতই লাগছে। আর মেঘালয় যেহেতু এই রুমের বাথরুমেই গোসল করছে তারমানে এটা নিশ্চিত যে ঘটিত সমস্যাটা আর কিছুই নয়৷ মেঘালয় এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে৷ কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!
সহজে অবাক হয়না মৌনি৷ আর অত সহজে দুশ্চিন্তাতেও পড়েনা। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ নিয়ে ফুলের বিছানায় এসে বসলো। একবার চাদরের উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে মনেমনে ভাবলো, ‘ভাইয়া খুব সুখে আছে মনেহচ্ছে। বাসর রাত যেকোনো ছেলের জন্যই সুখের৷ কিন্তু এরকমভাবে বিয়ে হওয়ার পেছনে কারণটা কি? ভাইয়া একবার জানালো ও না। তারমানে কোনো ঝামেলা নিশ্চয় হয়েছিলো।’
এমন সময় বাথরুম থেকে মেঘালয় বেড়িয়ে এলো। মৌনিকে দেখে বললো, ‘এই রুমে চলে এসেছিস?’
মৌনি চমকে গেলো ভাইকে দেখে। আজ মেঘালয়কে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। বড্ড সুখী সুখী চেহারা। সদ্য প্রেমে পড়লে মানুষকে যেমন দেখায়।
ও জিজ্ঞেস করলো, ‘নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করলি নাকি জোর করে ধরে বিয়ে দিলো?’
মেঘালয় একটু অবাক ই হলো। তারপর মুচকি হাসলো। সামান্য একটু আভাস পেলেই ঘটনার মূল পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারে এই মেয়েটা। একেবারে শার্লক হোমসের মতন। ও বললো, ‘ভাবী পছন্দ হয়েছে?’
মৌনি চোখ কপালে তুলে তাকালো৷ কপালে ভাঁজ ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘বাচ্চাটাকে দেখলে মনেহয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার্থী। ভাবী বলছিস কেন?’
– ‘হা হা হা৷ সেটা যেমনই হোক, ভাবী তো।’
– ‘হুম। মেয়েটা ভালো, ভাগ্যটাও ভালো যে আমার ভাইয়ের মত কাউকে পেয়েছে।’
– ‘তোর ভাইয়ের ভাগ্যটাকে কি খারাপ মনেহচ্ছে? স্টিল ছোট্ট বাচ্চা। যেভাবে বড় করবি, সেভাবেই বড় হবে।’
মৌনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘বাহ তাহলে সবকিছু ভালোই চলছে? সাতাশ বছর বয়সে এসে কচি মেয়ের প্রেমের স্বাদ নিশ্চয়ই থ্রিলার গল্পের মত এনজয় করছিস?’
মেঘালয় শব্দ করে হাসলো। তারপর এগিয়ে এসে মৌনির মুখের কাছাকাছি মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, ‘কলিজা ফাটছিলো। এরকম সিচুয়েশনে পড়লে মেনে নেয়াটা কতটা কষ্টকর সেটা একমাত্র ভেতরটা জানে। শুরুতে একেবারেই মেনে নিতে পারিনি। জোর করে মেনে নেয়াটা এভারেস্ট জয় করার মতই কঠিন ছিলো।’
মৌনি অবাক হয়ে বললো, ‘তারমানে জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছে? আমিও এটাই ভাবছিলাম। নিশ্চয়ই পরিস্থিতির চাপে পড়ে করতে হয়েছে। এখন মানতে পারছিস?’
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘হুম। অনেক ভেবে দেখলাম মেয়ে হিসেবে নেহাত খারাপ নয়৷ যদিও আমার সাথে যায়না তবুও মানিয়ে নেয়াটা একেবারে অসম্ভব কিছুনা। আমার সাথে চলতে চলতে ঠিক হয়ে যাবে।’
মৌনি কৌতূহলী হয়ে বললো, ‘মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো অপশন ছিলোনা?’
– ‘আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ছেলে নই। আর আমি ছেড়ে দিলে মেয়েটা নির্ঘাত এত মেন্টাল স্ট্রেস নিতে না পেরে সুইসাইড করতো।’
– ‘ঠিক কি হয়েছিলো বলতো?’
মেঘালয় খুব নিচু গলায় অল্প কথায় পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো মৌনিকে। মৌনি অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে, অল্পতেই বুঝে গেছে সবকিছু। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘যা হবার হয়ে গেছে এখন মেনে নেয়ার চেষ্টা কর। যেহেতু তুই দায়িত্ব এড়াতে চাইছিস না।’
– ‘হুম সেটাই করছি। তোর কেমন লাগলো ওকে সেটা বল?’
– ‘আমার তো প্রথম দিনেই ভালো লেগেছে৷ তোর সাথে ঢাকায় থেকে গেছে শুনে ভেবেছিলাম এবার বুঝি বাচ্চা মেয়েটা তোর প্রেমে হাবুডুবু খাবে। কিন্তু ঘটনা দেখি উলটো।’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘এই বাচ্চাকে নিয়ে কলিগদের সামনে যাবো কিভাবে বলত?’
– ‘বিয়ের পর কোনো মেয়েই আর বাচ্চা থাকেনা। তাছাড়া মেয়েটা এখন এডাল্ট ওকে?’
– ‘হুম মৌনি, এবার আব্বুকে ফোন দিয়ে সরাসরি বিয়ের কথা বলবো কিনা ভাবছি।’
মৌনি একটু নিশ্চুপ থেকে বললো, ‘সেটা আপাতত আমার উপর ছেড়ে দে৷ আমি আজকেই চলে যাই বাসায়, তারপর আব্বু আম্মুকে বুঝিয়ে বলে তোকে বাসায় নিয়ে যেতে বলবো। দুটো দিন সময় দে আমাকে।’
– ‘আজকেই চলে যাবি? অবনীর বিয়ে?’
– ‘বান্ধবীর বিয়েতে এসে নিজেই বিয়ে করে বসে আছো আর বলছো অবনীর বিয়ে? আগে ঠেলা সামলাও।’
মেঘালয় আর কিছু বললো না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করলো। এমন সময় মিশু এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, ‘আসবো?’
মৌনি চমকে তাকালো। আপাদমস্তক খেয়াল করলো মিশুর৷ চমৎকার গড়ন মেয়েটার, শুধু হাইট টা একটু অল্প। সেটা বোঝা যায়না, বাচ্চাবাচ্চা দেখায়৷ চুলগুলো দুই ঝুটি করে ব্যাগ নিয়ে ক্লাস ফাইভের ক্লাসে গিয়ে বসলেও দারুণ মানিয়ে যাবে। হাসলে গালে টোল পড়ে, তখন চমৎকার দেখায়। ভাই বিয়ে করে ফেলেছে, এখন মানিয়ে নিতেই হবে। মেঘালয়ের সিদ্ধান্তের উপর ষোলআনা নির্ভর করা যায়।
মৌনি এগিয়ে গিয়ে মিশুকে বললো, ‘শাড়ি পড়ে মিষ্টি দেখাচ্ছে তোমায়।’
মিশু মুচকি হাসলো৷ মৌনি এত দ্রুত ওকে আপন করে নেবে সেটা ভাবতেও পারেনি। মেঘালয়ের বোনটা মেঘালয়ের মতই একদম। মিশু প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললো, ‘আপু খাবার খাবেন আসুন। বাবা মা সবাই অপেক্ষা করছেন আপনাদের জন্য।’
মৌনি মিশুর সাথে খাবার টেবিলে চলে আসলো।
২২.
আরাফের সামনে এসে মৌনি সরাসরি বললো, ‘মিশুকে ভাইয়া বিয়ে করেছে।’
আরাফ যেন আকাশ থেকে পড়লো। হা হয়ে একবার মৌনির দিকে আরেকবার মিশুর দিকে তাকাতে লাগলো৷ মৌনি বললো, ‘পরে শুনিও সবকিছু। এখন নাস্তা করে নেই আসো।’
নাস্তার টেবিলে বসে সবার সাথে মৌনির আচরণ দেখে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। মৌনি নিজের বাবা মায়ের মত মিশুর বাবা মায়ের সাথে আচরণ করছে। এমনকি খাবার তুলেও খাওয়াচ্ছে মিশুর মাকে৷ সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে মিশুর বাবা৷ এরকম পরিবারে মেয়েটা যাচ্ছে ভেবে সত্যিই ভালো লাগছে। মৌনির মাঝে কোনো কৃত্তিমতা নেই৷ কত সহজেই আপন করে নিয়েছে যেন হাজার বছরের আপনজন।
চলবে..