#হীরের নাকফুল ও লাল বেনারসি
৪র্থ পর্ব
“ছয় মাস হয়ে গেল, তাই না?”
“ হুম, ছয় মাস হয়ে গেছে।”
অন্যমনস্ক গলায় বলে স্বর্ণা ।
আনন্দের বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে, ভালোবাসার লিলুয়া বাতাসে উড়তে উড়তে বিবাহিত জীবনের ছয়টা মাস কীভাবে যে কেটে গেল ভেবে ও অবাক হয়।
আজ ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করে মা’র বাসায় এসেছে।মা ওর পছন্দের পাঁচ রকম ভর্তা করেছেন।
পরম তৃপ্তি নিয়ে ও ভাত খাচ্ছে।
মা মুগ্ধ চোখে দেখছেন।
“ তোর শ্বশুর বাড়ির কাউকে এখনো কথাটা বলিসনি?”
মা’র কথায় লজ্জায় রক্ত বর্ণ হয় স্বর্ণার মুখ।চার মাস হল ওর ভেতর বেড়ে উঠছে আরেকটা প্রাণ।শ্বশুর বাড়ির কাউকে এখনো একথা জানানো হয়নি।
ও আহ্লাদী গলায় বলে,
“ না, কাউকে বলিনি।মা, তুমিও কিন্ত খালা, চাচী, ফুপু কাউকে বলবে না।”
স্বর্ণার মা ফেরদৌসী আহমেদ হাসেন।
“ আচ্ছা , বলব না।
“প্রমিস্।”
“ উফ্! আচ্ছা প্রমিস্।”
বিয়ের এক মাস পরেই স্বর্ণার ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়েছিল।পড়াশোনার ফাঁকে ছুটির দিনে ও শাশুড়ির পেছনে ছায়ার মত ঘুরঘুর করে।রান্নাঘরে গিয়ে শাশুড়ির রান্নায় সাহায্য করে।অলস দুপুরে বারান্দায় শাশুড়ির পাশে বসে।গল্প জমাবার চেষ্টা করে।শাশুড়ির গম্ভীর মুখ দেখে তাঁর মনে কী চলে তা অবশ্য বুঝতে পারে না।
এমনি এক ঝিম ধরা, নির্জন দুপুরে ও বারান্দায় শাশুড়ির পাশে বসে।
হাসি মুখে বলে,
“ মা, আপনার চুলে খোঁপা করে দিই।”
উনি পান সাজাতে সাজাতে নিস্পৃহ গলায় বলেন,
“দাও।”
চুলে খোঁপা করতে করতে স্বর্ণা সরল গলায় বলে,
“আপনার চুল এখনো খুব সুন্দর।”
শাশুড়ি কিছু বলেন না।
পান চিবাতে চিবাতে স্বাভাবিক গলায় জানতে চান,
“তোমার এখন কয় মাস চলছে?”
শাশুড়ির প্রশ্ন শুনে এক রাশ লজ্জা এসে স্বর্ণাকে ঘিরে ধরে।
একটু রাগও লাগে শাহেদের ওপর।স্বর্ণার হাত ছুঁয়ে প্রমিস্ করে বলেছিল এই খবরটা কাউকে দিবে না।
স্বর্ণা ঠোঁট উল্টে বলে,
“ শাহেদ আপনাকে বলে দিয়েছে।”
শাশুড়ি গাম্ভীর্যের খোলস আলগা করে এই প্রথম স্বর্ণার কোনো কথায় হাসেন।
“ আমার মাথার চুল এমনি এমনি তো পাকে নাই।বয়সে পেকেছে।”
স্বর্ণা কি বলবে ভেবে পায় না।
তীব্র একটা অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকে।
স্বর্ণাকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাতেই হয়ত শাশুড়ি এরপর সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যান।
পান চিবাতে চিবাতে বলেন,
“ এই শুক্রবার আমার খালাতো বোন বেড়াতে আসবে, দুপুরে খাবে।ঐ আপা আমেরিকায় থাকে।তোমার বিয়ের সময় দেশে ছিল না।কয়েকদিন আগে দেশে এসেছে।”
একটু থেমে বলেন,
“ তোমাকে প্রথম দেখবে।তুমি সুন্দর একটা শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে থেকো।”
শুক্রবার একটা ব্যস্ত দিন কাটে স্বর্ণার।খালা শাশুড়ি হাসিখুশী,ছোটোখাটো মানুষ।গল্পে, হাসিতে দুপুরের খাবার টেবিলের আড্ডা একাই জমিয়ে ফেলেন।অকুন্ঠভাবে প্রশংসা করেন স্বর্ণার রান্না রোস্ট,চিংড়ি মালাকারি ও চিকেন ভেজিটেবলের।
বিকেলে ডাইনিং টেবিলে ও যখন নাস্তা সাজাচ্ছে তখন বারান্দা থেকে খালা শাশুড়ির গলা শুনতে পায়,
“ তোদের স্বর্ণা তো দেখতে স্বর্ণের মতই সুন্দর।”
শাশুড়ির কথা শোনার জন্য স্বর্ণা কান খাড়া করে।
শাশুড়ির স্নিগ্ধ গলা ভেসে আসে,
“ আপা, ও শুধু দেখতেই স্বর্ণের মত সুন্দর না, মানুষটাও খাঁটি স্বর্ণের মত খাঁটি।আমার সংসারটা সোনার আলোয় ভরে দিয়েছে।”
শাশুড়ির কথায় ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে স্বর্ণা।
হৃদয়ের গভীর হতে উৎসারিত আবেগ কান্না হয়ে ঝরে পড়ে।
সেই কান্না কিছুতেই লুকানো যায় না।মন খুলে কাঁদার জন্য নাস্তার টেবিলের সব আয়োজন ফেলে স্বর্ণা নিজের রুমে ছুটে যায়।
এরপর যতই সময় গড়িয়েছে,ততই স্বর্ণলতার মত গভীর মায়ায় জড়িয়ে ধরেছে সংসার।
পেরিয়ে গেছে আরো অনেকগুলো মাস।
স্বর্ণার দুই বছরের ছেলে সাহিলকে নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকে ওর শ্বশুর-শাশুড়ি।সাহিল যখন খটখট করে হাসে তখন বয়স্ক দু’জন মানুষও শিশুর মত হাসেন।ও যখন নতুন কোনো শব্দ উচ্চারণ করে তখন আনন্দিত হয়ে দাদা-দাদী হাত তালি দিয়ে ওঠেন।
শাশুড়ি দিনের বেশীরভাগ সময় সাহিলকে নিয়েই থাকেন।স্বর্ণা ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লাস করে ফিরে আসার পর সাহিল দৌড়ে মায়ের কাছে যায়,মাকে চুমু খায়।একটু পরই আবার ফিরে যায় দাদীর কাছে।
স্বর্ণা গলায় কৃত্রিম অভিমান ফুটিয়ে বলে,
“ মা, আমার ছেলে তো আমাকেই চেনে না।”
শাশুড়ি হাসেন।
“ আমি আর কয়দিনই বা বাঁচব! বড় হলে দাদীর এই ভালোবাসার কথা ওর মনেও থাকবে না।”
সাহিল লাল রংয়ের একটা গাড়ি নিয়ে খেলায় মনোযোগী হয়ে পড়ে।
সেদিকে তাকিয়ে স্বর্ণার শাশুড়ি বলে ওঠেন,
“ স্বর্ণা , তুমি এবার আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নাও।”
“ মা, সাহিল এখনও ছোটো।ও আরেকটু শক্তপোক্ত হোক।”
“আমি শক্তপোক্ত থাকতে থাকতে নিয়ে নাও। আমি পেলে পুষে বড় করে দিয়ে যাই।আমার কেন যেন মনে হয় তোমার এরপর মেয়ে হবে।”
স্বর্ণা লাজুক ভঙ্গীতে হাসে।
কিছু বলে না।
ওর শাশুড়ি স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ আর এই যে বিয়ের পর এত কষ্ট করে পড়ছ, এটা বৃথা যেতে দিও না।”
সেই সময় পরপর দু’টো বিয়ের হুলস্থুল আয়োজন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বর্ণা।হুট করেই ননদ রেহনুমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়।রেহনুমার বিয়ের দেড় মাস পর দেবর সেজানের বিয়ে হবে।বিয়ের কথাবার্তা চুড়ান্ত হয়ে যায়।
রেহনুমার বিয়ের পনের দিন আগে একটা মজার ঘটনা ঘটে।ঘটকের মাধ্যমে রেহনুমার শ্বশুর বাড়ি থেকে জানানো হয় যে তারা বিয়ের শপিং হবু বউকে সাথে নিয়ে করতে চান।
স্বর্ণার শাশুড়ি শুনে বিস্মিত হন।
বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেরিয়ে তিনি কোনোমতে শুধু বলতে পারেন,
“ এমন আজব ঘটনা তো শুনিনি।”
দেবরের বিয়ের শপিং-এর সময় আসতেই স্বর্ণা সোজাসুজি ওর শাশুড়িকে বলে,
“ মা, আমরাও কিন্ত সেজানের বউকে নিয়ে বিয়ের শপিং করব।বউয়ের পছন্দে শাড়ি কিনব।”
“তোমার যেটা ভালো মনে হয় করো।”
শাশুড়ি পান চিবাতে চিবাতে বলেন।
কয়েক সেকেন্ড থেমে বলেন,
“ তবে তোমার বড় ননাসকে ভুলেও শপিংয়ের সময় নিও না।ওর চয়েজ খুব খারাপ।তোমার বৌভাতের শাড়ি ওর চয়েজেই কেনা হয়েছিল।”
শাশুড়ির কথা বলার ধরনে ও ফিক করে হেসে ফেলে।
শাশুড়িও মৃদু হাসেন।
“ সেজানের বউকে নিয়ে চুপচাপ শপিং করে আসবা।তোমার বড় ননাসকে জানালে ও ঠিক একটা গন্ডগোল বাঁধাবে।ওকে জানানোরই দরকার নাই।”
কথাটা কীভাবে যেন বড় ননাস রেবেকার কানে গেল।
দুইদিন পর রেবেকা এসে থমথমে মুখে স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি যে ঠিক করেছ সেজানের বউকে নিয়ে বিয়ের শপিং করবে এতে যে মেয়েটাকে কী পরিমাণ প্রশয় দেওয়া হবে সেটা বুঝতে পারছ! ওর পছন্দকে এত দাম দেওয়া কী ঠিক হবে? তাছাড়া ও হয়ত অনেক বেশি দামের শাড়ি পছন্দ করে ফেলবে।”
স্বর্ণা স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ যার বিয়ে তার পছন্দকেই তো সবচে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।বিয়ের শাড়িটাও তার পছন্দেই কেনা উচিত।”
তারপর একটু উদাস ভঙ্গীতে বলে,
“ আমার বিয়ের শাড়ি নিয়ে আমি যে কষ্টটা পেয়েছিলাম, আমি চাই না সে কষ্টটা অন্য কোনো মেয়ে পাক।”
( চলবে)